রাজস্থান ডায়েরিস : সিন্ধু সোম
পর্ব-১৫
রাজস্থান ডায়েরিস—২৯
তফাৎ যাও। তফাৎ যাও। রিন রিন। রিন রিন। মেহের আলী থেকে রবীন্দ্রনাথ। চিৎকার করে ওঠেন দেশবন্ধু। রবীন্দ্রনাথ শোনেন না। “উমা-শঙ্কর বিহার পর্ব”! মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসেন ভারতচন্দ্র। ড়সসসস্। কানে লাগে। বিরক্ত ম্যাকলে মিনিটের শক্তিশেল ছাড়েন। এক আলমারী সংস্কৃত বই পুড়তে থাকে। কালিদাসের চামড়ায় ফুটে ওঠে মোহর ছাপ। ফারেনহাইট ৪৫১। ত্রুফোর পাশে ফস করে ওঠে দেশলাই। ধরান ব্রাডবেরি। স্কচের গ্লাস। গুবগুব গুবগুব। কিছুটা রাষ্ট্র পড়ে পেটে। লিও-র কান্নাটা আরও জোরদার হয় এঞ্জোলোর থাপ্পড়ে। জয়দেব উদাস চোখে মাঠের দিকে তাকান। তার নেমপ্লেটের পাশে শ্যাওলা পড়েছে। বাগানের দেয়ালে নোনা। কর্পোরেট এসে রোজ শ্লীল-পেচ্ছাপ করে যায়। ভালগারিটির ব্লিচিং-এও আজকাল গন্ধ যায় না। রবীন্দ্রনাথ বিকৃত। বায়রনের ভঙ্গিতে তোলা আঙুল কেটে যায় আখের কলে। “সত্য করে বলো মোরে…”! এগিয়ে আসে সহজিয়া। চর্যার দেহ। এগিয়ে আসেন কালিদাস। এগিয়ে আসেন বাৎসায়ন। গ্রীস থেকে রোম। রোমকূপে রোমাঞ্চ। মিশর, মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা। বজাজ বলেন অজন্তা অশ্লীল। বুক দিয়ে মূর্তি আগলান নন্দলাল। সমরেশ, বুদ্ধদেবের পাশে খালি পায়ে এসে দাঁড়ান রামকিঙ্কর। ঐ পুরু প্রিমিটিভ ঠোঁট। স্রোতের মতো। ভাস্কর্য। ভিড় বাড়ে। অন্ধকার।
ঝুপ করে নেমে আসে। কুয়াশা। বন্ধ ঘর। বাইরে থেকে তালের রেশ আসছে। মুজরো। বাঈজী নাচে। বৃদ্ধার পা। গঙ্গার মতো শাখানদী, উপনদীকে পবিত্রতা বিলিয়ে দিতে থাকে। অন্ধকার আলোর সতীন। দৃষ্টির পরকীয়া। আমি অবয়ব দেখি। ঘাড়ের খুব কাছে। স্রোত? নাও হতে পারে। অন্ধকারই তার পরিচয়। আঁধারিনী পা। ছোঁয়ায় চমকে ওঠে নারী। বাজনার স্বরে ডাকছে অস্বাভাবিক। আমার ঠোঁট। পাখি। চন্দ্রবিন্দু। উফফফ্। আলতো কামড়ে শিউরে উঠে পাতা ঝরায় আঁধারিনী। বন্ধ দরজা। বন্ধ্যা নয় ঘর। জাজিমের দোলা। ভিজে ওঠে অন্তঃসারশূন্য দোলক। খড়্গের মতো অস্ত্র। ব্যবহার। অহং-এর ব্যবহার। দৈত্যকণ্ঠে উল্লাস কানে আসে। আমার স্তনের ভাঁজে পদ্মের শিশিরের মতো ঘাম জমে ওঠে। দাঁতের দাগ পরিয়ে দেয় মেখলা। আঁধারিনী নাকে অস্তমিত নাড়ির টান। পদ্মের পাঁকের দিকে নামতে থাকে আঙুল। ঝর্ণার আগে বৃষ্টির অপেক্ষায় চাতক। পিঁপড়ে। সারি সারি। খাবারের ভাণ্ডারে এসে দাঁড়ায় নগ্ন শিব।
আমার নারীত্বের মোলায়েম স্তন আর ঋজু শিশ্নে আঁধারিনীর অঙ্গারের ছোপ পড়ে। অন্ধকার শীৎকার নেয়। ফিরিয়ে দেয় কালসিটে। নখের দাগের মতো মেঘ। কালো রক্তের মতো অশ্রু নামে। আঙুলে শব্দ হয়। আঙুলে জীবন থাকে। উত্তাপ জমাট বাঁধে। নিতম্বের স্ফিত বুকে মহাসাগরের গভীরতা। অদৃশ্য । অর্ধনারীশ্বর। অথবা হরিহর। আচমকা। চক চক। মৃত্যদণ্ড। সরীসৃপের জিভ। আমি স্বর্গের দিকে উঠতে চাই। নরক উঠে আসে। ভার্জিল মনে পড়ে। বন্যা। নোনতায় জ্বালা ধরে চোখে। মুখে শব্দের স্বাদ শুধু। দুই উপনদীর মোহনায় হারিয়ে যায় নবকুমার। জন্মের পর জন্ম। কপালকুণ্ডলার চুল। আমার পিঠের স্রোতের ঢেউ। আমার বুকে অন্তঃক্ষরা পিচ্ছিলতা। আঙুলের চাপ পড়ে। হ্যাঁচকা টানে উপড়ে আসে আমার নরম স্তন। আঁধারিনীর অধিকারে। বিজলি। মেঘের বুকের ভাঁজ দপ করে জ্বালিয়ে দেয় কুচবরণ কন্যা। চুলের চিতায় আহুতি নেয় সংজ্ঞা।
দপ। দপ। একে একে আলো জ্বলে ওঠে ঘরে। চারদিক এখনও ঝাপসা। সমুদ্রের পর্বত ঢেউ। কলাপাতার ভেলার নীচে বেহুলার চোখ ভাসে। আমার বুক মুখ ভরে তখন পুরুষ এসেছে দ্বারে। জর্জের খালি গলা,”একি পুলক বেদনা…”! ঘরে প্রতিধ্বনি। ঝাপসা এখনও। দেয়ালে মহারাজ দেখছেন। রাণীকে! রাণী কে? দিতির আদল! আমি দিতির কানে মুখ বিছালাম। জাজিম পায়ের বাণী চিরদিন বুক পেতে নেয়। কম্পনের চূড়ান্তে এসে শীৎকার নীরবতা খোঁজে। লাল হয়ে ওঠা ঠোঁট তার রঙ সুদে খাটায় বুকে। আমি ভিক্টোরিয়াকে ভেজা লুঙ্গীর মতোন ছুঁড়ে ফেলি। ত্রিভুজের আলম্ব রেখায় মার্বেলের রঙ ধরতে চায় । সরলরেখার ভার। নেমে আসে সূর্যাস্তের বুকে। বৃষ্টি নামে। কালিদাস বৃষ্টির শব্দ তুলে নিয়ে দিতির গলায় পরিয়ে দেন একে একে। এক উভগামী অতীত এক নারীর শরীরের বর্তমান ওমে পরম হয়ে ওঠে। ডিমের আস্তরন ভাঙে। মিটিমিটি হাওয়া মাখে পুরুষ। প্রকৃতির কোলে। পাখির ছানার মতো ঠোঁট পাতে নগ্ন শরীর। দুই। দ্বিত্বে ফেরে নুড়ি। পুরুষাঙ্গ স্নেহময় হয়ে ওঠে। দুহাত পেতে গ্রহণ করে দুজন দুজনের কাছে। একতারার তার টানটান হয়। সুর ওঠে থেকে থেকে। দিতি খুলে রাখা আঁচল টেনে আমার মাথার ঘাম মুছে দেয়। আমি দিতির স্থবিরতা দেখি। সূর্য ফের ডুবে যায় পাহাড়ের খাঁজে। আস্তে আস্তে শীতলতা। নামে। আমার শীত শীত করে। ঘট। খুলে যায়। হাট দরজা। আমি নগ্নতা নিয়ে এগিয়ে এসে শূণ্যতা অনুভব করি দৈত্যপুরীর। অনুভূত হয়, পোষাকের শূণ্যতা নগ্নতার সংজ্ঞা দেয় না। অস্তিত্বের শূণ্যতা দেয়। আমার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দিতি। আমার মতোই। সম্মৃদ্ধ। আদরে ঢাকা শরীরে। আদরে নগ্ন মন……… দেয়ালের বন্ধ্যাত্ব গেয়ে উঠল রামকিরীরাগে,
“কুরু যদুনন্দন চন্দনশিশিরতরেণ করেণ পয়োধরে।
মৃগমদপত্রকমত্র মনোভবমঙ্গলকলসসহোদরে।
নিজগাদ সা যদুনন্দনে ক্রীড়তি হৃদয়ানন্দনে।।
অলিকুলগঞ্জনসঞ্জনকং রতিনায়কশায়কমোচনে।
ত্বদধরচুম্বনলম্বিতকজ্জ্বলমুজ্জ্বললয় প্রিয় লোচনে।।
নয়নকুরঙ্গতরঙ্গবিকাশনিরাসকরে শ্রুতিমণ্ডলে।
মনসিজপাশবিলাসধরে শুভবেশ নিবেশয় কুণ্ডলে।।
ভ্রমরচয়ং রচয়ন্তমুপরি রুচিরং সুচিরং মম সম্মুখে।
জিতকমলে বিমলে পরিকর্ম্ময় নর্ম্মজনকমলকং মুখে।।
মৃগমদরসবলিতং ললিতং কুরু তিলকমলিকরজনীকরে।
বিহিতকলঙ্ককলং কমলানন বিশ্রমিতশ্রমশীকরে।।
মম রুচিরে চিকুরে কুরু মানদ মানসজধ্বজচামরে।
রতিগলিতে ললিতে কুসুমখানি শিখণ্ডিশিখণ্ডকডামরে।।
সরসঘনে জঘনে মম শম্বরদারণবারণকন্দরে।
মণিরসনাবসনাভরণানি শুভাশয় বাসয় সুন্দরে।।
শ্রীজয়দেববচসি জয়দে হৃদয়ং সদয়ং কুরু মণ্ডনে।
হরিচরণস্মরণামৃতনির্ম্মিত কলিকলুষজ্বরখণ্ডনে।।”
আলোকলেখ্য—স্বয়ং
১লা নভেম্বর ২০১৮
সন্ধে ৮টা ৪৪
চূড়ান্ত ট্রান্সের পরে অবসাদ গরুড় হয়ে নামে রমণাঙ্ক লেগে থাকা দেয়ালের পাশে
দরজা খোলার পরেও প্রতীক্ষা কাজল টানে, কাস্কেট পুড়ে আসা ফাল্গুনের সোনা রক্ত হয়ে ওঠে সেই চোখে
অ-কথার ছবি। হ্যাঁ, কী বলছিলে যেন?
রাজস্থান ডায়েরিস—৩০
খালি গায়ে গলা ঘষছে হাওয়া। ঝিম। ঝিমুনি গায় পা। রেলের লাইন। সোজা। দৌড় দৌড় দৌড়। ঝপাং। ঋত্বিক সমেত গাড়ি নেমে যায় দ্বিধার অবসরে। শিঞ্জিনীর আদলে একটা মেয়ে উঁকি দেয় দেয়ালের বুক চিরে। মনে হয় সূর্য। রেললাইনের ওপর শুয়ে আছে বিষ্ণুর মতো। কামরার কাঁচে ফুটি ফুটি। জাফরি আর মিনা শেষ পর্যন্ত মিশ খায় বরফের মতো। ঝুঝুম ঝুম ঝুঝুম ঝুম। হারমোনিয়াম। অভিজিৎ বসুর মাথা দোলে ডায়নে বাঁয়ে। “মেদিনীপুরের আয়না চিরন, বাঁকুড়ার ঐ…”! আমি খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি। দিতির পায়ের শব্দ। স্নানঘর উঠে আসছে পরতে পরতে। স্নিগ্ধতার অপেক্ষা। ঝিলিক চোখ। কি বোঝে কে জানে। আমি তাকাতে চাইলেই নেমে আসে মাটিতে। খোলা গায়ে রোদ খেলা করে গুঁড়ো গুঁড়ো। গোল্ড ফ্লেকের সাঠ সোনালী ডিজেলের ইঞ্জিনের সাথে। ধোঁয়ার আকাশে আনন্দের কান্না অনাবিলতা খোঁজে।
গতি। টান। একক বাড়লে দুই বাড়ে। বাউল তাই ধীরেই চলে। দৈত্যপুরীর থাম। জন্মের নীরবতার ভার বয়। ঝগড়া। একচোট দেয়ালের মেয়ে। নিষ্পাপের পাপ ভেঙে আনে স্বর্গরাজ্য। ঘোমটা টানে অগভীর অন্ধকার। আমি দিতির নেমে আসা ঢেউয়ের অঙ্গীকার হাতে পরখ করি। অগোছালো। তাতে জলের গুছিয়ে রাখার রেশ। তবু। গোছানো অগোছালো ভাবে। এভাবেই শিকড় আসে। নাভি হয়ে ওঠে নাড়ি। চট ছট। চোখ বন্ধ। ছিটকানো কুয়াশা। দিতি ইচ্ছে করে! কপাল ঠোঁটের আদর খায়। যৌথ পরিবারের মায়ের নিজের জন্য রাখা ভাতের হাঁড়ির মতো। ওকে বলি, “যাবে না?” দিতি দূরে চেয়ে থাকে। দৈত্যপুরীর শিঙে আখেরনের সিঁদুর। ও বলে, “দেখো, পারানির নেয়ে-বৌ দোরের ওপারে বসে আছে। ঘাটে চলো না গো!”
নগ্ন দুই শরীরের ভাঁজ খোলে। গতি আসে। পায়ের ছাপ। এগিয়ে চলার আরক। দৈত্যপুরীর ছবি ছুটে আসে দেয়ালে দেয়ালে। রবির চক্রে শ্যাওলা। পিচ্ছিল। দড়ি বেয়ে ঝুল খায় ঝুল। অন্য শতাব্দীতে। ও আমায় দেখে কেন? এ বুকে কাগজ নেই আর। সই থাকে। অসংখ্য দলিল। প্রতিটা পুরুষের অথবা নারীর একটা করে হারেম থাকে। যেখানে চেতনার নিষিদ্ধ পল্লী শেষ। খামের ব্যর্থতা জুড়ে চিঠির প্রতিশ্রুতি। একদিন গলা ছোঁয় খোপ খোপ পাথরের শূন্য। গঙ্গার ঘাট। পোস্টার। পত পত। হাওয়া। পেতে বসে একদিন ছেড়ে যাওয়া একাকীত্বের স্মৃতি নিয়ে। কয়েক জন্ম খুইয়ে দিতিকে পাওয়া যায়। ছবি তাই উসুল করে প্রতীক্ষা। দামে। বিছানায়। চুলের কাঁটায়। আর জেনারেলস্ পেন্সিলের ধূপ ধূপ গন্ধে।
সর সর। সরে যাচ্ছে হাত। উচ্চতার শিহরণ নিচ্ছে কাগজ। আঙুল। এক থেকে দশে ঘুরছে চোখের সামন্ত। অন্য এক জন্মে আমি দিতি এঁকেছিলাম। ঝাড়বাতির জটিলতায় প্রদীপ ম্লান হয় না কখনও। নীচের দিকে নেমে আসি দুজনে। অহং কুকুরের মতো লেজ নাড়ে। বেল পাতায় চুঁইয়ে নামে মেঘফোঁড়ানি সোনা। সূর্যের চোখের নিচে গড়িয়ে যাওয়ার দাগ। অনেক দিন। দিতি কাচেনি সূর্যটাকে। মশারির দড়ি। জুল জুল চোখ। একটা উচ্চিড়িঙ্গে। বিছানা বিছানো রাস্তা। সাদা ধবধবে দৈত্যপুরীর দৈত্যশূন্যতা দিতি আর আমার শরীরে চাদরের মতো লেগে থাকে। আমার চোখের প্রকোষ্ঠে একটা আড়াই ইঞ্চি ফ্রেম। গর্ভে সোওয়া ইঞ্চি বর্ডারের একটা ফুলদানি। সাদাকালো ফুল আর দিতির ছবি মেখে আরাম করে খাচ্ছে একটা বাদুড়। ঝুপ ঝুপ ডানা। তাকাচ্ছে আমাদের দিকে মাঝে মাঝে। বাইরে বেরোনোর পথ খুঁজছি আমরা। এ সেই বাইরে। যে পথ দিয়ে জন্ম নিচ্ছে জন্মান্তর আমি, দিতি, ছবি। যুগে যুগে। তালে তালে। কষ্টের ওপর কষ্টের প্রলেপে। অবদমনের শুক্রানুতে…
আলোকলেখ্য—স্বয়ং
৩ নভেম্বর ২০১৮
রাত ১১টা ৪৩
জানলাবাদুড় সব পায়রা হয়ে এল। কিছু ফাঁকের ওপর প্রান্তে কানাগলির অন্ধকার
গরুর চোখের মতো যে নদীর ডাকঘর গুরুপত্নীর খামে মেশে, তাতে ছিন্নশাড়িটুক এক বিচত্র আভরণ!!!
ফিরতি গেঁথে পাথুরে স্বাদ সবটুকু গান নিয়ে গেছে
জয়দেব
Posted in: October 2020 - Serial, PROSE