শিল্পের দর্শন ও সমাজভাবনা,অনন্ত স্বর ও প্রতিস্বর : সুবীর সরকার
যে কোন শিল্পচর্চায় একটা দর্শন থাকে। কবি, সাহিত্যকর্মী, শিল্পী সবাইকেই সমাজভাবনা তাড়িত করে। জারিত করে। শিল্পী তো একটা সমাজেই জীবনযাপন করেন। তার একটা দেশ থাকে। অগনণ মানবসমাজ থাকে। দেশকালসময়কে অস্বীকার বা উপেক্ষা করে কখনই শিল্পচর্চা হতে পারে না। তাই জীবনের আলো অন্ধকার জড়িয়ে শিল্পচর্চায় একটা সজীব সমাজভাবনা উচ্চারিত হতেই থাকে। তবে, তা সবসময় প্রকাশ্যে হয়তো ধরা পরে না। অর্ন্তলীন চোরাস্রোতের মত হয়তো প্রবাহিত হতে থাকে। অনন্ত স্বর ও প্রতিস্বরের মত বুঝি বা।
আসলে জীবন নিয়েই তো শিল্পসাহিত্য। জীবনই তো উঠে আসে শিল্পকর্মের মাধমে। জীবনের পরতে পরতে জমে থাকা রহস্যগুলি, স্বেদবিন্দুগুলি শিল্পমাধ্যমে তীব্র ভাবে লেগে থাকে। জীবন দেখবার এক নুতন চোখ নিয়ে পাঠকেরা নিজেদেরকে খুঁজে নিতে পারেন। দর্শনের ঘোরে এক নুতনতর হয়ে ওঠা হয়ে ওঠে পাঠকের। আমি এখানে শিল্পচর্চার সাহিত্য মাধ্যমটিকেই বেছে নিয়েছি,তাই পাঠকপ্রসঙ্গের উত্থাপন।
আমাদের সাহিত্যের বিশাল ক্যানভাস জুড়ে আবহমানের এক কালখন্ডের যাতায়াতে কি গভীর এক জীবনবোধ খেলে বেড়ায়। সমাজভাবনার জারণ ও বিজারণ দিয়ে এক অনন্য জীবনবোধ বারবার জেগে উঠতে থাকে কালের পরিসর জুড়ে। জীবনানন্দ দাস, আল মাহমুদ তাদের কবিতায় দেশকালসমাজের নিপুণ এক ভাস্য সাজিয়ে দিয়েছেন। সব ও সমস্ত অতিক্রম করে শেষাবধী মানুষ তো জীবনকে অবসরের গানের উত্তাপ ছড়িয়ে দিতে দিতে ভরেই তোলেন কালের কলস। অনেকটা কুয়াশার ভেতর হারিয়ে যাওয়া একটা অবলুপ্ত সময়ের লিরিক বুঝি!
এই উপমহাদেশের অনেক গ্রন্থ পাঠ করে করে আমি পুষ্ট হয়েছি। সেই সব বইয়ের ভেতর দিয়ে যে গহিন এক জীবনবোধ, দর্শন ও সমাজভাবনার আলো আমাকে জাপটে ধরেছে তার থেকে আমি নিজেকেই খুঁজে নিয়েছি। খুঁজে পেয়েছি। নতুন হয়ে উঠেছি। তেমন কয়েকটি বইয়ের কথা এখানে বলেই ফেলি বরং। শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংসপ্তক’, আবু ইশাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’, সামসুদ্দিন আবুল কালামের ‘কাশবনের কন্যা’, ওয়ালীউল্লাহের ‘লাল শালু’, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’, ‘মাদারডাঙ্গার কথা’, ‘উত্তরের খেপ’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’, ‘চিলেকোঠার সেপাই’, পাপড়ি রহমানের ‘পালাটিয়া’, জাকির তালুকদারের ‘পিতৃগণ’, অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘তাসিলার মেয়র’, ‘গড় শ্রীখন্ড’, ‘দুখিয়ার কুঠি’, ‘মধু সাঁধু খা’, ‘মহিষকুড়ার উপকথা’, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘অলীক মানুষ’, অমর মিত্রের ‘ধনপতির চর’, কিন্নর রায়ের ‘মৃত্যুকুসুম’, ভগীরথ মিশ্রের ‘মৃগয়া’, দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপুরাণ’, ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, অভিজিত সেনের ‘দেবাংশী’, পিযুষ ভট্টাচার্যের ‘তালপাতার ঠাকুমা’, বিপুল দাসের ‘ভুবনজোতের বাঘ’ – এই কটি বইয়ের কথাই আপাতত লিখলাম।
এই সকল বই-এর ভুবনে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এক অদ্ভূত শিহরণ আমাকে বিদ্ধ করেছে। দর্শন ও সমাজভাবনার স্তর প্রতিস্তরের মিশেলে শিল্পমাধ্যমের এক চিরায়ত দর্শন এভাবেই সমাজ ও দেশ কাল সময়ের বিস্তীর্ণ পরিসর হয়ে ওঠে। আমাদের ভাবায়। আমাদের ভেতর প্রশ্নের জন্ম দেয়। আমাদের জীবনের ওপর ঝুঁকে পড়তে শেখায়।
চিত্রকলায় আমি বিষ্ময় নিয়ে আবিষ্ট হয়ে পড়ি রে্মব্রান্ট, পল গগা, মাতিস, সালভাদোর দালি, পিকাসোর ছবির বর্ণময়তার ভিতর। নানা রঙের জীবন। নানা রঙের মায়া। কি এক তীব্র দর্শনের অভিঘাত। জীবন নাড়িয়ে দেয়।
পাশাপাশি আমি যখন তানভীর মোকাম্মেলের চলচিত্র ‘নদীর নাম মধুমতি’, ‘চিত্রা নদীর পারে’, ‘লালন’ কিংবা ‘হাসন রাজা’ দেখি তখন তানভীরের দর্শনচিন্তা ও সমাজভাবনার বহুরৈখিকতা আমাকে একটা সদ্য জেগে ওঠা ভোরের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমি আলো মাখি। আমি জীবন মাখি।
শিল্পের দর্শন ও সমাজভাবনা,অনন্ত স্বর ও প্রতিস্বর নিয়ে এভাবেই ঘুরে ঘুরে সময়পরবের ভেতর কি তীব্র ঢুকে পড়তে থাকে!
Posted in: October 2020 - Cover Story, PROSE