শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কবিতা

অসাড়লিপি ২১



নেমে আসছে কনট প্লেস ও তার কুয়াশা অন্বয়
নেমে আসছে পেডার রোড ও তার গুরু দৎ স্মৃতি
বাঁক নিচ্ছে চৌরঙ্গী ও তার সাদা ভিন ভাষা
আমাদের ভাষার কোনও স্মৃতি নেই
মানুষ ও পশুর সারি ক্লান্তির কারণ খুঁজে
ফুসফুস সমুদ্র লবণ চাইছে
আমরা অনেক দিন আগেই গানের লিরিকে গুঁজে দিয়েছি
শরীরের অংশ বুঝতে পারছি হৃদয় যকৃৎ সঙ্গে দৃষ্টি মিশে
তবেই তৈরি হয়
                    অসাড়
পরপর অভিনেতা মাধ্যমের খেলা
পরপর চরিত্র সাজানোর নাম শীতকাল
যে চলার নাম সিনেমা
তার প্রতিটা মানুষের মুখে অন্যের স্বর
ভিজে অক্ষর ভিজে গন্ধ
আমরা বার বার চিৎকার করে বেরিয়ে আসতে চাইছি
আর গলায় বিঁধে যাচ্ছে
                    অসাড়
চোখের সামনে বড় হয়ে উঠছে মুখ
ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে হাসি
এক গাঢ় বাদামি রেখার মত বেড়ে উঠছে
আমাদের ধমনীসমুহ > শহরের রাস্তার প্যাঁচ

আমি শুনছি রঙিন খেলার নাম আমি শুনছি সমস্ত শহর, আমার দেশ ও কালের মধ্য শহর সমূহ এক ভ্রান্ত সমস্যের মধ্যে ফুটে উঠছে এক বিশালাকার ধাতব পুষ্পের মত। আমি শুনছি তাদের দানবীয় পাপড়ি মেলার শব্দ, তাদের সমস্ত কলকব্জা, কারখানার যন্ত্রপাতি। আকার নিচ্ছে সমস্ত বৃতি, দলমণ্ডল,  পুংকেশর, গর্ভকেশর, আর সেই বিরাট সমস্ত পুষ্পল কলকব্জার মধ্যে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আরও সমস্ত শহর পুষ্প। সম্পূর্ণ ধাতব। আমি শুনছি কীভাবে মরুভূমির শুষ্ক পাহাড় কেটে বড় হয়ে উঠছে পাপড়ি দুর্গ। বৃন্তে লেগে আছে গ্রাম ও তার না মেলা নবান্নের অঙ্ক। শুনছি গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসা কৃষকের খালি পায়ে চলার শব্দ। বছর শুরু হচ্ছে, আরও একটা শতাব্দি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারল না ভেবে মাথা নাড়ছে বিরাট ধাতব পরাগরেণু, যা আসলে আমাদেরই ভারি মাথা, শীতে জবুথবু হয়ে থাকা হাত। শীতকাঁটা গায়ে যে শহর বেড়ে উঠল তার নাম ভাষা। খড়িবোলি আসলে এক ধীর সূর্যোদয়। কুয়াশা ও মাটি অগ্রাহ্য করে যে বেঁচে উঠেছে। শুনছি সেই কৃষকমুখ যা আসলে ধাতব পাপড়ি, পাথুরে পরাগ।

আমি শুনছি সে মুখ যা আসলে এক পাথুরে পরাগদণ্ড ধীরে ধীরে সমস্ত শহর বেড়ে উঠছে তাকে ঘিরে, সমস্ত মরুপ্রকৃতি ভরে উঠছে পাথুরে ফুলে, সমস্ত সূর্যাস্ত ও চন্দ্রোদয় জুড়ে বেড়ে উঠছে ভূতুড়ে দানবীয় সমস্ত পাপড়ি, তাদের ফাঁকে ঝরে পড়ছে বিভিন্ন ভাষার স্বর।

আমি শুনছি সমস্ত পাথর উপড়ে আসছে, শহর, রাস্তা ও গ্রামোত্থান, কৃষক ও নিঃশ্বাস। সহস্রাব্দ ধরে ফসলের শরীরে ছড়িয়ে রাখছে যাহা কিছু আর্থসামাজিক, আমরা বুঝতে পারছি আমাদের ধাতব স্নায়ুপথে জাতিস্মর স্নায়ুদের লিখিত অভ্যুত্থানে কীভাবে সন্ন্যাসী ও পীরের দল বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, সমগ্র ধাতব পাপড়ির পথে ছড়িয়ে থাকে তাদের সাধনার ফসল।

শুনছি ঘোড়ার খুরের শব্দে খুলে যাচ্ছে সকালের দরজা, খুলে যাচ্ছে মধ্যযুগ, আদি ও অন্তযুগ সবকিছু অন্য মহাদেশের মাপে তৈরি হয়ে আছে। দেখছি কীভাবে আমাদের নিজস্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাষাহীনতায় মুখ থুবড়ে পড়ল।

শুনছি গোটা ভূখন্ড উধাও হয়ে যাওয়া। ইতিহাস কী তা বোঝার আগেই শুনছি সমগ্র পরিপার্শ্ব এক ধাতব পুষ্পবাগিচা, তার চারপাশে রোমান হরফে লেখা তারিখ, তার পাশে পালি ভাষায় লেখা উপদেশ

দেখছি শহর কোথায় নগরের চেয়ে আলাদা। নগর কোথায় হারিয়ে গেছে তাদের পাথরের উপর দিয়ে পায়ে চলা আর ঘোড়ায় চলায় প্রতিধ্বনিতে। পরপর পাথরের দেয়াল ভেঙে ফেলা হচ্ছে আর তার বদলে গজিয়ে উঠছে ধাতব পাপড়ি।

দেখছি আমাদের রক্তে মিশে আছে ভিন ভূগোলের কাচ। আমরা স্বীকার করেও তেমন কিছু করতে পারছি না। শহরের প্রতিটা অঙ্গে ছড়িয়ে যাচ্ছে নগরের ক্লান্ত রং। তার হলুদ আলর প্রাচীন শতাব্দিগুলো তখনও করদ হয়ে বেঁচে থাকা কৃষি সমবায়।

শুনছি উপড়ে আসছে আমার বিঃশ্বাস, আমার রক্তের ভারি গতি। তাড়াহুড়োয় হারিয়ে যাচ্ছে সমস্ত পুরনো নোট, উপড়ে আসছে এতদিনের সঞ্চিত অক্ষরের প্রতি পক্ষপাত। যাবতীয় কাজ ও চিন্তার পিছনে কিছু জং ধরা নাম-ফলক। কখনও না শোনা পদবি ও নাম। রহস্যময়তা তৈরি করতে পার এমন বাতাসে পরিত্যক্ত রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে চলেছে অজস্র ফেলে দেওয়া পুরনো ফিল্মের রিল> তাতে ধরা ধাতব পরাগ-মাথা, পাপড়ি। পাথুরে পাপড়ি দিয়ে ঘেরা নগর দৃশ্যে ঢুকে আসছে শহরের সহস্রাব্দ। তাতে শুধু তাঁত বয়নের কাল। একটা ভারি ভাবনা, দীর্ঘ বাজার, নদী ও বাণিজ্যপথ। রাজা ও করের জগৎ। নিজের নির্বুদ্ধিতায় হতবাক হয়ে দেখছি দাবীদাওয়াহীন গান। শুধুই ঈশ্বরভাবনার মত সন্ধান আমাদের অক্ষর পৃথিবী জুড়ে। আমারা অনন্ত পাথর যুদ্ধে। সহস্রাব্দের অমরার স্প্রিং এ আটকে মাতৃত্বের আভাসকে আনন্দ বলে ডেকেছি।      

Facebook Comments

Leave a Reply