কাশবনের ভাস্কর্য : শুভংকর গুহ

 “নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে।

আর্মির ট্রাক, ওপরে মোটা ত্রিপল দেওয়া হেড কভার। ট্রাকের ভিতরে একপ্রকার গন্ধ থাকে, গ্যাসোলিন পেট্রলের, সেই গন্ধ বেস এরিয়ার সামরিক বাহিনীর সৈনিক এবং পরিবারের সদস্যদের কাছে খুবই পারিবারিক। ট্রাক চলছিল আর ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ার মসৃণ পিচের রাস্তা দ্রুত সরে যাচ্ছিল। কালো কালো ক্ষুদে স্টোন চিপ ট্রাকের চাকার নিচে পড়ে কর্কশ মিহি শব্দ করছিল। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ার রাস্তা মেরামতির কাজ সবসময় হয়েই চলে। বেস এরিয়ার সমস্ত রাস্তাই সব সময় পরিপাটি থাকে। পিচ গলানোর গাড়ির পেটের ভিতরে লকলকে আগুন জ্বলছিল, আর পিচ গলে যাওয়ার ধুয়ো ও তার গন্ধের মধ্যে আমাদের পানাগড় ছেড়ে চলে যাওয়ার গভীর বিমর্ষ ছিল।
একটি মৃত কুকুর যার নাম লাকি সে দ্রুততর ছায়াছবির মতো, গাড়ির গতির সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে আসছিল। আর্মির ট্রাকের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে একমাত্র মৃত কোনো পশু, জীবন্ত পশুর পক্ষে সেই গতির পাল্লা দেওয়া সম্ভব নয়। এখন বুঝতে পারি মৃত মানুষ ও পশু স্মৃতির পাতায় ক্ষত দিয়ে যায়। বাদামি রঙয়ের একটি কুকুরের স্মৃতি আমাকে সারাজীবন যেন ফেরারি করে দিল। বেদনার স্মৃতি মনে রাখা যেন, এক প্রকার অসুখের অবলম্বন। এই অসুখের চিকিৎসার জন্য কোনো বৈদ্য নেই।
আমি মহাসড়ক দেখি নি। যতদূর দৃষ্টি ততদূরে রাস্তা, কত ধরণের গাড়ি, যানবাহন। রাস্তার দুইধারে ধানমাঠ, ধানমাঠের পাশে জলাশয়, বন জঙ্গলের মতো স্তূপ স্তূপ, ছেঁড়া ছেঁড়া বনস্পতির দখল। বাবা আর মা নিভৃতে অনেক কথা বলছিলেন। সম্ভবত নতুন জায়গা, মা বুঝতে পারছিলেন, তাঁর পাঁচটি ছেলের পক্ষে বর্তমান গন্তব্য কতটা মানানসই হবে। পড়াশুনো, বিদ্যালয়ে ভর্তি, আবার বই খাতাপত্তর… মা দীর্ঘ নয় কেমন জানি থেকে থেকে নিঃশ্বাস ছাড়ছিলেন, পরিবার ছাড়াও মানুষের স্থানিক নির্ভরতা অনেক বেশি জরুরি। আমি বাবা মায়ের থেকে অনেকটা দূরে, ট্রাক ভর্তি জিনিসপত্রের এক কোণে আমি একটি কাঠের ছোটো বেঞ্চির ওপরে বসেছিলাম। বাবা বড় ভাইয়ের সঙ্গে কিছু জরুরি কথা বলছিলেন। বড় ভাই বাবার কথা শুনে, মাথা নাড়ছিল। প্রবল তর্ক হচ্ছিল। এটা নয় অর্থাৎ ওটা। ওটা নয় অর্থাৎ এটা। মা এক সময় না বলে পরলেন না। তোমরা কি সারাজীবন তর্কই করে যাবে আর পরস্পর “না” আর “হ্যাঁ” বলেই যাবে।
কথাপ্রসঙ্গে তিনি “না” শব্দটি বিশেষ উচ্চারণ করতেন না। তাঁর কাছে কিছু দাবি করলে তিনি “না” বলতেন না। বলতেন, আচ্ছা ঠিক আছে, দেখছি। এই প্রসঙ্গে কিছু কথা আগেই বলে রাখি। বাবা যখন বৃদ্ধ হলেন, তখন তিনি মহাভারত জ্ঞানী, বেদ উপনিষদ পড়ছেন। যদিও পুত্রের কাছে তার পিতা কখনই বৃদ্ধ নন।
তিনি এক বিস্তৃত সময় সরণির পথিক। কিন্তু জীবজগতের শরীর বড়ই বিচিত্র এবং রহস্যময়। আমরা যাকে বলি অন্তরাত্মার ঘর, তারও ক্ষয় আছে। সৈনিক জীবনের তীব্র অনুশাসন তাঁর অভ্যাসের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। যিনি তাঁর জীবনধারণের সাথে সংসারের তাঁর পত্নী ও পুত্রদের সমস্ত আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতেন। সাংখ্য দর্শনের ওপরে তাঁর আরও একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বেদান্ত দর্শন নিয়ে আলোচনাধর্মী গ্রন্থ লিখছেন। যুগান্তর পত্রিকার সাপ্তাহিক ধর্মকর্ম পাতায় উপনিষদের ব্যাখ্যা করছেন। দর্শন, ভক্তিপাঠ, মহাকাব্য অধ্যয়ন তাঁর চাকুরি জীবনের অবসরের পরে একমাত্র সঙ্গী ছিল। তখন “দি হোলি মেসেজ” ইংরেজি ভাষায় লেখা গ্রন্থটি জনসমাজে সমাদৃত হয়েছে। এই গ্রন্থটি তিনি হোয়াইট হাউসের তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টন মহাশয়কে পাঠিয়েছিলেন। গ্রন্থটির প্রাপ্তি সংবাদ ও প্রশংসাসূচক বিনম্র শব্দ লিখে হোয়াইট হাউস থেকে চমৎকার উত্তর পাঠানো হয়েছিল।
যা বলছিলাম, পানাগড় থেকে কলকাতায় ফেরার রাস্তার স্মৃতি আমার প্রবীণ বয়সেও যেন গেঁথে আছে। কেউ জানতে চেয়েছিল, হয় তো, বাবা বললেন, এই রাস্তা দিল্লি চলে গেছে। আমরা যাচ্ছি উল্টো দিকে, কলকাতার দিকে। দাদা জেনে বলল, জি টি রোড। আরেকজন বলল, ইতিহাস বইয়ে পড়েছি। শেরশাহ এই রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন। আমি তখনও বিদ্যালয়ে পা রাখি নি। কিন্তু আমার বড় তিনজন তাদের জীবনের সঙ্গে বিদ্যালয় যুক্ত হয়ে গেছে। ট্রাকের চালক শিখ, তাঁকে বললেন, একটি জল খাবারের দোকান দেখলে দাঁড়াবেন। রাস্তার পাশে কখনও কখনও গ্রাম আধা ঘুমিয়ে থাকা নগরের মতো, বাজার দোকানপাট, আমি যে ভাবে যে পোশাকে এতদিন মানুষজনকে দেখে এসেছি, যেতে যেতে দেখলাম মানুষের পোশাক থেকে চলনে অনুশাসনের বাইরে এক স্বাধীনতা আছে। অধিকাংশই ধূতি আর ফতুয়া বা শার্ট, সাদা রঙয়ের। প্যান্ট শার্ট পড়া মানুষজনকে খুব একটা দেখতে পাচ্ছি না। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ার বাইরে এই বৃহত্তর জগত অন্যরকম। বাবা পড়েছিলেন সৈনিকের পোশাক। গরমের জন্য মাথার টুপি খুলে রেখেছিলেন।
বাবা মাকে বললেন, ময়রার দোকানটি বেশ পরিষ্কার, কি বলো?
মা বললেন – চলে যাবে?
তুমি কি কিছু খাবে? কোন মিষ্টি? জিলাপি খেতে ভালোবাসো তো?
মা আমাদের সবার মুখের দিকে তাকালেন। বললেন – ওরা যা খাবে।
কাঁচের বাক্সে রাখা, অনেক মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বললাম – বালুসাই।
বাবা বললেন – সবাই যা খাবে, তাই খাও।
আমার ইচ্ছের বালুসাই টিকল না।
কলকাতার শহরতলী অঞ্চলে ফিরে আমার কিশোর বয়সের বালুসাইয়ের স্বাদ নেওয়ার ইচ্ছেটি দীর্ঘতর পিছনের রাস্তায় ফেলে এলাম। যেমন ফেলে রেখে এসেছিলাম ছাত্রজীবনের চকচকে রোদে খলসে মাছের পিঠ দেখার আনন্দ।
দোকানটির সামনে মাটির উঠোন। লাল মাটির কাঁকড়। আমরা সবাই দুইটি বেঞ্চের ওপরে ভাগাভাগি করে বসলাম। একটি বড়সড় গাছ দীর্ঘতর ছায়া ফেলেছে। ছায়ার মধ্যে একটি বাদামি রঙয়ের কুকুর এ্যান্ড্রোক্লিশের ভঙ্গিতে বসে আছে। তখন থেকেই পশু এবং মানুষের অভিব্যক্তি খুঁজে যাওয়া আমার নেশায় দাঁড়িয়ে গেছিল। কেন জানি না বেড়াল কুকুর সব পশুদের সঙ্গে মানুষকে মেলানোর বিমূর্ত ভাবনা আমাকে তাড়া করে বেড়াত। সেই ভাবনা এখনও লালিত, একটুও টসকায় নি। জলের মধ্যে মাছ আর আকাশের পাখি ও ঘুড়ি আজও আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
সুন্দর কাশগাছের ঝোপ। যত কলকাতার দিকে এগিয়ে চলেছি, দুই ধারে জলা জমি ছেঁড়া ছেঁড়া ছড়িয়ে আছে। আর মেঘ নেমে এসেছে ধানমাঠের ওপরে। মাটির কুটির থেকে ধোঁয়া উঠছে। কৃষক কাজ করছেন মাঠে, দিন বদলের অভিধানে নতুন শব্দ খোদাই হয়ে যাচ্ছে।
কেন জানি মাকে বললাম – তোমার মতো রান্না করবে বলে, উনুন আঁচ দিচ্ছে।
মা বললেন – সব ধোঁয়াই রান্নার জন্য নয়।
বাবা মাকে বললেন – এ যে তুমি দেশের বাড়ির কথা বললে। নদীর সব নৌকাই যেমন পারাপার ও যাত্রীদের জন্য নয়, তেমনি সব ধোঁয়াই রান্নার আয়োজনের জন্য নয়। কিন্তু তুমি ভাবো আবার, সব ধোঁয়াই কিন্তু রান্নার উদ্দেশে।
এতশত বুঝি না, এখন বুঝতে পারছি, আর কিছুক্ষণ পরেই ক্যাপ্টেন ব্রজেন মিশ্রা নিজের কোয়ার্টারের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে এ্যাকোরডিয়ান বাজাবেন।
রাস্তার চারদিকে শহর দেখছিলাম। এতক্ষণ গ্রামনিসর্গ আমাদের সাথে ছিল। এখন চারদিকের চলমান চিত্র বদলে যেতে থাকল। বাড়ি ঘর উপছে উঠতে থাকল। পথের দুইধারে গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। এই দৃশ্য আমার দেখার অভ্যাসে আঘাত হানল। মাঝে মাঝে পুকুর, ডোবা, জলাশয়ের পাড় ধরে রাস্তা, পথচারী সাইকেল দোকানপাট বিদ্যুতের কাঠের পোল, দেওয়ালে দেওয়ালে আলকাতরা আর রঙ দিয়ে কি সব লেখা। কিছু পড়তে পারছিলাম কিছু পারছিলাম না। কেমন যেন সবকিছু, আমার দেখার অভ্যাসের বাইরে। ভাবছিলাম, এমনই যা দেখছি, এরকম একটি বাড়ি ঘরের ভিতরে আমাদের আশ্রয় হবে। আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লাম।
মোটেই এই সব কিছু দেখতে আমার ভালো লাগছে না। হঠাৎ করেই, নদীর ওপরে ব্রীজ, ট্রাক চলছে আর ঘটাং ঘটাং শব্দ হচ্ছে। ট্রাক ব্রীজের মধ্যেখানে যেতেই, বাবা মাকে আঙ্গুল দিয়ে কি যেন দেখালেন। মা চোখের পাতা না ফেলে দেখতে থাকলেন। তারপরে কপালে হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করলেন।
উচ্চারণ করলেন – জয় মা দক্ষিণেশ্বরী।
বাবা বললেন, গঙ্গা পাড় হলেই আমরা এসে গেলাম।
আমি বাবার দিকে তাকালাম। এ কেমন বিচ্ছিরি শহর। গায়ে গা লেগে বাড়িঘর। নানান গলিপথ। কত মানুষ, রাস্তার দুইধার দিয়ে, আর কেমন গুমোট চারধার। বাতাসে উদারতা নেই। আর সবকিছুই অগোছালো। কি অসম্ভব ধুলো। আমি মনে মনে বললাম, এ শহর আমার হতে পারে না। একটা শহর যদি মনের মতো না হয়, তা হলে সেই শহরে থাকব কি করে? মনে হচ্ছিল সবাইকে বলে যাই, তোমরা সবাই এখানে থাকো। আমি পণ্ডিতানিজির কাছে চলে যাই। এই ট্রাকেই ফিরে যাই।
মহাসড়ক থেকে নেমে যেতেই কিছু দূরে গাড়ির ড্রাইভার সিংজিকে বাবা বললেন, ওই সামনে কারখানার গেটের সামনে দাঁড়াবেন।
ট্রাক দাঁড়াতেই, দেখলাম কালো খাটো মতো একজন দাঁড়িয়ে আছেন। সাথে তিনজন। বাবাকে তিনি প্রণাম করলেন। মাকেও। বাবা আমাদের বললেন পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করো। উনি তোমার কাকা। আমার ছোটোভাই। সবাই প্রণাম করল। শেষে আমি করলাম। উনি সবাইকে আশীর্বাদ করলেন। আমাকে আশীর্বাদ করতে গিয়ে তিনি বললেন – ছোড়দা একদম তোমার মতো দেখতে। ছোটোবেলায় আমরা তোমাকে ঠিক এরকমই দেখেছিলাম। তোমার মুখ বসানো। তারপরে আমাকে বললেন – কোন ক্লাসে পড়া হয়?
আমি মনে মনে বললাম – আমাকে আঙ্কল টমসের মতো দেখতে। একজন কালো আফ্রিকানের মতো দেখতে। মোটেই বাবার মতো নয়। ঠিক যেমন ভাবে বাবা আমাকে আঙ্কল টমসের গল্প বলেছিলেন। তারপরে বইটি হাতে দিয়ে বলেছিলেন, পড়ে ফেলতে পারো।
বাবা কাকাকে বললেন – এখানে ভালো স্কুল আছে?
কাকা বললেন – কেন থাকবে না। তবে এখন তো ভাঙ্গা বছর।
বাবা বললেন – আমরা আর্মি ম্যান, আমাদের সন্তানরা যেখানে যখন ইচ্ছে, ভর্তি হতে পারে। কারণ আমাদের বদলির চাকরি। বিদ্যালয় স্তরে সরকারের সেরকম হুকুম আছে।
তা হলে তো কোনোই অসুবিধা হবে না। যদি কোর্স সামলে নিতে পারে, তবে কথাই নেই। ট্রাকের মাল খালাস হোক, আমি সব দেখে নিচ্ছি। ওরাই সব করে দেবখন, তোমাকে অতশত ভাবতে হবে না ছোড়দা। তোমরা মুখ হাত ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে নাও। তোমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা আছে। এখন তোমরা সবাই খুব ক্লান্ত।

মাত্র দুইটি ঘর। একটি ঘরের মধ্যে আমরা ক’জন। আরেকটি ঘরে বাবা মা, কনিষ্ঠজন। একটি গ্রীল দেওয়া বারান্দা। বারান্দার পাশে মায়ের আয়োজনের ঘর, অর্থাৎ রান্নাঘর। ঘরের প্রবেশ বাহিরের দরজা খুললেই আধো আঁধার আচ্ছন্ন স্যাঁতস্যাঁতে গলিপথ। একদিন দরজা খুলে দেখলাম পাশের বাড়িতে বিয়ের কোলাহল। কনে বৌ এসেছে। শীলপাটার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে, একটি সিঁদুরে মাখানো বড় মাছ হাতে নিয়ে। নতুন বৌকে বরণ করা হচ্ছে। সানাই বাজছে। রান্নার মশলার গন্ধ পাড়া জুড়ে থৈ থৈ করছে। মহাভোজের আয়োজন চলছে।
মা বললেন, মাস্টারমশাই আসবেন। পড়তে বসো।
কিছুক্ষণ পরে সাইকেল চালিয়ে মাস্টারমশাই এলেন। গায়ে গাঢ় লাল রঙয়ের জামা। মাথায় সিঁদুরের টিপ। মাথার অগোছালো চুল পিঠের ওপরে নেমে এসেছে। অনেকটা তান্ত্রিকের মতো দেখতে। ভীষণ বদমেজাজি। আমি খুব ভয় পেতাম। তাঁর কথাবলার সাথে মুখ থেকে লাল দোক্তা পাতা খয়েরের থুতু ছিটে আসত। বড়ই বেমানান চরিত্রের একজন গৃহশিক্ষক।
এখানে দিনরাত্রি সমান হয়ে গেল। চারদিকের গলি পথ জলাশয় দোকানপাট মানুষজনের সাথে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারলাম না। রাতের বেলায় ঘুম আসত না। বালিশ হাতিয়ে পানাগড়ের কাশবনকে কল্পনা করতাম। কেমন সোঁ সোঁ বাতাসের শব্দ, আর মালগাড়ির ওয়াগনটিকে দেখলাম, চলতে শুরু করেছে। আমি সেই ওয়াগনের ভিতরে বসে আছি। চারদিকে ঘন কাশবন। হাজার হাজার সাদা রঙয়ের খরগোশ চরাচর জুড়ে ছুটে চলেছে।
এখন মনে হয়, একটা ফিল্ম দেখছি, বহুদূরে বাড়ির টিনের ছাদ রূপোর মতো চকচক করছে। আর ক্যামেরা চলছে, জলতরঙ্গ বেজে চলেছে। টুপ টুপ করে স্মৃতির গড়িয়ে যাচ্ছে, জড়িয়ে ধরে সাপটে নিতে গিয়ে বুঝতে পারি, আত্মজীবনের ভালোবাসার সময়গুলি নির্জন সমাধি ক্ষেত্রের ছায়া হয়ে যায়।

Facebook Comments

2 thoughts on “কাশবনের ভাস্কর্য : শুভংকর গুহ Leave a comment

  1. সুন্দর। তীব্র গরমে একটু যেন শীতল পাটির উপর বসে শৈশবে মায়ের হাতে তাল পাখার বাতাশ খাওয়া।

  2. কি যে ভালো লাগলো দাদা ৷মনটা কেমন হয়ে গেলো৷ চকচকে রোদে খলসে মাছের পিঠ দেখার আনন্দ, বাড়ির টিন চকচকে রুপোর মতো৷ঐ ছোট্ট বয়সের স্মৃতিকে মাথায় রেখে এতো অপূর্ব অনুভূতি মন ভরিয়ে দিলো

Leave a Reply