রঙ্গন রায়-এর কবিতা

হেমন্ত

জানলার নিচে মুরগির খসখস শব্দে এখন আর বিরক্ত লাগছেনা এতটুকু
আলতোভাবে বিকেল নামছে, এরপর ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে পড়বে –
এক অদ্ভুত মন খারাপ আছে এই হেমন্তে
উপভোগ করা যায়, উল্লাস করা যায় না –
প্রতিটি পাখির ভেতর যেন এস্রাজের সুরের মত ছড়িয়ে গেছে ঋতুমতী
না হওয়া হেমন্তের দুপুর –
তারপর রেসকোর্স পাড়ার দিকে, শহরের বাইরের দিকে, মানুষের
আলগা হয়ে আসা ভীড়ের থেকে দূরে, আরোও দূরে …
রিক্সা থেকে আমার লাফ দিতে ইচ্ছে করে,
যেকোনো চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়
আমি ভালো আছি –
আমার কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নিলেও; আমি ভালো আছি –
কিন্তু একথা সবাই জানে ভালো থাকার কথা কেউ চিৎকার করে বলেনা কখনো
আমার সত্যিই ভীষণ অস্বস্তি হয়,
রেসকোর্সের এদিকে এখনো রয়ে গিয়েছে ইউরোপিয়ান বাড়ি
ফাঁকা নির্জন একা একা বাড়ি – গাছের খসা পাতা – বিলিতি আলোর শেষ বিন্দু
তার মধ্যে দিয়ে রঙিন পোশাকের নরনারী হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাচ্ছে
ঊনবিংশ শতাব্দীর দিকে —
আমার এসব একদম ভালো লাগেনা, ভালোবাসার ভেতর ভালোবাসাহীনতা দেখি
এমন সময় তুমি বোলপুর থেকে আদিবাসী মেয়েদের নাচের ভিডিও পাঠাও,
সেই সুর আমার মধ্যে আসে, অদ্ভুত ঘোর তৈরি করে ভেতর ভেতর
প্রখর ইউরোপীয় পাড়ায় বসে পাই
আদিবাসী মেয়েদের চুলের গন্ধ, মাদলের শব্দ —
অথচ চারপাশের ইউক্যালিপটাস সাদা মুখো সাহেবের মত
আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে, হাসতেই থাকে

বাঘ

নেপালিবস্তির মোমোওয়ালা যেদিন বলেছিল – আগে এখানে বাঘ বেরোতো সন্ধ্যা হলেই
আমি দুদ্দাড় দৌড়ে তোমার কাছে চলে গিয়েছিলাম, মনে হয়েছিল
সারা রাস্তায় যেকোনো ঝোঁপের ধারে বাঘ গুঁড়ি মেরে বসে অপেক্ষা করছে মাংসের;
অথচ তোমার বাড়িতে মাংস চড়েছে রান্নাঘরে,
তীব্র গন্ধে মম করছে আমাদের সুচতুর খিদে —
মুখ টানটান করে হাই তুলছে দরজায় বসে থাকা তোমাদের কুকুর
তার পা দিয়ে কান চুলকোনোর শব্দে দেখি
মাথা নিচু করে সান্ধ্যকালীন অফিস ফেরতা মানুষ
যন্ত্রের মত হেঁটে চলেছে রাস্তায়, গা দিয়ে ঘাম ও সিগারেটের গন্ধ —

আমি থমকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জীবন দেখি,
এরা কেউ বাঘের ভয় পায়না
এখন আর বাঘের কোনো ভয় নেই –
নিচু আলোর ল্যাম্পপোষ্টের তলে টিউশন পালানো ছাত্রছাত্রী
চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে হাত ধরে,
এইমাত্র বাড়িতে তোমার বাবা ঢুকলেন – মা হাতজোড়া রান্না নিয়ে এসে
দরজা খুলে দিতেই দুজনের ক্লান্ত চোখে সংসার সকালের সূর্যের মত
ঝিলিক দিয়ে উঠলো —

স্তব্ধ এই সন্ধ্যাবেলায় আমি অহেতুক শুধু বাঘের ভয়ে পালিয়ে বেড়াই,
জানিনা আজ এই সময়ে নেপালি বস্তির নেপালি মোমোওয়ালা
আমায় আরোও ভেতরের দিকে নিয়ে যাবে কি না –
যেখানে রোজকার জীবন আমার বয়স বেড়ে যাওয়ার মতই দুঃখ ও আনন্দদায়ক

Facebook Comments

Leave a Reply