সায়ন্তন চৌধুরী-র কবিতা

১.

ভোর চারটের মেট্রোপলিটানে রাস্তাগুলো কেঁপে উঠল
রি-রি হাওয়ায়; প্লেনট্রী থেকে খসে পড়ল
পাতা ও প্রশাখা, যেন দূরে কোথাও
ইউএফও নেবেছে আর অদৃশ্য তরঙ্গ এসে ঘুম
পাড়িয়ে দিচ্ছে দুর্বল স্যাপিয়েন্সদের।
শুধু একজন অবসাদগ্রস্ত ফিজিসিস্ট, আমি দেখলাম,
টেরেসে দাঁড়িয়ে — সে আমাকে লক্ষ্য করল, এবং বলা উচিত,
ওইমুহূর্তেই আমি তার বাস্তবতায় যুক্ত হলাম;
কনভেনিয়েন্স স্টোরগুলি, গ্যাস স্টেশন আর
স্ট্রীটলাইটের সুসজ্জিত আলো,
বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং, ট্রাম্পের টুইট,
সারারাত খোলা থাকে যেসব ক্যাফে ও ম্যাকডি —
মাছিভর্তি টেবিল টিকে রয়েছে বাসী অস্তিত্বের ভেতর।
ফ্যাটফেটে জনহীন মলের আন্ডারগ্রাউন্ড, নিয়নের সাইন,
একা একা রঙ পাল্টানো ট্রাফিক সিগন্যাল —
সবকিছু একটা ভূতুড়ে জাহাজের ডেকে অপেক্ষা করছে
কখন পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরের লাইটহাউস থেকে
এসে পৌঁছাবে হাইড্রোজেন-পোড়া তড়িৎচুম্বকীয় সংকেত;
অথবা একটা আইসিবিএম, নর্থ কোরিয়া থেকে।

২.

শেষরাতের ট্রানজিট; আমি বসেছিলাম আমার জ্যাকেটটা
হাতে ভাঁজ করে, হলুদ হ্যান্ডরেলে ঠেস দিয়ে
একটি কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে ফোনে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলছিল —
যখন একটা স্ক্রিইইইইইচ শব্দ ছুটে গেল সাবওয়ের দেয়াল ঘেঁষে
আর আমার মনে হলো শহরের সারফেসে সবকিছু
পুড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, শুরু হয়ে গ্যাছে নিউক্লীয় উইন্টার;
বাবা-মায়ের কঙ্কাল ডাইনিং টেবিলে মুখোমুখি স্থির,
হাতে চামচ-ধরা: কোনাকুনি ফাটা টেলিভিশন স্ক্রিন।
পপলার গাছের ছায়া আমাদের বাড়ীটার ওপর —
একটা সামান্তরিক ক্রমশ রম্বস হচ্ছে, তারপর বর্গক্ষেত্র
হয়ে ফের সামান্তরিক।
আমার পড়ার টেবিলে বইগুলো পুড়ে যাচ্ছে, বোর্হেসের
কালেক্টেড ফিকশনস, নীলচে কভারটা কুঁকড়ে গেল উত্তাপে।
আন্ডারগ্রাউন্ড টানেলের বাইরে ভোরবেলা বৃষ্টি পড়ছে।

৩.

তিনটে ইনস্ট্যান্ট কফির পাউচ দিয়েছে
হোটেলের ঘরে, যার প্রথমটা আমি গরম জলে
মিশিয়ে খেয়েছি;
আরেকটা খরচ করব কিনা ভাবতে ভাবতে
দেখলাম রাত দেড়টার সময় পর্চে এসে দাঁড়ালো
একটা কালো মার্সেডিজ, কোনো ভিআইপি,
যাকে খুন করবার জন্যে হয়তো
আমার পাশের ঘরে ভাড়াটে কিলার ওঁত পেতে আছে।
কাজটা আমিই করতে পারি, পাশের ঘরের লোকটা
সেইমুহূর্তে ভাবল; তাকালাম আয়নার দিকে।
মাথার ভেতর নীনার স্মৃতি যেন টাইমল্যাপস ফুটেজ,
প্ল্যানেট আর্থ-এ যেমন দেখায়: আস্তে আস্তে
পাপড়ি মেলছে আগুনরঙা র‍্যাফ্লেসিয়া,
শান্তভাবে চাকালাগানো চেয়ারে বসলাম,
কিউবিস্ট পেন্টিংয়ের মতো
নীনার ল্যাংটো শরীর — ঠোঁট আর স্তন,
এখন অবিভাজ্য এই দৃশ্যগুলি। ড্রয়ার খুলে দেখি
একটা শক্তপোক্ত বাইবেল, ব্যাককভারের ভেতরদিকে
আত্মহত্যাকামী চিঠি; গভীর রাতে যখন
শ্লথ হয়ে আসছে ঘড়ির কাঁটা আর
কালো লিম্যুজিনে চড়ে প্রেতাত্মারা হাওয়া খেতে বেরিয়েছে,
বেডল্যাম্পটা নিভিয়ে দিতে দিতে শুনতে পেলাম
ক্লান্ত একঘেয়ে গান ভেসে আসছে পাশের ঘর থেকে —
বিলি হোলিডে, সানডে ঈজ গ্লুমি।
ঘুম পাচ্ছে আমার।

৪.

একটা সময় ছিল যখন আমরা অন্ধকারকে ভয় পেতাম।
অন্ধকার — তার ধূসর স্পেসশিপ নিয়ে নেমে আসছে
পৃথিবীর ওপর; মেরুভল্লুক চোখ তুলে দেখে নেয়
বরফে পিছলে-পড়া সূর্যাস্তের আলো।
আমরা মেট্রোর পুরোনো কাঠের বারে বসে মদ খাই;
একটা সময় ছিল যখন আমরা গুহায় থাকতাম আর
ভয় পেতাম অন্ধকারকে।
এটা কি সত্যিই বৃষ্টি, যা নেমে আসছে আকাশ থেকে
এবং ধাতব সোডিয়াম আলোতে গলে ঝরে পড়ছে
নোংরা অ্যালির ভেতর পার্ক-করা এসইউভি’র ছাদে?
ডকইয়ার্ডে তিনজন লোক পিস্তল তাক করে আছে
এক বৃদ্ধের দিকে: যেন সেন্ট ফ্রান্সিস এক্ষুনি
হেঁটে যাবেন জলের ওপর দিয়ে; যখন ঢেউয়ে
মিনারের ছায়াগুলি লিসৎয়ের সুরে কাঁপতে আরম্ভ করল,
বুলেট ঝাঁঝরা করে দিল বুড়োটাকে — সেইমুহূর্তে
চাঁদ ফেটে গেল একটা থকথকে জেলির টুকরোর মতো,
অ্যামিবার মতো
অন্ধকার, তার নির্যাস কালো গোলাপের পাপড়ি থেঁৎলে
গড়িয়ে আসছে আমাদের ভেতর —
উড়ে-যাওয়া এয়ারক্র্যাফ্ট থেকে আছড়ে পড়ল সোনিক বুম।
চোখ-ঝলমলে হাইরাইজগুলোয় কম্পিউটারের সামনে
বসে আছে টাই-পরা কর্পোরেট কর্মী;
টেবিলের কোণে একটা কাঁচের গ্লাস, অর্ধেকটা জলে ভর্তি,
তরলের রূপোলী প্রান্তে সে তাকিয়ে ইউরি গেলারের মতন।
তার স্নায়ুতন্ত্র জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে ক্যানসারের ডিপ্রেসন,
জানলার বাইরে শহরের আলোকোজ্বল ব্রীজ
আর ফ্লাইওভার, জ্যামিতিক টাওয়ার ও
ডিস্টোপিয়ার রুগ্ন-বেগুনি আকাশ: ভিয়েতনামী রেস্তোরাঁয়
গরম লাইট-শেডে বসে একটি নীল-সবুজ মাছি যেভাবে
লক্ষ্য করে ভোজনরত যুবক-যুবতীদের;
একটা সময় ছিল যখন আমরা অন্ধকারকে ভয় পেতাম।

৫.

একটি কাঁচের গ্লাস, যার তলদেশে
ধরা আছে পৃথিবীর সবক’টা সূর্যাস্তের আলোকবিন্দু,
মাটিতে পড়ে টুকরো-টুকরো হয়ে গেল।
ঘন্টার পর ঘন্টা মাইক্রোস্কোপে চোখ রেখে
যেসব বায়োলজিস্টদের ঘাড় টনটন করছে,
তারা মুখ তুলে দেখল মরচেপড়া করোগেটেড টিনে
নেমে আসছে হাজার বছরের জমানো বৃষ্টি।
শহরের ব্যাকগ্রাউন্ডে মাশরুম ক্লাউড,
লেট ক্যাপিটালিজমের পরিত্যক্ত মেগামেশিনগুলি,
অ্যাসিড, শূন্যতা — অর্ধবৃত্তাকার!

Facebook Comments

Leave a Reply