যে ধরণের কবিতা পড়ছি বা পাঠে চাইছি : শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

কবিতার প্রচল চেহারা নিয়ে অনেক সময় এক ধরণের দ্বন্দ্ব কাজ করেছে, যেমনটাবা সরল বাক্যের গদ্য নিয়ে, ঠিক তেমনই যা দেখছি তাই নিয়ে কবিতা লিখে ফেলা বা কলেজ কলিজায় আলোড়ন তোলা চমক লাগানো অনুপ্রাস জাতীয় খেলা, বা নাচুনে ছন্দে লেখা শোকগাথা সবকিছুকেই সন্দেহের চোখে দেখেছি একটা বয়সের পর থেকে কিন্তু কবিতা আমাদের ভাষার মানুষের কাছে সহজ, আবৃত্তি-যোগ্য, নাটুকে এবং নালিশ-প্রবণ, এটাই স্বাভাবিক প্রবণতা বলে মেনে নিয়েছি। দেখেছি পশ্চিম বাংলায় লেখা বাংলা কবিতার প্রধান ধারা কীভাবে বদলহীন থেকে যায়, মানুষের রুচি বদলালেও কবিতা পাঠকের রুচি বদলায় না। তার ভাল কবিতা বিচারের মাপকাঠি থেকে যায় বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে। আমাদের ভাষার সমসাময়িক কবিদের যাবতীয় পাঠতালিকা প্রধানত সেইসব ক্লাসিকেই ভরা থাকে, অন্ততঃ স্বাভাবিকতায়। কারণ বোধহয় আমরা অভ্যাস বদলে গেলে ভয় পাই। আমাদের চারপাশে এত চাপ যে আমরা কবিতার ক্ষেত্রেও নতুন কিছু পরখ করতে চাই না। বহু পোড় খাওয়া কবিতা পড়ুয়া ও কবিদেরও মধ্যেও দেখা যায় এই অনীহা।

এতক্ষণ যাঁরা পড়লেন, তাঁরা নালিশ দেখবেন। যদিও তা সত্যি তবুও খানিকটা কৈফেয়তের মত বলে রাখা নিজেরই কাছে, নিজের ক্রমশ নতুন ধরণের কবিতা পড়তে চাওয়ার চাহিদা। যেমন সরল ও ছোট বাক্যের “হালকা-ফুলকা” গদ্য আমার নয় (আবারও বলি শুধু প্রবন্ধের কথা বলছি, আখ্যান আমি পড়ি না সেই ২০১২ সাল থেকে), তেমনই নয় সেই একই তালিকাভুক্ত কবিতা। দীর্ঘদিন আর্যনীল মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যে থাকার ফলে বেড়েছে উদ্ভাবনী কবিতা পড়ার চাহিদা, যা আসলে জমিল সৈয়দ বা সুব্রত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া শুরু। এবং ধীর হলেও পাঠাভ্যাস বদলের শুরু, যত বয়স বাড়ছে তত বাড়ছে গভীরতর ভাবনা উদ্রেককারী, ভাবনাবাহী কবিতা ও প্রবন্ধের প্রতি আকর্ষণ, কিছুতেই আর মেনে নিতে পারি না নির্ভার কবিতা, কারণ মনোরঞ্জন আসলে আমার জন্ম মফস্বলের এক ব্যর্থ ডাক্তারের নাম, এবং যখনই সেই নামের উদ্ভব হয় বিশেষণরূপে, আমার স্বাভাবিক ব্যকরণ প্রীতির কারণে বিশেষ্য তার উপস্থিতি জাহির করে ভেঙে দেয় আরোপন।

অর্থাৎ আমি কবিতার কাছে কী চাইছি? ভাবনার রসদ। কল্পনা, চিত্রকল্প, অন্বয়ের চমকের বাইরে, এই চরিত্র থাকতেই পারে, কিন্তু তার সঙ্গে জুড়ে যাবে কিছু ভাবনার উদ্ভাস — প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভাল, যে সব স্বামী আকাদেমিয়ানন্দ বা সাধ্বী আকাদেমিয়াপ্রাণা কবিতাকে গত শতকের ছকে সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রে ফেলতে চান তাঁরা অবাক হবেন অন্য অনেক ভাষায় কবিতা পড়ার শব্দার্থবিজ্ঞানরীতি বা সেম্যান্টিকস এসে গেছে, সেখানে বেড়ে উঠছে শব্দের মূলপ্রাণ তার বহুগামীতা বা অর্থহীনতা — ভাবনা অর্থাৎ দার্শনিক থেকে ভাষাতাত্ত্বিক, ইতিহাস থেকে ভূতত্ব, অর্থাৎ নানা জ্ঞান শাখা। এখানে প্রশ্ন উঠবে তাহলে কি কবিতা পিছনে হাঁটছে, হাঁটতেও পারে, তবে এখনও বৃহত্তর কবিতা চর্চাকারীদের কাছে তা হয় নি, কারণ বিষয়ভিত্তিক কবিতা লেখা শখের কবির কাজ, কিন্তু এই সময় কবিতার ভিতরে থাকছে নানা জ্ঞানশাখা থেকে আহরিত তত্ত্ব ও তথ্যের চূর্ণ, তারাই সাহায্য করছে ২১ শতকের কাব্যতত্ত্ব তৈরি করতে।

একদিকে যেমন ইন্সটাগ্রাম কবি ও স্ল্যাম পোয়েট্রি ও র‍্যাপ, অন্য দিকে তেমন ভাবনাজগত। আমার জগৎ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ভাবনা-মানচিত্র, সেখানকার নতুন আঙ্গিকে দেখতে চাওয়া কবিতা, মিশ্রমাধ্যম কবিতা, সংকর-কবিতা। অনেকেই নাক উঁচু করে বলবেন সে আর নতুন কী? আমিও তাঁদের বলব, একই রকম আঙ্গিক ও বিষয়ের কবিতাতেই বা আর কি নতুন আছে? বস্তাপচা শব্দভাণ্ডার ও বস্তাপচা বাকরীতি আমাকে আর টানে না।

Facebook Comments

Leave a Reply