যখন সবাই ছিল সংখ্যালঘু অথবা বাথরুমের জানলা থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে : নীলাব্জ চক্রবর্তী
যখন সবাই ছিল সংখ্যালঘু অথবা বাথরুমের জানলা থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে
সপ্তদশতম পর্ব
৩১
= = = = = = = = = = = = = = = =
লেখার কাছে যাব
= = = = = = = = = = = = = = = =
স্মৃতি এক প্রভাত হইল। শরৎ হইল তদনুরূপ। হেমন্তও, ক্রমে, ক্রমান্তরে। অনন্যোপায়। ফলতঃ, কেন্দ্রে কেন্দ্রাতিগে সরস্বতী, অর্থাৎ অধিষ্ঠানহেতু যে অনন্যতা। দেহ ঈষৎ ইত্যাদি ভ্যালেনটিনা রৌদ্র, সম্ভব হইল। অথচ, সকল পক্ষীই, বস্তুতঃ, গৃহাভিমুখে পুনর্ব্বার, শ্রীমৎ জীবনানন্দ বহুকাল পূর্ব্বেই এই সাতিশয় সত্য এবং সমুজ্জ্বল অনিবার্যতা লিপিবদ্ধ করিতে একপ্রকার বাধ্যতাই, স্বীকার্য হইয়াছিলেন। অনুরোধ। পার্শ্ব পরিবর্তন করিতেছে। কৃতজ্ঞতা। গমনপদ্ধতি যেমত অবাধ ও নিরপেক্ষ, তাহার উন্মুক্ত অভিমুখে, স্মৃতি পুনর্ব্বার আসিতেছে। অভিজ্ঞান। যে আমি, ভাষার ভিতর নামিয়া, যতি। অন্বেষণ করতঃপূর্ব্বক তাহার সমুদয় পালক ও চিহ্ন। অনুনয়…
নির্মিত স্মৃতি
এই নামে
কোনও কোনও ধাতব বাক্সের ভেতর
যেসব মাদারিপুর
ক্রমে
আলো অবধি
আর অপেক্ষা করছে না অভিমান
ওই কাঁচা ফ্রেম
অর্থাৎ
বেলজিয়ান কাঁচে
কেন যে
বৃষ্টি
কোথা থেকে সাদাকালো হয়ে এলো
মনের শরীর ভাগ হয়ে এলো…
# * # * #
— জলের দরে ফলের রস… জলের দরে ফলের রস… আসুন আসুন…
— হ্যাঁ, মানে, এই পাঞ্জাবীটা, আসলে, বাড়িতে তো, পরে খুব আরাম… ছিঁড়ে গেলেও, তাই, বাড়িতেই তো… পরি… হ্যাঁ, ওই একটু ছিঁড়েছে আর কী…
— এবার নাকি হিটলারকে মরণোত্তর নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার কথা উঠেছে!
— আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা, আমাদের উদারতা অমুকতমুক সব আসলে একচোখো এবং ঢ্যামনামির পরাকাষ্ঠা… নজরুল একা নন, শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন অনেক মুসলমান পদকর্তা… মুন্সী বেলায়েৎ হোসেন, সৈয়দ জাফর… খোঁজ নাও। ক’জন হিন্দু ঈদের গান বেঁধেছেন? হাহ, নাকি উদার, জ্ঞানী, মহৎ… হিন্দুরা জানে নিজের প্রতিবেশীর ধর্মাচরণ সম্বন্ধে যথেষ্ট? নিজেকে সেক্যুলার প্রমাণ করার দায় শুধু মুসলমানের? হিন্দুর নেই? দুর্গাপূজায় মুসলমানের ঠাকুর দেখার ছবি ভাইরাল হয়… কোনোদিন দেখেছ ঈদের হিন্দুর নামাজ পড়ার ছবি ভাইরাল হতে? দুই ঈদের ফারাক জানে কটা হিন্দু? জানে সবেবরাত কিসের উৎসব? ‘মহরমের শুভেচ্ছা’ কথাটা যে আদতে ভুল, জানে লোকে? সেক্যুলারিজম শব্দটা গুলিয়ে ঘেঁটে নিজের ইচ্ছে মতো করে নিজের সুবিধামতো খাওয়াচ্ছে তথাকথিত শিক্ষিতরা… খালি মুসলমানকেই হিন্দুদের মনের মতো হতে হবে? হিন্দুর দায় নেই মুসলমানের মনের মতো হওয়ার? কেন?
— দ্যাখো একটা কথা বলি, তারকোভস্কি দেখতে দেখতে তোমার বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত মনে পড়বে, না কি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত দেখতে দেখতে তারকোভস্কি… সে তোমার ব্যাপার। তবে, কিছু এসে যায় না এতে… আমি তো ফিল্মের এক্কেবারে কিছু বুঝিই না বলতে গেলে…
— বস কথা কম বলবে, শুনবে বেশী। বস হয়েছেন, কথা কম বলুন! অন্যের কথা একটু শোনার অভ্যাস করুন তো! আর কতদিন এভাবে চালাবেন?
— দ্যাহো দিহি! পাচিলডার উপ্রে ম্যালাডি কাসের টুকরা, পেরেক পুরেক, কাঁটা গাইথা রাখা আসে… হেইখানে একখান সোন্দরলাকান পাখি আইসা কেমুন বইসে…
— আরে! তোর পাঞ্জাবীটা তো ছিঁড়ে গেছে এখানে অনেকখানি…
— এই জিনিসটারই নাম ক্যাসেট! আগে এর মধ্যেই গান ভরা থাকত? কেমন এবড়োখেবড়ো দেখতে… এটা কি ল্যাপটপে চলবে?
— আনন্দ তবে করার জিনিস, অ্যাঁ! আমি তো এতদিন ভাবতাম ওটা পাওয়ার ব্যাপার…
— ওইখানে তো পুকুরটা অতদূর অবধি ছিল, সেই যে, মনে নেই, সিপিয়েম জোর করে ভরাট করে দিল, বছর ত্রিশ আগে… ওখানে বিশ্বদের বাড়িতে পুকুরপাড়ে একটা অশ্বত্থ গাছ ছিল… সবাই বলত বট গাছ… ওদের বাড়িটাকে স্পেসিফাই করত ‘বটগাছ-ওয়ালা বাড়ি’ বলে…
— ওই লোকটাকে, হি হি, দ্যাখ একবার… কোনও সেন্স নেই… একটা ধূসর রঙের পাঞ্জাবী পরেছে আর তার সাথে কেমন ক্যাটকেটে ডীপ নীল একটা মাস্ক… কেমন রে বাবা… ইসসসস…
— মিউনিসিপ্যালিটি থেকে আজ দু’জন মহিলা এসেছিল বাড়িতে। তুমি কতবছর ধরে প্রেশারের ওষুধ খাও খোঁজ নিচ্ছিল…
— হালার আকাশডারে আইজ কেমুন ঘুলা ঘুলা দেহায়… মনে লয়, কেডা জানি মাথার উপ্রে একখান ময়লা চাদর না কুনো তিরপল টানায় রাখসে নিহি…
— বিশ্বাস করো এই গোটা পৃথিবীটা, আমাদের জীবনের সবটা… সব… স্রেফ কবিতা দিয়ে তৈরী… এবং… প্লিজ প্লিজ, এটাও বিশ্বাস করো যে কবিতা বলে কিছু নেই আসলে…
— আমাদের হরি আজকাল কালীতলা মোড়ে ডিম নিয়ে বসছে… তোমরা তো বাবুলের দোকান থেকে ডিম নাও দেখি প্রায়ই… হরির কাছ থেকে নিতে পারো তো…
— চঞ্চল চৌধুরীর গান তো আগে শুনিনি দাদা। অসম্ভব ভাল লাগল ওঁর গলা। টোনাল কোয়ালিটি। মারাত্মক, হ্যাঁ। খুবই ভাল। অমিতকুমারের কথা মনে পড়ছিল বারবার…
— না না! ভারতনাট্যমের থেকে ওডিশীর ড্রেস অনেক বেশী সুন্দর…
— আজ কতক্ষণ ছাদে ছিলাম… একটাও কাঠবিড়ালী দেখতে পেলাম না তো!
— আচ্ছা, দৌড়াদৌড়ি আর লৌড়ালৌড়ি কি একই জিনিস?
— জানো, তখন জুলাই মাস… এটিএমের লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম… সন্ধ্যা হবে হবে… কেমন একটা মনে হল পুজো এসে গেছে… আজ সপ্তমী… ওই যে বছর বাইশ-চব্বিশের ছেলেটা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে চেক জামা, জিন্স আর সাদা স্নিকার পরে, এই এটিএম থেকে টাকা তুলে ও এখন বন্ধুদের সাথে ঠাকুর দেখতে বেরবে…
— সেকী! তুমি বাঙাল? একদম বোঝা যায় না তো! তোমাকে দেখে তো আমাদেরই মতো মনে হয়…
— সন্ধ্যা হয়ে এল… ক’টা বাজে? প্রেশারের ওষুধটা খেয়ে নিতে হবে… এক-একদিন ভুলে যাই… অনেক রাত্তিরে হয়তো মনে পড়ল…
— বড়দিনে আমরা ডগমগ হয়ে খ্রিস্টান সাজি… অহো পার্কস্ট্রীট… আহা কেক ও সাজানো ঝাউগাছের সন্ধ্যা… ওহো লালটুপি… ঈদকে নিজের ভাবি না কেন? যত সমস্যা ফেজটুপিতে আমাদের, না?
— আমি বড় হয়ে গাড়ি কিনব বাবা… আমি নিজে চালাব… পারব না? কবে লাইসেন্স পাওয়া যায়? কে দেবে আমাকে লাইসেন্স?
— ক্যামেরা সরাও ক্যামেরা সরাও…
— ব্রাহ্মণ্যবাদ নিয়ে কখনও কথা হবে না আমাদের?
— মানকচু একটু বেশী বেশী করে ঝাল দিয়ে রান্না করতে পারো…
# * # * #
সাদা ডায়েরী
এখন লিখতে বসে ভাবছি, আজ সকাল থেকে দুপুর অবধি, এই তো এইটুকু সময়ের মধ্যে কতগুলো কেমিক্যাল ব্যবহার করলাম নিজের প্রয়োজনে! জেল টুথপেস্ট, লিক্যুইড হ্যাণ্ডওয়াশ, শেভিং ফোম, শ্যাম্পু, লিক্যুইড বডি সোপ, আফটার শেভ, ডিও বডি স্প্রে, রুম ফ্রেশনার… হা হা… আমাদের জীবন আসলেই কী সহজসরল, না? সারাদিন কতকিছু এইভাবে… দিন আসলে একটা ‘অ্যাপ’-এর নাম এখন। ইনস্টল করুন। নতুন ভার্সন আপডেট করুন প্রতিদিন। অভ্যাস করুন। হ্যাঁ, অভ্যাস, আরেকটা অ্যাপ। ইনস্টল করুন। উইণ্ডোশপিং সেরে ফেরার পথে কর্তিত বৃক্ষের গোড়ায় অনেকটা জল ঢেলে আসুন। লক্ষ করুন ‘ভৌ দিন… ভৌ দিন…’ বলতে বলতে একদল লোক বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যায়। এই নির্বাচনী বহুদলীয় গণতন্ত্র ব্যাপারটা ঠিক কী আসলে? তুলো কমে যাওয়া ছোট কোলবালিশের মতো… একবার এদিকে ফাঁকা হয়ে চেপ্টে অন্যদিকটা ফোলে তো আরেকবার এদিকে সলিড বানাতে গেলে ওদিকটা চেপ্টে চুপসে শুধু খোলটুকু পড়ে থাকে। একবার এই পার্টি… একবার ওই পার্টি… তুই বেড়াল না মুই বেড়াল কেস পুরো…
২০০৫ সালের কামারহাটি পৌরসভার নির্বাচনের কথা মনে পড়ল হঠাৎই। মোট আসনসংখ্যা ৩৫। একটি দুটি আসনে বামফ্রণ্ট প্রার্থীর জয় নিয়ে সংশয় ছিল সংশ্লিষ্ট মহলে। একজনকে জিগ্যেস করেছিলাম, “কেন দাদা? যদি একটা সিটে তোমাদের বিরোধীরা জিতেই যায়, একটা কাউন্সিলর হয় যদি ওদের… তাতে কী এমন ক্ষতি?” প্রাপ্ত উত্তরটা স্পষ্ট মনে আছে এখনও… “না না, এলাকার ওভারঅল পোলিটিক্যাল ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যেতে পারে বিরোধীরা একটা দুটো আসনে জিতে গেলে।” তো, আল্টিমেটলি সেই তথাকথিত ‘ওভারঅল পোলিটিক্যাল ব্যালেন্স’ সেবার নষ্ট হয়নি অবশ্য। ৩৫ টি আসনের ৩৫ টি তেই বামফ্রণ্ট জয়লাভ করে। পুরোপুরি নিরঙ্কুশ ও বিরোধীশূন্য। এতদ্বারা কামারহাটি এলাকার মানুষের ‘বাম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ’ চরিত্র অক্ষুণ্ণ থাকে সেবার। মজার, না? যাইহোক, বলাই বাহুল্য, চেয়ারম্যান হন সিপিয়েমের নেতা আর ভাইসচেয়ারম্যান পদটি দেওয়া হয় শরিক সিপিআইকে…
= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =
অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখিত
= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =
(চলবে)
Posted in: NOVEL, October 2020 - Serial