অকবি’ র দিনলিপি : একটি ব্যক্তিগত গদ্য – প্রদীপ চক্রবর্তী
প্রথম ছায়াজাতক, পাতা ঝরার খসড়া
ল্যান্সডাউন মোড়ে, এক শীতের সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে আছেন জীবনানন্দ | লুঙ্গি, একটা খদ্দরের পাঞ্জাবি, হাতে বাজারের ব্যাগ | ট্রামের সেকেন্ড ক্লাস ঘন্টি, হুসহাস করে বেরিয়ে যাচ্ছে এলোমেলো কিছু গাড়ি | কিছু পথচারী | হাতেটানা কিছু রিক্সা ল্যান্সডাউন রোডের কাছে দাঁড়িয়ে আছে | মোড়ের মাথায় একটা পুড়ে যাওয়া নারকেল দড়ি থেকে কাচি সিগ্রেট ধরিয়ে, মুখে কেয়া খয়ের আর সাতক্ষীরার জর্দা মেশানো পান খেতে খেতে, পানের বোঁটা থেকে জিভে চুন মেশাতে মেশাতে একজন পথচারী লক্ষ করছে এই একান্ত উদাসীন মানুষটাকে |
তিনি প্রায়ই দেখেন, মানুষটা এই প্রাকসন্ধ্যায়,
এই পঞ্চাশ দশকের শুরুর সন্ধেগুলোতে পায়ে চটি, লুঙ্গি আর খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে কেমন যেন এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করেন | মানুষটা আনমনা, জনারণ্যে একা ও বিচ্ছিন্ন | পরিচিত কবি বন্ধুদের দেখলে ফুটপাত বদল করেন সন্তর্পণে | চোখের দৃষ্টি সুদূর পরাহত, কোথায় কোন নিঃসীম আদিগন্ত বিস্তৃত গোধূলিসন্ধির কুয়াশা ভেদ করে দূর সুদূর, কাকে খোঁজেন যেন ۔۔۔!
এই জীবনানন্দ একজন ব্যর্থ মানুষ | যার বেকারি চিরস্থায়ী | প্রায় আমৃত্যু তিনি কাজ চলে যাওয়া এবং কাজ না পাওয়ায় ভুগেছেন | বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে, শেষ হয়েছে, দেশভাগ হয়েছে, দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে কিন্তু সেই অর্থনৈতিক মন্দা যেন সারাজীবন তাঁকে তাড়া করেই ফিরেছে | অর্থাভাব, চাকরির অভাব, সুস্থিতির অভাব তাঁকে উদ্বিগ্ন, তাড়িত ও আত্মবিশ্বাসহীন করে রেখেছিলো, সারাজীবন |
ব্যথিত আধুনিকতায় ধ্বস্ত জীবনানন্দ যত আহত হয়েছেন ততই তাঁর লেখনীতে, তাঁর বহুখণ্ডব্যাপী উপন্যাস ও গল্পের বিস্তারে আমরা পাই মন্দা সময়ের প্রবল, বিষাক্ত শকুন আর শেয়ালদের এক অন্ধকার সুড়ঙ্গলালিত জগৎ |
কবি যেন গত শতাব্দীর সেই সংশয়দীর্ণ মানুষ,
যিনি আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে মননে আধুনিকতায় অভ্যস্ত না হওয়া অসহায় | যাবতীয় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তি সম্পর্কের দুর্গতি ও তার সর্বব্যাপক ছায়াকে তুলে ধরছেন, তাঁর আদ্যন্ত গ্রাম ও শহরের গল্প,
উপন্যাসে |
“গ্রাম ও শহরের গল্প” নামে একটি গল্প লিখেছিলেন জীবনানন্দ |
গল্পে শহরে বসে দুটি নারী পুরুষের কথা চলেছিল এরকম :
শচী অনেকক্ষণ পরে বললে, ‘চলো না পাড়াগাঁয় যাই — ‘
‘কোন পাড়াগাঁয় ?’
‘যেখানে ছিলাম আমরা –‘
‘সেই বকমোহনার নদীর ধারে ? ভাঁটশ্যাওড়া ময়নাকাঁটার জঙ্গলে ?’
শচী মাথা নেড়ে বললে, ‘হ্যাঁ — সেখানেও –‘
সোমেন বললে, ‘অসম্ভব ।’
এই ফিরতে চেয়েও না ফিরতে পারার এক অসম্ভব আকুতি, অসহায় দ্বন্দ্ব ও একান্তে বিক্ষত জীবনানন্দকে আমরা পাই তার জীবৎকালে অপ্রকাশিত অজস্র গদ্যগুলিতে | ‘গ্রাম ও শহরের গল্প’ জীবনানন্দের একটি গল্পের নাম | কিন্তু বলা যায়, তাঁর সব গদ্যরচনাই, ‘ছায়ানট’ বা ‘বিলাস’,
‘মাল্যবান’ বা ‘সুতীর্থ’ এই সবেরই ভিতরকার সংঘর্ষ তৈরী করছে গ্রামশহরের বিরোধ | সবকটির জন্যই নির্ধারিত হতে পারতো ওই একই নাম : গ্রাম ও শহরের গল্প | তাঁর গদ্যের প্রায় সর্বত্রই জীবনানন্দ দেখান সেই মানুষের ছবি, প্রকৃতির থেকে ছিন্ন হয়ে যে মানুষ যন্ত্রসভ্যতার এক যক্ষপুরীতে এসে দাঁড়িয়েছে, যে মানুষ তার পরিবেশ থেকে কেবলই বিযুক্ত দেখে নিজেকে | যে যোগ তার হতে পারতো, আর যে বি- যোগের মধ্যে সে আছে, জীবনানন্দের নায়কেরা কেবলই তার ভিন্ন দুই রণন জাগিয়ে তোলে তাদের ভাবনায়, ব্যবহৃত প্রতিমায় |
জীবনানন্দ ১৯৩৩ – এর আগস্ট মাসে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন, ‘কারুবাসনা’ নামে | যদিও এ বইটির নাম তিনি দিয়ে যান নি | শুধু ‘আ নভেল’ বলে উল্লেখ করেছেন |
‘কারুবাসনা’ নামকরণ সম্পাদকের | পাণ্ডুলিপিতেই এর উৎস রয়েছে : কারুবাসনা আমাকে নষ্ট করে দিয়েছে | ۔۔۔ আমার সংসারকে ভরে দিয়েছে ছাই – কালি – ধূলির শূন্যতায় | ۔۔۔ শিল্পী সত্তার উদ্ভাসন অনেকটা হঠাৎ ওঠা সুনামীর মতো | কখন আসে কখন যায়, টেরই পাওয়া যায় না | কিন্তু, সেই দ্বিতীয় সত্তার জন্ম -উদ্ভাসন – বিস্তার ও বিলোপের মধ্যে থেকে যায়, একজন সামাজিক স্রোতের বিরুদ্ধে গোড়ালি চেপে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের আনখশিখর লড়াই| জীবনপ্রবাহের মধ্যে নানারকম ত্রুটি – বিচ্যুতি, স্খলন ও কবন্ধ সময়ে, সূক্ষ্ম অভিমানসন্ধানী চেতনপ্রবাহের শুষ্ক রক্তচিহ্ন, তামস অন্ধকার আর বিপ্রতীপ ভালোবাসার গাঢ় মাখামাখি আত্মস্থ করে যিনি চলেন তার একাকিত্বের খোঁজ রাখেন ক’জন ? প্রতিবেশী, বন্ধুর মুখোশ পরে বন্ধুত্বের ছলনায় আক্রান্ত একান্ত শিল্পের মনন, বিদ্রুপে, ব্যঙ্গ-এর ছুরি ও লৌহপিঞ্জরে নির্যাতিত হতে হতে শতধা হয়ে, সুসভ্য জানোয়ারদের সমবেত উল্লাসের বাইরে যে অনাহূত অনাদৃত একা এসে দাঁড়ায় আকাশের নীচে, সেই একসময় উপেক্ষিত, অনাদৃত, অবহেলিত এবং না খেতে পেয়ে, যক্ষ্মায় কিংবা দুর্দিনের তিমিরে হারিয়ে গেছেন,
একক বেদনায় | এক রাশ অভিমান বুকে নিয়েও কেউ কেউ বেঁচে আছেন আজও | একজন বিনয় মজুমদার, একজন চন্ডিদাস বা রামকিঙ্কর, ঋত্বিক ঘটক, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা আর – একজন ভিলোঁঁ, হাইনে, ভারতচন্দ্র বা একালে আশি’ র কবি বিষ্ণু বিশ্বাস ! কিছুটা কী নয় কমল কুমার, অমিয়ভূষণ বা তারক সেন, মানবেন্দু রায় – প্রশ্ন অনেক কিন্তু রাতের আকাশ ফেরৎ দেয় তারার চুমকি বসানো সদাসর্বদা তিমিরান্ত ময়ূর পাখা | তাতে আছে হয়তো পুলকিত সৌন্দর্যের মানসিক সুখাদ্য ۔۔۔ নেই কেবল উত্তর ۔۔۔!
বল্মীকের অক্ষৌহিণী ۔۔۔ দুই
‘মাল্যবানের অবকল্পনা আছে, অবপ্রতিভাও”
মনে করতেন জীবনানন্দ | কোথাও কারুবাসনার ‘হেম ‘ ও কী জীবনানন্দ থেকে অভিন্ন ? —
‘চেতনার একটি সূর্যের বদলে অবচেতনার অন্তহীন নক্ষত্র পেয়েছে সে’, তখন আমরা বুঝতে পারি যে , এ কেবল মাল্যবানেরই কথা নয়, তার স্রষ্টারও কথা | বহুল প্রতিমায় পুঞ্জ হয়ে উঠছে যাঁর অন্তহীন নক্ষত্র | অবকল্পনা আর অবচেতনায় জীবনানন্দ যখন দেখেন যে
‘আমাদের এই মেট্রোপলিসে, স্ত্রী পুরুষের সম্পর্ক, মানুষে মানুষে সম্পর্ক, মানুষ ও প্রকৃতির সম্বন্ধ সূক্ষ্মতা হারিয়ে ফেলেছে, সফলতাও, সরলতাও ‘, তখন আজকের পৃথিবী তাঁর কাছে দেখা দেয় কোনও এক ‘ ভোজালি ‘ বা চেঙ্গিস খাঁ ‘ র প্রতীকে , কখনো বা পশু পতঙ্গের এক দমচাপা মিছিলে |
ব্যক্তিজীবনে ব্যর্থ মানুষের, দাম্পত্যও যদি ব্যর্থতার যন্ত্রণায় মর্মভেদী হয়, তখন সেই অন্তর্মুখী মানুষ হয়ে পড়েন দিশেহারা | কারুবাসনায়, শুরুতেই, স্ত্রী সম্বন্ধে হেম বলছে – ‘সে আমার উপর বিরক্ত | দেশে এসে বলেছিলাম ছ-সাত দিন থাকবো, থাকতে থাকতে তিনমাস হয়ে গেলো | প্রায় একমাস থেকে বলছি, চাকরির চেষ্টায় কলকাতায় আজিকালই যাবো | কিন্তু আজও গড়িমসি করে দেশের বাড়িতেই কাটাচ্ছি | ۔۔۔ সে আমাকে যখন প্রথম বিয়ে করেছিল, তিন বছর আগে, — তখন কি চাইতো জানি না, কিন্তু আজ একজন সামান্য স্কুল মাস্টারের গৃহস্থালির ব্যবস্থাও নিজের হাতে যদি সে পায়, জীবনকে ধন্য মনে করে | কিন্তু এমনই ব্যবস্থা একটা ইস্কুল মাস্টারিও জোটে না |
‘আচ্ছা, আমি যদি ট্রাম কন্ডাক্টর হই ? কী বলো কল্যাণী ?”
‘টি – সি হবার জন্যই এম – এ পাশ করেছিলে ?”
‘কিন্তু সেও তো কাজ — মাসে মাসে ২৫-২০ কি দেবে না ?”
‘বেশ তো , তা হলে তাই করো গিয়ে |’
( পৃষ্ঠা -২-৩ , কারুবাসনা , জীবনানন্দ সমগ্র , প্রতিক্ষণ )
জীবনানন্দের কর্মজীবিকাহীন অবস্থা, তাঁর স্ত্রীর মনোভাব, তাঁর সংকল্পের শৈথিল্য এবং পুববাংলার মধ্যবিত্ত উচ্চবর্ণ শিক্ষিত শ্রেণীর উপর সেই অর্থনৈতিক দুর্গতির সর্বব্যাপক ছায়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, হেম ও কল্যাণীর দাম্পত্য কথোপকথনে |
আত্মবিশ্বাসহীন, বেকার যুবক এই মৌন, লাজুক পিতা, স্বামী ও কবিকে ভাগ্যের হাতে বারংবার বিপর্যস্ত হতে হয়েছে | বারংবার এক কলেজ থেকে আরেক কলেজে চাকরি এসছে, গেছে | বিয়ের আগে সিটি কলেজ ( ১৯২২ – ২৮ ) বাগেরহাট কলেজে মাস তিনেক ( ১৯২৯ ) এবং রামযশ কলেজে কয়েকমাস ( ১৯২৯- ৩০ )
বিয়ের পর দীর্ঘ সাত বছরের মতো বেকার ছিলেন তিনি | এই সাত বছরে তার ঠিকানা হ্যারিসন রোডের প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং | এই বেকার অবস্থায় তিনি জীবন বীমার দালালি করেছিলেন | বন্ধুর সঙ্গে যৌথ ব্যবসা | ধোপে টেকে নি | অথচ এর মধ্যেই কবি জীবনানন্দের চলছে গভীর ক্রমবিকাশের কাল | কারুবাসনা উপন্যাসে ‘হেমে’ র মুখ দিয়ে জীবনানন্দ কি বলছেন ۔۔۔ দেখি পরপর ۔۔۔
এক / ‘ গত বছর কলকাতায় যখন পঁচিশ টাকার ট্যুইশান করি, ট্রাম, সিনেমা ও চায়ের পথ এড়িয়ে, খুব একটা সাদাসিধে মেসের জীবন্মৃত অবস্থার ভেতর থেকে কয়েকখানা বই কিনতে পেরেছিলাম : ইংরেজি কবিতার বই দুটো, একখানা আমেরিকান উপন্যাস গত শতাব্দীর, একখানা নভেল এবং আরো দু – তিনখানা বই | ۔۔۔ টিনের সুটকেসে করে বইগুলো দেশে নিয়ে এলাম, খড়ের ঘরের জানলার কাছে বসে পড়লাম, বাইরে বিকেলের আলোয় সন্ধ্যার অন্ধকারে কখনো শরৎ কখনো হেমন্তকে দেখেছি, শালিখ – ঘাসে ঘাসে পোকা খুঁটে খেয়েছে, ফড়িং উড়েছে, পাতা খসেছে, দাঁড়কাকের দল গভীর কীর্তির অব্যর্থতায় ঘরের দিকে উড়ে গেছে তাদের, সন্ধ্যমণির পাপড়ির মতো লাল মেঘে আকাশ গেছে ছেয়ে |”
হেম তার বাবাকে বলছে ۔۔۔
দুই / ‘যতই বয়স বাড়ছে, এই আট চালা ঘরখানাকে ততই ভালো লাগছে আমার, চারদিকে এই আম – কাঁঠাল – লেবুর বন, জঙ্গল – মাঠ – নিস্তব্ধতা, বিশেষ করে এই আষাঢ় – শ্রাবণের রাতে ۔۔۔”
হেমের বাবা নিজেকে মোটামুটি নিরুচ্চার
রাখেন, অথচ সংসারের সমস্ত পরিস্থিতিতে তার শান্ত উপস্থিতি টের পাওয়া যায় | হেমের কলকাতার মেসের জীবন, চাকরি, ট্যুইশান নিয়ে তিনি চিন্তিত |
হেম বলছে , ‘মাঝে মাঝে মনে হয় বয়স চৌত্রিশ হয়েছে বটে – সত্তর হয় নি, কিন্তু তবুও সবই যেন সমাপ্ত হয়ে গেছে, কেমন একটা গভীর অবসাদ পেয়ে বসে | সন্ধ্যার অন্ধকারে মেসের বিছানার থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না, মনে হয়, সব দেখেছি, জেনেছি, বুঝেছি, সব লিখেছি , তখন ঘুমিয়ে পড়া যাক, অন্ধকার বেড়ে চলুক,কোনোদিনও যেন এই অন্ধকার শেষ হয় না, ঘুম কোনোদিনও ফুরোয় না যেন আর |’۔ ۔۔
এই বেদনার আরেক প্রসারিত ফেনপুঞ্জ আমরা দেখি, মাল্যবানের মনে | বোধের দ্বন্দ্বপারমিতা|
গভীর নৈরাশ্যে মানুষ সম্পর্কে, আধুনিক মানুষ সম্পর্কে এক দ্বিস্তর অভিজ্ঞতার অদ্ভুত আঁধার|
যেখানে জীবনানন্দ অমোঘ এক কবিতায় বলেছেন, অন্ধ সবচে বেশি দ্যাখে আজ | প্রেমহীন করুণাহীন হৃদয়হীন মানুষের, সুপরামর্শ ছাড়া পৃথিবী অচল | যাদের এরপরেও গভীর আস্থা আছে মানুষের উপর, এবং যাদের কাছে আজো স্বাভাবিক বলে মনে হয়, মহৎ সত্য ও রীতি কিংবা শিল্প অথবা সাধনা, শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয় |
বোডিংয়ের জীবন যাপনে মাংসলোলুপ বাসিন্দাদের হিংস্রতা দেখে মাল্যবানের মনে হয়েছিল, ‘ এ তো স্বাভাবিক | শেয়াল বেড়াল চিতেবাঘ কেঁদোবাঘের মতো মানুষ হিংসাত্মক তো |’সেই স্বাভাবিকতায় মাল্যবান তার পরিজনদের মুখে দেখে ‘মাকড়ের ঠ্যাং , ফিঙের ঠ্যাং , কাতলের মুখ, ভেটকির মুখ | ‘দেখে ‘ মাকড়সার জালের মতো জড়িত চোখ ‘, তার স্ত্রীর স্বভাবে সে দেখে ‘কত যে সজারুর ধাষ্টামো কাকাতুয়ার নষ্টামি ভোঁদরের কাতরতা বেড়ালের ভেংচি কেউটের ছোবল আর বাঘিনীর থাবা এই নারীটির |’
আধুনিক সভ্যতার, মানুষের, আপতিক ও শরীরী ক্লেদ গভীর দৃষ্টিতে দেখেছিলেন জীবনানন্দ| এ যুগে কোথাও কোনো আলো, কোনো কান্তিময় আলো, চোখের সমুখে নেই যেমন জানতেন, তেমনি কোথাও হয়তো এই গভীর বিশ্বাস তাঁরও ছিল, দুর্দশা থেকে স্নিগ্ধ আঁধার বা অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত আলোর মতো নবীন নগরী গ্রাম উৎসবের দিকে জীবন চলেছে কেবল | গ্রাম শহর, মন ও শরীরের শত ছিন্নতার মধ্যে তাঁর মনে হয়েছে —
‘নিজের মনটা তার স্বাতীর শিশির হলেও শরীরটা তার শুক্তি নয় | কিন্তু শামুক – গুগলির মতো ক্লেদাক্ত জিনিস |’
কারুবাসনার কবি, সুতীর্থ, মাল্যবান, জলপাইহাটির লেখক কি বলছেন তার উপন্যাসের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে ۔۔۔۔ এবং মর্মান্তিক হয়ে উঠছে , ট্র্যাজিক হয়ে উঠছে সেই সত্যই একসময় তাঁর জীবনে ۔۔۔
কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক উপন্যাস থেকে —
— ‘কিন্তু পথে নেমেই কী রকম শূন্যতা, কোনো উপায় দেখি না যেন | খানিকটা বৃষ্টি হয়ে গেলো, একটা শেড খুঁজে বার করতে করতে ঢের ভিজে গেলাম | ভিজে ফুটপাথে হাঁটতে হাঁটতে একজন রোগীর ছিটোনো থুতু আরেকটু হলে গায়ে লাগছিলো, একটা দোকানের মস্ত বড়ো পাপোস আমার মুখের সামনে ঝেড়ে নিলো | একটা মহিষের লেজের বাড়ি খেলাম | এগিয়ে চলি, কয়েকটা কাক দেবদারু গাছের ভিজে শাখার দিকে উড়ে গেলো | — বাদলের বাতাসে, আবছায়ায়, জনমানব, ট্রাম বাস , গাছের পাতা পল্লব, পাখপাখালির কলরবে এক – একটা সন্ধ্যা বড়ো চমৎকার কেটে যায় আমার |’
বা
মা ,
— ‘কয়েক মিনিট বসে থাকতে থাকতে জীবনটা কেমন ছটফট করে ওঠে, আবার বেঞ্চির থেকে উঠে গিয়ে ফুটপাথে দাঁড়াই | রাস্তা পেরুতে গিয়ে একটা বাস আর একটু হলেই গিলে ফেলেছিলো আর কি !”
বা
মা ۔۔۔۔
– ‘ কিন্তু তবুও আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে ।”
– ‘কার ? তোমার ? কেন ? ”
– ‘চৌকাঠের সঙ্গে দড়ি ঝুলিয়ে কিংবা বিষ খেয়ে যে মরণ, সে রকম মৃত্যু নয়, আউট্রাম ঘাটে বেড়াতে গিয়ে সন্ধ্যার সোনালী মেঘের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করে, মনে হয় আর যেন পৃথিবীতে ফিরে না আসি |’ ( কারুবাসনা , পৃ: -১২৩)
দিনশেষ – চিরস্তব্ধ দেশ ও একটু জীবনানন্দের জন্য — তিন
۔
সালটা উনিশশো ছিয়ানব্বই | বছর পঁচিশের যুবক আমি | কুরুক্ষেত্র পত্রিকাটি কষ্টে সৃষ্ঠে করি | এবং এই সময়ই নিয়মিত যাই মণীন্দ্র গুপ্তের বাড়ি | আমার প্রিয় কবি দম্পতি, মণীন্দ্র গুপ্ত ও দেবারতি মিত্র | পরের দিকে, গড়িয়ার – যোগীয়া এপার্টমেন্টে |
মণীন্দ্র বাবু সেই সময় তার কালজয়ী গ্রন্থ , অক্ষয় মালবেরির, কাজ করছেন | সঙ্গে আবহমান বাংলা কবিতা নিয়ে ভাবনাচিন্তা, কাজ | মণীন্দ্র গুপ্তের অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার অফুরন্ত | তখন আমার কোনো ফোন ‘ই নেই | বা রেকর্ডার | কত অমূল্য জীবনের অভিজ্ঞতা ও গল্প শোনাতেন !
তো, এই সময় একটি কথা প্রসঙ্গে জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু সম্পর্কে আমাকে তাঁর একটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন | যা পরে, আমার আরেক ঘনিষ্ট কবি, সম্পাদক,
‘চিত্রকের’ – পার্থপ্রিয় বসুর পত্রিকায়, লিখিত আকারে প্রকাশিত হয় | ডিসেম্বর, ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত এই পত্রিকাটির পুরোনো পাতাগুলো খুলে আমি দেখছি, পূর্বে মণীন্দ্র গুপ্তের মুখে শোনা সেই অভিজ্ঞতার, অনবদ্য লিখিত ভাষ্য |
পাঠক, মণীন্দ্র বাবুর সেই লেখা, ‘কারুবাসনা ও সেইসব দিন’, থেকে আমি মণীন্দ্র গুপ্তের বয়ানে, কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর প্রসঙ্গে তাঁর একটি ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতার বর্ণনা এখানে তুলে ধরছি | এই অমূল্য অংশটুকু পড়ুন —
‘শেষ দুর্ঘটনা ঘটলো ১৪ অক্টোবর ১৯৫৪, শরৎহেমন্তের সন্ধিতে | আর এইসব শূন্যতা ও মৃত্যুর কথা লিখেছিলেন ২১ বছর আগে,
বর্ষায় | আরো কত আগে থেকে তিনি মৃত্যুর কথা ভাবছিলেন, তার সাক্ষ্য দেবে তাঁর
কবিতা | তাঁর এই মৃত্যু চিন্তায় শুধু পরিত্রাণ নেই, হয়তো তার চেয়েও গভীর হয়ে ছিল বিশ্রাম ও সৌন্দর্য্যচিন্তা | কিন্তু শরীর রক্তমাংসের — তার অকস্মাৎ ধ্বংস ভয়ঙ্কর | জীবনানন্দও
জানতেন, তখন দেহ ‘থ্যাঁঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে, মর্গের টেবিলে শুয়ে থাকে |
তাঁর নিজেরও তো তাই হলো | সন্ধ্যার মুখে, দেহ নিয়ে, শেষ ঢেউটি চিরকালের মতো সমুদ্রে ফিরে গেলে তখন বোধহয় আকাশ ভরে সৌন্দর্য ফুটে ওঠে |
কবি শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় চুনীলাল দে’ র সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন | শঙ্কর শেলী ক্যাফে থেকে চুনীলালকে রাসবিহারী এভিনিউ’র ট্রামলাইনের সামনে ডেকে এনে বললেন, — এই চুনী, দাদাকে দেখিয়ে দিন তো, ঘটনাটা কোথায় ঘটেছিলো | শেলী ক্যাফের মালিক চুনীলাল বিরাট চেহারার কেউ নন, ফর্সা, আমাদের মতোই সাধারণ উচ্চতার, কিন্তু তাঁর ব্যায়াম করা মজবুত শরীর ও বিশাল বুক |
চুনীলাল ল্যান্সডাউন রোডের মোড়ের কাছাকাছি এসে বললেন — ঠিক এই
জায়গাটায় | তারপর আনুপূর্বিক ঘটনাটা বলে গেলেন |
— তখন সন্ধে হয়ে এসেছে | ট্রামটা গড়িয়াহাটের দিকে যাচ্ছিলো | ট্রাম ড্রাইভার জোরে জোরে বারবার ঘন্টা বাজিয়েছিল | লোকেরা হৈ হৈ করে উঠেছিল | এই ক্যাফের বদলে তখন আমার মিষ্টির দোকান | আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি, একজন কেউ ট্রাম চাপা পড়ে তলায় ঢুকে গেছেন — আটকে গেছেন — লোকেরা তাঁকে তলা থেকে বার করে আনতে পারছে না | আমি তখন ক্যাচারের সামনে দাঁড়িয়ে প্রাণপণ শক্তিতে ট্রামটাকে একটু তুলে ফেললাম | লোকেরা তাঁকে বার করে নিয়ে এলো | তখন তাঁর জ্ঞান নেই | সবাই বলাবলি করছিলো — ড্রাইভারের দোষ নেই, উনি ভুলো মনে পথ হাঁটছিলেন, অথবা বোধ হয় আত্মহত্যার চেষ্টা | আমি ভদ্রলোককে চিনতে পেরেছিলাম, এই রাস্তায় ওঁকে হাঁটতে দেখেছি, ওঁর বাড়ির লোক আমার দোকান থেকে মিষ্টি কিনে নিয়ে যায় |
চুনীলাল গোপালচন্দ্র রায়কে বলেছেন, তিনি জীবনানন্দকে ট্রামের তলা থেকে বার করেছিলেন, আমাকে বলেছেন তিনি ট্রামটাকে উঁচু করে তুলে ধরেছিলেন | আমার মনে হয়েছিল, চুনীবাবুর পক্ষে তা সম্ভব |
তারপর তো ৪৫ বছর কেটে গেছে | শেলী ক্যাফে উঠে গেছে, চুনীবাবুকেও আর দেখতে পাই না | শঙ্কর, শেষ দিকে যাঁকে দেখলেই জীবনানন্দ বাড়ি খুঁজে দিতে বলতেন, অনেকদিন আগেই মারা গেছেন | ল্যান্সডাউন রোডের নাম শরৎ বসু রোড হয়েছে | বালিগঞ্জের ট্রাম, ঘন্টা বাজিয়ে এখনও আসে যায় | জীবনানন্দের ১০০ বছর হলো | এখনো হয়তো তাঁর এই শহরে হাঁটতে হাঁটতে কারুবাসনার দেশকে মনে পড়ে —
‘কয়েকটি আদিম সর্পিণী সহোদরার মতো
এই যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে
পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে এদের বিষাক্ত বিস্বাদ স্পর্শ
অনুভব করে হাঁটছি আমি |
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে – কেমন যেন
ঠান্ডা বাতাস,
কোন দূর সবুজ ঘাসের দেশ নদী জোনাকির কথা মনে পড়ে আমার — ‘
(ফুটপাথে, চতুরঙ্গ, আশ্বিন ১৩৪৫ )
এখানে একটি কথাই আমার সংযোজন | ট্রামও আজ আর নেই | তার পুরোনো ঐতিহ্য ও পরম্পরা নিয়ে সে চলে গেছে ধূসর ইতিহাসের পাতায় ! জীবিত জীবনানন্দ জানতেই পারলেন না, মৃত্যুর পর হুজুকে বাঙালি তাঁকে সেলেব্রিটি করে, নকল বুঁদির গড় তৈরী করে পুজো করেছে কেবল | আর প্রতিদিন পূজোর ছলে তাকে ভুলে থেকেছে | কবিতা লেখা হয়েছে তাঁর ওপর ঝুড়ি ঝুড়ি | মানুষ আরো বেশি কবি হয়েছে, কিন্তু যত দিন যাচ্ছে অমানুষ হচ্ছে ঢের | না হলে এই তো বছর তিনেক আগে অকাল প্রয়াত, কবি বিকাশ কুমার সরকার, কবিতার মঞ্চে ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে | অথচ কবি’রা তারপরেও নিজস্বী তোলে, কবিতা পাঠ করে যায় অবিরাম | মর্মান্তিক ভাবে মারা যায়, বেশ কিছু বছর আগে, মৌমাছির কামড়ে তরুণ কবি চঞ্চল জানা | কেউ আর খোঁজ রাখেন না | আত্মহত্যা করে, জীবনের কাছ থেকে বিষাক্ত ছোবল খেয়ে খেয়ে, নব্বইয়ের দুই কবি বন্ধু, তাপস কুমার লায়েক ও অনিকেত পাত্র | তারা আজ প্রায় বিস্মৃত | একই ভাবে আত্মহননের পথ বেছে নেন, কবি প্রমোদ বসু | সারাজীবন ব্যতিক্রমী সাহিত্য সাধনা করে, যিনি একটা স্বতন্ত্র কাব্যের ভুবন তৈরী করেন | বস্তা পচা, ঘুণ ধরা কবি সমাজের মুখে থাপ্পড় কষিয়ে, সেই বাংলা কবিতার, নিজেকে মজা করে ভিলেন বলতেন, সেই কবি বারীন ঘোষালকেও সহ্য করতে হয়েছিল মৃত্যুর পর, ভূইঁফোড় মুৎসুদ্দি শ্রেণীর কবন্ধ কবিদের তামস যুগের অপমান ۔۔۔۔ হায় ! মৃত্যুর পরেও ۔۔۔
এবং গণনাতীত পারাবত মেঘের স্বরূপ ۔۔۔চার
নিহিত নি – শব্দগুলো তাড়না দেয় | ۔۔۔ শব্দ না লেখার তিনশত চুয়াত্তরটা সিঁড়ি বেয়ে যত অতল বিতল পাতালে নামি, সেই পুষ্ট অবচেতনার ক্রমবিকাশে, কোথাও যেন শব্দ শেকলের মরচেকে গুঁড়িয়ে দেয় অবলীলা | অসীম এই অনন্তকে ধরে মাত্র মানুষের তিনটি অক্ষর | ۔۔۔ মাত্র তিন অক্ষর ۔۔۔? একটা মাত্র “অ’ একটা মাত্র ‘সী’ আর একটা মাত্র ‘ম’ ۔۔۔ব্যাস ۔۔۔হয়ে গেলো ? ۔۔۔ দু আঙুলের ফাঁকে যেমন তাজমহল ধরে, গর্বিত প্রেমিকার স্পর্ধিত ভেজা ভেজা ঠোঁট এগিয়ে যায় লাজুক প্রেমিকের দিকে ۔۔۔ সেভাবে শব্দের ভেতর অনেক শব্দ থাকে ۔۔۔ থাকে মৌন ও মুখর ۔۔۔ অনেক গুপ্তঘাতক ۔۔۔ মুখোশের হাড় ও পাশা , থাকে তণহা মরীচিকা ۔۔۔ কতো মীরনের ছুরি ۔۔۔! শব্দের চেয়েও না শব্দগুলো অনেক বেশী ভয়ঙ্কর | মভ পর্দা ইকেবানা ঝিরি জাফরী ۔۔۔ , এই প্রলোভন ۔۔۔| অথচ পৃথিবী প্রান্তিক একটা বাড়ির গুপ্ত কুঠুরি থেকে প্রাণপণে ডেকে যাচ্ছি ۔۔۔۔, শব্দ ভাঙা না শব্দের পিপাসাগুলো , কেউ শেখাচ্ছে না আমায় | ۔۔۔কেউ বলছে না, শব্দ আসলে শব্দ নয় ۔۔۔ শব্দ না লেখাটাই, আসলে, আলিবাবার গুহায় ঢোকার প্রবেশাধিকার ۔۔۔শর্ত ও মুক্তি ۔۔۔!
নিজেকে লিখতে গিয়েই, সে হঠাৎ জেগে উঠেছিল একদিন | কিন্তু এই জেগে ওঠা গ্রেগর সামসার মতো হয়তো নয় | ঘুম আর স্বপ্নের মধ্যে একদিন তৈরী হয়ে যায় কাল্পনিক খসড়ার তলস্পর্শহীন, উজানডহর | সে হয়তো বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো | কুয়াশামাখা গোধূলির অব্যর্থ অস্থিরতায় | হেমন্তসম্ভব জন্মদৃশ্য উপমেয় হলো রহস্য আর শূন্যবোধের আলোছায়ায় দুকূল ছাপানো | সে হয়তো বেঁচে থাকার নাম দিলো ‘দিশেহারা পূর্ণশশী |’ নিঃশেষ প্রতিহত শব্দের ধ্বনিত স্বপ্নঘোর | সেই তন্নতন্ন রূপদ্যুতি সাতপ্রস্থ অলংকার দয়া বা নির্দয়া, আবার সার্জনের টেবিলে শায়িত দেহক্লেদ | সঙ্গ স্পর্শ, মনোরোগের অন্দরবার আর চারপাশের বহির্জীবন মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠে হঠাৎ জাগরণের সময়বাত্যায় | সমস্ত কিছুর ভেতর এই বোধ তাকে বিচ্ছিন্ন করে, অসংসারী একবিঘৎ মাত্র | এই আমি’র অতল আয়ুষ্কালে | অছিন্ন বহতার মতো, অন্তঃশীল আনকন্সাস, একটি পুষ্ট ও পরিবর্ধিত অবচেতনার অন্তসপটের আড়াল ۔۔۔|
শেষরাতের হাওড়া থেকে বর্ধমান লোকাল ট্রেনে প্রায় বাড়ি ফিরতেন কবি ও বর্ধমান রাজ কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট অধ্যাপক এবং ব্যতিক্রমী কবি সুব্রত চক্রবর্তী | মনের দহনে পুড়ে পুড়ে এই শক্তিশালী কবি একদিন হারিয়ে গেলেন ভোরের কুয়াশায়|একজন ব্যতিক্রমী কবি সুব্রত চক্রবর্তী অকাল প্রয়াত হন, মাত্র, ৩৯ বছর বয়সে | তিনটি মাত্র কবিতার বই | ‘ বিবিজান ও অন্যান্য কবিতা ‘, ‘বালক জানে না ‘ এবং ‘নীল অপেরা’ | একসময় তাঁর অনেক কবিতার পংক্তি পাঠকের মুখে মুখে ঘুরতো | ‘আকাশ যে নীল নয়, ঘুড়ি জানে, পাখি জানে — বালক জানে না ۔۔۔’ হয়তো নিজের স্বল্প আয়ুর ঠিকানা মনে মনে জানতেন কবি | তাই হয়তো এই অমোঘ কবিতা তিনি লিখেফেলেছিলেন ۔۔۔۔
“বৃষ্টির ভেতরে ওই জবাগাছ, আমি তার ক্ষমা ও সারল্যে যেতে চাই | / ۔۔۔ এই ঘর, ভূতে – পাওয়া সারাদিন, বিছানা ও কাঠের টেবিল / নষ্ট মোম, আধখোলা কলমের নিস্তব্ধতা ছেড়ে চলে যাবো | / বৃষ্টির ভেতরে ওই জবাগাছ আমাকে ডেকেছে / সুখী ফুলে , পাতার আনন্দে | / ম্লান এই ঘর, এই যে জীবন, থেঁতো দিন, ভূতগ্রস্ত শব্দগুলি, চাদর ও নিঃসঙ্গ টেবিল, /
ক্ষয়া মোম, ঠান্ডা, মৃত খরখরে কাগজ / সব ছেড়ে বৃষ্টির ভেতরে, ওই জবাগাছ, / আমি তার সহজ সরল ব্যর্থতায় চলে যেতে চাই’
কেবল গভীর চিঠিগুলোতে, কমলকুমার মজুমদারের সঙ্গে আলাপনে পাওয়া যেত তাঁর ব্যথিত মনের বিপন্ন বিস্ময় !
যেমন ঋত্বিক ঘটক ۔۔۔۔| ঘনিষ্ট বন্ধু, কিংবদন্তি অভিনেতা ও নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য, তার শেষের দিনগুলোকে নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘ ইদানিং ঋত্বিক প্রায়ই বলতো, Life is a predicament | প্রায়ই | ভীষণ একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব কথাবার্তায় ব্যক্ত হতো | বুঝতাম জীবনটা যাপন করার ব্যাপারেই একটা সংকটের সৃষ্টি হয়েছে | চিরায়ত সংকট | তবু যে যখন এই সংকটে পড়ে তার কাছে তখন এটা মহাসংকট | সংকট উভয়ত | প্রাণেরও, প্রাণীরও | তারপরই কলকাতার পথে – প্রান্তরে দেখি এক নচিকেতার বিশৃঙ্খল অবিসংবাদী পদযাত্রা | অমৃতের সন্ধানে চূড়ান্ত আত্মপীড়ন | এবং সেই হননপ্রক্রিয়ার মাধ্যমেই নিজেকে বস্তুর এলিমেন্টাল অধিষ্ঠানে ফিরে পাওয়া | যুগসন্ধির এই সংক্রান্তি তিথিতে এই কাপালিকব্রতও মিথ্যার সত্য | ঈপ্সিত যখন সোনার পাথুরে বাটি, তখন সবটাই অংকের হিসেবে আসতে বাধ্য | কালের হিসেবে সবটাই ঘটনা | সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে যদিও সেটা অঘটন বলে গণ্য হতে পারে | সুতরাং অনভিপ্রেত |’
নীলকণ্ঠ সেজে যুক্তি তক্কো গপ্পে ঋত্বিক নিজের মুখে বললেন, ‘আমাদের জেনারেশনটা বাস্তবের সঙ্গে নাড়ির যোগ হারিয়েছে – হয় আমরা চোর, নয় বিভ্রান্ত, আর নয়তো কাপুরুষ হয়ে পালিয়ে যাবার মিছিল | খাঁটি কোনো বেটা না | এক শালাও না |’
ছবিতে নীলকণ্ঠের সেই ক্যামেরা দিকে তাকিয়ে দেশি মদ ছিটিয়ে প্রতিবাদের দৃশ্য আমরা ভুলি কি করে ! ‘কেন তুমি চেয়ে আছো মা, মুখপানে ۔۔۔’ | এই রবীন্দ্র গানের অব্যর্থ প্রয়োগ, আজো রক্তে তুফান তোলে | শিল্পী গল্পে মাণিক , মদন তাঁতির শুধু তাঁত চালানোর মধ্যে দিয়ে যে গল্প আমাদের বলেন, সেখানেও দেখি যে নিঃশব্দ প্রতিবাদ, শিল্পী সত্তা আর খিদের দ্বন্দ্বে জিতে যায় মনুষত্ব, সেই মানবিক প্রতিবাদ আজ কোথায় ? কোথায় সেই শ্রেণীকরণের উর্ধে মানুষের জিতে যাবার উদাহরণ আজ ?
করুণ হলেও নীলকণ্ঠের কাছে এই মৃত্যু কাম্য ছিল | এরপরেই প্রায় বিনা ভূমিকায় খুব সাধারণভাবে আত্মীয় পরিজনের অনুপস্থিতির সুযোগটুকু নিয়ে ঋত্বিক কুমার ঘটকও মারা গেলেন | তাঁর সেই পলায়নপর মৃত্যুমুহূর্তটি যেন তাঁর রচিত কোন চিত্রকল্পের সঙ্গে হুবহু মিলে গেলো | শেষপর্যন্ত তিনি নিজের কাছে নিজে পরাজিত হলেন | তাঁকে নিয়ে বহুদিনের পুরোনো সব সান্ত্বনা – আশ্বাস – অনুরোধ – রাগ – বিরক্তি হঠাৎ ফুরিয়ে গেলো | আর কারো কোনো দুর্ভাবনা রইলো না | সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর এই খেদজনক মৃত্যু প্রমাণ করে দিলো বৈশিক পতনশীলদের মধ্যে তিনিও একজন | তবু ভবিষ্যতে হয়তো তাঁর ছবি দেখতে দেখতে মনের মধ্যে অদ্ভুত ধরনের অনুভূতি সঞ্চারিত হবে | তখন মুগ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোগ করবো খানিক অস্বস্তি | শুনতে পাবো ঋত্বিকের কণ্ঠস্বর আবার যেন এ দেশের মধ্যবিত্ত বুদ্ধিমান সম্প্রদায়কে বলছেন, — ফু: — ! ‘
মরা ঘুঘুর একটা দরজা আছে ۔۔۔۔পাঁচ
‘দু’একটা অদ্ভুত রাস্তা থাকে
দু’একটা ফাঁকা বহির্ভূত রাস্তা
দু’একজন ধু ধু করা লোক থাকে সেই রাস্তায়
যারা ফেরে না, ফোকরে তাকায় না
যে পায়ে কাদা সেই পায়ে কাঁকর
এমন মরিয়া ম্লান, মায়াতুর, চালতার পচা ۔۔۔
জমা পড়ার একটা পাহাড় আছে দূরে
মরা ঘুঘুর একটা দরজা আছে ۔۔۔’
(রাস্তায় যদুনাথ — স্বদেশ সেন )
একটা পথ একদিন কখন যেন চলতে শুরু করেছিল | একটা সীমাশেষহারা পথ |
গন্তব্যহীন | উদ্দেশ্যরহিত একটা চলা | এই ভেতর ভিজে ওঠা চলা আসলে এই কয়েকমুহূর্ত বেঁচে আছি এটা বোঝার জন্য | নিজের বোধ, চেতনা, কল্পনা, একাকিত্ব, উপলব্ধি, নিজের আমি ‘ কে প্রতিদিন গ্লানি আর বেঁচে থাকার তুচ্ছতাকে ঘা দিয়ে দিয়ে নিজের একান্তে চাওয়া স্বাধীন সত্তাকে নিয়ে নিজের মতো করে বাঁচতে চাওয়ার চলা | যে যাবতীয় ভিড় থেকে প্রচার থেকে পিষ্ট হবার সমূহ সম্ভাবনা থেকে বাঁচিয়ে চলতে চায় | আর এই চলাচলের একান্ত আশ্রয় তার শব্দ লেখা | তার অবুঝ অনুভবের প্রবাহে |
সে ছোট ছোট শিকলি কেটে কাগজের নৌকো তৈরী করে ভাসিয়ে দেয় শহুরে বর্ষার ক্ষণিক জলের বৃত্তে | নীল পাথুরে আকাশ সেই জলেও মুখ দেখে | সেই নৌকো সওদাগরের নয়, নয় বাণিজ্য তরী | ছোট ছোট কাগজে গোল্লাছুট শব্দের ফসলে ভরা | সে লেখে সে শোনে সেই পড়ে কেবল | এই সফর যাত্রায় কোনো সঙ্গী হয় না | নির্ভার |
যাদবপুরের এক রিফিউজি কলোনিতে প্রায় অন্ধ অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন, সাহিত্যিক জগদীশ গুপ্ত | গত শতাব্দীর পুববাংলার কুষ্টিয়ায় জন্ম তার | অভাব আর দারিদ্র ছিল তার নিত্যসঙ্গী | যৌবনেই তাঁকে চাকরি নিতে হয় | নিতান্তই সাধারণ চাকরি | বোলপুর অদূরেই শান্তিনিকেতন | রবীন্দ্রনাথ তখন জীবিত | সেই প্রবল রবীন্দ্র প্রভাব ও প্রতিপত্তির যুগে, যখন তিনি কেবল শংসাপত্র দিচ্ছেন কবি থেকে কেরানি, এমনকি বিজ্ঞাপন দাতারা সেই শংসাপত্র পেয়ে আপ্লুত | সপরিবারে যাচ্ছেন বুদ্ধদেব বসু শান্তিনিকেতন | মোসাহেব মুৎসুদ্দিরা তাঁকে ঘিরে রীতিমতো কোলাহলমুখর, ঠিক সেই সময় জগদীশ কিন্তু অটুট একা এবং রবীন্দ্রপৃথিবী থেকে শত হাত দূরে | শ্রদ্ধাশীল কিন্তু একক | তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ , ‘বিনোদিনী’ |
তাঁর প্রথমদিকের প্রায় অনেক গল্পই অমনোনীত হয়ে ফেরৎ আসতো তাঁর কাছে | প্রথম গল্পগ্রন্থ ছাপার জন্য কোনো প্রকাশক পান নি | বোলপুরের এক সহৃদয় ব্যক্তি খরচ
দিয়েছিলেন | সেই বইয়ের তিরিশ পঁয়তিরিশ কপির বেশী বিক্রি হয় নি | পোকায় কেটেছে | নষ্ট জঞ্জালে হারিয়ে গেছে সব | ‘লঘু – গুরু’ , ‘অসাধু সিদ্ধার্থের’ মতো উপন্যাসের লেখকের প্রেরণা কি ছিল ? বরং কিছুটা রসিকতা করে প্রেরণা সম্পর্কে দিয়েছিলেন অদ্ভুত এক যুক্তি |
তাঁর স্ত্রী তাঁকে চুপ করে বসে থাকতে দেখলেই, হাতে একটা পয়সা দিয়ে বলতেন বাজার থেকে ধনে কিংবা কাঁচালঙ্কা কিংবা সোডা কিংবা মৌরি কিনে আনতে | অনবরত বাজারে ছোটা এবং বৌয়ের ফাইফরমাশ খাটা এড়াবার জন্যই তিনি কলম হাতে লেখার ভান করতেন| ভান করতে করতে একদিন হঠাৎই একটি গল্প লিখে ফেললেন | এটা বেশ ভালো ধরণের রসিকতা, কিন্তু সত্যিকারের আত্মউদ্ঘাটন নয় |
তাহলে ? জীবিত অবস্থায়, তার লেখালিখি নিয়ে কলম ধরেছিলেন, কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার, অধ্যাপক অনিলবরণ রায় এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ | কিন্তু পাঠক প্রীতি পান নি কোনোদিনও | ভাগ্যের হাতে মার্ খেয়ে খেয়ে বিপর্যস্ত লেখকের কলমে আমরা পেতাম নৈরাশ্য ও নিয়তির কাছে পরাজিত অদ্ভুত সব জটিল চরিত্র তাঁর উপন্যাস ও গল্পগুলোতে | এতটাই হৃদয় বিদারক বাস্তবতা ও নৈরাশ্য আর সেভাবে বাংলা সাহিত্যে আর কারোর লেখায় দেখা যায় নি | অথচ তিনিছিলেন একান্ত ভাবেই স্বতন্ত্র এবং একা | তিনি কারোর দ্বারা প্রভাবিত হন নি, কেউ তার দ্বারা প্রভাবিত হয় নি | কেবল এটুকু বিশ্বাস করতেন, হয়তো একদিন পাঠক তার লেখাকে চিনতে পারবে | তাই তাঁর ‘শশাঙ্ক কবিরাজের স্ত্রী’ নামের গল্পগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে আমরা দেখি,
তিনি একটি শ্লোক তুলে ধরেছেন ‘কালোহয়ং নিরবধি: বিপুলা চ পৃথ্বী’, ۔۔۔۔
তার চরিত্রে রোমান্টিকতা, আশাবাদ কিছুই ছিল না | ছিল না কোনো রকম প্রতিবাদ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে | তবু তাঁর একান্ত নৈরাশ্য আর মানুষের অন্ধকার দিক নিয়ে নির্লিপ্ত সাধনা ও রক্তাক্তমগ্ন লড়াইএর সাক্ষী তাঁর অদ্ভুত রসের একদম নতুন ধারার লেখাগুলি |
আমরা দেখি, নির্জন দুপুরে খালাসিটোলায়, এক চুমুকে জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো এক গ্লাস দেশি মদ, খালি পেটে ঢকঢক করে পান করে, না কাচা ঈষৎ ময়লা খদ্দরের লনফনে হাতাতে মুখ মুছে, কপাল কুঁচকে একরাশ বিরক্ত মুখে নিঃশব্দে বেরিয়ে যাওয়া ‘পুতুল নাচের ইতিকথার’ স্রষ্টা মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে | যিনি বন্ধুদের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে, অটুট আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাঁর প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’ জমা দিয়েছিলেন আরেক কবি ও দুঁদে সম্পাদক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কাছে | সেই গল্পের জন্য সেই যুগে সাম্মানিক পেয়েছিলেন তিরিশ টাকা | খোদ সম্পাদক, অচিন্ত্যকুমার নিজে বাড়ি খুঁজে খুঁজে মাণিকের হাতে টাকা তুলে দিয়েছিলেন | পদ্মা নদীর মাঝি, পুতুল নাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য, জননী, শহরতলি, মাঝির ছেলে, চিহ্ন উপন্যাসের কালজয়ী স্রষ্টার নিত্য সঙ্গী ছিল দারিদ্র | অথচ আপোষহীন, আদ্যন্ত বামপন্থী এই ক্ষণজন্মা সাহিত্যিকের শেষ যাত্রায় দু একজন লেখক বন্ধু ছাড়া কেউ ছিলেন না | কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, প্রকাশকদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাঁদা তুলেছিলেন, মাণিকের শেষ কৃত্যের জন্য |
সারাজীবন গর্বিত তরুণদের লিটিল ম্যাগাজিনে লিখেছিলেন কমলকুমার মজুমদার | স্বশিক্ষিত, বহুবিষয়ে তর্কাতীত জ্ঞানী, বাক বৈদগ্ধ্যে যিনি প্রায় সক্রেটিসের সমতুল, সেই কমলকুমার, জগদীশ গুপ্তের মতো অধিক পরিণত বয়সে তাঁর গল্প – উপন্যাসগুলো লিখতে থাকেন| একই ব্যক্তি, উচ্চাঙ্গের গণিত ও মেটাফিজিক্সের ওপর সিরিয়াস প্রবন্ধ পত্রিকার সম্পাদনা করছেন, আবার পাশাপাশি, রগরগে গোয়েন্দা পত্রিকার সম্পাদনা ! ‘হরবোলা ‘ নামক নাটুকে দলের পরিচালক, আবার, সিগনেট প্রেসের, প্রধান প্রাণপুরুষ, ডি • কে বা দিলীপ কুমার গুপ্তের অনুরোধে প্রচুর প্রচ্ছদ আঁকা | একই সঙ্গে দেশি মদ ও মুঠো মুঠো লবঙ্গ, প্রচুর ঝাল মশলার খাবার আবার বৌবাজারের ভীম নাগের দোকান কিংবা বালিগঞ্জের গাঙ্গুরাম থেকে বাছাই করা সন্দেশ ও সিঙাড়া খাওয়া ও খাওয়ানো, এতো বিপরীত মেরুতে চলা জীবন বা মনস্তত্ব, খুব কমই পাওয়া যায় | কমলকুমার ছিলেন তরুণ কবি – সাহিত্যিকের কাছের মানুষ | সমকালীন, প্রথিতযশা কেউ তাঁকে প্রায় চিনতেনই না | তিনি তাঁর দ্বিগুণ ছোট তরুণদেরকে ‘আপনি’ বলে কথা বলতেন | অথচ তাঁর মুখের ভাষা ছিল খাঁটি মধ্য কলকাতার| যাকে বলা হয় কাঁচা বাংলা | খালাসিটোলার এই মধ্যমণি যখন পরিণত বয়সে লিখতে লাগলেন, তখন তাঁর বাংলা গদ্য, প্রচলিত বাংলা গদ্য থেকে শত যোজন দূরে | কোনো কোনো পন্ডিত বলেন, বাংলা গদ্যভঙ্গি মূলত, ইংরেজি সিনট্যাক্স অনুযায়ী চলে | ফরাসি ভাষার পন্ডিত কমলকুমার ফরাসি সিন্ট্যাক্সে বাংলা চালু করেন | গুরু – চন্ডালী শব্দের অবাধ মিশ্রণে, প্রচুর নতুন নতুন শব্দ ব্যবহারে, অনেকটা কবিতার মতো জাদু ছড়ানো গদ্যে তিনি লিখে গেছেন, ‘সুহাসিনীর পমেটম’, ‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক’, ‘শ্যাম নৌকো’, ‘খেলার প্রতিভা’,
‘কয়েদখানা’, ‘নিম অন্নপূর্ণা’, ‘গোলাপ সুন্দরী’, ‘মল্লিকা বাহার’, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র মতো লেখাগুলো | খুবই অখ্যাত একটি লিটল ম্যাগে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ প্রকাশিত হয় | নিজের লেখা অংশটুকু কেটে নিয়ে, সাদা মলাটে বাঁধিয়ে, তিনি তরুণ পরিচিত সাহিত্যিকদের এই লেখা পড়তে দিতেন | তাঁর রচনার মতোই তিনি ছিলেন নিজেই রহস্যময়, দুর্বোধ্য এক মানুষ | তিনি মনে করতেন একশোর বেশী পাঠক থাকা, লেখকের পক্ষে অপমান | এখন যেটা দেখার, কমলকুমার মজুমদার যে উচ্চস্তরের বহুমুখী প্রতিভাবান ও মেধাবী মানুষ ছিলেন, তিনি পাঠক বলতে যা বুঝতেন, সেরকম একশো জন বাঙালি পাঠক আজো সেঅর্থে কোনো লেখকের ভাগ্যে জুটেছে ? বই পড়লেই পাঠক হয় না, পাঠকের পাঠক হয়ে উঠতে গেলে অর্জন করতে হয় সেই শ্রম শিক্ষা বোধ মেধা মনন ও সংস্কারমুক্ত চেতনার গভীরতা | নতুন, মানব সভ্যতার অগ্রগতির অগ্রপথিক | নতুনের দুঃখ নেই, কারণ সে সদ্য নতুন ও পথের দিশারী | নতুন ভাবনার কবি লেখককে সহজেই ম্যারাপ বেঁধে, তেড়ে, দলপাকিয়ে মুরুব্বি ও প্রতিষ্ঠিত লেখকদের সঙ্গে নিয়ে পলিটিক্স করে কুচক্রী হওয়া যায়, কিন্তু পাঠক হওয়া যায় না | পুরোনো সংস্কারকে ভেঙে নতুনকে বোঝার মতো মেধা সবার থাকে না| সেই স্তরের পাঠক চিরকালই কম, তাই এই একশো পাঠক, লাখখানেক নির্বোধ পাঠকের চেয়ে অনেক বড়ো |
যদিও আপতিক ভাবে, কমলকুমার ছিলেন, হাস্যময়, রসিকতামুখর, বৈদগ্ধের সঙ্গে আদিরসাত্মক বাক্যের মিশ্রণে এক অনন্যসাধারণ বাগ্মী | একটা প্রসিদ্ধ কথা আছে | যে, প্রকৃত বিদগ্ধ তাকেই বলে, যাঁর মস্তিষ্কটি হবে এরিস্টটলের মতো, মুখের ভাষা হবে চাষার মতো | তিনিই ফৈয়াজ খাঁর গান গাইতে গাইতে একই সঙ্গে রামকৃষ্ণ কথামৃত থেকে গল্প বলতেন, খিস্তি করতেন, আবার তাঁর হাত দুটো ব্যস্ত থাকতো কাঠখোদাইয়ের কাজে | জলরঙের ছোট ছোট ছবি আঁকায়, চাইনিজ ইঙ্কের অনায়াস স্কেচে | পৃথিবী, এই বিরলপ্রতিভার মানুষ বেশী পায় নি |
সত্যিই কি এই সব মানুষের সন্ধান বেশী পাওয়া যায় ? মরা ঘুঘুর একটা দরজা থাকে, ঠিক কোথাও ! বহুদূর দিগন্তসরণীর ভেতর, ঘৃণা – আক্রোশ – অবহেলা – উপেক্ষার ভেতর নম্রনীল অতিপ্রাকৃতিক জ্যোৎস্নার স্তব্ধ ধ্বনি কেবল ۔۔۔ |
বিলীন বিস্মিত মরা ঘুঘুর দরজার ওপারে অদ্ভুত পেঁচানো সিঁড়ি অন্তহীন নেমে গেছে সুড়ঙ্গের মুখে | গভীর সঞ্চারী, এই বিপুল জনারণ্যে একজন কমলকুমার, ঋত্বিক ঘটক, রামকিঙ্কর, মাণিক, জগদীশ গুপ্ত, সুব্রত চক্রবর্তী, জগদীশ গুপ্ত, স্বদেশ সেন হেঁটে যান অন্তহীন সময়ের স্রোতে | এরা হেরে গিয়েও হারেন না |
এই লেখার শেষে, একজন চির অপমানিত, ব্যথিত সাধকের প্রসঙ্গে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধু সমীর সেনগুপ্তের একটি অপূর্ব অভিজ্ঞতা এখানে তুলে ধরছি | তিনি হলেন, রামকিঙ্কর বেইজ | পাঠক, শিল্পীর কিছুই পার্থিব পাওয়ার নেই, নেই কোনো বৈষয়িক হিসেবনিকেশ | তার আছে কেবল চেতনা | আপাত – নির্জীব দেহের মধ্যগত সংহরিত জীবনবীজই সঞ্জীবিত হয়ে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে সময়ের ব্যবধানে উপভোক্তার মনে | পৃথিবীর অনন্ত ভূস্তরে, ইতিহাসের সংখ্যাহীন পল অনুপল ভরে মৃত সোনার মতো স্নায়ুজাল ছড়িয়ে শিলীভূত হয়ে আছে এইরকম সৃজনী শক্তির স্রোত | আমি সন্ধান করি তার | আর করি বলেই, সমীর সেনগুপ্তের বয়ান তুলে ধরছি এখানে ۔۔۔
‘তখন সকালের ট্রেন শান্তিনিকেতন পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে যেত | রতনপল্লী যাবার পথে রিকশা থামিয়ে দিশি মদের দোকান ‘আকর্ষণী’ থেকে শক্তি দুটো বোতল নিয়ে নিলেন | বাড়ির সামনে শক্তির হাঁকডাকে কিঙ্কর দা লুঙ্গি সামলাতে সামলাতে, খালি গায়ে বেরিয়ে এলেন | ‘আরে কবি, এসেচিস — আয় আয়, কিছু এনেচিস তো হাতে করে ? উটি কে ? ”
শক্তি হেসে বললেন, ‘ এনেছি কিঙ্কর দা | এ আমার বন্ধু সমীর |’
ঘরে ঢুকে দেখা গেলো চারদিকে জীর্ণতার ছাপ | দড়ির একটি খাটিয়ার ওপর মলিন বিছানা, ময়লা ধরে কালো হয়ে যাওয়া মশারি চাঁদোয়ার মতো তোলা | মেঝেয় চতুর্দিকে বিড়ির টুকরো ছড়ানো | মেঝেতে বসে পড়লেন রামকিঙ্কর | দেখাদেখি বসলেন বাকি দু ‘ জনও | খাটিয়ার তলা থেকে বেরুলো কয়েকটা বড়ো সাইজের মাটির ভাঁড় | আলকাতরা দিয়ে সীল করা শোলার ছিপি অভ্যস্ত হাতে খুলতে খুলতে আদিবাসী মেয়ে মুংরীকে ডেকে গাঁয়ে পাঠালেন,
যদি খানিকটা শুয়োর পোড়া পাওয়া যায় | বেলা তখন তিনটের কাছাকাছি | সকাল থেকে খাওয়া দাওয়া বলতে কিছুই হয় নি — এখন ঐ শুয়োর পোড়া, তাও যদি পাওয়া যায় |
অতি সাবধানে ভাঁড়ে ভাঁড়ে মদ ঢেলে প্রায় জাপানি চা — চক্রের পরিচালিকার মতো কমনীয় ভঙ্গিতে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন কিঙ্কর দা | শুয়োর পোড়া এলো, ফুরিয়ে গেলো |
আবার দুটো বোতল আনানো হলো, সঙ্গে ছোলা ভাজা, সে দুটোও ফুরিয়ে গেলো | আবার দুটো আনানো হলো বেশি পয়সা দিয়ে, তখন রাত দশটা বেজে গেছে | তারপর আর আমার কিছু মনে নেই | শুধু মনে আছে অফুরন্ত বাংলা মদ, অফুরন্ত বিড়ি, অফুরন্ত কথা, স্খলিত গলায় রবীন্দ্রনাথের গান —
কতো রাত জানি না, যখন আমার চেতনা ফিরে এলো, প্রচন্ড পিপাসা | চৈত্র মাসের শান্তিনিকেতনের গরম, তার উপরে ভাঁড়ের পর ভাঁড় নির্জলা দিশি মদ — ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, সম্পূর্ণ অচেনা জায়গা | হাত বাড়িয়ে দেখলাম পাশে শুয়ে অচেতন হয়ে ঘুমোচ্ছে শক্তি | কিঙ্কর দা কোথায় বুঝতে পারলাম না | জল পাই কোথায় এখন ??
উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখি মাথা এতো টলছে যে দাঁড়ানো অসম্ভব | ফের বসে পড়লাম | কিন্তু জল তো পেতেই হবে | হামাগুড়ি দিয়ে এগোলাম দরজাটার দিকে |
দরজা পেরিয়ে একটা দাওয়ার মতো জায়গা, বাঁদিকে, দরজার দিকে পিঠ ফিরিয়ে, আন্দাজ ৩০ ডিগ্রি কোণ করে একটা টুলের ওপর কিঙ্কর দা বসে আছেন, সম্পূর্ণ নগ্ন | লুঙ্গিটা কোমর থেকে কোথাও খসে পড়ে গেছে , টের পান নি |
তাঁর সামনে উঁচু একটা টুলের ওপর বসানো একটা অর্ধসমাপ্ত মাটির ভাস্কর্য, সিলিংয়ের একটা বাঁশের বরগা থেকে লণ্ঠনটা ঝুলছে |
ডান হাতের মুঠোয় ভাতের গ্রাসের মতো মাটির তাল | টুলে বসে, স্তব্ধ হয়ে কাজটার দিকে তাকিয়ে আছেন রামকিঙ্কর, স্থির | লক্ষ লক্ষ মশা ছেঁকে ধরেছে, তিনি টের পাচ্ছেন বলে মনে হয় না | চোখে একটা অদ্ভুত ভাবলেশহীন দৃষ্টি |
সেই অর্ধচেতন অবস্থাতেও বুঝতে পারলাম, অনধিকার প্রবেশ করে ফেলেছি | এখানে আমার কোনো জায়গা নেই, জল না খেয়ে মরে গেলেও, এখানে ঢুকে রামকিঙ্করকে জিগেস করা যায় না, জল কোথায় পাওয়া যাবে ?
জিগেস করলেও উনি বলতে পারবেন না |’
এই অবিস্মরণীয় ঘটনার বর্ণনা পড়ে পাঠক, আমি ও আপনি দুজনেই স্তব্ধ | এই আপাত প্রাকৃত নশ্বরতার মধ্যেও, আমাদের অর্ধস্ফুট বাক্য, বিস্ময় আর বিষয়ী পৃথিবীকে দুই জগতের মধ্যবর্তী বিভক্তিরেখায় এনে দাঁড় করিয়ে দেন এমন একজন যিনি তুচ্ছ বাহ্যিকতার পৃথিবীতে হেরে যাওয়া, আসলে সময়ের উদ্বর্তনে জিতে যাওয়া একজন
মহাকাল – রামকিঙ্কর | এরপর এই কবিতার টুকরো গুলো কেবল আমার আপনার জন্য অবশেষ নিয়ে পড়ে রইলো ۔۔۔۔
‘কোনোদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম — অবিরাম ভার
সহিবে না আর — ”
এই কথা বলেছিলো তারে
চাঁদ ডুবে চ’লে গেলে — অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে |”
( আট বছর আগের একদিন / জীবনানন্দ দাশ )
দরিদ্র , অন্ত্যজ, এক নিরক্ষর নাপিত পরিবারের ছেলে রামকিঙ্কর বাঁকুড়া শহরের
যুগীপাড়ায় গতশতাব্দীর প্রথম দশকে ( ২৫ মে, ১৯০৬ ) জন্মগ্রহণ করেন | কেবল অবিস্মরণীয় প্রতিভা, গভীর স্বজ্ঞা ও পূর্বসংস্কারবশতই তিনি হয়তো শিল্পী হয়ে, জীবিত অবস্থায় যাবতীয় কষ্ট অপমান আর শত প্রতিকূলতাকে জয় করে আপন মনে বিভোর থেকে কাজ করে যেতে পেরেছেন | যেহেতু তিনি তাঁর সমস্ত কাজগুলোই করেছেন অহৈতুকি কাজ ভেবে, কেবল মনের আনন্দে | যেহেতু বাহ্যিক প্রাপ্তির কোনো আশা বা ইচ্ছে ছিল না তার, সে হিসেবে তিনি ছিলেন সর্ব অর্থেই একক ও প্রথাগত যাবতীয় ঐতিহ্য পরম্পরা ও মধ্যবিত্ত সীমিত সামর্থ্যের উর্ধে | তাঁর কাজ আমি বহুবার শান্তিনিকেতন সহ অনেক জায়গায় অনেকভাবে খুঁটিয়ে দেখেছি | তার জীবনী নানাভাবে পড়ে মনে হয়েছে, তিনি আদি অনাদি কালের কালভৈরব বা নটরাজ | কথা বলতেন কম, তথাকথিত ভদ্র ঘরের ড্রইংরুম শোভিত নরনারীর সঙ্গে, নাগরিক জীবনের কূটকচালি তঞ্চকতা থেকে শত হস্ত দূরে থাকতেন | কেবল মানতেন রবীন্দ্রনাথকে, আর দিশি মদ আর হা হা হা হা অট্টহাসি আর প্রাণখোলা দরাজ গলায় রবীন্দ্রগান তথাকথিত ভদ্রসমাজের বাইরে অন্ত্যজ পল্লীর সরল সাঁওতাল গ্রামীণ জীবনকে | গুরু আচার্য নন্দলাল বসু, তার আরেক শিষ্য বিশিষ্ট শিল্পী, বিনোদবিহারীকে, মাটির দেয়ালে রামকিঙ্করকে ভাস্কর্যের কাজ করতে দেখে, ডেকে নিয়ে দেখিয়েছিলেন, বিনোদ, গিয়ে দেখো রামকিঙ্কর মাটির কাজ করছে, তার হাতের ডেক্সটারিটি দেখে বুক কেঁপে যায় | এ কি আর এক জন্মের সাধনায় হয়েছে | অনেক জন্মের সাধনা নিয়ে কিঙ্কর জন্মেছে | ‘যদিও আন্তর্জাতিক মননের অধিকারী মুক্ত মনের রামকিঙ্করের সঙ্গে, সনাতন ও ধ্রুপদী ভারতীয় শিল্পের ঐতিহ্য ও পরম্পরায় বিশ্বাসী নন্দলালের সঙ্গে, অর্থাৎ গুরু শিষ্যে প্রচুর বিরোধ হয়েছে | কিন্তু পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল অটুট | সত্যিই তো তিনি ছিলেন শিশুর মতো সরল অথচ সাধক এবং সবার ওপরে রক্তমাংসের মানুষ | তাঁর ও প্রেম আঘাত কামনা বাসনা আছে | তাই মণিপুরের মহারাজকুমারী ও পরবর্তী কালে নাট্যকার ঔপন্যাসিক এবং সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহিত্যিক এম • কে • বিনোদিনীকে ভালোবেসেও অপ্রকাশ্য প্রেমের দহন ও জ্বালা সহ্য করে কুলশীলহীন শিল্পী প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় কাটিয়ে দিয়েছেন সারাজীবন | যদিও পার্থিব চাহিদা ও মডেল হিসেবে সফল রাধারানী তার জীবনের সঙ্গে অনেক কুৎসা সহ্য করেও শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে ছিলেন | যাইহোক এই অহৈতুকি শিল্পী সাধককে ভালোবাসতেন তার ছাত্র ছাত্রীরা ۔۔۔আর আমি দেখি কেবল অব্যক্তের ভালোবাসায়, অনপেক্ষ ও দুর্মর আগুনগুলো আপন স্বভাববশে জ্বলে পুড়ে একদিন ঠিক নিভে যায় | কেবল পড়ে থাকে অস্তিত্বে নৈঃশব্দে নির্জনে থিতিয়ে কিছু অন্তর্লীন অন্ধকারের আলো | হয়তো সেই অন্তহীন আলোকিত অন্ধকারে আমাদের মতো মানুষের এই “ব্রাত্যজনের রুদ্ধ সংগীত ” একমাত্র বেঁচে থাকা | সূচীপত্রহীন এক উলঙ্গ সাদা পাতার সামনে স্বতঃসিদ্ধ শব্দজন্মের দায় নিয়ে ۔۔۔হয়তো জীবনানন্দ বুঝেছিলেন এই অমোঘ সত্য ۔۔۔۔
‘টের পাই যূথচারী, আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারিদিক মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা,
মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে ‘ ۔۔۔۔۔
বিরুদ্ধপথযাত্রী এই মানুষগুলোই আমাদের প্রেরণা | আর সেই পথেই আমি এখন যাই
আসি | কখনো সকালবেলায় , কখনো সন্ধের ঘোরে | বাজারের থলি, দুধের বোতল আর জীবনের আয়ুটুকু প্রাণপণে আঁকড়ে | এবং দেখি একগাদা ছাই ছেঁড়া ন্যাকড়া মরা ইঁদুরের কলজে ফুঁড়ে হীরে জ্বলছে, শত শরতের আয়ু নিয়ে ۔۔۔۔
( বিশেষ দ্রষ্টব্য — এই লেখা আসলে এই সমস্ত মহান স্রষ্টার জীবন থেকে জীবনীশক্তি নিয়ে, মানুষ হিসেবে নিজেকেই বাঁচিয়ে তোলার জন্য |
এই অন্বেষণ এদের মধ্যে দিয়ে নিজের ভাবনাকে এক্সপ্লোর করার চেষ্টা | এই যৎসামান্য ক্ষুদ্র প্রয়াস বা শ্রদ্ধাঞ্জলিটুকু প্রথম লেখা হয় , ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে | পড়ে ছিল | যেভাবে পড়ে থাকে অনেক লেখা | আবার নতুন করে , একটু ঘষামাজা করে পুনর্লিখিত হলো , এই দুহাজার কুড়ির অক্টোবর মাসে )
Posted in: October 2020 - Cover Story, PROSE