অস্তিত্ব এবং অন্যান্য খুঁটিনাটি অথবা নোটস যা জনরাবিহীন – তদোগেন গিরতে
আ টেইল অফ টু সিটিজ
এলিট বর্গ হন প্রদোষে প্রাকৃত (বয়সানুসারে অকার্য না করলে যা হয়), জন্ম এলিট আর কী, আমরা তো প্রাকৃতই জন্মাবধি– প্রভাতে পাকিত, ফলে রব ওঠে– দাদুর হোল! অপেক্ষাকৃত মার্জিতেরা ছড়া কাটে– ভূঁয়েতে ধরিছে তাল, মশয় কী দিনকাল! বৃদ্ধ বেশ গায়ে গতরে, বোধ হয় ডায়াবেটিস, সঙ্গে হাইড্রোসিল, যত্রতত্র রাস্তার ধারে বসে পড়েন প্রস্রাবত্যাগে, ঘোরকৃষ্ণ তমতমে মু্খ, চিৎকার করেন—‘আঁটকুড়ের ব্যাটারা!’ উৎপীড়ন চলে, যতক্ষণ না তাঁর মুস্কো ভাইপোদের কেউ ছুটে আসছে। আবার তিনিই যখন উপাসনাগৃহে, আমরা যাকে বলি কাচমন্দির, গান ধরেন –‘তোমার চরণ-ধূলায় ধূলায় ধূসর হব’, কাচমন্দির আলো হয়ে ওঠে, চোখের বাস্পে সে আলোর চ্ছটা ভাঙ্গে, মনের ভেতরে কিচ্ছু না বুঝেই ডুকরে উঠি। রটে, অপয়া, নাম নেয়া বারণ, নিলেই বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার মিস, কেউ ডাকে অজা, উকিলপট্টির রবিবাবুর গলা নকল করে কবিতা পড়ে একটু খ্যাতি চাওয়া অশীতিপর দাবি করেন, উনি আশ্রমের সমসাময়িক—‘ব্যাটা তো নাচত, গুরুদেব পইপই করে বলেছিলেন– আমার গান গাসনি, তবুও…কী আস্পর্ধা!’
আমরা অবশ্যি জানতাম, ওই গানদাদুও তিনি, মাটিতে বসে প্রস্রাব করা মানুষটি তিনি, ডাক্তারের চেম্বারে অপেক্ষারত রুগীদের সরিয়ে—‘আমাকে আগে দেখুন’ বলা লোকটিও তিনি, এই সব মিলেই তিনি, আমরাও আসলে তিনি, এবং তিনিও আমরা। ততদিনে প্রহ্লাদ যা জ্ঞানাবধি জানে, হিরণ্যকশিপু যা মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে জানতে পারে, আমরা জেনে ফেলেছি, আমরা জানি, সকলেই হরি, খাঁচার পাখি আর বনের পাখি দুজনাই হরি, কৃষ্ণকলি, আর যে প্রেম তার নাম কৃষ্ণকলি দেয় তারা দুজনাই হরি, কুকুরও হরি, তার বাকলসও হরি, দাদুতেও হরি, আমাতেও হরি, আমারো বয়স হলে ওই রকম ছেলেপিলের দল আমাকে নিয়ে আমোদ–গোঁসাই কাকা সিধে নিতে এসে গান ধরেন—‘মন তুমি কী চিরজীবী? দিন কী তোমার এমনি যাবে?’, ঠাকুমার গঞ্জনা শুনতে শুনতে মা গুনগুন করে—‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়’। আমরা জানি, সমান বলে কিছু নেই, চঢ়াই-এর পর উৎরাই, আবার চঢ়াই, তবে বৃদ্ধ বয়সে এসে বুঝি, এই যে প্রাকৃতিক, ব্যবসা একেও কবেই ধরে ফেলেছে, ক’-এ কমললোচন শ্রীহরি যদি খগ আসনে মুরারী না হলেন, যদি অনন্ত নাগের বিড়েতে, নিমীলিত চোখ, মিটিমিটি না হাসলেন, তবে তিনি হরিই নন। ওই পেডাস্টাল তৈরি হলো ব্যবসা, পেডাস্টালে ওঠানোও ব্যবসা, পেডাস্টালের সংরক্ষণ ব্যবসা, সর্বশেষে পেডাস্টাল থেকে নামানোও ব্যবসা।
আমরা তো প্রভাত মাত্র, হরিকে জানি, মধুসূদন দাদা, হীরক চিনি না, শুধু জানি ফ্রান্সিস হীরের পাহাড়ে ওঠে, আর আমাদের তিনপাহাড়ে জরির টুপি পরা বালক এক আজও পাথর সাজায়, পাথর সাজায়, বিশাল বটের ঝুরি লম্বা হয়, ভূঁয়ে গাঁথে, আমাদের বয়স বাড়ে, সিংহ সদনের সামনের বেদিকে দেখিয়ে বোলপুরের রিক্সাওয়ালা ট্যুরিস্টদের বলে—এইখানে ইংরেজ রবীন্দ্রনাথের ফাঁসি দিয়েছিল। সেই বালকও জরির টুপিতে দাঁড়িয়ে শোনে, অমলিন, মৃদু, শালবীথি জুড়ে হাওয়া খেলে, আম্রকুঞ্জে বোল আসে, পোকাও, কাচঘরের সামনের আমলকি গাছে পাতা ধরে, মাধবীলতা হোস্টেল থেকে কে যেন গেয়ে ওঠে—আজ আমাদের ছুটি।
ব্যাংকিং-এর বই হাতে উপাধ্যায় আসেন, ব্রহ্মবান্ধবের উত্তরপুরুষ, বিষ্ণুপ্রিয়, বজ্রপানা চেহারা, কিন্তু গলায় কী যে মায়া– আমার চেতনা চৈতন্য করে– আমরা জানতে পারি, ইংরেজিতেও দুটি হোল আছে, একটি শূন্যতা, আর সেই শূন্যতাই যখন আগায় ডব্লিউকে বসায়, পুকুরকে পুকুর টলমল করে, জল নিজেতেই আবিষ্ট হয়, মৃদু হয়, শোক, আক্রোশ, পরিতাপ, অনুতাপ, না পাওয়ার যন্ত্রণা, পাওয়ার যন্ত্রণা, পেয়ে ধরে রাখার, হারাবার যন্ত্রণা– সব্বাইকে ভুলে, অথচ সমস্তকেই ধারণ করে…।
আমরা তো আমচোর, বেলচোর, লেবুচোর– নোবেল পেয়েছেন বলে তাঁর বাগানের লেবুর কী দোষ? পকেট পুরে বেরোতে বেরোতে, দেখি চামড়ার চটি, নীল জিন্স, সাদা ফুলশার্ট, তখন কলেজে, বলি—‘জ্যেঠু, একটা প্রণাম করি?’ কাকুর মুখে শুনেছি, হুই এক টকটকে সৌম্যরঙা আলী সাহেব থাকতেন, পেয়ারা পেড়ে রেখে দিতেন, চুরি করতে আসা ছেলেদের বসিয়ে খাওয়াবেন বলে, সংগে দুটি খোশগল্প। সুচিত্রা মিত্রের বাড়ি কুকুর থাকে, গোরা সর্বাধিকারীর ঘোড়া, কণিকা-নীলিমা-সুচিত্রা আসলে তো দিদা, বা জ্যেঠিমা, পৌষমেলায় স্টলে বসে খালি গলায় গান ধরেন—তোমার খোলা হাওয়া, লাগিয়ে পালে– শঙ্খ ঘোষ চুল ছাঁটান বিচিত্রা সিনেমার উল্টোদিকে রাস্তার ধারে, গাছের গুঁড়িতে টাঙ্গানো আয়না, সংগে অর্ঘ্য সেন। গৌরপ্রাঙ্গনে খোলা মঞ্চে ভীমসেন, কুমার গন্ধর্ব, কিশোরী আমোনকার, মান্না দে। আমজাদ বাবুর নাকি ক্লেপ্টোম্যানিয়া ছিল, দুষ্প্রাপ্য এল পি…, একথা যে বলেছিল সে অল্প বয়সেই ফাগুন কুড়াতে ফুলের বনে চলে গেছে। সে কালে আশ্রমমাঠের ধারে জিমের চাতালে বিক্রম গাইত গজল– গুলাম আলি, মেহদি হাসান– কবে যে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে শুরু করল জানতেই পারিনি। মনোজ তো নাচিয়ে ছিল, দোলের আগে আমাদের রিহার্সাল দিত, মণীষা গাইত, ভারী ভদ্র, ধৈর্য্যশীল দুই ভাইবোন। নাট্যঘরে শারদছুটির আগে নাটক, কোনোদিন জারুলতলায় হাত পা অবসন্ন করে দেয়া পন্ডিত জসরাজ।
বিশাখ বলেন, যে মুদ্রার একটি মাত্র পিঠ, সে রাক্ষস নিশ্চয়, গিলে খায়– ঘোড়াশালে ঘোড়া, হাতিশালে হাতি, মায় নটেশাক। ভালোবাসার অপরপিঠে ভালবাসাই চকচক করে তবে আকে ঘৃণা বলেও জানি। বোলপুর হাটের মাছওয়ালা পাঁচশ টাকার চিংড়ি শান্তিনিকেতনী ঝোলায় তুলে দিয়ে আড়াই টাকার পোনা কেনা আমাদের কাছে শান্তিনিকেতনের নামেই গঞ্জনা গায়। পাড়ার পেঁচো মাতালও শান্তিনিকেতনের নেশাড়ুর কেচ্ছা শানায় হলফ করে। ও দেশে যখন লোকে নেরুদা পড়ে, দস্তয়েভস্কি, আমাদের তখন বাবুই দড়ি আর খড়ের হিসেব নিকেশ, খাটিয়ার ছাউনি বোনা, কাঁচা দেয়ালে গোবরমাটির প্রলেপ। ওদেশে বরফ পড়ে, বসন্তে চেরী, আমরা তো রুখা সুখা, শীতে কাঁথা কম্বল নিয়ে পালায় উত্তুরে বাতাস, গ্রীষ্মে কুয়োর পাঁজর গুনি, রিং-এর পর রিং বেরোয়, কাদা, ওদেশে তখনো ধূমসবুজ। বাবার শ্রাদ্ধের দিন কলাভবনের সৌমেনজ্যেঠু আসেন, বাবার নাম ধরে ডাকেন, সমীর সমীর! কাকু গজগজ করে– নেমন্তন্ন করেছি বলেই আসতে হবে, মাতাল, চরিত্রহীন কোথাকার! কাকু কমিউনিস্ট, ইটানগরের কোয়ার্টারে প্রণব আসেন, বাবার বন্ধু, কলেজকালের, অফিসিয়াল ভিজিট, বাবা তখন ওখানকার রাজভবনের নির্মাণ, তদারকী! একসংগে ছবি, দেখে, কাকু গজরায়– তুমি না ফরওয়ার্ড ব্লক? কংগ্রেসের সঙ্গে ছবি?
শান্তিনিকেতন আমাদের অবজ্ঞা, আমরা বদলে আক্রোশ। শান্তিনিকেতনের বাজাড়ু এলেই মোচার দাম বাড়ে, ঝিঙে ফুল শুকায়। দোটানায় পড়ে ভুবনডাঙ্গা, বর্ডার তো, কৃষ্ণগোপাল, মিঠে গদ্যের হাত, বংশাণুক্রমিক দপ্তরী, তস্য পিতা খোদ রবীন্দ্র দ্বারা বিশ্বভারতীতে মোতায়েন, এক সভায় গাল পাড়েন, অপর সভায় পড়েন ঢলে। ব্যতিক্রম ঐ নেপালদার দোকান, বাদ্যযন্ত্র যাই হোক, মুশকিলাসান, স্বয়ং আমজাদ আলি খান যাঁর অনুরক্ত, রবিশংকর, বিলায়েত, বাবা আলাউদ্দিনের স্নেহধন্য, বোলপুর আর শান্তিনিকেতন দুদলকেই কেটার করে চলেন, স্নেহে, বকুনিতে, বোলপুরে ঘরে ঘরে ডোয়ারকিন, ওদিকে সারেঙ্গী, সরোদ।
শুধু আমরা ঐ প্রভাতে পাকিত, জন্মপ্রাকৃতরা জেনে গেছিলাম, কংগ্রেসও হরি, সিপিএমও হরি, বোলপুরও হরি, শান্তিনিকেতনও—রতনপল্লীর রিকশাওয়ালা কংগ্রেস মাহাতোর ছেলের নাম যে নকশাল মাহাতো। রাতে যখন ঘুম আসত না, ঐ বালক ঢুকে পড়ত ঘরে, দিব্যকান্তি। জরির টুপি খুলে ফেললেই, মাথা জুড়ে পাকা ফসল, আবক্ষ দাড়ি, শুধু চাউনি সেই একই। সেই না-বালক আজও বলে—বুঝলি খোকা, তোকে কথামৃতের গল্প শোনাই—সে কালে, পয়সাকড়ি হলে বাগানবাসায় অনেকেই কীর্তনীয়া তুলতেন, সুন্দরী। তা এক বাবুও তুলেছেন, সন্ধ্যায় যান, কীর্তন শোনেন, বাড়ি ফেরেন। একদিন রাত জুড়োতেই বিরহে কাতর, বাগানবাড়িতে পৌঁছে দেখেন, ওই অপরূপা, গামছা পরনে, হাতে গাড়ু, প্রাতঃকৃত্য সারতে চলেছেন, বাবুর তো বাহ্বালোপ—কোনোক্রমে বললেন—তুমি! তুমিও!
শোন খোকা, সবটা নিয়েই জগত, আর ইরিভারেন্স উইদাউট ম্যালিস, এই হল যাত্রা শুরুর কথা। মায়াবন বিহারিনী না বানালে বিহারীলালের ভূত কি অমনি ভাগে? ডিকেন্স পড়েছিস তো, আ টেল অফ টু সিটিস, বোলপুর আর শান্তিনিকেতন এই দুই নিয়েই সে কাহিনী তবে এর একটা টেইল ও আছে, ল্যাজ, আমিই হলুম গিয়ে সেই ল্যাজ। ল্যাজ না থাকলে, বুঝলি তো, গল্পই বা কী, আর বাস্তবই বা কী!
Posted in: October 2020 - Serial, PROSE