মহাকাশ, মহাবিশ্ব : শংকর লাহিড়ী

শংকর লাহিড়ী [বিস্ময় আর খোঁজ মানুষের এই দুটো গুণই ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে মানব সভ্যতার। নিজের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ও তারই মাঝে নিজের আপাত অবস্থানকে চিনে নিতে চেয়েছে সে চিরকাল। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পেরেছি আমাদের পৃথিবীকে, তারপর পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ, মহাবিশ্ব। কত অজানা খবর, কত আবিষ্কার ঘটে চলেছে দিনের পর দিন। সেই সমস্ত কথা নিয়েই এবার কলম ধরলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, চিত্র-পরিচালক ও প্রকৌশলী শংকর লাহিড়ী। কসমোলজি নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ও জ্ঞানের কথা অনেকেই জানেন। যে দক্ষ শৈল্পিক ভঙ্গিতে তিনি এই সমস্ত জটিল তত্ত্ব ও আবিষ্কারের কথা লেখেন তার সাথে ইতিমধ্যেই অনেক পাঠক পরিচিত। শুরু হলো অপরজনের নতুন ধারাবাহিক বিভাগ – “মহাকাশ মহাবিশ্ব”।]

পাখিদের দেবীর ওড়নায় অশ্রুজল:

আশির দশকে কবিতাভাবনা নিয়ে একটা গদ্য লিখেছিলাম, যার নাম ছিল ‘দা অরিজিন অফ দা মিল্কিওয়ে’। সেই মুক্ত গদ্যে উল্লেখ ছিল ইটালিয়ান চিত্রকর টিন্টেরেট্টোর আঁকা একই নামের এক অপূর্ব সুন্দর ছবির কথা, যাতে আছে আকাশ-শয্যায় দেবতা জুপিটারের স্ত্রী দেবী জুনোর স্তন্যপান করছিল শিশু হারকিউলিস। শিশুটির অবৈধ পরিচয় জানতে পেরে তাকে বুক থেকে সরিয়ে দিলে, দেবীর উন্মুক্ত স্তন থেকে ফোয়ারার মতো দুধের অবিরাম প্রবাহ রূপান্তরিত হ’য়ে সৃষ্টি হয়েছিল নক্ষত্রখচিত ছায়াপথ। সেই থেকে তার নাম হয়েছে মিল্কিওয়ে। আর হিন্দু পুরাণে আছে, মহাদেব জটা থেকে গঙ্গাকে মুক্ত করে পৃথিবীতে নামিয়ে দিয়েছিলেন ; আকাশ জুড়ে বুঝি সেই প্রবাহকেই দেখা যায়, যাকে আমরা বলেছি আকাশগঙ্গা। এবং এই বুঝি সেই ক্ষীরসমুদ্র বা দুধের সাগরও, যেখানে শেষনাগের ওপরে ভগবান বিষ্ণু লক্ষ্মীদেবীকে সঙ্গে নিয়ে বিরাজ করছেন।

একই নীহারিকামন্ডলীর এইভাবে অনেক নামও। ছায়াপথ, আকাশগঙ্গা, বা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। আমাদের সূর্য এবং আরও প্রায় তিরিশ-চল্লিশ হাজার কোটি নক্ষত্রের এই বাসভূমি। একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দূরত্ব এক লক্ষ পাঁচ হাজার আলোকবর্ষ! গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে ২৬,০০০ আলোকবর্ষ দূরে, স্পাইরালের একটি বাহুর (Orion arm) কিনারে আমাদের সৌর মণ্ডলের অবস্থান।
পৃথিবীর বহু দেশে, পুরাণে, উপকথায়, নানা নাম ও বর্ণনা আছে এই গ্যালাক্সির। মিশরীয় এবং আইরিশ উপকথায় আছে এক স্বর্গীয় গাভীর কথা, যার অমল দুধের প্রবাহ থেকেই জন্ম নিয়েছে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। হাঙ্গেরি দেশের লোককথায় আছে, হুণদের প্রবল পরাক্রমী সম্রাট আটিলা যখন আকাশপথে যুদ্ধজয়ে বেরিয়েছিলেন, তখন তাঁর ঘোড়ার খুরের স্ফুলিঙ্গ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে নক্ষত্রখচিত ছায়াপথ।
তবে সম্পূর্ণ অন্যরকমের গল্প আছে অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা আর এস্টোনিয়ায়। কুইন্সল্যান্ডের আদিবাসীরা মনে করেন, তাদের প্রাচীনকালের বীরযোদ্ধা বারবাক বান (Burbak Bun) বুঝি দেশ থেকে টারমাইট বা উইপোকাদের তাড়িয়ে দিলে তারা আকাশে আশ্রয় নিয়ে ওই উজ্জ্বল পথ তৈরী করেছে। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার লোককথায় আছে যে, তাদের বীর নর্তক যিনি আসলে আকাশের উজ্জ্বল লাল নক্ষত্র ‘আন্টারেস’ (star Antares in Scorpius), তিনি একবার শিকারে বেড়িয়েছিলেন। তখন জঙ্গলের বাদুড়ের বাসায় নাড়া পড়লে হাজার হাজার বাদুড় ক্রোধে তাঁকে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যায়। মহাকাশের ছায়াপথ আসলে সেই বাদুড়ের ঝাঁক, যার মধ্যে নৃত্যরত সেই বীর, যা আসলে উজ্জ্বল লাল ‘আন্টারেস’ নক্ষত্র। এই গল্প নিয়ে ছবি এঁকেছেন অস্ট্রেলিয়ান চিত্রকর Ainslie Roberts (1965), নীচে সেই ছবি।

আফ্রিকার কালাহারি মরুভূমির উপজাতিদের মধ্যে লোককথা আছে যে, প্রাচীনকালে এক দৈবী বালিকা রাতের ঘোর অন্ধকারে বন্ধুর বাড়ি যাবার পথ খুঁজে না পেয়ে, উনুন থেকে জ্বলন্ত আগুনের টুকরো আকাশে ছুঁড়তে থাকলে তৈরী হয় এই ছায়াপথ। এরকমই এস্টোনিয়ার রূপকথায় আছে, আকাশের অধীশ্বর উক্কু-র কথা। উক্কুর কন্যা লিন্দু ছিলেন পাখিদের দেবী। সাদা পাখির ঝাঁক আকাশজুড়ে উড়ে বেড়াত, আর শিকারী পাখিদের আকাশ থেকে তাড়িয়ে লিন্দু তাদের রক্ষা করতেন। এই লিন্দু একদিন প্রেমে পড়লেন। সূর্য বা পৃথিবী, এমনকি ধ্রুবতারাও নয়, লিন্দু প্রেমে পড়লেন উত্তর আকাশের আলোর। সেই আলোর সাথে আকাশের রাজা উক্কু তাঁর মেয়ের বিবাহের কথা দিলেন। কিন্তু কিছুকাল পরে উত্তরের সেই বাহারি আলোর চঞ্চল মতিগতি দেখে মন ভেঙে গেল কন্যার। তার বধুবেশে ওড়নার ওপরে ঝরে পড়লো তারই চোখের জল। এই অশ্রুভেজা ওড়না সমেত মেয়েকে যখন মহাকাশের স্বর্গে নিয়ে এলেন তার পিতা, তখন এই ওড়নাই হয়ে উঠলো আকাশজোড়া ছায়াপথ। পাখিরা সেই থেকে তাদের দেবীর ওই ওড়না দেখেই রাতের আকাশ পারাপার করে। আজকের জ্যোতির্বিদরাও লক্ষ্য করেছেন যে, অনেক পরিযায়ী পাখির ঝাঁক পৃথিবীর উত্তর থেকে দক্ষিণের দীর্ঘ উড়ানপথে দিকনির্ণয় করে ওই মিল্কিওয়েকে অনুসরণ করেই।

জগতপারাবারের তীরে এই ছায়াপথেই আমাদের বাস। এইখানেই আমাদের ভুবনডাঙ্গার মাঠ, গমের খেত, সকল ঘাগরা-চোলি, বল্লম ও বেহালা, বিড়ি ও ব্যান্ডেজ! আমাদের ঝরাপাতা আর ঘাই-হরিণীরা। (নীচে, ১৫৭৫ সালে টিন্টেরোট্টোর আঁকা ‘দা অরিজিন অফ দা মিল্কিওয়ে’ ছবি)।

এই ছায়াপথের কেন্দ্রবিন্দুকে প্রদক্ষিণ করছে আমাদের সৌরজগত, কুড়ি কোটি বছরে একবার, ঘণ্টায় পাঁচ লক্ষ মাইল বেগে! সৌরজগতের কেন্দ্রে আছে সূর্য, তাকে ঘিরে আছে প্রধানতঃ আটটি গ্রহ, আর কয়েক কোটি গ্রহাণু, ধুমকেতু ইত্যাদি, যারা প্রধানতঃ আছে সৌরমন্ডলের শেষপ্রান্তে কাইপার বেল্ট-এ। এদের সবাইকে ঘিরে রেখেছে উর্ট (অথবা ওর্ট) ক্লাউড নামে একটা হিমশীতল বরফের গোলক। সূর্য থেকে আনুমানিক ৭৫ হাজার কোটি কিলোমিটার দূরে শুরু হয়ে, ১৫ লক্ষ কোটি কিলোমিটার দূরে গিয়ে শেষ হয়েছে এই গোলকের বহির্ভাগ। তারপরে শুরু হচ্ছে অন্য নক্ষত্রজগত, যেখানে সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাব আর নেই। এসব আমরা আগের পর্বগুলোয় আলোচনা করেছি।

আগেই বলেছিলাম, আমরা যারা পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের বাসিন্দা, রাতের আকাশে আমরা ছায়াপথের যেটুকু দেখতে পাই, তার চেয়ে অনেকটাই বেশি সুন্দর ও সম্পূর্ণ দেখা যায় দক্ষিণ গোলার্ধ, (যেমন অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ড) থেকে। এমনটা কেন হয়, তা বোঝা যাবে নীচের ছবিটা (Credit: R Smethurst) দেখলে, যেভাবে আমি ছবিটার মধ্যে বাংলায় লিখে দিয়েছি।

এবারে ফিরে আসি আমাদের সৌরমন্ডলে, যেখানে সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরে চলেছে উপবৃত্তাকার পথে, একটি সমতলে। এই সমতলটিকেই বলা হয় ‘এক্লিপ্টিক প্লেন’। অন্য গ্রহরাও কমবেশি এই তলের ওপরে থেকেই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু তাদের উপগ্রহরা তেমন নয়। যেমন আমাদের চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে যে তলে, সেটা এক্লিপ্টিক তলের সাথে ৫-ডিগ্রি কোণে রয়েছে। যদি তারা উভয়ে একই তলে থাকতো, তবে অনেক বেশি অমাবস্যা এবং পূর্ণিমায় সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ সম্ভব হত। তাহলে নিত্যনৈমিত্তিক গ্রহণ নিয়ে বিশেষ কোনও রোমাঞ্চই হয়তো থাকতো না মানুষের কাছে। অনেক পূর্ণিমাতেই আর জ্যোৎস্নায় ভেসে যেত না জগতসংসার। জ্যোৎস্নার বদলে, গ্রহণ হত। নীচের ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে। চাঁদের কক্ষতল যেখানে পৃথিবীর কক্ষতলকে ছেদ করেছে, সেই অবস্থানে চাঁদ, পৃথিবী এবং সূর্য একই সরল রেখায় এলে গ্রহণের পরিস্থিতি তৈরি হয়।

ওপরের ছবিতে বাঁদিকে ও ডানদিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, চাঁদ-পৃথিবী-সূর্য মুখোমুখি রইলেও, ঠিক এক সরলরেখায় তারা নেই। চাঁদ রয়েছে কখনও একটু ওপরে, অথবা নীচে। সেই অবস্থানে গ্রহণ সম্ভব নয়, তাই তাকে ‘আনফেভারেবল’ বলা হয়েছে। কারণ ওই অবস্থানে পূর্ণিমারাতে পৃথিবীর ছায়া এসে চাঁদের গায়ে পড়ছে না, তাই চন্দ্রগ্রহণ হতে পারছে না। সেরকমই, অমাবস্যার দিনে সূর্যকে আড়াল করলেও চাঁদের ছায়া এসে পৃথিবীকে ছুঁতে পারছে না বলে, হচ্ছে না সূর্যগ্রহণও।

কিন্তু যখন অমাবস্যায় সূর্যগ্রহণ হয়, সেই ফেভারেবল অবস্থানে চাঁদ ও পৃথিবী কোথায় থাকে এবং কিভাবে হয় খন্ডগ্রাস, পূর্ণগ্রাস ও বলয়গ্রাস গ্রহণ, তা বোঝা যাবে নীচের দুটি ছবিতে।

ছবিতে দেখা যাবে, পৃথিবীর ওপরে দিনের বেলায় সূর্যালোককে আড়াল করে চাঁদের ছায়া নেমে এসেছে, বৃত্তাকারে। সেই বৃত্তের কেন্দ্রে ঘন অন্ধকার যায়গাটিকে বলে প্রচ্ছায়া (Umbra), আর তার বাইরের লঘু অন্ধকার জায়গাকে বলে উপচ্ছায়া (Penumbra)। যখন সূর্য, চাঁদ ও পৃথিবী একই সরলরেখায় এসে দাঁড়ায়, তখন পৃথিবীর ওপরে ওই ঘন অন্ধকার প্রচ্ছায়া অংশ থেকে দেখা যায় সূর্যের পূর্ণগ্রাস গ্রহণ, আর উপচ্ছায়ার লঘু অন্ধকার থেকে দেখা যায় খন্ডগ্রাস, যেমন নীচের ছবিতে বোঝানো হয়েছে।

আর যখন পূর্ণিমা রাতে চন্দ্রগ্রহণ হয়, সেই ‘ফেভারেবল’ অবস্থানে চাঁদ ও পৃথিবী কোথায় থাকে, এবং কিভাবে হয় চাঁদের খন্ডগ্রাস ও পূর্ণগ্রাস গ্রহণ, তা বোঝা যাবে নীচের দুটি ছবিতে।

পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ স্থায়ী হয় মাত্র ছয়-সাত মিনিট। তার চেয়ে চন্দ্রগ্রহণের স্থায়িত্ব হয় অনেক বেশি সময় ধরে, প্রায় দুই ঘন্টা। কারণ চাঁদের তুলনায় পৃথিবীর আকার অনেক বড় বলে, পৃথিবীর ছায়া থেকে চাঁদের বেরিয়ে আসতে অনেকটা সময় লেগে যায়। এছাড়া, পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণে যেমন সূর্য সম্পূর্ণ ঢেকে যায়, কালো বৃত্তের বাইরে দেখা যায় শুধু তার করোনার ছটা, অন্ধকার হয়ে আসে দিনের আলো, তেমনটা কিন্তু পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের সময় হয় না। পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের সময় সূর্যকে আড়াল করে চাঁদের সামনে পৃথিবী এসে দাঁড়ালেও, পৃথিবীর বায়ুমন্ডল দিয়ে সূর্যালোক বিচ্ছুরিত হয়ে তার সাতরঙের মধ্য থেকে লাল রশ্মিটুকু চাঁদের গায়ে এসে পড়ে। পূর্ণিমারাতে পূর্ণগ্রাস চাঁদকে তাই লাল দেখায়, যেমন দেখা যাচ্ছে নীচের ছবিতে।

এবার মনোযোগ দিয়ে দেখা যাক, সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর কক্ষপথে পৃথিবী কেমন একদিকে হেলে থেকে ঘুরছে। কক্ষপথের সমতল বা এক্লিপ্টিক প্লেন থেকে এই টিল্ট, বা হেলে থাকার পরিমাপ হল প্রায় ২৩.৫ ডিগ্রি। এই হেলে থাকার জন্যেই পৃথিবীতে ঋতু পরিবর্তন হয়। আসে গ্রীষ্ম শরৎ শীত বসন্ত। আসে বর্ষণের কাল। আর পৃথিবীর ঘূর্ণনবেগ এবং টিল্টের জন্য তৈরি হয় নানা ধরণের প্রবাহ, সমুদ্রস্রোত। পৃথিবীর নিজের অক্ষ যেমন হেলে আছে, তেমনই সূর্যের অক্ষটাও হেলে আছে প্রায় ৭-ডিগ্রি (নীচে ছবিতে)।

মহাকাশে ছড়িয়ে আছে যে বিপুল নক্ষত্রজগত, সেই জগতের একেক অংশকে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ নানারকম কল্পিত নকশার আকারে চিনতে শিখেছে। কোথাও একদল নক্ষত্র মিলে মনে হয়েছে যেন এক শিকারী, অথবা তারা যেন কোনও জলজ জীব, অথবা যেন বন্যপ্রাণীর মতো কোনও আকৃতি। আকাশের নক্ষত্রমন্ডল বা কনস্টেলেশানদের নামকরণ হয়েছে সেভাবেই। একই মন্ডলির মধ্যে যে নক্ষত্ররা রয়েছে, তাদের কেউ আছে অনেক কাছে, হয়তো মাত্র দশ আলোকবর্ষ দূরে, আর কেউ হয়তো রয়েছে কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে। কিন্তু ঊর্ধাকাশে তাকিয়ে মনে হচ্ছে তারা বুঝি সবাই পাশাপাশি, একই দূরত্বে।

এইভাবে আকাশের চারপাশে তাকালে দেখা যায়, একে একে অবস্থান করছে এক এক মন্ডলি, যাদের নিয়ে গড়ে উঠেছে রাশিচক্র। মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ আর মীন রাশিরা। পৃথিবী থেকে আকাশে তাকালে এইসব রাশি প্রতিদিনই নির্দিষ্ট অবস্থানে থাকে। কিন্তু সূর্যের চারদিকে আমরা পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে যখন সূর্যের অবস্থানকে লক্ষ্য করি, তখন দেখি সূর্যের অবস্থান ক্রমে এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে সরে যাচ্ছে । এভাবেই রাশিচক্রে অবস্থান পাল্টাচ্ছে মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি গ্রহরাও।

নীচের ছবির কেন্দ্রে রয়েছে সূর্য। তাকে আপন কক্ষপথে ঘুরে ঘুরে প্রদক্ষিণ করছে আমাদের পৃথিবী। নীল রঙে আঁকা এই কক্ষপথে সারা বছর ধরে পৃথিবীর অবস্থানকে মাস ও তারিখ দিয়ে চিহ্নিত করা আছে। যেকোনও অবস্থান থেকে সূর্যের দিকে তাকালে দেখা যাবে সূর্য তখন কোন রাশিতে রয়েছে। বাইরের বড় বৃত্তটিতে নজর দিলে বোঝা যাবে সূর্যের অবস্থান, এবং তার সাথেই আকাশে বারোটি রাশি নিয়ে গঠিত যে রাশিচক্র।

নক্ষত্রমন্ডল ও রাশিচক্র ছেড়ে, এবার নজর দেওয়া যাক আমাদের নিজেদের বাসভূমি এই পৃথিবীর দিকে। পৃথিবী নামক গোলকটার গায়ে যেকোনও যায়গার স্থানাংক নির্দিষ্ট করা হয় সেই জায়গার অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ দিয়ে। এর জন্যে আঁকা হয়েছে কল্পিত কিছু রেখা, যেমন অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমা রেখা। পৃথিবীকে যদি ঠিক মাঝখান দিয়ে আড়াআড়ি একটা বৃত্তাকার রেখা টেনে সমান দুভাগে ভাগ করা যায়, তবে তার উত্তরদিকের অংশকে বলা হয় উত্তরগোলার্ধ, এবং দক্ষিণদিকের অংশটি দক্ষিণ গোলার্ধ। আর ওই আড়াআড়ি বৃত্তাকার রেখাটির নাম বিষূবরেখা, বা সেলেশ্চিয়াল ইকোয়েটর (Celestial Equator)। একে মোট ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করা হয়েছে। এর শূন্য ডিগ্রি শুরু হয়েছে ইংল্যান্ডের গ্রিনউইচে, যেখান থেকে পূর্বদিকে ১৮০ ডিগ্রি এবং পশ্চিমে আরও ১৮০ ডিগ্রি ভাগ করা হয়। এই বিন্দুগুলো দিয়ে পৃথিবীর উত্তরমেরু থেকে দক্ষিণমেরু অবধি ওপর-নীচে দাগটানা যে কাল্পনিক রেখারা, তাদের বলা হয় দ্রাঘিমা রেখা, বা দ্রাঘিমাংশ (longitude)। পৃথিবী একঘন্টায় ১৫ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশ ঘুরে যায়। এইভাবে ২৪ ঘন্টায় মোট ৩৬০ ডিগ্রি, অর্থাৎ সম্পূর্ণ হয় পৃথিবীর আবর্তন, যাকে আমরা এক দিন বলি।

এই যে গ্রীনউইচ দিয়ে শূন্য ডিগ্রি দ্রাঘিমারেখা গিয়েছে, একেই বলা হয় ‘প্রাইম মেরিডিয়ান’ বা মূল দ্রাঘিমারেখা। খ্রিস্টপূর্ব দুশো বছরে প্রথম নাকি মেরিডিয়ানের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। কিন্তু ক্রমে বিভিন্ন দেশ নিজেদের সুবিধেমতো এক একটা জায়গাকে মেরিডিয়ান ঘোষণা করায় ব্যবহারিক জীবনে খুবই অসুবিধেয় পড়তে হয় সবাইকে। শেষে, ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে, আন্তর্জাতিক মেরিডিয়ান কনফারেন্স ডেকে, ভার্নাল ইকুইনক্সকে মনে রেখে, সবাই মিলে গ্রীনউইচকেই শূন্য দ্রাঘিমা, বা প্রাইম মেরিডিয়ান ঘোষণা করা হয়। সেই প্রথাই আজ সর্বত্র চলছে।

আর বিষুবরেখা বা ইকোয়েটরের সমান্তরাল যে বৃত্তাকার রেখাগুলো, তাদের বলা হয় অক্ষাংশ (latitude)। এরা উত্তরমেরু থেকে দক্ষিণমেরু অব্দি ভূপৃষ্ঠকে ডিগ্রির মাপে সূচিত করে। বিষুবরেখার নিজের অক্ষাংশ শূন্য। এখান থেকেই শুরু হয় উত্তরমুখী এবং দক্ষিণমুখী ডিগ্রি গণনা। উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু অব্দি মোট ১৮০ ডিগ্রি।
এইভাবে অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশ উল্লেখ করে পৃথিবীর যেকোনও স্থানকেই চিহ্নিত করা যায়। এই দিয়েই তৈরি হয়েছে জিপিএস, বা গ্লোবাল পোজিশানিং সিস্টেমও। তবে মহাদেশব্যাপী স্থলভূমির নড়াচড়া, বা প্লেট টেকটনিকের জন্য এর হিসেবের সাথেও যুক্ত হয় আরও কিছু জটিল গণনা। তবে সেই নিয়ে আলোচনা এখানে নিস্প্রয়োজন। জিপিএস-এর হিসেবে, কলকাতার (ময়দান এলাকার) স্থানাংক হচ্ছে 22˚34’21.5220”N, 88˚21’50.0112”E.

কিন্তু ভূপৃষ্ঠ ছেড়ে ঊর্ধাকাশে নক্ষত্রলোকে কিভাবে স্থানাংক বোঝানো যাবে? কিভাবে চিহ্নিত করা হবে মহাকাশে একটা নক্ষত্রের অবস্থানকে? এর জন্যে পৃথিবীর চারপাশের আকাশকেও একটা গোলক ধরে নেওয়া যায়, যার কেন্দ্রে আছে পৃথিবী, আর ওই আকাশ-গোলকের গায়ে যেন খচিত আছে সমস্ত নক্ষত্রমালা। এইবার একটা জটিলতার মুখোমুখি হতেই হবে আমাদের। মনে রাখতে হবে কয়েকটা সমতল ও তাদের সম্পর্ককে।
১। এক্লিপ্টিক প্লেন। এই সমতলেই পৃথিবী তার কক্ষপথে সূর্যের চারপাশে ঘুরে চলেছে। অন্যান্য গ্রহরাও রয়েছে মোটামুটি এই তলেই।
২। পৃথিবীর গোলকের মাঝামাঝি যে বৃত্তাকার বিষুবরেখা, বা সেলেশ্চিয়াল ইকোয়েটর, তার তল। একে আয়তনে বহুগুণ বিবর্ধিত করে নেওয়া যায় কল্পনায়।
৩। গ্যালাক্টিক প্লেন। এটা আমাদের ছায়াপথ বা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ডিস্ক, বা সমতল, যার ওপরে অবস্থান করছে কয়েক হাজার কোটি নক্ষত্র। যদি এই তলের ওপরে, ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে একটা উল্লম্ব রেখা দাঁড় করানো যায়, তবে সেটাই সূচিত করবে গ্যালাক্টিক পোল, অর্থাৎ তার কল্পিত উত্তর ও দক্ষিণ মেরুকে।

এই তিনটে তল– গ্যালাক্টিক প্লেন, এক্লিপ্টিক প্লেন এবং পৃথিবীর বিষুবরেখা বা, সেলেশ্চিয়াল ইকোয়েটর পরস্পরের থেকে বিভিন্ন কোণে হেলে রয়েছে।

নিজের কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর এই সাড়ে তেইশ ডিগ্রি কোণে হেলে থাকার জন্য যখন উত্তর গোলার্ধে সরাসরি সূর্যালোক এসে পড়ে তখন সেখানে গ্রীষ্মকাল হয়। ঠিক তখনই দক্ষিণ গোলার্ধে হয় শীতকাল। আবার এর উল্টোটা হয়, যখন পৃথিবী তার কক্ষপথের বিপরীত প্রান্তে পৌঁছে যায়। তখন উত্তর গোলার্ধে শীতকাল, আর্কটিক অঞ্চলে তখন দীর্ঘ রাত। আর দক্ষিণ গোলার্ধে তখন গ্রীষ্ম, অ্যান্টার্ক্টিকাতে তখন দীর্ঘ হয় দিন। নীচের ছবিতে বোঝা যাবে সেই অবস্থান দুটো। আর মার্চমাসের ২১ এবং সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখে সূর্যের দিকে যখন পৃথিবী হেলে পড়ছে না, যখন সূর্য ও পৃথিবীর অক্ষরেখাদুটি পরস্পর সমান্তরাল, তাকে বলা হয় যথাক্রমে, ভার্নাল ইকুইনক্স এবং অটাম ইকুইনক্স। এই দুইদিন পৃথিবীতে দিন ও রাত্রির সময়কাল সমান।

এই দুই ইকুইনক্স বিন্দুতে, বছরে দুইদিন সূর্যকে স্পর্শ করে পৃথিবীর বিষুবরেখা বা সেলেশ্চিয়াল ইকোয়েটর। ২১শে মার্চের শুভদিন, যাকে বলা হয় ‘ভার্নাল ইকুইনক্স’, এখান থেকেই শুরু হয়েছে পৃথিবীর শূন্য দ্রাঘিমাংশ, যা গ্রীনউইচের মধ্য দিয়ে গেছে। মহাকাশের কোনও নক্ষত্রের অবস্থানকে শূন্য দ্রাঘিমা থেকে শুরু করে বিষুবরেখার ওপরে পূর্বদিকে কত ঘন্টা দূরে (এক ঘন্টা, মানে ১৫ ডিগ্রি) এবং বিষুবরেখা থেকে কত ডিগ্রি ওপরে রয়েছে, তাই দিয়ে নক্ষত্রের স্থানাংক নির্ণয় করা হয়। এই দুই পরিমাপকে বলা হয়, যথাক্রমে, Right Ascension এবং Declination (নীচে ছবিতে)। প্রথমটির মাপ ঘন্টা-মিনিটে, আর দ্বিতীয়টির মাপ ডিগ্রীতে।

নীচের ছবিতে, ডানদিকে দেখা যাচ্ছে উত্তর গোলার্ধে শীতকাল নেমে এসেছে। মেরু অঞ্চলে যখন প্রায় সারাক্ষণই রাত। তখন ডিসেম্বর মাস। আর ছবির বাঁদিকে, জুনমাসে, পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ যখন সূর্যের দিকে ২৩.৫ ডিগ্রি হেলে পড়েছে, সেখানে তখন গ্রীষ্মকাল, দারুণ গরম।

পৃথিবীর নিজের গোলকের গায়ে তিনটে বৃত্তাকার রেখা আছে ; তাদের মধ্যে ঠিক মাঝখানে আছে বিষুবরেখা। সেখান থেকে ২৩ ডিগ্রি ২৭ মিনিট উত্তরে আছে কর্কটক্রান্তি রেখা (Tropic of Cancer), আর ততটাই দক্ষিণে আছে মকরক্রান্তি রেখা (Tropic of Capricorn)।

পৃথিবীর দুই গোলার্ধে, এই দুই রেখার (কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি) ঠিক মাথার ওপরের আকাশে সূর্য বছরের একটা দিনে এসে পৌঁছয়। কিন্তু এই রেখা পেরিয়ে আরও উত্তরে, অথবা আরও দক্ষিণে গেলে, কখনও আর সূর্যকে মাঝআকাশে দেখতে পাওয়া যায় না। উত্তর গোলার্ধে যখন গ্রীষ্মকাল, তখন ২১ জুন দুপুরে সূর্যকে এই কর্কটক্রান্তি রেখার মাথার ওপরে দেখা যায়। তখন দিন সবচেয়ে বড়, আর রাত সবচেয়ে ছোট। এই দিনটাকে বলা হয় Summer Solstice (দক্ষিণ গোলার্ধে তখন উইন্টার সলস্টিস)। আর ২১ ডিসেম্বর মকরক্রান্তি রেখার ঠিক ওপরে যখন সরে আসে সূর্য, উত্তরে সেদিন Winter Solstice ; রাত সবচেয়ে বড়, আর দিন সবচেয়ে ছোট। (দক্ষিণ গোলার্ধে সেদিন সামার সলস্টিস)।

যেসব দেশের ওপর দিয়ে এই তিনটে রেখা গিয়েছে, তাদের কয়েকটাকে মনে রাখা যাক :

কর্কটক্রান্তি রেখা : আলজেরিয়া, নাইজার, লিবিয়া, ইজিপ্ট, সৌদি আরব, আবু ধাবি, ওমান, ভারতবর্ষ।
ভারতের অঞ্চলগুলোর মধ্যে আছে, ঝাড়খন্ডের লোহারডাগা, আর পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর। এছাড়াও আছে গুজরাট, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ত্রিপুরা ও মিজোরাম।

মকরক্রান্তি রেখা : আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, বোতসোয়ানা, ব্রাজিল, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, প্যারাগুয়ে।

বিষূবরেখা : কলম্বিয়া, ব্রাজিল, ইকুয়েডর, গ্যাবন, কঙ্গো, উগান্ডা, কেনিয়া, সোমালিয়া, মালডিভস, ইন্দোনেশিয়া।
মাঝসমুদ্রে জাহাজ যখন এই বিষুবরেখাকে পার করে যায়, তখন একটা ভারী হইচই উৎসব পালন করা হয় জাহাজে। এটা চলে আসছে কয়েকশো বছর ধরে, দেশে দেশে। বাণিজ্যিক জাহাজ বা যাত্রীবাহী ভেসেলেও এই উৎসব হয়। তবে সবচেয়ে বেশি হইচই হয় সামরিক জাহাজে। সেখানে তরুণ নৌসেনা, যারা জীবনে এই প্রথম বিষুবরেখা পার হচ্ছে তাদের জন্য (প্রায় র‍্যাগিং-এর মতো, তবে সবটাই মজার) অনুষ্ঠিত হয় ‘লাইন-ক্রসিং সেরিমনি’। প্রত্যেক নাবিক আজীবন মনে রাখে তার প্রথমবার বিষুবরেখা পেরোবার অনুষ্ঠান। যারা অভিজ্ঞ জাহাজী, অনেকবার বিষুবরেখা পেরিয়েছে, তাদের বলা হয় ‘Shellback’। আর যারা আনকোরা তরুণ, এই প্রথম ‘লাইন ক্রস’ করবে, তাদের বলা হয় ব্যাঙাচি বা, Tadpole অথবা Pollywog।
অভিজ্ঞদের মধ্য থেকে দুজন সাজে সমুদ্রদেবতা নেপচুন ও তার স্ত্রী। নেপচুনের হাতে বিশাল ত্রিশূল, মাথায় জরির মুকুট, মুখে স্যান্টা ক্লজের মতো একরাশ সাদা দাড়ি। এই নেপচুনকে নেচে গেয়ে খুশি করতে হবে, তবেই পাওয়া যাবে তুফানি সমুদ্রে সুরক্ষার আশ্বাস। নব্য ব্যাঙাচিদের জাহাজের ডেকের ওপরে এক লাইনে বসিয়ে, তাদের মজা করে নানা ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়। ডাক্তার এসে গম্ভীরভাবে টিপেটুপে দেখে বলেন, এরা তো অপুষ্টিতে ভুগছে, এদের একবাটি পাঁচন খাওয়াতে হবে। সেই পাঁচন তৈরি হয় বীয়ার, কাঁচা ডিম আর লংকার গুঁড়ো ইত্যাদি মিশিয়ে। সেইটা খাওয়ানোর পরে, এদের, মানে যারা জীবনে প্রথম বিষুব রেখা ক্রস করবে, তাদের মাথার চুল এলোমেলো করে কাঁচি চালিয়ে কেটে, তাতে কাঁচা ডিম ফাটিয়ে আর গায়ে লাল নীল রঙ মাখিয়ে দেওয়া হয়। এবার এরা একসাথে মার্চ করে গিয়ে, ডেকের ওপর যে নোঙর রাখা আছে তার ওপরে, এক আছাড়ে নারকেল ভাঙার মতো করে, একটা করে বীয়ারের ক্যান ফাটাবে। তারপরে এদের স্নান করানো হবে হোস পাইপের জলে। নীচে ছবিতে, একটি যাত্রীবাহী জাহাজে বিষুব রেখা পার হওয়ার সময় ‘ক্রসিং দা লাইন’ অনুষ্ঠান। একদিন আগে থেকেই সারা জাহাজে রীতিমত ঘোষণা করে শুভ সময়ের অনুষ্ঠানসূচী জানিয়ে দেওয়া হয় সবাইকে।

নীচের ছবিতে, একটা সামরিক জাহাজের বিষুবরেখা পার হওয়ার সময়ে, তরুণ ট্যাডপোলদের নিয়ে ডেকের ওপরে নৌকো চালানো অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন জলদেবতা নেপচুনের এক প্রতিনিধি। পাঁচন খাইয়ে, হোস পাইপের জলে স্নান করানো হবে এবার।

বিষুবরেখা অতিক্রম করা হয়ে গেলে, সেদিন রাত্রে সবাই মিলে হইচই করে স্পেশাল ডিনার খাওয়া হবে। দেবতা নেপচুন ট্যাডপোলদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে জাহাজের পক্ষ থেকে তাদের সবাইকে ‘ক্রসড দা লাইন’ শংসাপত্র দেবেন (নীচে ছবি)। এবং তখন থেকে ওই ব্যাঙাচিদের পরিচয় হবে ‘Shellback’, অর্থাৎ তারা বিষুবরেখা-পার-করা মান্যগণ্য নাবিক। শংসাপত্রে আছে দেবতা নেপচুনের অফিসিয়াল সীল—Domain Of Neptunus Rex.

খুব সুদৃশ্য সেই শংসাপত্রে সমুদ্রদেবতা নেপচুন তাঁর দরবারের স্থানাংক (শুধুই দ্রাঘিমাংশ, কারণ বিষুবরেখার অক্ষাংশ তো শূন্য ডিগ্রি হবেই) নথীভুক্ত করে সবাইকে উদ্দেশ্য করে লেখেন যে, বিশ্বের ও দরিয়ার সমস্ত ট্যাডপোল, পর্যটক, অভিযাত্রী, নাবিক, জলদস্যু, জলপরী, মারমেড, সামুদ্রিক প্রাণী, তিমিমাছ, ডলফিন, হাঙর, ধাড়ি কাঁকড়া, সরীসৃপ ও অক্টোপাস, সবাইকে এতদ্বারা চেতাবনী দেওয়া হচ্ছে যে, বিষুবরেখা পার করা এই নাবিককে আজ থেকে আমরা শেলব্যাক বলে গণ্য করছি, তাই কেউ যেন একে কখনও কামড়ায় না, খায় না, এর কোনও রকম ক্ষতি করার সাহস না করে, এবং যেন যথাযথ সম্বোধন করে সম্মান জানায়।

বিষুবরেখা পার হওয়ার এমন অনুষ্ঠানের কথা আমি প্রথম জানতে পেরেছিলাম, আফ্রিকায় এক জাহাজির ডায়েরী থেকে। সে লিখেছিল, কঙ্গো নদীর ওপরে ভেসেলে যেতে যেতে বিষুবরেখা পার হওয়ার সময় সূর্যাস্তে দেখা রক্তিম বিরাটাকার সূর্যের কথা। সেই লেখা আমাকে অভিভূত করেছিল। মনে মনে আমিও তবে সেইদিনই প্রথম পবিত্র লাইন ক্রস করেছি। তারপরে স্বপ্নেও কখনও ! কঙ্গোই পৃথিবীর একমাত্র নদী, বিষুবরেখা যাকে দুবার ছেদ করেছে।

প্রিয় কবি ও লেখক বন্ধুরা, যারা সমুদ্রে চলেছ, যাদের পালে বাতাস, অথবা যাদের হাতে জাহাজের চাকা ঘুরছে, O you who turn the wheel and look to windward, মনে রেখ, আমি এক স্বপ্নে পেরোনো শেলব্যাক, অবশ্য আমার সিন্দুকে তার শংসাপত্র নেই।

(ক্রমশঃ)

Facebook Comments

Leave a Reply