বর্গভীমা ও শোলমাছ : কবি রঞ্জিত সিংহ : এক উপমঞ্জরির কাঠিন্য ও অম্লতা – প্রশান্ত গুহমজুমদার
মানুষই সব কিছুর মানদন্ড- প্রোটাগোরস জানালেন।
হাক্স্লির ভাষায় ‘… to be a self is the original sin, and to die to self, in feeling, will and intellect, is the final and all-inclusive virtue…’.
ব্যক্তি এবং ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্ব, সংকট, প্রকাশ ইত্যাদি বিষয়ে অনেক কবি সাহিত্যিকই এমন দোলাচলে। কবি রঞ্জিত সিংহ এই দর্শনের, এই ভাবনার কতদূরে? আমিত্ব বিষয়ে অনিশ্চয়তা, সমষ্ঠির আর্শিতে আত্মদর্শন, অপর মানুষ যখন বিশ্বসিত, অথচ তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের অক্ষমতার সংকটে কতখানি আক্রান্ত কবি? তাঁর এ যাবৎ সৃষ্টি, একটি কাব্যগ্রন্থ ‘বর্গভীমা ও শোলমাছ’- পাঠককে, আমাকে কবি-র রচনার কাছে নিয়ে যায় বারবার এই সন্ধানে। জানি, সবটুকু সীমাবদ্ধতা নিয়েও প্রস্তুত হতে হয় এই কবি-র কবিতায় অবগাহনের জন্য। শিক্ষিত হতে হয়। সেই শিক্ষা, অভিনিবেশ, চেতনা অর্জনের সচেষ্ট হই। ভালোবাসার তাগিদেই অনন্যোপায় আমি। কিন্তু কতটুকু দীক্ষিত হওয়া গেল সে প্রয়াসে? সে উপযাচন কি আদৌ সফল হয়! কবিতার সত্য বুঝি মৃত্যু-র মত! কল্পনা করা যায়, অভিজ্ঞতা বা এ যাবত প্রকাশিত দর্শন-এর সাহায্য নেওয়া যায়, বহু বহু পাঠ করা যায়, ফিরে ফিরে, তবু তার রহস্যময়তা ক্রমে অধিকতর মধুর হয়ে ওঠে। অগত্যা সে আপাত-সরল সত্য যা কিনা চেতনায় অপূর্ব অধরা, তার সমীপবর্তী হওয়ার ব্যগ্রতায়, কেবল ব্যাকুল হওয়ার কারণে, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আশ্রয় করে স্পর্ধা করি, হাজির হই রঞ্জিত সিংহ রচিত শব্দসমূহের সামনে, তাঁর অনুভবের, তাঁর অভিজ্ঞতার, আর্ত প্রাণের, তাঁর কবিতা-র কাছে। কবি-র কাছেই তো জেনেছি, ‘… ‘না’ বলতে একেবারে যেদিন ভুলতে পারবে,/ সেদিনই ‘হ্যাঁ’-এর যাত্রারম্ভ, অরুণোদয়,/উদিত সবিতা, গায়ত্রী মন্ত্রের ধ্বনি বেজে চলবে/ অহোরাত্র শরীরের কোষে কোষে। কুলকুন্ডলিনী/ দ্রৌপদী জাগ্রত হবেন তোমার শরীরেও।‘ মৃত্যুকে তথা সত্যকে অনুসরণ করে নশ্বরতাকে, অবসান সত্য মেনে নশ্বর অস্ত্বিত্বের শরীরে কেবল এই অপটু করতলটুকু রেখে দেওয়া। স্পর্ধা তো করা যেতেই পারে!
রঞ্জিত সিংহ, এই নামটির সঙ্গে, তাঁর কবিতার সঙ্গে পরিচিতি আমার সেই তরুণ বয়সে। যখন ‘পূর্বমেঘ’, যখন ‘এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা’। সে হবে ’৬০-এর শেষ দিকের গল্প। ইতিমধ্যে সময় গড়িয়েছে। ক্রমে তাঁর প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছি। অনুসরণ করেছি। দেখলাম, অনেকটা পথ হাঁটার পর বোধে যখন তিনি একা, আক্রান্ত, আর্ত, তিনি নিজেকেই আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন ‘…নিজেকে ভালোবাসতে শেখো…/ সকলকে ভালোবাসতে পারলেই/ নিজেকে ভালোবাসতে জানবে; জানবে তুমি কে?/ কি সব ধনরত্ন খুঁজছো বাইরে, যা তোমার ভিতরেই/ পূর্ণ ভাবে বিদ্যমান…।’ এই পূর্ণতাকে জানার পথে পথে বহু উপলব্যথিত অভিজ্ঞতা ক্রমে সঞ্চয়ে তাঁর। খোঁজ কিন্তু চলেছেই। কবি ক্রমে চারপাশের জায়মানতাকে পাঠ করতে প্রয়াস করেছেন, কখনো মমত্ববোধ দিয়ে, কখনো পূর্বজ কবির চোখ দিয়ে, কখনো বা ভয়াল তন্ত্রের শিক্ষায়। ক্রমে সেসব অভিজ্ঞতায় নিজেকেই কবি আবিষ্কার করেছেন। এবং জেনেছেন, ‘…একজন সেই শাপভ্রষ্ট দাহিকাশক্তি,/ দহনের কর্ম নিয়ে আমি এখানে প্রেরিত।/ আমি দাহ, দাহ্য, দাহিকা একাধারে। …’। এই একাকীত্ববোধ, এই উপলব্ধি তারপর দেখেছি, কবিকে, ক্রমশ নিয়ে গিয়েছে ত্রাসমিশ্রিত বিচিত্র তন্ত্র সন্নিধানে, কখনো বহুদূরের ভালোবাসায়, কখনো বা নিয়তিবিশ্বাসে, আধিদৈবিক চেতনায়। এবং সতত ক্লান্তিহীন চেতনায় মানুষের কাছে। তাঁর কবিতা গ্রন্থে, যার সংখ্যা অন্তত ১৪টি, এমনটাই ক্রমে পেয়ে থাকি। আর অন্তে সে সবের অন্তর্মাধুর্য, শোক, আশ্চর্য ভালোবাসা আমাকে ধীরে গ্রাস করে। ‘বর্গভীমা ও শোলমাছ’ বইটির ২৯টি রচনায় ব্যতিক্রম অভিজ্ঞতা কিছু ঘটে না। আমি আচ্ছন্ন হয়ে থাকি।
এই পরিব্যপ্ত পরিস্থিতিতে পুনরায় পড়তে থাকি বইটির প্রথম নির্মান।
জ্যৈষ্ঠমাসের মাঝদুপুরে চড়া রোদে
হুমড়ি খেয়ে পড়ে আমার জীবনটা।
একে নিয়ে কী যে করি, কোথায় যাই?
চতুর্দিকে মানুষজন, বেচাকেনা, দরদস্তুর,
কেউ আমাকে চেনে না, আমিই কি ওদের চিনি?
শুধু একটা হাসির শব্দ, নারীকণ্ঠে ঝর্না হাসি,
হাসি আমার মায়ের নাম, দেখি নি তাকে,
সেও আমাকে দেখে নি, তবু আমরা মা ও ছেলে।
#
কালবোশেখের বাজপড়া তালগাছটার মতো
ফোঁপরা একটা শরীর পানাভরা ডোবার জলে।
কাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
চতুর্দিকে নারীকণ্ঠে ব্রাম্ভণী নদীর কলকল হাসি,
হাসি আমার মায়ের নাম, কেউ কাউকে দেখি নি,
তবু আমরা মা ও ছেলে।
সার্বিক বিপন্নতা ছবি হয়ে থাকে শব্দে, শব্দে। রহস্যময়, নাটকীয়, অথচ সংহত। অসমাপ্ত। অকরুণ। পানাভরা ডোবার মতো এই জীবনে, সোজা ন’ন, বাধ্যতাহেতু কিছু বেঁকে টিকে থাকা। কবি-র। পণ্যায়িত যাপনের স্বাভাবিক হট্টগোলে, আপাত চেনা মানুষের অরণ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা বঙ্কিম জীবনে নিরাশ্রয়। কেউ তাঁর জন্য অপেক্ষায় নেই, তিনিও তেমন নির্ভরতা পেলেন কই! সেই আবিল পরিস্থিতিতে, সেই ধূসর ব্যপ্ত চরাচরে
‘ শুধু একটা হাসির শব্দ, নারীকণ্ঠে ঝর্না হাসি,
হাসি আমার মায়ের নাম, দেখি নি তাকে,
সেও আমাকে দেখে নি, তবু আমরা মা ও ছেলে।
–যেন নিছক উচ্চারণ নয়, আজীবনের আশ্রয়ের জন্য এক নোনা হাহাকার। পটে আঁকা বহুমাত্রিক সাদাকালো এক ছবি। মুঙ্ক-এর সেই আর্ত ‘The Scream’ ছবি মনে পড়ে। যেন রক্তমাখা আকাশের নিচে বয়ে যাওয়া প্রকৃতির অন্তহীন কান্না। মনে পড়ে ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’। অপ্রতিরোধনীয় ওই ‘হাসি’ শব্দে বিপন্ন হই। ওই শব্দ কি নিছক কৌতুক, নাকি উপহাস কিংবা ভয়! অথবা আশ্রয়ের আশ্বাস! যেহেতু ওই অনির্দিষ্ট ক্রিয়াপদ মনে করিয়ে দেয় ‘…হাসি আমার মায়ের নাম, দেখি নি তাকে, …’। যত নিবিড় হতে থাকে চারপাশের অন্ধকার, ফিরে ফিরে আসি এই কবিতাটির কাছে। একান্তে সে শব্দসমূহের শরীর থেকে বিকিরিত আলোর জন্য। যেন বা অনিবার তাড়নার বিরুদ্ধে, অবহেলার বিরুদ্ধে এক আর্ত মানুষের অস্বীকারের নিজস্ব অথচ তীব্র অনন্য মুদ্রা।
ন্যূনতম কোন ক্রম গ্রাহ্য না করে তাঁর কবিতায় চলতে চলতে মনে হয়েছে, জীবনের জন্য, মনোভূমির সামান্য আশ্রয়ের জন্য, ভালোবাসার জন্য তাঁর খোঁজ অশেষ। পারিপার্শ্বিক বিচিত্র অথচ ফাঁপা চলমানতা কিংবা স্থবিরতার চিত্র তার লেখায় বারবার পাই আর মনে পড়ে জীবনানন্দের সেই উচ্চারণ ‘…মানুষটা ম’রে গেলে যদি তাকে ওষুধের শিশি/ কেউ দেয়-বিনি দামে-তবে কার লাভ-/…’। এই বেদনাবোধ সর্বক্ষন কবিকে তাড়না করে। তিনি লিখতে প্ররোচিত হ’ন ‘…যার যা অক্ষমতা, নিজের চেয়ে কি বেশি জানবে অন্যে?/ সমস্ত জীবনটাই তো কর্মনাশা নদী, নদীর দু’ধার বুনোগাছপালায়/ঠাসাঠাসি, ফুল ফোটে না, পাখি বসে না, বসন্তে নতুন পাতা/ জন্মায় না, চৈত্রে পাতা ঝরে না।/ শুধু শেয়ালের উঁকিঝুঁকি, বুনো বেড়ালের চুরিচামারি,/ ভামের নষ্টামি, কালাচের ফোঁসফোঁসানি।…’। ফলত, তিনি ক্রমে অনিকেত। তাঁর চারপাশে বয়ে যেতে থাকে ‘একেবারে নিশ্চিহ্ন’ করে দেওয়ার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বাতাস। তিনি লেখেন ‘…আমি আছি কি নেই, কারুর খেয়াল নেই, কেউ খেতেও দেয় না/ সবুজ গুল্মের গুহা জলের তলায়, সেখানে শুয়ে পড়ি। …’। এ কেমন আধিভৌতিক শোক!
দীর্ঘ ৫০ বছরের কবিজীবনে কবি চলন বদলেছেন, নানান বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করেছেন পথ, দর্শন-ও স্বভাবতই বদলে গিয়েছে তাঁর। এলিয়ট এবং ইয়েট্স্-এ নানানভাবে তিনি পুনর্জীবিত। ক্রমে তাঁর প্রতীতি জন্মেছে যে, বাঁধা সড়কের পথ ছেড়ে, যেহেতু সংহত লিরিকের পথ তাঁকে আর তৃপ্তি দিচ্ছে না, তিনি পা রাখলেন লিরিকবিরোধী পথে। সঙ্গে থাকলো জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং নিয়তিবাদ। ফলত আমরা পেয়ে যাই মানুষের বিত্রস্ত জীবন, ব্যঙ্গ শ্লেষ মিশ্রিত বিচিত্র মুখোশ-মন্ডিত সামাজিক চিত্র, আত্মপরিচয়ের সংকট, যৌনতা, প্রেম, মৃত্যুচেতনা, কথ্যছন্দের অপরূপ চলন। কয়েকটি কবিতার অংশবিশেষ পাঠ উপরোক্ত ধারনার পরিপূরক হতে, আশা করা যায়, বিঘ্ন ঘটাবে না।
ঘনশ্যামদার মুদির দোকান লুট হয়েছে, সাহাবুদ্দিনের
মুরগির পোলট্রি ভেঙে মুরগিও লুট। ক্ষুধার বিকল্প নেই,
ক্ষুধার ভাষা নেই। ক্ষুধা কাউকে মান্যতা দিতে জানে না। (কালগ্রাসী করলা নদী)
এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে এসেছে মানুষের শান্ত জীবনে এবং আবাস কিংবা পরিধান নয়, কবি দেখছেন, ক্ষুধা, স্রেফ ক্ষুধা বদলে দিয়েছে আক্রান্ত মানুষকে। সেখানে সে একা, স্বার্থপর। মৃত্যু যতই অনিবার্য হোক না কেন, ক্ষুন্নিবৃত্তি সেই ভাষাহীন লড়াইয়ে একমাত্র ভাষা, একমাত্র অস্ত্র। সে যে বাঁচতে চায়! সত্য নয়। মৃত্যুকে নয়।
আর চারপাশের নাগরিক পৃথিবীটাকে কেমন দেখলেন কবি! সেই দেখা-ও এক অনন্য দর্শন।
‘…ওঁর বাড়িটা ছিল কেওড়াতলা শ্মশানঘাটের গায়ে, একদিন
এমনি গিয়েছি দেখা করতে, অনেক পরবর্তীকালের ঘটনা।
তখন খুব বুড়ো হয়ে গেছেন, হাঁটতে চলতে কষ্ট হয়, ম্লান হেসে
বললেন, ‘বসো রঞ্জিত, চা খাবে? ‘একক’-এর ৫০তম সংখ্যায়
একটা কবিতা দিও।‘ দিয়েছিলাম।
##
‘শরীর আপনার কেমন আছে, শুদ্ধদা?’ ভালো না, এবার গেলেই হয়।
অসুবিধে নেই, পা বাড়ালেই শ্মশান। শববহনের জন্য জনা চারেক
লোক, খাটিয়ায়, ব্যাস্।(শুদ্ধদা)
‘…নির্মাল্য ডাক্তারকে সেদিন জিজ্ঞেস করলাম, বললে,
আপনার বন্ধুর মাথায় যা ঢোকে, বেরুতে চায় না।
কাকাতুয়া বললে, ছাড়ো তো নির্মাল্যের কথা, কতগুলো
পুরোনো থিয়োরি নিয়ে বসে আছে। ওর কথায় আলু খাচ্ছো না তো?
বুঝবে, দেরি নেই, আমেরিকা বলে দেবে, আলু খাওয়া, মাস্ট্-মাস্ট্-মাস্ট্,
তা না হলে আলুর দোষ হবে।(কাকাতুয়া)
এমনই দেখি। দুঃখ, শোক, কৌতুক, বিদ্রূপ, নাটকীয় প্রকরণ তাঁর কবিতায় অক্লেশে পা ফেলে। অসংগত, বাহুল্য মনে হয় না এতটুকুও। বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় ভাষার চলন।
‘…সায়াহ্নের দোরে টোকা দিতেই, দোর খুলে গেল, ব্রেন ডেথ
হলে যা হয়, সব অন্ধকার, অন্ধকারের ভিতরেই গভীর জঙ্গল,
একটা রোগা নদী, জলহীন কঙ্কালসর্বস্ব জলাধার,
পাখির বাসায় সাপ, সর্বত্র অচেনা অথচ চেনা মুখের ছায়া।
##
তোমরা কে? কোনো উত্তর নেই। চোখভরা জলে চেয়ে আছো?
বলছে, তুই তো এখন আমাদেরই, ওদের কেউ নস আর।
তখন তো তোর চোখ ছিল, দৃষ্টি ছিল না।
এখন দৃষ্টি আছে, চোখ নেই। (সায়াহ্নের চোখ)
সায়াহ্নের দুয়ারে এসে দ্রষ্টব্য আর দর্শক, এপাশ আর ওপাশ একাকার হয়ে যাচ্ছে। মিশে যাচ্ছে অন্ধকার আর আলো। অলৌকিক এক দৃষ্টি তিনি পেলেন অবসানে এবং ‘তোমরা কে’ – এ প্রশ্ন হয়ে পড়ল বাহুল্যমাত্র। আমরা অবগত হই, চোখ দৃষ্টির সহায়ক নয়। দেখা আর বোধ-এ গ্রহণ, একই কর্ম নয়। সায়াহ্নে কী এমনই প্রাপ্তি নির্দিষ্ট আমাদের জন্য! কবি কিন্তু আমাদের সামনে এই সত্যই তুলে ধরতে প্রয়াস করেন!
…সেই তুমি মরে গেছো কবে কতদিন আগে, মনে পড়ে?
এখন এসেছো আমি হ’য়ে, বসো, নিভৃত হও, এই প্রথম তুমি
তমালতরুর অসংখ্য দীর্ঘ, দৃঢ়, পুষ্ট বাহুতলে বসতে এসেছো।
আমি হ’য়ে বসো। (পোষাক-বদল)
এক অনবদ্য উদ্ঘাটন! সরল রেখায় চলতে চলতে তাঁর কবিতা জ্বালিয়ে রাখে এমনই সব অবিজণাপিত আলো। পাঠের পর আমূল বিমূঢ আমি পুনরায় পাঠ করি সে নির্মান।
‘…হরিপদ, হরিপদ, কারুর কথায় কর্ণপাত আর নয়, চলো,
নিভৃত হয়ে চলো, তোমার পিছনের বর্ণমালা সব মুছে গেছে।(পিছন নিও না)
কবি এক সাক্ষাৎকারে কবি প্রদীপ চক্রবর্তীকে জানিয়েছিলেন, …একটি কবিতার উংকর্ষ নির্ণয়ের অন্যতম মানদণ্ড কবিতাটি একই সঙ্গে সময় সংলগ্ন ও সময়-অতিক্রমী কিনা…। আরো বলছেন, …একটি কবিতা যখনই চিরন্তনতায়, সার্বভৌমত্বে উত্তীর্ন হয় তখনই তো কবিতাটির আবেদন বিশ্বগত।
এই অভিজ্ঞতার আলোয় ‘বালির পাঞ্জাবি, কুয়াশার আলোয়ান’-এর কবিতাংশ পড়া যেতে পারে।
‘…হঠাং বালির পাঞ্জাবি, কুয়াশার আলোয়ান, কানা চোখ,
তোবরানো নাক, সারা পায়ে ব্যান্ডেজ জড়ানো, দুর্গন্ধ,
একজন লাঠি-ভর বিশাল কঙ্কাল ওর বেডরুমে।
ঐ মানিকের গলায় সে বলছে ‘আর কতদিন এভাবে চলবে মানিক?’
…
ইন্দির ঠাকরুণ ফোঁকলা দাঁতে গাইছেঃ
‘হরি, দিন যে গেল, সন্ধে হল, পার করো আমারে।‘’ (‘বালির পাঞ্জাবি, কুয়াশার আলোয়ান)’
সময় গড়িয়ে যায়। বালিঘড়িতে ক্রমে নিচে জমতে থাকে বালি। আর নাগরিক জীবন ক্রমে প্রবেশ করতে থাকে এমন এক যাপনে, যা অতিক্রম করে যাওয়ার পথ তার আর নেই। সেই বিবিধ গ্যাজেট, শারীরিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, আলস্যে মানুষ ক্রমশ স্বেচ্ছাবন্দী। এই পরিধির বাইরে যে জীবন, সে অত্যন্ত অবিন্যস্ত, অসহায়, একা, আর্ত। বিবর্ণ আকাশের নাস্তি-সময় নিশ্চিত উর্ণনাভ দিয়ে গ্রাস করে, অনিবার্য নিয়মেই তাকে, তাঁর সর্বস্ব। অন্ধকার নিশ্চিতভাবে ব্যক্ত হয় সমগ্র শহুরে যাপনে। নিঃসংশয় ইন্দির ঠাকরুণ কিন্তু চিরদিন সন্ধ্যার আগমনের ঘন্টা বাজিয়ে সতর্ক করে চলেন। আর অন্ধ, ঘুমন্ত নাগরিক ক্রমে হারিয়ে যান অনিবার্য জঞ্জালের মধ্যে।
‘দরজা’ শীর্ষক কবিতা আমাদের এক নাটকীয় উদ্ভাসের কথাই বলে। ‘কি করে জানলে? হাসতে হাসতে মেয়েটি ঘোর বর্ষার / জল থৈ থৈ।/ সারারাত পায়চারি, জলে জলাকার, গোড়ালিডোবা জল।/ কোথাও সে নেই। কী হলো, কী হলো বলো তো?/ পরদিন সকালেকুসুম মানে ঐ মেয়েটি যথারীতি রান্নাঘরে।/ চোখের গভীরে হাসি। বহুদিন আগে নাকের ওপর/ যে দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, চোখের ওপর সেই দরজা/ আজ যেন খুলে গেল।‘
এইসব নির্মাণ কি একই সঙ্গে সময় সংলগ্ন ও সময়-অতিক্রমী নয়!
এক সদা-জাগ্রত কবি এমন সব অনুভব করেন, দীর্ন হতে থাকেন, আপ্রাণ চেষ্টা করেন আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা আপীড়িত মানুষের পাশে বসতে। অথচ মানুষই ফিরিয়ে নিয়েছে মুখ বারবার। অব্যক্ত যন্ত্রণায় কবি বলে ওঠেন,
অবাঞ্ছিত, রঞ্জিত সিংহ, অপ্রয়োজনীয়, যার সঙ্গ
শুধু বর্জনীয় নয়, যার কাছে গেলে গন্ধগোকুলের
একটা অস্বস্তিকর গন্ধ, যা মানুষকে ঠেলে সরিয়ে দেয়,
কাছ ঘেঁসতে দেয় না।(সবুজ একটা বিন্)
অথবা,
…কার অভিশাপে আমি বাদুড় হয়ে গেছি? ফল খেতে মানা,
বাড়ি ঢোকা মানা। কে যেন আমার পিঠে ‘ট্রেসপাসার’ কথাটা
কাগজে লিখে সেঁটে দিয়েছে। আমি কে? বহুদিন ভুলে গেছি।
এমন অজস্র লবনাক্ত অনুভব এই তিন ফর্মা-র গ্রন্থে কবি বেঁধে রেখেছেন আমার জন্য। প্রবল এক কষ্ট ক্রমশ গ্রাস করে আমাকে। কবির সঙ্গে মন্ত্রের মত বলতে থাকি,
…আমি ভাঙাভঙ্গুর শব্দালংকার মাত্র। পড়ে আছি একপাশে।
ইচ্ছে করে একবার বলি জ্যোৎস্নার ছেলেকে, বর্গভীমার মন্দিরে
একবার নিয়ে যেতে পারিস? মাকে ছাড়া আমার কষ্টের কথা
বলবো কাকে? জিজ্ঞেস করবো শুধুঃ যাকে আমি খুব ভালোবাসতাম,
সে কি তুমি? নাকি সেই নারী যার মধ্যে তোমার গর্ভগৃহ?
ক্রমে তাঁর আশ্রয় হয়ে ওঠে মা, এক বিমূর্ত অথচ অসীম এক অস্তিত্ব। আর্ত শিশুর যেমন। অলীক উষ্ণতায় নিজেকে জড়িয়ে মুড়ে আশ্বস্ত করতে হয় নিজেকেই।
‘…কাব্য হইতে কেহ বা ইতিহাস আকর্ষণ করেন, কেহ বা দর্শন উৎপাটন করেন, কেহ বা নীতি, কেহ বা বিষয়জ্ঞান উদ্ঘাটন করিয়া থাকেন, আবার কেহ বা কাব্য ছাড়া আর কিছুই বাহির করিতে পারেন না…। – রবীন্দ্রনাথ । এই সহজ বাক্যনিচয় আমার আশ্রয়। এই নিয়েই কবিতায়। ফলে আর কোনো সঙ্কট থাকে না কবি রঞ্জিত সিংহের কবিতার শব্দে শব্দে অকুতোভয় ভ্রমণের। আর অহোরাত্র অবগাহন ঘটে। সে যে কী আনন্দ! দুঃখের মধ্যেও তো এক অপূর্ব আলো থাকে, এক আনন্দ, সে আমি পেতে থাকি তাঁর এই ২৯টি রচনায়। এমনই বিষাদবিধুর অথচ ‘সময়জ্ঞানহীন’ আনন্দ পেয়ে যাই ‘পিছন নিও না’ শীর্ষক কবিতাটিতে। অপার প্রকৃতিকে প্রেক্ষাপটে নিয়ে এক অলৌকিক গন্তব্যবিহীন যাত্রায় ‘নতুন অক্ষর সজ্জায় নিরক্ষরের মতো’ কবি ‘সময়ে বাহিত হয়ে’ চলেছেন নিভৃত হওয়ার আকাঙ্খায়। এমন সাধ জেগে ওঠে তখনই, যখন পার্থিব শরীরে আর প্রাপ্তির সাধ থাকে না। এক বোধ জেগে ওঠে যা প্রায় মৃত্যুর মতো, যা ক্রমে নিয়ে যায় এক অনশ্বর জগতে। কোনো পিছুটানই আর গ্রাহ্য নয়। ভিতরে ভিতরে অহর্নিশ জেগে থাকে এক অপরূপ নিভৃত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আর কিছু নয়। এবং এক আদর্শ কবিতার মত অনিঃশেষ, অসমাপ্ত গন্তব্যহীন সে বয়ন। গ্রহনের শেষে অনন্ত প্রদীপের মত সে শব্দসমূহ অমলতাস ফুলের মতোই প্রজ্বলিত।
বইটি পাঠান্তে হয়ত কখনও মনে হয়েছে, এই গ্রন্থের কবিতাসমূহের সীমাবদ্ধতা আদৌ কী আছে? থাকলে কোথায়! তিনি যে নির্মিতি চেয়েছেন, তেমনই কি কবি সক্ষম হয়েছেন! এই ২৯টি কবিতাকেই কী সঙ্ঘত, এমন শব্দে অভিহিত করা সঙ্গত! কখনও তিনি অতিরিক্ত বাঙময় হয়ে উঠছেন না তো? ফলত কবিতা নিজেই উন্মুক্ত করে দিচ্ছে না তো নিজেকেই?
পরবর্তী পাঠে ভেবেছি অন্যতর। কবিতার কাছে নিভৃত নতুনের, বেদনার, আনন্দের যে প্রার্থনা থাকে, সে আমার পাওয়া হয়েছে এবং একটা স্বীকারোক্তি সম্ভবত বাহুল্য হবে না যে, এঈ ্যে এতো শব্দ ব্যবহৃত হ’ল এই গদ্যে, সে সবকিছুই আমার আংশিক দেখার ফল। সম্পূর্ণ দর্শন সম্ভবও নয়। ভালোবাসা সব সময়েই একরৈখিক। কবিতা বা ভালোবাসা, কিছুই বোঝার নয়। সম্ভব হলে, সে কি আর কবিতা থাকে! অন্যতম প্রিয় কবি আলোক সরকার ‘কবিতা-ভাবনা’ নিয়ে কথা প্রসঙ্গে বলেছে যেমন, ‘…কবিতার কোন স্থির সংজ্ঞা নেই। তা বারবারই দ্বিতীয় হয়। সব কবিতাই এক বিশেষ স্বতন্ত্র আত্মবৃত্ত অবিমিশ্র প্রথম বীজের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ; সেই বীজ তাঁর ব্যক্তিগত হওয়ার ধর্মের ভিতর একাগ্র। তাঁর হয়ে ওঠার ধর্ম, যেমন তার নিজের, সেইরকম তাঁর বিন্যাসের ধর্ম, তাঁর নির্বাচনের ধর্ম, এমনকি তার প্রত্যাখ্যানের ধর্ম এবং বলার তেমন কোনো প্রয়োজনই নেই, তার প্রতিক্রিয়া, তার আমন্ত্রণ, অন্যের কাছে তার আবেদন, অন্যের আবেগ অথবা কল্পনার উপর তার শাসন এক নিশ্চিত প্রথমতা; পাঠকের পূর্ব অভিজ্ঞতার পূর্ব প্রত্যাশার কাছে যা কোনোভাবেই দায়বদ্ধ নয়…’। সুতরাং, একাকী শোকের, প্রাপ্তির, শর্তহীন ভালবাসারব্যবচ্ছেদের সক্ষমতা অর্জনের প্রয়াসী আমি হচ্ছি না। ভালো লাগার, মুগ্ধ হওয়ার হেতুসব ব্যাখ্যা করা বা কাটাছেঁড়ায় ব্যগ্রতা নেই আমার। সম্ভব নয়। তখন কি আর ভালবাসার কবিতাসব থাকবে কবিতা! অন্য কিছু হবে। কবির ‘বর্গভীমা ও শোলমাছ’ আমাকে এতদূর নির্ভীক করেছে। অনুভব করেছি হয়তো অতিরিক্ত কিছু, যে অপূর্ব প্রাপ্তি চিরকাল অব্যক্তই রয়ে যাবে।
ঋণঃ
১) ত্রিষ্টুপঃ সম্পাদক- ব্রজকুমার সরকার
২) তমসুকঃ সম্পাদক- সমীর চট্টোপাধ্যায়
৩) কুরুক্ষেত্রঃ সম্পাদক- প্রদীপ চক্রবর্তী
৪) কবিতা ক্যাম্পাসঃ অলোক বিশ্বাস
Posted in: October 2020 - Cover Story, PROSE