ব্যক্তিগত সিনেমাটিক : সেঁজুতি দত্ত

[ব্যক্তিগত সিনেমাটিক – সিনেমা সংক্রান্ত নিজের ভাবনাগুলি অথবা প্রতিনিয়ত যা কিছু নিজেকে ভাবাচ্ছে সেগুলিকে সিনেমার রেফারেন্সে ভাবার একটা প্রয়াসে এই কলাম। তাই এই কলামটি যেমন ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক আবার তেমনই ব্যক্তিগত এবং সিনেমাটিকও বটে। সিনেমায় পাওয়া বিশেষ কিছু মুখ নিয়ে লেখা এই কলাম এবং সেই প্রতিকৃতির বাছাই প্রক্রিয়া অবশ্যই ব্যক্তিগত। সেই মুখ সিনেমার, সেই মুখ ব্যক্তিগত এবং সেই মুখ রাজনৈতিক।]


প্রথম মুখ, চারুলতা

এই কলামটা লেখা শুরু করলাম কিছুটা সম্পাদকের উৎসাহে আর কিছুটা ব্যক্তিগত চাহিদায়। সিনেমা সংক্রান্ত নিজের ভাবনাগুলি অথবা প্রতিনিয়ত যা কিছু নিজেকে ভাবাচ্ছে সেগুলিকে সিনেমার রেফারেন্সে ভাবার একটা প্রয়াসে এই কলাম। তাই এই কলামটি যেমন ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক আবার তেমনই ব্যক্তিগত এবং সিনেমাটিকও বটে। হিসেব করে দেখলাম, মাসে একটা লিখলে বছরে বারোটা লেখা হবার কথা। তাই আপাতত একটা প্ল্যান মাথায় রাখছি; আগামী এগারোটা লেখা আমি সিনেমায় পাওয়া বিশেষ কিছু মুখ নিয়ে লিখব এবং সেই প্রতিকৃতির বাছাই প্রক্রিয়া অবশ্যই ব্যক্তিগত। সেই মুখ সিনেমার, সেই মুখ ব্যক্তিগত এবং সেই মুখ রাজনৈতিক।
সিনেমায় মুখের কথা ভাবলে, তা আবেগ এবং অনুভূতির বাইরে কল্পনা করা মুশকিল। ইংরেজি থেকে যে শব্দটি আমরা এক্ষেত্রে ধার নিতে পারি তা হচ্ছে অ্যাফেক্ট। সিনেমার ক্লোজআপের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই মুখের অভিব্যক্তি। সেই অভিব্যক্তির দ্বারা প্রকাশিত হয় আবেগ, অনুভূতি, প্রগলভতা, বিহ্বলতা, চাঞ্চল্য, এমনকি রাগ-অনুরাগ, যৌনতা সমস্ত কিছু। যেন বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিজেদের সঞ্চালনার গতি ত্যাগ করে শরীরের সমস্ত স্পন্দন ঠেলে দিয়েছে মুখের দিকে। চলমান শরীর সেই মুহুর্তে যেন স্থির হয়ে থাকে কিন্তু মুখ হয়ে পড়ে অভিব্যক্তিতে স্পন্দমান। একটাও শব্দ উচ্চারণ না করেও ক্লোজআপে দেখা সিনেমার মুখ নিজেকে বাঙময় করে তুলতে পারে। পর্দা এবং ফ্রেমে প্রক্ষিপ্ত মুখ অভিব্যক্তির বহির্প্রকাশে আবদ্ধতার বিরুদ্ধে দ্রোহের সূচনা ঘটায় যেন।
যেহেতু কথা হবে মুখ নিয়ে, এই কলামের প্রথম কিস্তিতে তাই আলোচনা করতে চাই বাঙালির প্রিয় নারী চরিত্র চারুলতাকে নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের নয় সত্যজিতের চারুলতা। এমন একটি মুখ যেখানে ছাপা থেকে যায় একটা যুগের ইতিহাস। একটু আগের বাক্যটাকে নিয়ে যদি ভাবি তাহলেই বুঝব কী প্রচণ্ড লেখক/নির্মাতা-ব্যক্তিনির্ভর আমাদের সাহিত্য অথবা চলচ্চিত্র পাঠ। যদিও সাহিত্যে লেখককে বাদ দিয়ে চরিত্রের স্বকীয়তা বের করে আনা প্রায় অসম্ভব কিন্তু সিনেমার ক্ষেত্রেও কী আমাদের পাঠ একই রকম হবে? লেখক নাহয় তাও তার চারপাশের মানুষদের প্রতি নজর রেখে চরিত্র নির্মাণ করলেন কিন্তু একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার ক্ষেত্রেও কী আমরা একই কথা বলতে পারি? সিনেমায় যে মুখ আমরা দেখি সেই মুখ কী শুধুই নির্মাতার সৃজনশীলতা অথবা নিদেনপক্ষে সিনেমাটোগ্রাফারের ফ্রেমে আবদ্ধ একটি বাধ্য অভিনেত্রীর মুখ নাকি আরও বেশি?
এক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন উশকে দিতে মন চায়। চারু যখন দেখে, আমরা যখন চারুকে দেখি এবং এই একে অপরকে দেখার কাঠামো যখন একজন নির্মাতা তৈরি করে দেন তখন সেই মুখের অর্থ কী হয়? যখন সেই মুখ হয় একজন মহিলা তারকার, এবং সেই মুখে আমরা দেখতে পাই নিজেদের আধুনিকতার ইতিহাস এবং সেই ইতিহাসবোধ থেকে যখন একাত্ম হয় যাই চরিত্রের সঙ্গে তখন নির্মাতা কী আমাদের অলক্ষ্যে চলে যান?
উত্তর হয়ত সহজ নয়।
এবছর সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবার্ষিকী। চলচ্চিত্রের ছাত্রী আমরা যারা, প্রত্যেকেই তার কাজ মনে করার চেষ্টা করছি এই সময়ে। স্মরণে রাখছি তার অবদান। এবং যে কোনো সাধারণ বাঙালির মতই “চারুলতা” (১৯৬৪) ছবিটি আমাদের মননে থেকে যায় বাঙালি নারীর আধুনিকতায় পদার্পণের আখ্যান হিসেবে। আমরা দেখি সত্যজিৎ কিভাবে উনিশ শতকের সময়টি তুলে আনছেন তার প্রতিটি ফ্রেমে। কিন্তু ছবির ক্লোজআপ কী নির্মাতার নিয়ন্ত্রণ মেনে চলে? আর এখানেই আমাদের অ্যাফেক্টের প্রসঙ্গে আবার ফেরত যেতে হয়।
আখ্যানধর্মী সিনেমা মুখের ক্লোজআপকে আখ্যানের অন্তর্গত করে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু অভিব্যক্তি এবং অভিনয়, যা পুরোটাই মুখের মালিকের নিয়ন্ত্রণে, সেই আখ্যান ভেঙে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করে অবিরত। নারীর মুখকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মিস্টিফিকেশন চলতে থাকে, সিনেমায় মুখের ক্লোজআপ সেই প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করতে থাকে, ঠিক যেন প্রতিবাদের মত। নারীর মুখের ছবির সামনাসামনি এসে দাঁড়ায় পুরুষ নির্মাতার সেই মুখকে দেখতে চাওয়ার চাহিদা। এই টানাপোড়েনে মুখের অর্থ পালটাতে থাকে।
সত্যজিতের “চারুলতা” সিনেমায় তাই আমরা দেখতে পাই ক্লোজআপের রকমফের। এই রকমফের জেন্ডারড। চারু, অমল এবং ভূপতি এই তিনটি মুখ্য চরিত্রের ক্লোজআপ যদি আমরা আলোচনা করি তাহলে দেখতে পাব যে লিঙ্গগত অবস্থানের হেতু এই তিনজনের মুখের ক্লোজআপ তিনরকমভাবে আলাদা। অমল এবং ভূপতির প্রায় সমস্ত ক্লোজআপ আখ্যানের সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থাননির্ভর। নিজের নিজের প্রেক্ষিতে এই দুই পুরুষ আত্মনির্ভর এবং দৃঢ়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাইব ভূপতির অমলের জন্য নিয়ে আসা বিবাহপ্রস্তাবের দৃশ্যটি। সম্ভাব্য বিবাহের আলোচনায় এই দুই ঔপনিবেশিক যুগের পুরুষ চরিত্রের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বাহিরের হাতছানিতে। এই বাহির নারীর অন্দরের দ্বৈততায় নির্মিত নয়। এই বাহির পুরুষের গতিশীলতায় নির্মিত। আমরা টু-শটের মিড ক্লোজআপে তাদের দেখতে পাই – আধুনিকতার হাতছানিতে উজ্জ্বল দুই পুরুষের স্বপ্নাভ মুখ।


সিনেমায় চারুর ক্লোজআপ সেই দিক থেকে বরাবরই দ্বান্দ্বিক, অন্তর্মুখী এবং লেয়ারড। সিনেমা এবং সেটির নির্মাতার পক্ষে এই ক্লোজআপে ওভারইনভেস্ট না করে কোনো উপায় থাকে না। আমরা যদি এখানে চারুর প্রথম বাগানে একা লিখতে বসার দৃশ্যটি মনে করি তাহলে এই দ্বন্দ্বগুলো হয়ত আরেকটু ভালোভাবে দেখতে পাব। সে একই সাথে লিখছে বাহিরের পাঠকদের জন্য, কারণ তাকে ছাপাতে হবে, আবার লিখছে নিজের কথাও। অস্বীকার করছে পুরুষের লেখনী। চারুর মুখের ওপর চলতে থাকে তার শৈশবের অভিজ্ঞতা। তার মুখ আর পর্দা সেখানে এক হয়ে যায়। কী আছে চারুর সেই শৈশবে? আছে নদী, নকশা করা নৌকার পাল, গাজনের মেলা, মায়ের (?) চরকা কাটা ইত্যাদি। এই মন্তাজটি যখন স্ক্রিনের পরিপূরক চারুর মুখের ওপর প্রতিফলিত হতে থাকে সেটাকে তখন বাইরে থেকে প্রক্ষিপ্ত মনে হয় না। মনে হয় যেন স্ক্রিনের ভেতর থেকে ফুটে উঠছে সেই সব দৃশ্য, কারণ চারু ভাবছে। তার লেখা ‘আমার গ্রাম’ যেমন একধাপ তাকে বাহিরের দিকে নিয়ে যাবে তেমনই মনে করিয়ে দেবে তার শৈশবের কথা, ঘরের কথা, তারই মত আরও মেয়েদের কথা।
এবারে যদি অমল, চারু এবং ভূপতির ক্লোজআপগুলোর তুলনা করি তাহলে দেখব যে অমল এবং ভূপতির সেই টু-শটগুলো চারুর ‘আমার গ্রামের’ প্রক্ষেপণের চাইতে একরৈখিক এবং অস্বচ্ছ। এই একরৈখিকতা মোটেও মন্তাজের জাক্সটাপজিসনের অভাবে নয় বরং আখ্যানে পুরুষের সম্পূর্ণতাই এই অস্বচ্ছতা তৈরি করে। যা দেখছি তার বেশি যেন কিছুই আর দেখার অথবা পড়ার থাকছে না।
সত্যজিৎ রায় সজ্ঞানে একটি নারীবাদী ছবি নির্মাণ করেছেন এই দাবি করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এটা অবশ্যই ভাবা যায় যে সিনেমায় ক্লোজআপ যে পুরুষ নির্মাতার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে সেই চিহ্নগুলিকে হয়ত সত্যজিৎ তার ছবি থেকে মুছে দেবার চেষ্টা করেননি। এর সঙ্গেও যেটা ভাবার, হয়ত এই কলামের আগামী লেখাগুলোতেও সেই ভাবনা চলবে, যে মুখের ক্লোজআপ আমাদের এই নির্মাতাকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র পাঠের বাইরে আর কোনও নতুন পাঠের রাস্তা খুলে দেয় কিনা।

[লেখক – সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।]

Facebook Comments

Leave a Reply