পিয়াল দাস ও তাপস দাস-এর কবিতা

অর্কেস্ট্রেশন

পিয়াল দাস ও তাপস দাস

একই অনুভূতিকে দুটি আলাদা মানুষ বা সত্ত্বা কিভাবে প্রকাশ করে তারই অনুসন্ধানের চেষ্টায় এই প্রয়াস। অস্তিত্বের সংকট, একাকিত্ব, এবং সেখান থেকে সম্ভাব্য উত্তরণের ইতিহাসের সন্ধান করে দু’জনের দু’টি দু’টি করে কবিতা রইলো।

অনিকেত

পিয়াল দাস

এই পথ তার বড়ো চেনা – চেনা নাকি?
পিচ রাস্তার গলি, সামান্য বাঁদিকে নেবে বাঁক,
তারপরে হাঁটু জল।
পটিয়সী সব জানে,কায়দা কানুনে দড়।
এক সর্বনাশ দিয়ে আরেক সর্বনাশ ঢাকে,
হাতের পাতায় তার ডানা ভাঙ্গা রক্তের দাগ রয়ে গেছে,
ধূসর সবুজ সেই জল ছুঁয়ে দেখে –
নিরালম্ব ওই হাতে কিছুই আঁটেনা।
অবিরাম অভিঘাতে ভিত ছাড়া উঠেছে দেয়াল
ওপারে উদোম জমি এলিয়ে রয়েছে –
অভিবাসী দীন করতল, ঠিকানাবিহীন।

বাসাবাড়ি

তাপস দাস

নিঃসঙ্গ চরে খাওয়া জঘন্য আরশিময়
কলহপর জেনেও তবু পড়শি রাখা ভালো।
আজানুলম্বিত সকাল, অপরাহ্নে বেহিসাবি সময়
ঢোলা পাজামার মতো লটপটে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, কালো
বেড়ালের ঝাঁক গিলে খেতে আসে ভরসন্ধ্যাবেলা
ঘর অধিকার করে। অন্ধকারে ভয় করে,
খাতাপত্রে লাথ মেরে পথে নেবে আসি, দেখি ভিখারির বাচ্ছা খেলা
করে খোবলানো রাস্তায় বসে, আমি তাদেরও অধম, জোরে
হাঁটা দি উদ্দেশ্যহীন, রগের শিরা দপদপ করে, জিভে
ধাতুর স্বাদ, ছতনাগ মোড়ে রাস্তার কল
থেকে আঁজলা ভরে জল খেতে গিয়ে তৃপ্তির অভাবে
বিরক্ত কেশে উঠি – এ তেষ্টা মেটার নয়। বিষাক্ত ধুতরোর ফল
থেঁতলে ঘেঁটে আকন্দের আঠা দিয়ে মেখে সেই ক্বাথে দোমেটে
করেছে আমারই বাজ পড়া কাঠামোকে। সমূহ মুকুর
টুকরো হয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ে, হেঁটে হেঁটে আরো হেঁটে হেঁটে
ক্রমশঃ তারার আলোকে চষা ক্ষেতে ঢুকে পড়ি, লোমওঠা কুকুর
আমার ছায়া থেকে দলবেঁধে দূরে সরে যায়- রাগ ও ঘেন্নায় ঢেলা তুলে
ছুঁড়ে মারি – তাক ফসকে যায়, হাতে শুধু
নোংরা লেগে থাকে। অথচ পড়শি হলে
গাছের ছায়ায় সবজেটে ঘাস হতো, বেগুনি ঘাসফুল ধূ ধূ
মাঠ ছেয়ে দেবে।

বোধিলাভ গাড়লের কাজ – আমি খুশি তেষ্টার জল পেলে।

যাত্রাপথে

পিয়াল দাস

দ্রব হয়ে আসে শ্লথ বিষণ্ণতা,
ওটাই দরোজা বুঝি?
গত জন্মের পাপ পুণ্য যা কিছু জমানো
ওই দিয়ে টুকটাক সাজানো রয়েছে।
শোবার ঘর সান্তোরিনি
বসার ঘর হালকা গোলাপী
বাহারি গাছের টব –
আর কিছু অলস সন্তাপ।
দুঃখকে খুঁজতে বেরিয়ে
টলতে টলতে শীর্ণকায় –
শূন্যের দিকে ছুটে যাওয়া।
আসলে কিছুই নেই –
কবাট ভেঙে হাড় কঙ্কাল
পরিপাটি প্রান্ত দুপুরে আসর সাজিয়ে বসে।
প্রেমের মুরিদ সব
তার শেষ জানাজায় শরিক হয়েছে।

বাসাবদল

তাপস দাস

দরোজায় টোকা দি। বহুকাল কোন দরজার
সামনে এসে দাঁড়ানো অভ্যাস নেই, তাই মৃদুভাবে আর
টোকা দিতে পারিনেকো আজকাল, আওয়াজ কর্কশ লাগে। বাসা নিঃসাড় –
‘কে?’ বলে কোন সাড়া নেই, সম্ভবতঃ ঘরের অন্ধকার
আমার মতোই বুড়ো হয়ে গেছে। রক্তে সুগার
আর পায়ে বাত, কেউ এসে ছুঁয়ে গেলো কিনা, তাতে তার
কিছু আসে যায় নাকো আজকাল। এই ভেবে দেহের সামান্য ভার
দরোজার বাম দিকে দিতে, ফাঁক হয়ে যাওয়া দূই পাল্লার
মাঝখান দিয়ে জেগে ওঠে অন্ধকারের সিঁথি। সহসা হাঁকার
দিয়ে বাড়ি বলে ওঠে ‘কাকে চাই? ‘ – কাকে চাই? কাকে চাই? আমার
ঘোলাটে স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করে ওঠে – আদিগন্ত পারাপার
জুড়ে ঢাকের গর্জনে, বিগত বাড়ির গঠন ধুন্ধুমার
ভেঙ্গে পড়ে আমার চতুর্দিকে! কাকে চাই? আজ আর তা জানাবার
মানে হয় কোন? আমাকে হতভম্ব দেখে সলজ্জ হেসে অন্ধকার
পাল্লা হাট করে খুলে ধরে – সিঁথি যেন রাজপথ! জগৎসংসার
ভুলে আমি হাঁ করে চেয়ে থাকি – শুনি উজ্জ্বল অন্ধকার
তার নাভিমূল থেকে বলে ওঠে ‘এতকাল রোদে ঘুরে ঘুরে কেনই বা আর
অসহায় আত্মপ্রবঞ্চনা – শুকনো ঘা, পুরনো বাড়ি, পুষে রাখা সমূহ দরকার?
তার চেয়ে অইখানে বসো! ভাত বাড়ি – নুন ও কাগজি নেবু, এই সামান্য উপচার,
তোমার হবে তো তাতে?’ আমি বসি। বসে পড়ি। নিরুদ্বেগ, দ্বিধাহীন। পুনর্বার।

Facebook Comments

Leave a Reply