বিটকয়েন : সহস্রলোচন শর্মা

বিটকয়েন : পর্ব ২

গত সংখ্যায় বিটকয়েনের জন্ম বৃত্তান্ত সম্পর্কে অবগত হয়েছি আমরা। এবার শুনবো তার যৌবরাজ্যে অভিষেকের গল্প। তার শৌর্য, বীর্য, প্রতাপের গল্প। এই গল্পের মধ্যে দিয়েই প্রশমিত হবে বিটকয়েন নিয়ে উঠা আমার আপনার মনের নানান ধন্দের। এই পর্বেই আপনি পাবেন আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর। তো দ্বিতীয় পর্বের গল্পটা শুরু করা যাক, মনের ভিতর ঘোরাফেরা সেই মোক্ষম প্রশ্নটা দিয়ে, টাকা থাকতে খামকা বিটকয়েন ব্যবহার করতে যাবো কেন আমরা? প্রশ্নটাকে ঘুরিয়ে বলা যায়, বিটকয়েন ব্যবহারের সুবিধা কি কি? আজ আমরা বিটকয়েন ব্যবহারের সুবিধা নিয়েই আলোচনা করতে চলেছি।
বিটকয়েন ব্যবহারের সুবিধা অনুধাবন করতে গেলে অনেকগুলো জটিল বিষয়কে গোচরে আনতে হবে আমাদের। সেই সমস্ত বিষয় গুলোকে ধীরে ধীরে উন্মোচন করা প্রয়োজন। তবে তার আগে খুব সংক্ষেপে বিটকয়েনের মূল উপযোগিতার কথা জেনে নেওয়া যাক। বিটকয়েন ব্যবহারের মূল উপযোগিতা হলো ব্যাঙ্কের খবরদারি থেকে মুক্তি। ঠিক এই কথাটাই তাঁর প্রবন্ধের প্রথম লাইনে বলতে চেয়েছেন নাকামোতো (পর্ব ১ দেখুন)। ব্যাঙ্কের মধ্যস্থতা ছাড়াই যে কোনও ব্যক্তি দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তিকে (Peer-to-peer, P2P) যে কোনও রকমের অর্থ (ক্রিপ্টোকারেন্সি) যে কোনও সময়ে প্রেরণ করতে পারেন। ব্যাঙ্কের মাধ্যমে এই অর্থ প্রেরণের অনেকগুলো অসুবিধা রয়েছে। ব্যাঙ্ক থেকে ইচ্ছা মতো টাকা তোলা যায় না। ইচ্ছা মতো টাকা জমাও দেওয়া যায় না। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলা বা জমা দেওয়ার ঊর্ধ্ব সীমা আছে, আছে নজরদারি, আছে কৈফিয়ৎ। অতিরিক্ত টাকা জমা করতে গেলে ব্যাঙ্ককে সেই টাকার উৎস জানাতে হবে। অতিরিক্ত টাকা তুলতে গেলে আগে থেকে জানাতে হবে ব্যাঙ্ককে। আছে ট্যাক্সের ঝামেলা। ব্যাঙ্কের এক শ্রেণীর কর্মচারীদের যোগসাজশে অনলাইনে টাকা গায়েবের ঝঞ্জাটও আছে। আর আছে জালিয়াত। বিজয় মালিয়া, নীরব মোদীর মতো বিশিষ্ট জালিয়াতের সংখ্যা তো নেহাৎ কম নেই পৃথিবীতে। এই জালিয়াতদের দৌলতে ব্যাঙ্কের দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়। ক্রিপ্টোকারেন্সিতে এই সমস্ত ঝামেলা একেবারেই নেই। দুই ব্যক্তির মধ্যে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিময়ের জন্য তৃতীয় কোনও প্রতিষ্ঠানের (ব্যাঙ্ক) কোনও বিধি নিষেধ থাকে না এখানে। দৈনন্দিন জীবনে কোনও ব্যক্তি যে ভাবে নিজের চামড়ার ওয়ালেট থেকে যাঁকে খুশি, যখন খুশি, যত খুশি অর্থ দান করতে বা খরচা করতে পারেন, তাতে যেমন ব্যাঙ্কের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, ঠিক সেই রকমই ক্রিপ্টো ওয়ালেট থেকে যাঁকে খুশি, যখন খুশি, যত খুশি অর্থ দান করতে বা খরচ করতে পারেন কোনও গ্রাহক, তার জন্য ব্যাঙ্কের মতো কোনও সংস্থার কোনও ওটিপির প্রয়োজন পড়ে না। সর্বোপরি ব্যাঙ্কের থেকেও অনেক বেশি নিরাপদ ক্রিপ্টো ট্রান্সাকশন। এখানে গ্রাহকের একাউন্ট হ্যাকিং হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ এখানে আছে ‘ব্লকচেইন’ (Blockchain)এর মতো উচ্চমার্গের সুরক্ষা, যা হ্যাক করা কোনও হ্যাকরের পক্ষেই সম্ভব নয়। সোজা কথা হলো, ব্যাঙ্কের খবরদারি থেকে মুক্তি পেতে এবং অধিক নিরাপত্তা আশায় ক্রিপ্টোকারেন্সির দিকে ঝুঁকছে মানব সভ্যতা।
এখন প্রশ্ন হলো, কি এমন সুরক্ষা আছে এই ব্লকচেইনে যা ব্যাঙ্কের নেই? এই ব্লকচেইন পদ্ধতি কতটা সুরক্ষিত তা না জানলে যে ক্রিপ্টোকারেন্সির উপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারবেন না কেউই। সহজ কথায় ব্লকচেইন বোঝার জন্য একটা উদাহরণের সাহায্য নেওয়া যাক। ধরা যাক এই মুহূর্তে ১০ জন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিটকয়েন আছে, অর্থাৎ ১০ জনের বিটকয়েন একাউন্ট আছে। এবার আমি একটা বিটকয়েন একাউন্ট খুলে, ৫টা বিটকয়েন কিনলাম। এই খবরটা একটা সংকেত পরিণত হয়ে সাথে সাথে ইন্টারনেটের মাধ্যমে অন্যান্য সকল বিটকয়েন গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যাবে। এই সংকেতকে ক্রিপ্টোলজির ভাষায় হ্যাশ (hash) বলা হয়। এবার ধরা যাক, উপরোক্ত ১০ জন ব্যক্তির মধ্যে ৮ম ব্যক্তির একাউন্টে ২টো বিটকয়েন পাঠাতে চাই আমি। সাধারণ ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে, আমি যদি কারও একাউন্টে অনলাইনে টাকা ট্রান্সফার করতে চাই, তাহলে তাঁর একাউন্ট নাম্বারটা জানা থাকতে হবে আমার। ঠিক তেমনই ৮ম ব্যক্তির একাউণ্টে বিটকয়েন ট্রান্সফার করতে গেলে সেই ব্যক্তির বিটকয়েন একাউন্ট নাম্বারটাও জানা থাকতে হবে আমার। এই একাউন্ট নাম্বারকে ক্রিপ্টোকারেন্সির ভাষায় বলা হয়ে থাকে ‘পাবলিক কি’ (Public key)। অর্থাৎ এই নাম্বারটা নিশ্চিন্তে পাবলিকের মধ্যে শেয়ার করতে পারেন গ্রাহক। এই পাবলিক কি অনেকটা ‘আইডি’র (ID) মতো। আইডি দিয়ে লগইন করার পর যেমন পাসওয়ার্ডের প্রয়োজন হয়, তেমনই, পাবলিক কি জানার পর সেই ব্যক্তির একাউন্টে প্রবেশ করতে গেলে একটা নির্দিষ্ট পাসওয়ার্ড জানার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই জাতীয় পাসওয়ার্ডকে ক্রিপ্টোকারেন্সির ভাষায় ‘প্রাইভেট কি’ (Private key) বলা হয়। অর্থাৎ পাবলিক কি ব্যবহার বাইরের দরজাটা খুলতে পারলেও প্রাইভেট কি জানা না থাকলে ভিতরের দরজা খুলতে পারবে না কেউই। আমার পাঠানো টাকা বা সংকেতিক লিপি কেবলমাত্র সেই উদ্ধার করতে পারবে যাঁর কাছে আছে সঠিক প্রাইভেট কি।
এই ‘পাবলিক কি’ আর ‘প্রাইভেট কি’র মাঝের প্রক্রিয়াটাই ব্লকচেইন নামে পরিচিত। আমার পাঠানো টাকা ৮ম ব্যক্তির একাউন্টে যুক্ত হওয়ার আগে এটা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে আমার ট্রান্সাকশনটা সঠিক বা ভ্যালিড কি না। কারণ, এমন হতে পারে যে, আমার একাউন্টে আদতে আছে ১ বিটকয়েন আর আমি ২ বিটকয়েন পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছি। আমার ট্রান্সাকশনটা সঠিক কি না তা নির্ধারণ করে দেবে ব্লকচেইন। ইতিপূর্বে আমি যে ৫টা বিটকয়েন কিনেছিলাম, একটা সংকেতের ব্লক হিসেবে সবার কাছেই রয়ে গেছে সেই তথ্যটা। এবার যেই মুহূর্তে আমি বিটকয়েন ট্রান্সাকশন কনফার্ম করলাম সেই মুহূর্তে একটা নতুন সংকেত বা হ্যাশ (ব্লক নয়) তৈরি হয়ে পৌঁছে গেল সবার কাছে। এবার এলো হ্যাশ ডিকোডের পালা। সবার কাছে সেই সংকেত বা হ্যাশ পৌঁছে গেলেও সবাই কিন্তু সেই হ্যাশ ডিকোড করতে পারবেন না (পর্ব ৩ দেখুন)। ট্রান্সাকশনের সংকেত বা হ্যাশ আপলোড হবার সাথে সাথে কিছু ব্যক্তি (সবাই নন) সেই হ্যাশ ডিকোড করে, ট্রান্সাকশন সঠিক না বেঠিক তা বিচার করতে বসে পড়েন। যে সমস্ত ব্যক্তি কোনও ট্রান্সাকশন বিচার করে সঠিক না বেঠিক নির্ধারণ করেন তাঁদের ‘মাইনার’ (miner) বলা হয়। আমার বা আপনার মতো যে কোনও বিটকয়েন একাউন্ট হোল্ডারই মাইনারের ভূমিকা পালন করতে পারেন, তার জন্য কারও অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। এই মাইনারাই আমার ট্রান্সাকশন সঠিক কিনা নির্ধারণ করে নতুন ব্লক যুক্ত করে থাকেন।
ধরা যাক, কোনও একজন গ্রাহক বা মাইনার বললেন এই ট্রান্সাকশন সঠিক। অমনি সেই তথ্যটা নতুন একটা ব্লক হিসেবে (হ্যাশ নয়) আগের ব্লকের সাথে জুড়ে গেল। পুরানো ব্লকের সাথে নতুন ব্লক যুক্ত হয়ে ব্লকের একটা চেইন তৈরি হলো। ব্লকের এই চেইনকেই ‘ব্লকচেইন’ বলা হয়। এখানে স্পষ্ট করা প্রয়োজন, যে কোনও ট্রান্সাকশনের খবর প্রথমে হ্যাশে বা সংকেতে পরিণত হয়। আর সেই হ্যাশ ডিকোড করে তাকে কেউ স্বীকৃতি দিলে বা কনফার্ম করলে তবেই একটা ব্লক তৈরি হয়। জনৈক এক গ্রাহক বা মাইনার, আমার ট্রান্সাকশনকে বৈধ ঘোষণা করে একটা নতুন ব্লক যুক্ত করলেই যে আমার ট্রান্সাকশন বৈধ বলে গণ্য হবে এমনটা নাও হতে পারে। বিষয়টা নির্ভর করছে, আমি কত বিটকয়েন পাঠিয়েছি তার উপর। সাধারণ ভাবে বলা হয়ে থাকে ১০০০ বা তার কম ডলারের সমপরিমাণ বিটকয়েন বিনিময়ের জন্য একজন মাইনারের স্বীকৃতিই যথেষ্ট। ১০০০ থেকে ১০,০০০ ডলারের সমপরিমাণ বিটকয়েন বিনিময়ের জন্য ৩টে মাইনারের স্বীকৃতির প্রয়োজন বা ব্লকচেইনে ৩টে নতুন ব্লক যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। আর ১০,০০০ ডলারের বেশি মূল্যের ট্রান্সাকশনের জন্য ৬টা ব্লকের সংযুক্তি প্রয়োজন। স্বীকৃতি সূচক এই নতুন ব্লকগুলো যুক্ত হওয়ার পর আমার ট্রান্সাকশন বৈধ বলে বিবেচিত হবে। ট্রান্সাকশন বৈধ ঘোষণার পরই কেবলমাত্র ওই ৮ম ব্যক্তির পক্ষে তাঁর ‘প্রাইভেট কি’ ব্যবহার করে ওই অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব। আর ওই ৩ জন বা ৬ জনের ব্যক্তির মধ্যে কোনও একজনও যদি আমার ট্রান্সাকশনকে বেঠিক বলে ঘোষণা করেন তাহলে আমার ট্রান্সাকশন বাতিল বলে গণ্য হবে।
সে কি কথা! মাত্র এক জন বেঠিক বললেই ট্রান্সাকশন বাতিল হয়ে যাবে? কেউ তো ইচ্ছাকৃত ভাবেও আমার ট্রান্সাকশনকে বেঠিক বলতে পারেন। তাহলেও আমার ট্রান্সাকশন বাতিল হয়ে যাবে? না, ব্লকচেইন পদ্ধতিতে ইচ্ছাকৃত ভাবে কোনও ট্রান্সাকশনকে সঠিক বা বেঠিক ঘোষণা করতে পারেন না কেউই। কোনও ট্রান্সাকশন সঠিক না বেঠিক তা ঘোষণা করতে গেলে লাগে ‘প্রুফ অব ওয়ার্ক’ (Proof of work)। অর্থাৎ কোন যুক্তিতে ট্রান্সাকশন সঠিক বা বেঠিক, তাও উল্লেখ করতে হবে বক্তাকে। সর্বোপরি এই গণনা মনুষ্য নির্ধারিত বা ম্যানুয়াল প্রসিডিওর নয়। পুরোটাই কম্পিউটার নির্ধারিত। উদাহরণ হিসেবে, কম্পিউটারের সাহায্যে কোনও পরীক্ষার এমসিকিউ (MCQ) উত্তরপত্র চেক করার পদ্ধতির কথাই ভাবা যাক। সেই উত্তরপত্র চেক করার ক্ষেত্রে কোনও শিক্ষকের ব্যক্তিগত মতামত কখনই কার্যকারী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে না। কোন উত্তরটা সঠিক আর কোন উত্তরটা বেঠিক তা কেবলমাত্র কম্পিউটারই নির্ধারণ করে দেয়। ঠিক তেমনই, ক্রিপ্টো ট্রান্সাকশনের ক্ষেত্রে কোন ট্রান্সাকশনটা ঠিক আর কোন ট্রান্সাকশনটা ভুল তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা কোনও ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে নয়। সেই ‘প্রুফ অব ওয়ার্ক’ সম্পূর্ণতই যান্ত্রিক পদ্ধতি।
এই পর্যন্ত ঘটনা প্রবাহ পড়ে পাঠক ভাবতেই পারেন, আমার বিটকয়েন বিনিময়ের ঘটনার খবর যদি সমস্ত গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যায়, সবাই যদি জেনেই যায় আমার ট্রান্সাকশনের খবর, তাহলে আমার তথ্য আর সুরক্ষিত থাকল কোথায়? সে তো জেনেই গেল সবাই। সেই তুলনায় তো ব্যাঙ্কের ট্রান্সাকশন বা ব্যাঙ্কে রাখা আমার টাকার পরিমাণ তো গোপনেই থাকে। কেউ তা জানতে পারেন না। তাহলে ব্লকচেইন পদ্ধতিকে সুরক্ষিত বলা হচ্ছে কোন যুক্তিতে? এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, যে সমস্ত যুক্তি সাজিয়ে ব্যাঙ্কিং সুরক্ষাকে ব্যাখ্যা করে থাকি আমরা তা আদতে ত্রুটিপূর্ণ, বাস্তব ঘটনাটা বরং ঠিক উলটোই। ব্যাঙ্কে সুরক্ষা কম, ক্রিপ্টোকারেন্সিতে সুরক্ষা বেশি। একটা উদাহরণ দিয়ে এই ঘটনাটা ব্যাখ্যা করা যাক। ধরা যাক, আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং ডাক্তারখানায় গেছেন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করবেন বলে। ডাক্তারখানায় গিয়ে দেখলেন আরও কিছু রোগী ইতিপূর্বেই হাজির হয়েছেন সেখানে। প্রত্যেকেই একটা খাতায় নিজের নাম লিখিয়ে অপেক্ষা করছেন। ধরা যাক, সেই খাতায় ৬ জন রোগীর নাম লেখা আছে। এবার আপনি ৭ নাম্বারে নিজের নামটা লিখে দিলেন। ক্রিপ্টোকারেন্সির ভাষায় এটাকেই বলা হয় একটা হ্যাশ আপলোড করলেন আপনি। এবার ধরা যাক, আগের ৬ জন রোগী ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় নিজের নাম লিখে রেখেছেন। কেউ পাঞ্জাবী ভাষায় নিজের নাম লিখেছেন তো কেউ মালায়ালম ভাষায় নিজের নাম লিখেছেন। অর্থাৎ, প্রকাশ্যে নাম লেখা থাকলেও সবার কিন্তু সেই নাম পড়ার ক্ষমতা নেই। তর্কের খাতিরে ধরা যাক এঁদের মধ্যে ২ নাম্বার রোগী বাংলা ভাষায় নিজের নাম লিখেছেন এবং আপনি তা পড়তেও পারছেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, যে অপেক্ষমান রোগীদের মধ্যে ২য় রোগী কোন জন? জানেন না, সাধারণ ভাবে তা জানার কথা নয়। ঠিক তেমনি আপনার ট্রান্সাকশনের একটা হ্যাশ আপলোড হলে আপনার ‘পাবলিক কি’ সামনে আসে। ভিন্ন ভাষায় লেখা নাম যেমন আপনি পড়তে পারেন না, তেমনই সেই হ্যাশ ডিকোড করার ক্ষমতা সবার থাকে না (পর্ব ৩ দেখুন)। সেই পাবলিক কি’র হ্যাশ দেখে কারও পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয় যে আপনি কে বা কোথায় থাকেন। অর্থাৎ আপনার পরিচয় গোপনই থাকে।
এবার দেখুন, ডাক্তারখানায় রাখা খাতায় নিজের নাম লেখা মাত্রই কি আপনি ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেন? পারেন না। ডাক্তারখানায় ডাক্তারের একজন সহযোগী বা কম্পাউন্ডার থাকেন, তিনি এক এক জন রোগীর নাম ধরে ডাকতে থাকেন। যাঁর নাম ডাকা হবে কেবলমাত্র তিনিই ডাক্তারের সাথে দেখে করতে পারবেন। প্রথম জন ডাক্তারের চেম্বারে ঢোকা মাত্রই, ডাক্তারের সেই সহযোগী, খাতায় লিখে রাখা প্রথম জনের নামের পাশে একটা টিক চিহ্ন বসিয়ে দিলেন। অর্থাৎ এনার ডাক হয়ে গেছে। এই টিক চিহ্ন কিন্তু সবাই দেখতে পাচ্ছেন। তাতে সবাই বুঝতে পারছেন প্রথম জনের পালা শেষ হয়েছে। নামের পাশে এই টিক মারা বা কনফারমেশনটাই ক্রিপ্টো দুনিয়ায় ব্লক নামে পরিচিত। একে একে ৬ জন রোগীর নামের পাশে টিক চিহ্ন পড়লে বা ৬টা ব্লক যুক্ত হলে তবেই আপনার নাম ধরে ডাকা হবে, তবেই আপনি ডাক্তারের সাথে দেখা করতে পারবেন, তবেই আপনার ট্রান্সাকশন বৈধ বলে ঘোষণা হবে। ব্লকচেইনের ক্ষেত্রে ডাক্তারের সহযোগী বা কম্পাউন্ডারের এই ভূমিকাটাই পালন করে থাকেন মাইনাররা। মাইনারাই আমার ট্রান্সাকশন সঠিক কিনা নির্ধারণ করে নতুন ব্লক যুক্ত করে থাকেন। এই মাইনার বা পরীক্ষকদের মধ্যে অন্তত ৩ জন বা ৬ জন মাইনার যদি আপনার ট্রান্সাকশনকে সঠিক বলে ঘোষণা করেন তবেই আপনার পাঠানো অর্থ উপরোক্ত ৮ম ব্যক্তির কাছে পৌঁছে যাবে। তারপর সেই ৮ম ব্যক্তি আপনার দেওয়া তথ্য জানতে পারবেন, ঠিক যেমন ৬ জন রোগীর পর ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে ডাক্তারকে আপনার ব্যক্তিগত রোগের কথা জানাতে পারেন আপনি।
আবার ফেরা যাক ডাক্তারখানার উদাহরণে। এবার আপনি ডাক্তারখানায় গিয়ে দেখলেন, অপেক্ষমান রোগীর নাম লেখার কোনও খাতা নেই। বদলে আছে সাদা কাগজের কিছু টুকরো। তাতে নিজের নাম লিখে ডাক্তারবাবুর টেবিলে রাখা ট্রে’তে জমা দিতে হবে। এবার কিন্তু আপনার নাম আর প্রকাশ্যে এলো না। আপনিও অন্য রোগীর নাম জানতে পারলেন না। জানতে পারলেন না ঠিক ক’জন রোগী আছে আপনার আগে। এবার কি আপনি নিশ্চিত হলেন যে, ক্রমানুযায়ী রোগীর ডাক পড়বে? বাক্সে রাখা চিরকুটগুলো ঘেঁটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, আছে ডাক্তারবাবুর মর্জি। তাঁর পরিচিত লোককে আগে ডেকে নিতে পারেন তিনি। অর্থাৎ চিরকুট পদ্ধতি মোটেও নিরাপদ নয়। এই পদ্ধতিতে গোপনীয়তা বেশি থাকলেও সমস্ত ক্ষমতা একটা ব্যক্তি বা সিস্টেমের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। চিরকুট পদ্ধতির থেকে সবার সামনে নিজের নাম ক্রমানুযায়ী লেখাটা অনেক বেশি যুক্তি সম্মত ও নিরাপদ। এবার আপনি ডাক্তারের জায়গায় ‘ব্যাঙ্ক’কে ভাবুন। ব্যাঙ্ক হলো একটা কেন্দ্রীভূত (centralize) ক্ষমতা। শুধুমাত্র ব্যাঙ্কের হাতেই আছে আপনার জিয়ন কাঠি। ব্যাঙ্কে রাখা সমস্ত হিসাব আয়কর দপ্তরের অধীন। বছরের শেষে আপনাকে আয়ের পরিমাণ ও উৎস জানাতে হবে সবিস্তারে। ব্যাঙ্কের হাতেই আছে তছরূপের ক্ষমতা। ব্যাঙ্কের হাতে তছরূপের ক্ষমতা আছে বলেই জালিয়াতি হয় ব্যাঙ্কে। দেউলিয়া হয়ে পড়ে ব্যাঙ্ক। ক্রিপ্টোকারেন্সিতে ক্ষমতার কোনও কেন্দ্র থাকে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার (decentralize) মতো অন্যান্য গ্রাহকরাই বলে দেবেন আপনার ট্রান্সাকশন সঠিক না বেঠিক। ক্রিপ্টো দুনিয়ায় এই জাতীয় হিসাবকে ‘ডিসেন্ট্রালাইজ লেজার’ (decentralize ledger) বা ‘পাবলিক ডিজিটাল লেজার’ (public digital ledger) নামে অভিহিত করা হয়। ডিসেন্ট্রালাইজ লেজার হলো ডাক্তারখানায় গিয়ে প্রকাশ্যে নাম লেখানোর মতোই লাভজনক। তাতে আপনার মনে হতে পারে, আপনার ব্যক্তিগত আয় ব্যয় তো জেনেই গেল সবাই। গোপন আর রইল কই? কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সিতে আপনার আয় ব্যয়ের হিসাব সবার জানা থাকলেও, আপনাকে চিহ্নিত করতে পারবে না কেউই। তাই আপনার আয় ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগও নেই কারও। ফলে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে আমার ট্রান্সাকশনের হিসাব অন্যান্য গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে যাওয়াটা বিপজ্জনক নয় সুবিধাজনক।
যেহেতু ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে বেচাকেনার কোনও হিসাব থাকে না কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থা বা ব্যাঙ্কের কাছে, তাই ব্যাঙ্কের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় যে আপনার ওয়ালেটে কত ক্রিপ্টোকারেন্সি জমা পড়ল বা আপনার আয় কত হলো। এতে আপনার আয় সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকারে থেকে যাচ্ছে রাষ্ট্র বা সরকার। ফলে আপনার আয় ট্যাক্সের আওতা ভুক্ত হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই থাকছে না। বিষয়টা নজরে পড়েছে সব দেশের সরকারেরই। ইউএসএ সরকার লক্ষ্য করেছেন তাঁদের পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ট্যাক্স কম জমা দিচ্ছেন কিছু নাগরিক। কেন? কেন কম ট্যাক্স জমা দিচ্ছেন তাঁরা? তাঁদের সেই টাকাগুলো গেল কোথায়? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, যাঁরা ট্যাক্স কম দিচ্ছেন তাঁদের প্রত্যেকের ব্যাঙ্কের সাথে ক্রিপ্টো ওয়ালেট লিঙ্ক করা আছে (দেখুন কোনও কেন্দ্রীয় দপ্তর কিভাবে আপনার গোপন তথ্য সংগ্রহ করে নিল)। তাঁরা বুঝে গেলেন, ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে বেচাকেনা করছেন সেই সব নাগরিকরা। আর এই বেচাকেনার কোনও নথিও নেই সরকারের কাছে। কারণ ক্রিপ্টোকারেন্সি হলো সরাসরি দুই ব্যক্তির মধ্যে আদান প্রদান। মাইনাররা শুধু ট্রান্সাকশনটা সঠিক না বেঠিক তা নির্ধারণ করে দেন মাত্র। ইচ্ছা অনুযায়ী ট্রান্সাকশনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না তাঁরা। বাস্তবে, আপনার চামড়ার ওয়ালেট রাখা টাকার হিসাব যেমন অন্য কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়, তেমনই আপনার ক্রিপ্টো ওয়ালেটে রাখা ক্রিপ্টোকারেন্সির হিসাবও কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থার পক্ষে জানা সম্ভবপর নয়। সরকার তাঁর অসহায়তার কথা বুঝতে পারলেন। অগত্যাই বেছে বেছে প্রায় ১০,০০০ ইউএস নাগরিককে সমন ধরিয়েছেন সেই দেশের সরকার। সেই সমনের সার কথা হলো ‘হিসাব দাও’। ইউএসএর পর এখন সব দেশের সরকারই ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে বেচাকেনার উপরে ট্যাক্স ধার্য করছেন। যে সমস্ত নথিভুক্ত অনলাইন শপিং স্টোর ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে পণ্য বেচাকেনা করেন, তাঁরা বর্তমানে ট্যাক্সের আওতাভুক্ত হয়েছেন। আপনি বা আমি, যখনই টাকাকে ক্রিপ্টো ওয়ালেটে ট্রান্সফার করবো তখনই সেই টাকা করযোগ্য বলেই ধরা হচ্ছে। নিরুপায় হয়েই ক্রিপ্টোকারেন্সিকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন সব দেশের সরকারই[১]। এখন জানার বিষয়, সাধারণ নাগরিকরা ক্রিপ্টোকারেন্সিকে স্বীকৃতি দিতে কতটা প্রস্তুত হয়েছেন। জানতে হবে, পাঠক হিসেবে আপনি কি ক্রিপ্টোকারেন্সিকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত? এখনও নয়! তাহলে শুনে রাখুন, ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিময় করে আপনি কিন্তু রাতারাতি মালামাল হয়ে যেতে পারেন। কি ভাবে? পরবর্তী পর্বে থাকছে তার হদিশ।

(ক্রমশ)

[১] বাংলাদেশ, নেপাল, আলজেরিয়া, বলিভিয়া, ইকুয়াডর সমেত বেশ কয়েকটা দেশে ক্রিপ্টো কারেন্সি বিনিময় এখনও নিষিদ্ধ রয়েছে।

Facebook Comments

Leave a Reply