মানিক সাহা-র কবিতা

আজ সকালে



অথচ আজ সকালে উঠে দেখি আমি
                        অন্য একটি জামার ভেতর
এত সকালেই তার রং গাঢ় হয়ে উঠেছে

বিস্তীর্ণ রাত পরেছিল যে মাঠে
তার প্রান্তের আত্মবিস্মৃতি যুগপৎ ইঙ্গিতময় ও সৌম্য

এমন হয়তো অনেকদিনই হয়েছে – দেখিনি কিংবা দেখার ধৈর্য
কারসাজি করে বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে গেছে,
বন্ধুদের বাড়িগুলি নরম হয়ে আসা আলোয় স্নিগ্ধ অরণ্যে আশ্রয় নিয়েছে

যে প্রলাপ থেকে নদী জন্ম নেয় – তাকে আমার মাথার ভেতর
ঢুকিয়ে দিয়েছে এক আদিবাসী গান
হাঁটতে হাঁটতে নদীর বুকের উপর অন্তহীন আকাশ
ফুটে উঠতে দেখেছি একদিন…

আর আমার শত্রুরা পানশালায় বসে আমাকে হিংসা করেছে
তাদের জামার বোতাম থেকে ধূসরবর্ণ মেঘ
পাঠিয়ে দিয়েছে সামাজিক মাধ্যমে
                        সেই মেঘে তুমুল বৃষ্টিপাত

আমি মেঘ ও বৃষ্টির নিচে এসে দাঁড়িয়েছি
যাবতীয় চর্যাচর্য – যাবতীয় নিন্দা ও ব্যভিচার – ভিজে গেছে

ভিজে যাওয়া এক রোমান্টিক মৈথুন

তার সামাজিক কোন মান্যতা না-ই থাকতে পারে
হতে পারে – এই যে আমরা যারা নীলাভ সবুজ ঘাসে
পা দিয়ে চাঁদ ছুড়ে দিই আকাশের দিকে
এই যে আমাদের বিরুদ্ধে নদী লুকিয়ে রাখার অভিযোগ
অথচ আমাদেরই মাথার উপর অব্যর্থ সামিয়ানা টানা

আজ সকালে উঠে
দিব্যোন্মাদ ধ্বনির কথা শুনেছি
বৃষ্টির তুমুল থেকে তারা সরে দাঁড়িয়েছিল
অজস্র হ্রেষাধ্বনি, উন্মাদপ্রায় কিউবিকল, ল্যাটিন সাহিত্য ও
স্প্যানিশ গান নিয়ে আমরা যখন অনিবার্য নক্ষত্রকে
তাচ্ছিল্য করার গল্প লিখছি, এবং
সিগারেট খাইনা বলে কবিরা যখন আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে, তখন

তখন দুকূল ছাপানো, বিচিত্র আকৃতির শপথবাক্যগুলি আমার
মিথ্যা বলে মনে হয়েছে
আমার পরাজয়ের অধিকার আমি কাউকে দিইনি বলে
তোমরা যুদ্ধসন্ধির সাদা কাগজ নিয়ে
                 আকাশ আঁকার ব্যর্থ চেষ্টা করে গেছ।



মফস্বলের কবিতা



ভিড়ের মধ্য থেকে কয়েকটি গাছ আমাদের ডাকছিল
আমাদের তৈজষপত্রাদি – লাবণ্যময় আলোয় ডুবিয়ে রাখা চোখ
স্তুতিবাক্যময় ময়দানের ঘোরতর বিশালত্ব – সবকিছুর অতীত
নিয়ে চমৎকার গান গাইছিল আমাদের প্রিয় ভিখারির দল।

বস্তুত অর্ধোন্মাদ কারখানা মালিকের
অযূত আয় ও অনাচার নিয়ে কেউ কোন কথা লিখিনি

সাধারণ, অতি মধ্যবিত্তের ভঙ্গুরতাকেই নশ্বরতা ভেবেছি এতদিন
আমাদের শরীর কোমর অবধি মাটিতে গেঁথে গেছে
                        আমাদের হিরণ্ময় সুখ – আলোছায়াময়

আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে
আমিষ উৎসবের বৃহত্তর আয়োজন আর অসংখ্য দন্ডনায়কের
                                        পেশিবহুল মৌনতা
আমাদের ক্লান্ত করে
আমরা ধারাবিবরণী শুনে অভ্যস্ত
আমরা ক্রিটিক ও জাজ সাজার অভিনয় করি

পাহাড় বেয়ে ওঠার মুহূর্তকে তোমরা বলো চাটুকারিতা
এবং অর্জনকে বলো অ্যাচিভমেন্ট ছোঁয়ানো পার্চমেন্ট

নগরের যে-কবি নায়ক হবে, যে-কবি নায়িকা হবে – যাদের
নিকট ভবিষ্যৎ জুড়ে ধীমতি সমুদ্রের তীর, বিস্তীর্ণ
                                        পাইনের সারি
যে-কবি শহুরে বলে গ্রামের বাতাস উপেক্ষা করার
চেষ্টা করে, অথচ যার কপালের দাগে দাগে
                        গ্রামের নিদারুণ মাটি লেগে আছে
তাদের মদ ও নেশার আসরে দেখতে মন্দ লাগে না।

অতরব এইসব পুরস্কার, অর্জন, অ্যাচিভমেন্ট – উপেক্ষা করে
আমরা নিকট ও দূর – অনস্তিত্বময় যার ঘ্রাণ
তেজপ্রবাহের ন্যায় বিকশিত ও নির্বিকল্প – সেই সবকিছু
                                           সাদরে গ্রহণ করি

আমাদের নদী ও সমুদ্রের ভেতর অনন্ত বেগুণীবর্ণ অক্ষরমালা
নাগরিক পরিহাস উপেক্ষা করে
সন্ন্যাসীর মতো তন্নিষ্ঠ ও ধ্যাণমগ্ন হয়ে থাকে।

Facebook Comments

Leave a Reply