পূবালী রাণা-র কবিতা
কথামালা
কথা হত অনর্গল,
কথা হত সতীপীঠের নীরবতায় ।
বেসুরো রবীন্দ্রসঙ্গীত মনে বেজে উঠত
সাঁওতাল পরগনার মতো নিস্তব্ধ
স্বপ্নশব্দ গাঁথা মালায় অনিঃশেষ স্বরলিপির
এক অখণ্ড প্রহর ছিল আমাদের
ব্যস্ততা, ক্ষুদ্রতা, অসাম্যতার মধ্যেও তৃষ্ণার্তের
এক আজলা জল ছিল আমাদের ব্যক্তিগত সম্পদ,
কারণে অকারণে ছোট্ট ঋতুপাখি খুঁটে খেত আমার অকাল বসন্ত।
টুপ টুপ করে বকুল ঝ’রে পড়ত।
রাশি রাশি ঝরা বকুলেরা নীরবতার ভাষায় বলতঃ
“তোমায় ভেজাব বলেই দাঁড়িয়ে আছি অনন্তকাল।’
বিধবাগোধূলির মতো আজ আমার চিলেকোঠার আকাশ
সেখানে রঙ বেরঙের ঘুড়ির নেই অস্তিত্ব ।
চিলেকোঠার অন্ধকার ঘরে আমি একা থেকে দেখছি
হৃদয়খুনি হাতে তুমি গুছিয়ে রাখছ আমার শব,
দিগন্ত পারের কোনো এক ঝাঁ চকচকে অট্টালিকায়
তখন সন্ধ্যা নামছে, তুমি সেই অট্টালিকার সম্রাট
আমি দাসী সেজে জুগিয়ে যাচ্ছি তোমার নেশার সামগ্রী
নারী
আমার ঘুণ ধরা কাঠের ঘাটে, ছারপোকা ভরা বিছানায় তার ছিল অবারিত যাতায়াত। সে ছিল আমার পুরুষপ্রতিভা, সে ছিল আমার শীতল জীবনে রক্ত-উষ্ণের ফায়ারপ্লেস । সোনালি রাঙতায় মোড়া বনেদি দিনে নয়, বৃষ্টিমুখর সেতার সন্ধ্যার দিনে সে ছিল আমার বিষুববলয়। ডাকাতিয়া প্রেমের জ্বরে হাডুডু খেলা আর বৃষ্টির মন্থনে ভেসে যাওয়া ছিল সেই মধুমাসে । আমার মনিপদ্মের মন্দিরে তখন বাজত হাজারো কাঁসরঘণ্টা। আমার সমুদ্রনেশা বুকে সহস্র মশাল জ্বালিয়ে সে ছুঁয়েছিল সম্ভোগের আঁতুড়ঘর, অরণ্য প্রবাদের মতো হাজার পাখি বসেছিল চোখের অরণ্যে ।
আগ্রাসী স্রোতের নেশায় যেমন ক’রে ভাঙে নদীর পাড়, যেমন করে ডাঙার মাটি মিশে যায় জলসোহাগী নদীর বুকে, তেমন করেই ভেঙে পড়ছিল আমরা এক একটা মাটিস্তম্ভ! আমার ললিতকলা বুকে, আমার অজাতশত্রু কোমরের ভাঁজে আঙুলের ছোঁয়ায় সে এঁকেছিল সূর্যোদয়!
আমিও আকাঙ্ক্ষার বাস্তুভিটায় এতদিন আত্মগোপনে ছিলাম, সেদিন তার লোমশ বুকের ভাস্কর্যে খুঁজে পেয়েছিলাম বেরোনোর পথ । ঝড়বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরে তার নিজস্ব শরীরী গন্ধে খুঁজে পেতাম এক অপার্থিব সুখ,
আবহমানের এই পিপাসার ভাষা প্রতিটি মেয়েই জানে গোপন সোহাগে।
প্রতিটি প্রেমই অস্তরাগের সূর্যে রেখে আসে আগামী দিনে প্রত্যাশা । অথচ, মেঘের আড়ালে একদিন নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় সূর্যোদয় । সন্ত্রাসী প্রতিহিংসার বুলেট এসে ঝাঁঝরা করে দিয়ে গেল হৃদয়গ্রন্থী। বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকের বাগান খোলার প্রতীক্ষার মতো এক একটা অস্পৃশ্য রাত কাটিয়ে বুঝতে পারতাম, এইসব বহুজাতিক কোম্পানির ছলনা। অন্য লাভদায়ক ব্যবসায় মত্ত সে এখন।
জীবন্ত মাছেদের খেলাঘরে অগণিত নিষ্প্রভ মৃত মাছের চোখ থাকে কি? একুরিয়ামের মাছ শূন্য দৃষ্টিকে চেয়ে থাকে নদীর দিকে? সাঁতারের আমন্ত্রণ তাকেও কি পাঠায় বন্দি সময়! এইটুকু কাচঘর ভাঙতে পারলেই কি মেলে নদীর ছোঁয়ার প্রার্থনা! পেক্ষাগৃহে অভিনয় শেষে মুখের রঙ তোলা অভিনেতার মতো নিজেকে মনে হয়! যতক্ষণ রঙ ছিল, ছিল লোক মনোরঞ্জনের অভিনয়!
দর্শকহীন পেক্ষাগৃহের অভিনেত্রী যেন আমি এক, যার অভিনয় ছিল, শেষ হলে সেও সাধারণ মেয়ে এক।
প্রেমের ন ঘূর্ণাবর্তে খাবি খেতে খেতে পেয়েছি চোরাবালির অতলস্পর্শী ভূমিপ্রেমিককে এবার ! প্রেমে করলে মেয়েরা সীতার মতো আত্মত্যাগ লেখে পাতালের চিরস্থায়ী আসনে বসে । এই জন্ম পেয়েছিলাম, হে প্রেমিক রাম,
যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে যাও, নারীরাই আগুন ও ছাই ।
শ্বাপদ
খুব বেশি ভয় করলে চেনা ডাকঘরও কেমন অচেনা মনে হয়। নিজের ঘর ঘর নয়, নিজের দেশ দেশ নয়। কখনো প্রশ্নহীন উত্তর কখনো উত্তর হীন প্রশ্ন!
মিথ্যে দেশপ্রেমের লহরে ডুবে যায় শান্তির প্রাসাদ। যারা যুদ্ধ চায় তারা জানে না দীর্ঘ প্রাচীরের ওপারে হাই তোলে নেকড়ে। নখর বিস্তৃত বেলাভূমি। লাল চাদরে আবৃত ঘুমন্ত ফুটপাত। চারিদিকে শুধু বিভ্রান্তির কুয়াশা। আমরা সবাই তুরুপের তাস। রাত্রির প্রান্ত ছিঁড়ে যায় শ্বাপদের ক্রুর আগ্রাসনে। দুঃস্বপ্নের মত অন্ধকার। গাঢ় কালো ছায়া।
আবার একটা অন্ধকার যুগ আমাদের পেরোতে হবে। কতটা সময় তা জানা নেই।
Posted in: October 2020 - Cover Story, POETRY