গোলাপি সাইকেল পথ আর জ্বর হওয়ার রাত : কৌশিক চক্রবর্তী

কোথাও একফালি বিষণ্ণতা ছায়া ফেলে। ছায়াটা সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে, ছোটবেলার চাঁদের মতন। আমি একটা কবিতার খোঁজে হাঁটি। মনখারাপের এলোমেলো গলি দিয়ে। এই ব্যস্তবাগীশ শহরে। একটা হারিয়ে যাওয়া খাতাকে, একটা বারবার ফিরে পেতে চাওয়ার বৃষ্টিভেজা সন্ধেবেলায় একলা ছাতাকে আমি জড়িয়ে ধরি। “শূণ্যতায় কারা যেন কান্না বের করে খেয়ে নেয় লুকিয়ে লুকিয়ে…”
দূরে একটা সাইকেল করে একজন চলে যায়। তার সঙ্গে আমার আর দেখা হয় না। আমার একলার গাছতলায় আমি একা একাই ভিজে যাই। নিজের একলায়। তার সঙ্গে আমার আর কথা বলা হয়ে ওঠে না। আমার খুব অভিমান হয়। আমি তাকে ভুল সুরে গান বানিয়ে দিই। একটা অভিমান জমতে জমতে রাত্তিরের শিরশিরে শীত হয়ে যায়। আমার জ্বর হয়। একরাশ চোখজ্বালা নিয়ে আমি টলতে টলতে চেনা ফুটপাথ খুঁজি। “নামের মিহিন মেখে ওইখানে / শুয়ে আছে বয়ে যাওয়া অসুখের প্যারাগ্রাফ।”
আমার ঘুম না হওয়ার স্বপ্নে বারবার সেই ছমছমে বাঁশির শব্দ ভেসে আসে – পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে তারা পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন – এই সব রহস্যের রং তাই অন্ধকার বলে মনে হয় – আর তাই কালো অন্ধকার সেই কাচের দরজা দেখলেই আমার ভয় করে অথবা রাগ।
হাতের কাছে আধলা ইঁট ইচ্ছে করে সোজা ছুঁড়ে দিই – ঝনঝন করে কাচের টুকরোগুলো ঝরে পড়ে নিচে –– আমি নিজেই চিৎকার করে উঠি আর অসহ্য লাগে আমার আর কান্না পায় আর কী অবসন্ন লাগে আমার আর চোখের সামনে ভারী একটা কালো কালো কালো পর্দা নেমে আসে আমার আর ক্রমাগত হালকা লাগে আমার আর একটু আগেও যে আমি টেবিলের গাঢ় কাচে অস্পষ্ট হলেও নিজের মুখের ছবি বা সামান্য আদল অ্যাক্সিডেন্টালি দেখে ফেলে মুখ লুকোতে চাইছিলাম – এই একটু আগেও যে আমি’র গলার কাছটায় কিছু একটা আটকে থাকছিল – এই কান্না পাওয়া গ্রেগরিয়ান চান্টের মতন ছড়িয়ে পড়তে চায় – এই একটু আগেও যে আমি মনে করছিল রানওয়ে জুড়ে পড়ে আছে শুধু কেউ নেই শূণ্যতা – আকাশে তখন থমকিয়ে আছে মেঘ – মনে করছিল তার আবহমণ্ডল মেখে কেবল বেদনাবিধুর রাডারের অলসতা আর কিঞ্চিৎ সুখী পাখিদের সংবেগ আর এই কিছুক্ষণ আগেও যে জানতো এমন বিশাল বন্দরে বহুকাল থামেনি আকাশবিহারী বিমানযান আর তাছাড়া তখন এখানে ওখানে আগাছার জঞ্জাল আর শূণ্য ডানায় গতিবেগহীন হাওয়াবাতাসের অরণ্য – এই একটু আগেও যে বলছিল আই অ্যাম আ সিক্‌ ম্যান… আ স্পাইটফুল ম্যান… আই অ্যাম অ্যান আন-অ্যাট্র্যাক্টিভ ম্যান… সেই আমারই এবার কালো কফির গন্ধ নিয়ে কোনো একটা পরিচিত হাল্কাপল্কা সুর গুনগুন করতে ইচ্ছে করে – অভ্যেসবশত কলম ধরে রাখি আঙুলের ফাঁকে – অনেকদিন পর আমার আর খুন করতে ইচ্ছে করে না।
“চোখের শরৎ নিয় মাটি আসে, গন্ধ আসে / রেশম ভাঙতে ভাঙতে আয়নার ঠাণ্ডা / শুনতে পায় – গুঁড়ো চশমার হলুদ সেলোফেনের কোরাস”
এই ভুলভুলাইয়া শহরের অলিগলি পাকস্থলীতে ঘুরে বেড়ানোর এক নিজস্ব মজা আছে – বিশেষ করে, যতক্ষণ লেখা আমার কাছে কথা কয় না, দেখা দেয় না – তার সঙ্গে মাঝেমধ্যেই আমার এমন লুকোচুরি খেলা চলে – আমি তার পাঁচিলের সীমানা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারি না – আবার সেভাবে ভাবলে, এ অর্থহীন যুক্তি সাজানোর ক্লান্তি কেবল – আসলে আমিই চাই কিছুদিন নিজের মতন করে একা থাকতে – এমন একটা থাকা, যেখানে লিখতে চাওয়ার জ্বর হওয়া নেই – আমি তাই তাকে ফোনও করি না – ইচ্ছে করে না আত্মগোপনের দিনে কোনও কথোপকথনের – আনমনে বসে ভাতের থালায় নক্‌শা কাটতে আমার খুব ভালো লাগে – সম্ভবত সে-ও ছুটি চায় – তাই আমার লুকিয়ে থাকার দিনগুলোয় সে খুব বেশি ডাকাডাকি করে না – হয়ত সচেতন ভাবেই কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখে – নতুন করে পাব বলে, সে বারবার হারায় – কে বলতে পারে, আমি যেরকম ভাবে তার থেকে আড়াল খুঁজে যাচ্ছিলাম এতদিন, সে-ও তেমনই ছুটি চাইছিল একঘেয়ে জ্বরের ঘরবাড়ি থেকে – কিন্তু সে কি জানে, আমি কীরকমভাবে আমার নিজস্ব আণ্ডারগ্রাউণ্ডে প্রতিদিন তৈরি করছি এক ব্যক্তিগত গেরিলা যুদ্ধের নীলছাপ? আর তাই রাতের অন্ধকারে যখন একবারের জন্য হলেও তার সঙ্গে আমার কথা বলবার খুব প্রয়োজন তখন সে আর ফোন ধরে না – আমি টের পাই, আজ অনেকদিন হয়ে গেল, আমি এক ধারাবাহিক আত্মহত্যার বিবরণ ছাড়া আর কোনো প্যারাগ্রাফের মধ্যে নেই
আমার মনে হয় – আত্মহননই সবচাইতে সমর্থনযোগ্য পরিত্রাণ। খোলসে ঢুকে পড়ি – প্রজাপতি হব বলে। ট্রেন ছাড়ার শব্দ কানে আসে – আমি প্ল্যাটফর্মে একা দাঁড়িয়ে থাকি – স্বপ্নগুলো আবার জটিল জ্যামিতি হয়ে যায়। এত আলো, এত শূণ্যতা অথচ … আমি হাঁটতে থাকি … এই একলা সন্ধানের দিনগুলোয় কেউ কেউ ঘুমোতে পারে না – গোপনে গোপনে তারা খুন হয়ে যায়
যে কারণে ঘুম আসে না ওই উচু ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে আটকে থাকা এক চিলতে হলদে চাঁদেরও – আমার ফোন বাজে না – সে ডাক পাঠায় না – একটা সাইকেলের চাকার দাগে আমি চোখ পেতে দিই। একটা চুপি চুপি গানে আমি কান পেতে দিই। একটা আকুল করা হাসিতে একটা মায়াময় চোখের জন্য এই নির্বাসন এই আণ্ডারগ্রাউণ্ড এই ক্রমাগত মরে যাওয়া – তবু ছাড়তে চাই না তাকে – নিঃশব্দে অথচ গোপনে ঘাড়ের কাছে সে নিঃশ্বাস ফেলে চলে – জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার – দুজনে দুজনের মুখোমুখি হতে কি ভয় পাই তবে? শরীরে শরীরে তাই এত বর্ম – প্রতিদিন তাই নিজেকেই খুন করে চলাটুকুই আমার একমাত্র পরিত্রাণ –
“হাসপাতাল ফেরত জানলা দিয়ে স্যাঁতস্যাঁতে অসুখ / বাসি রোদ্দুর মেলে দেয়…” এই যে আমি টের পাই আমার প্রতিদিনকার এই মরে যাওয়া দেখে উল্টোদিকের আয়নায় উশ্‌কো খুশ্‌কো চুল না কাটা দাড়ি নিয়ে একটা মুখচেনা লোক দাঁত নখ শানাচ্ছে… আমার অসহ্য লাগছে – এই যে যত আলো-অন্ধকার বিমর্ষ শুঁড়িখানায় ভরে উঠছে আমার কলকাতা… আমার অসহ্য লাগছে – এই যে কেবলই মাংসের ম্যানিকুইনদের রতিভঙ্গিমার বিজ্ঞাপন… আর আকাশফোঁড়া বাড়িগুলোয় ঢাকা পড়ছে আমার এক চিলতে জানলার আকাশ… আমার অসহ্য লাগছে – আমি কি তাহলে আবার কয়েকটা ইঁট তুলে নিয়ে এলোপাথাড়ি ছুঁড়ে দেব এদিক ওদিক… চুরমার করে দেব সমস্ত দরজা জানলা খোলা বারান্দা – কে না জানে ক্যালেণ্ডার পৃষ্ঠাগুলো নিয়ে তার সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক… আমি কি তাহলে সবকটা দেওয়ালের গায়ে আলকাত্‌রা লেপে দেব – আমি বুঝতে পারছি না – অথচ সকলে কেমন জেনে গেছে, কী ভীতু, ওয়ার্থলেস, ক্লাসিকাল ভাঁড় আমি – আয়নার ভেতর থেকে সেই বিশ্রি লোকটা আবার হাসছে – সারা কলকাতা হাসছে, হাততালি দিচ্ছে কাপুরুষ ও ইম্পোটেন্ট জোকারদের মধ্যবিত্ত অক্ষরবিলাসে – আমার হাত নিশপিশ করছে –আমি আবার ঢুকে পড়ছি এই ভুলভুলাইয়া শহরের অলিতে গলিতে পাকস্থলিতে – মনে হচ্ছে আবার নিজেকে খুন করে ফেলতে পারি আমি…
“এক একটা রাস্তা থেকে কেউ কেউ পা পায়…” আর যারা পায় না? তাদের নির্জন পাড়ায় তাহলে কেবলই সন্ধে নামে, বলো? আমার যে ইচ্ছে করে, একবার একটা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াব, একবার একটা উঠোনে গিয়ে মেখে নেব চোখের জল। সবটাই তাহলে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতন?
এই তাহলে সাব্যস্ত হলো – বিষণ্ণ আততায়ী অথবা বধির জোকার, এ ছাড়া আর কিছুই হওয়ার নেই আমার –

Facebook Comments

Leave a Reply