রবীন্দ্রনৃত্য ভাবনাঃ প্রেক্ষিত ও চলন – সোমা দত্ত
দ্বিতীয় পর্ব
রবীন্দ্রনাথের নৃত্য অভিজ্ঞতা:
১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংলন্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরাজদের বেশকিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন।সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে তা এখন আমরা একপ্রকার জানি।সদ্য যুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন।যে কথা আগেও বলেছি আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেননা।মূলবাসী ও গ্রামীন পরিসর ছাড়া নারী পুরুষ ্যুথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায়না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।সেখানকার নাচের আসরের বিস্তৃত বিবরণ আমরা পাই তাঁর ‘ইউরোপ প্রবাসীর পত্র’ থেকে।নাচের আসরে মাঝে মাঝেই যে তাঁকে বড় বিড়ম্বনায় পড়তে হত তাও তিনি উল্লেখ করেছেন।সহজে সকলের সাথে মিলে উঠতে পারতেন না বলেই হয়ত অপরিচিত সঙ্গিনীর সাথে নাচে প্রায়ই ভুল হত।নাচের আসরের নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে সঙ্গিনীর অনুমতি নিয়ে কি নাচ নাচবেন তা লিখিতরূপে ঠিক করতে হত। এ প্রসংগে তিনি সেদেশের নানা প্রকার নাচের নাম উল্লেখও করেছেন আবার এর মধ্যে কিছু নাচে যে তিনি অত্যন্ত পারদর্শী তাও জানাচ্ছেন। কিন্তু সঙ্গিনী পছন্দ না হলে তিনি নাচে বারবার ভুলও করে ফেলেছেন,কখনো কারো গাউন মাড়িয়ে কারো গায়ের উপর পড়ে বেতালে পা ফেলে, এমনকি সহ নর্তকীর পা ও মাড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করছেন। আবার পছন্দের সঙ্গিনীর সাথে খুব সুন্দরভাবে ‘গ্যালপ’ নেচেছিলেন বলে নিজেই নিজের তারিফ করছেন।
এই নাচের আসর রবির কেমন লেগেছিল, তা সহজেই অনুমান করা যায়।ঘরভর্তি মেয়ে পুরুষ জোড়ায় জোড়ায় নাচছে, নাচের ফাঁকে যুগলে নিভৃত সময় কাটাচ্ছে এ সমস্তই যদি তার খুব খারাপ লাগত বা সংস্কারে বাঁধত তবে নিশ্চিত বারবার ও মুখো হতেন না।পত্রে একাধিক সন্ধ্যার বিবরণ পাওয়া যায়। প্রথমদিকের এই জোড়ায় জোড়ায় নাচে অসোয়াস্তি যেমন ধরা পড়েছে তেমনি কি যেন একটা উচ্ছ্বাসের ঢেউ উঠত এই ঘরের মধ্যে তাও উল্লেখ করতে ভোলেননি।সম্ভবত এই উচ্ছ্বাস এই আনন্দের ভাবই তাঁকে নাচের প্রতি বেশি করে টেনেছিল। ১৮৮০ সালে ইংলন্ড থেকে ফিরেই রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো বাড়িতে ‘মানময়ী’ নাটকের অভিনয়ের সময় “আয় তবে সহচরী” গানটি রচনা করে হাতে হাত ধরে বিলিতি ঢঙয়ে নাচিয়েছিলেন।পরে ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দে নাটকটি পুনরায় পরিবর্তিত আকারে অভিনীত হয় ‘ভারতীয় সংগীত সমাজ’ এর প্রযোজনায়, নাম হয় ‘পূর্ণবসন্ত’।এই গীতিনাট্যটির মহড়ায় কবি নিজে হাততালি দিয়ে নাচ শিখিয়ে দেন।
সংস্কারের আবহে ঠাকুরবাড়ি:
পুরাতন সংস্কার কাটিয়ে ঠাকুরবাড়িতে নুতন সংস্কার গড়ে ওঠার ্যে ধারাবাহিকতা চলেছে দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথের পরবর্তী প্রজন্মেও এলিট বঙ্গসমাজে তার বেশ প্রভাব পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথের মেজদাদা ও সেজদাদা, সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কথাও এ প্রসংগে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কারণ কিশোর রবির জীবনে তার এই দুই দাদার প্রভাব অনেকখানি। মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের প্রভাবে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে কীভাবে পরিবর্তনের বন্যা বইতে লাগল তা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন তাঁর স্মৃতিকথায়।সত্যেন্দ্রনাথ তার স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীকে নিয়ে হুড খোলা ফিটন গাড়িতে কলকাতাবাসীকে হতবাক করে বেড়াতে বেড়তেন।সত্যেন্দ্রনাথ যখন আমেদাবাদে চাকুরীরত ছোটদুই সন্তান নিয়ে জ্ঞানদানন্দিনী একলাই থাকতেন লন্ডন শহর থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে ব্রাইটন নামক সমুদ্র তীরবর্তী স্থানে।তিনি নিজে আবার এক কদম এগিয়ে দুটি ঘোড়া কিনে স্ত্রীকে নিয়ে ঘোড়সওয়ারী করতেন ময়দানে।জোড়াসাঁকো থেকে ময়দান পর্যন্ত পথচারীর তাক লেগে যেত এমন দৃশ্য দেখে তা বলাই বাহুল্য। ঠাকুরবাড়ির নতুন প্রজন্ম নারীকে অন্তঃপুর থেকে বাইরে নিয়ে এলেন, ঘরে বাইরে সংগী করে নিলেন বলা যায়।এ সমস্তই রবীন্দ্রনাথের বিলাত যাওয়ার আগের ঘটনা, আর এ সমস্ত ঘটনার যথেষ্ট প্রভাব যে তার ওপর পড়েছিল তা বলাই বাহুল্য।
উনিশ শতকের নব্য বাঙালি উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত যে শুধুই সাহেবিয়ানায় মজে থাকেনি বরং বিদেশি সমাজ সংস্কৃতির দাপটে সে নিজের দিকেও ফিরে দেখতে শিখেছিল তা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য।একদিকে খ্রীষ্টান পাদরিদের দাপট,ইংরাজি শিক্ষার বোঝা অন্যদিকে ইংরাজ সরকারের দাপট, বাঙালি শুধুই তা সহ্য করেছে এবং তাঁবেদারি করেছে বিষয়টা এমনও নয়।নিজের দেশ ধর্ম সমাজ শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিকে মনোনিবেশ করেছে।যে ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেছে তা সাধন করতে মন দিয়েছে।যুগের সাথে সময়ের সাথে তাকে নতুন করে গড়ে নিতেও উদ্যোগী হয়েছে, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি এর মধ্যে অগ্রগণ্য।শুধুমাত্র পরিবারই নয় রামমোহন থেকে বিদ্যাসাগর, কেশব সেন থেকে দীনবন্ধু মিত্র, মধুসূদন দত্ত, বাঙ্গলায় ধর্ম থেকে সমাজ ও সাহিত্য সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বিপুল সংস্কারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন অষ্টাদশ শতক থেকেই।
মাতামহীর মৃত্যু দেবেন্দ্রনাথের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল যা তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে।তৎকালীন বিলাসজীবন ছেড়ে প্রাচীন সংস্কৃত দর্শন পাঠে মনোনিবেশ করলেন তিনি।রাজা রামমোহনের প্রভাবে উপনিষদের তত্ত্বজ্ঞান সম্বন্ধে আগ্রহী হলেন এবং মূর্তিপুজার বিরোধী হয়ে উঠলেন।অতঃপর ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ গঠন ও ধীরে ধীরে ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ।২৬ বছর বয়সে তিনি ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষা নিলেন এবং ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে মন দিলেন।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের একের পর এক দৃঢ় পদক্ষেপ ঠাকুরবাড়ির সংস্কারের মূলে আঘাত করেছিল। পৌত্তলিকতা থেকে সরে এসে পারিবারিক বৈষ্ণব ধর্ম ত্যাগ করলেন।পারিবারিক দেবতার পূজা বন্ধ, ব্রাহ্মসভায় প্রকাশ্য বেদপাঠ, ব্রাহ্ম সংগীতের প্রচলন, অপৌত্তলিকভাবে পিতার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান এবং রবীন্দ্রনাথের জন্মের দু’বছর বাদে অপৌত্তলিকভাবে সুকুমারী দেবীর বিবাহ এ সমস্তই তৎকালীন হিন্দুসমাজে যথেষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপ।কুলদেবতার পুজো বন্ধ করে দেওয়াতে পরিবারে পর্যন্ত ভাঙ্গন এসেছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে।গীরিন্দ্রনাথের(দ্বারকানাথের তৃতীয় পুত্র) বিধবা স্ত্রী পুত্র,পুত্রবধূ, কন্যা ও জামাতাদের নিয়ে উঠে গিয়েছিলেন দ্বারকানাথের বৈঠকখানা বাড়িতে।কূলদেবতা লক্ষী জনার্দনের সেবা বন্ধ ও মূর্তি স্থানান্তরের প্রশ্নেই এই সিদ্ধান্ত।
এভাবে ঠাকুরবাড়ির আত্মীয় পরিজন থেকে যেমন তাঁদের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল তেমনি সমাজে অগ্রগণ্য বহু মানুষের সাথে নিজস্ব এক পরিমন্ডল গড়ে তুলেছিলেন তারা।তাদের নিজস্ব রুচি ও সংস্কার উৎসব তারা নিজেরাই গড়ে নিতে পেরেছিলেন।পূজোয়াচ্চা বন্ধে সামাজিক পরিসরে হিন্দু সমাজের সাথে ঠাকুরবাড়ির বিচ্ছেদ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে সামাজিক পালা পার্বণ, উৎসবের ক্ষেত্রে জামাইষষ্টি ,ভাইফোঁটা চালু থাকল, সাথে যোগ হল ‘মাঘোতসব’ , নববর্ষ (পয়লা বৈশাখ) প্রভৃতি অনুষ্ঠানগুলি, যা নতুন এক সংস্কৃতির জন্ম দিল।
ব্রাহ্ম সমাজ ও ব্রাহ্মধর্ম:
ব্রিটিশ উপনিবেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক যে আক্রমণ তার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ গড়ে উঠছিল অষ্টাদশ শতক থেকেই তার বেশ কয়েকটি ধারা চিহ্ণিত করা যেতে পারে।একদল খৃষ্টান ধর্ম ও ইংরাজী শিক্ষার বিপরীতে প্রাচীন সনাতনী ধর্মীয় সংস্কৃতিকে মহৎ বলে দাঁড় করাতে চান। অন্যদল যুক্তিবাদী, পাশ্চাত্য শিক্ষার যা কিছু ভালো দিক তাকে গ্রহণ করে নিজ ধর্ম শিক্ষা সংস্কৃতির উন্নততর রূপ গড়ে তুলতে চান।ঈশ্বর ও ধর্মীয় পরিসরের বাইরে জগত ও জীবনের যুক্তিবাদী কাঠামোই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য।তাদের এ পথ সহজে গ্রহণযোগ্য নয় কারণ এখানে ঈশ্বরের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ করা হয় ফলে প্রচলিত ধর্মগুলি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়।আর একদল হলেন যারা হিন্দু ধর্মের আধারে প্রচলিত,প্রচারিত কুসংস্কারগুলিকে বর্জন করে আচারসর্বস্বতার বাইরে এক পরিসর তৈরি করতে চান যাতে একদিকে ইংরাজ পাদ্রী ও অন্যদিকে যুক্তিবাদী উভয় আক্রমণ থেকে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করা যায়।
ইংরাজ পাদ্রীদের আপাত সংস্কারহীন বাহ্যিক রূপে আকৃষ্ট হয়ে এবং হিন্দুধর্মের জাতপাত বর্ণভেদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে ধর্মান্তরণ হিন্দুসমাজের মাতব্বরদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠেছিল।ধর্ম রক্ষা ও ব্যাপক অর্থে হিন্দুত্বেরই প্রচার ও প্রসার হয় এমন কিছু করার প্রয়োজন তারাও বোধ করেছিলেন।সেদিক থেকে অপৌত্তলিকতা সত্ত্বেও দেবেন্দ্রনাথের প্রাচীন বৈদিক ধর্মে আসক্তি,যুক্তিবাদী ও নিরীশ্বরবাদীদের তুলনায় সহনীয় ছিল তাদের কাছে।সমাজ সংস্কারের থেকে ধর্ম হিসেবে একে গড়ে তোলায় অধিক মনোযোগ দিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এ কথা বললে অন্যায় হবে বলে মনে হয়না।
ফলত আদি ব্রাহ্ম সমাজে যে উপনয়ন অর্থ ছিল কোনো ব্রাহ্ম উপদেষ্টার উপর কোনো বালকের শিক্ষার ভার অর্পণ সেখানে তিনি উপনয়ন পদ্ধতিতে শালগ্রামশিলা ও হোমযজ্ঞাদি বাদ দিলেও গায়ত্রী মন্ত্র ও বেদমন্ত্র পাঠের রীতি চালু করলেন,যাকে বিশুদ্ধ উপনয়ন বিধি বলে মান্যতা দেওয়া হল ব্রাহ্মধর্মে।নব্য ব্রাহ্ম যুক্তিবাদীরা যদিও এরীতির বিপক্ষেই ছিলেন এবং রক্ষণশীলতা ও সংস্কারের প্রশ্নে ব্রাহ্মসমাজও ভেঙ্গে গেল।কেশব সেনের নেতৃত্বে সমাজ সংস্কারের ধারা চলতে লাগল যা তথাকথিত হিন্দুধর্মের বর্ণভেদ, জাতিভেদ,কৌলিণ্যপ্রথা এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল।নারীশিক্ষা, বিধবাবিবাহ, বাল্যবিবাহ প্রথা রদ প্রভৃতি ক্ষেত্রেও প্রভূত সংস্কার সাধিত হয়েছিল।মহামারীর সময় দলগঠন করে ত্রান ও সেবাকাজে নিযুক্ত হয়েছিল সংস্কারপন্থী এই অংশ।
হিন্দু মেলা ও দেশাত্মবোধ:
‘হিন্দু মেলা’ শুরুর সময় রবীন্দ্রনাথ পাঁচ বছরের বালক। ১৮৬৭ সালের ১২ই এপ্রিল এই মেলার সূচনা হয়।মেলার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ন্যাশনাল পত্রিকার সম্পাদক নব গোপাল মিত্র।পৃষ্ঠপোষক ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজ নারায়ণ বসু,আরো অনেকে।
দেশীয় শিল্প ও সংস্কৃতির প্রসার ও এরই মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার ভাবনা ছিল এই মেলার মূল লক্ষ্য। এঁরা হিন্দু জাতীয়তাবাদকেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদ মনে করতেন আর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যাপক অর্থে হিন্দুত্বের গন্ডির মধ্যেই অবস্থান করেছেন এবং হিন্দুমেলার সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।তাঁর পুত্রদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আবার ছিলেন সংস্কারপন্থী।শুধুমাত্র মেলা বা উৎসব নয়,পরবর্তীকালে তাঁত ও দেশলাই কল করবার উদ্যোগ ও স্বদেশি স্টিমার কোম্পানী করে বাঙ্গালির অর্থনৈতিক মেরুদন্ড শক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।সফল না হলেও তাঁর এই উদ্যোগ অবিস্মরনীয়।
এই হিন্দু মেলাকে কেন্দ্র করে দেশাত্মবোধক গান কবিতা রচনার ঢেউ উঠল এবং ঠাকুরবাড়ির যুবকেরাও সেই দলে সামিল হলেন।সত্যেন্দ্রনাথ,গণেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সকলেই দেশাত্মবোধক কবিতা ও সংগীত রচনা করেছেন দেশের গৌরব বর্ণনা করে, জগতসভায় ভারতবর্ষের উচ্চাসন লাভ করার আকাঙ্খা প্রকাশ পেয়েছে এই সাহিত্যে। রবীন্দ্রনাথ এই আবহেই বড় হয়ে উঠছেন, স্বাভাবিকভাবেই দেশ এবং ধর্ম সম্বন্ধে একরকম ধারণা তার তৈরি হচ্ছে বাড়ি থেকেই।হিন্দু মেলাকে কেন্দ্র করেই তার প্রথম রচনাও প্রকাশ হচ্ছে। প্রথম কয়েকবছর যে উন্মাদনায় মেলা সংগঠিত হয় সে উৎসাহ ক্রমশ কমতে থাকে।অন্যদিকে যুক্তিবাদী সংস্কারপন্থীদের প্রভাব বাড়তে শুরু করে, যারা ধর্মীয় পরিসরের বাইরে সেকুলার ভারতের সত্যরূপকে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। আবার হয়ত এও বলা যায় যে উচ্চবিত্ত শিক্ষিত বাঙালির মেলা বা উৎসবের কোনো গভীর প্রভাব ছিলনা জনজীবনে তাই সে হুজুগের অবসান হয় উনবিংশ শতকেই।
যুক্তিবাদী কাঠামোর বাইরে কোনো কাঠামোতেই সমাজের আমূল পরিবর্তনের ঝুঁকি এবং আশা কোনোটাই থাকেনা।যুগের দাবীতে খানিক এদিক ওদিক করে মূল কাঠামোকে বজায় রাখায় চেষ্টায় সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়না।সেকারনেই ব্রাহ্মধর্ম মূলত কলকাতার এলিট বাঙ্গালীর মধ্যেই কিছু সাড়া ফেলেছিল এর বাইরে তার প্রভাব নগণ্য।ধর্মগত দিক থেকে রবীন্দ্রনাথও একরকম এই ব্রাহ্ম ধর্মীয় চর্চার মধ্যেই বড় হচ্ছেন এবং উপনিষদের প্রগাঢ় প্রভাব থাকছে তাঁর মননে ।রবীন্দ্রনাথের উপনয়নকালে বৈদিক মন্ত্রজপ, সদ্য ব্রাহ্মণ হওয়ার পরবর্তীতে গায়ত্রীমন্ত্রের জপ তাঁর জীবনেও বহুকাল প্রগাঢ় প্রভাব ফেলেছিল।নিজস্ব সামাজিক জীবনেও তিনি বহুকাল ধর্মীয় আচার সংস্কার রক্ষা করে চলেছেন।কিন্তু এর থেকে মুক্তি ও পেয়েছিলেন তিনি তাঁরই গভীর বোধ ও দেশ ও সমাজ সম্বন্ধে জ্ঞান ও উপলব্ধির মধ্য দিয়ে।
[ক্রমশ]
Posted in: ARTICLE, October 2020 - Serial