মাতৃরূপেণ সংস্থিতা : জ্যোতির্ময় শীল
হাজরার একটু ভিতরে সংকীর্ণ বিপিন পাল রোড দিয়ে হাঁটলে আদি কলকাতার আমেজটা এখনো পাওয়া যায়। দু-ধারে পুরোনো আমলের ধাঁচে গড়া পর পর বাড়ি আর তার মধ্যে মধ্যে সরু গলি। স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ভাব জায়গাটাকে রহস্যময় বানায়। প্রায় সব বাড়ির সদর দরজার পাশে উঁচু দোর যেখানে রোজ বিকালে এখনো আড্ডা বসে। সে জন্যই জায়গাটা কলকাতার বুকে হয়েও পাড়া পাড়া ভাবটা এখনো আছে এখানে। এই বিপিন পাল রোডেই পরে মিত্তির বাড়ি যেখানে এক বৃহন্নলার দল প্রায় বার চোদ্দো বছর ভাড়া আছে।
সকাল সাড়ে ন’টা। অক্টোবর মাস। দিনটা দুর্গাপূজোর সপ্তমী। পাশের পাড়ার লোকাল প্যান্ডেল থেকে পুরোনো দিনের কিশোর কুমারের গান বাজছে। পূজোর লগ্নটা এবারে একটু বেলা করে পড়েছে। মিত্তির বাড়ির দালানে বৃহন্নলারা নাচ প্র্যাকটিস করছে। এই সময়, শবরীকে শাড়ি পড়ে ভিতরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আস্তে দেখে মিনতি জিজ্ঞেস করল,
‘এই..এই আমার ক্যাটরিনা কাইফ! কি র্য! এখন কোথায় চল্লি?’
‘মিষ্টিকে একটা জামা দিতে যাচ্ছি আরকি।’
‘বাবা! মেয়েটার জন্যে খুব পিরিত উথলে পড়ছে দেকচি। ঘরে এনে তুলবি নাকি!’
‘না গো মিনুদি! এই মেয়েটার সদ্য মা টা চলে গেল তো, তাই একটু…।’
‘অতো দরদ দেকাতে হবেনি বেশ্যার মেয়ের জন্যে। নিজের ঘর সামলাগে। আজ সপ্তমী খেয়াল আছে তো? আমরা কয়েকজন ময়দান যাবো একটু পরে। তুই আর মধু হাজরার সিগন্যালে থাকবি। পাঁচ হাজার টার্গেট আমাদের বুঝলি?’
শবরী ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে এলো। সদর দরজার কাছে এসে, মিনতির কথাটা কানে এলো ‘হুঁ! হিজড়ের মা সাজার সাধ হয়েচে! রেন্ডির মেয়েকে জামা দিতে যাচ্চে!’ সঙ্গে বাকীদের হাসি।
শবরীর বাপ-মার দেওয়া নাম ছিলো শবর। শবর সাঁতরা। খুব ছোটো বেলাতে যখন শবর পাড়ার মেয়েদের সাথে খেলাম বাটি খেলতো, দিদির জামা পড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতে নেচে দেখাতো তখন ওর মার অসব তোয়াক্কা করেনি। ওর বাবা অবশ্য ছেলের এরকম মেয়েলি ভাব দেখে মুখ ভার হয়ে যেত। ওর মা তখন বলত যে ‘বাচ্চা তো! অতো মেয়ে-ছেলে বোঝে নাকি? বড়ো হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ শবর বড়ো হতে লাগল কিন্তু ভিতরে মেয়েই থেকে গেল। প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই শবর নিজের আলাদা ভাবটা নিজেই টের পেতে শুরু করল যখন ক্লাসমেটরা ওকে দেখেই ‘আস্তে লেডিস’ বলে উত্যক্ত করত। প্রায় রোজই স্কুল থেকে কেঁদে কেঁদে বাড়ি ফিরত আর ওর মা ওকে সান্ত্বনা দিয়ে সামলাত। যত বয়স বাড়তে থাকল, এক একটা করে বিশেষণ জুটতে থাকল—’হিজড়ে’, ‘ছক্কা’, ‘মগা’, ‘হোমো’। ধীরে ধীরে, এসবও গা সওয়া হয়ে উঠছিল। কিন্তু এর পর ওর যখন ষোলো বছর, তখন মা হঠাৎ চলে যায়। আগলে রাখার মানুষ কেউ আর রইল না। শবরের বাবা শবরকে ছেলে বলে পরিচয় দিতে বরাবরই সম্মানে লাগত। মেয়েলি চালচলন উপরন্তু লেখাপড়ার গুণও নেই। মা মারা যাওয়ার পর থেকে ওর বাবা কথায় কথায় গায়ে হাতও তুলতে আসতো। ‘আগের জন্মের পাপের শাস্তি পেয়ে আমার এরকম ছেলে হলো।’ এ কথা অনেকবার শুনেছে তার বাবার কাছ থেকে। শবরের উপর মানসিক অত্যাচার বাড়ল যখন ওর দিদির পর পর কয়েকটা বিয়ের ভালো সম্বন্ধ ভেঙে যায়। বাপ-দিদি দুজনেই অকারণে ওকেই দুষতে লাগল। তবে এসব মানসিক যন্ত্রণা ক্লাইম্যাক্সে আসে তার একটা ভুলে। পাড়ার ছেলেরা একবার শুধুমাত্র খিল্লি করার জন্যই অনেক দেখানো অনুনয় বিনয় করে শবরকে নাটকে এক মহিলার পার্ট করার জন্য রাজি করালো। শবর আন্দাজ করতে পারেনি সেটা। যদিও সে কোনোভাবেই চায়নি হতে প্রথমে। এরপর নাটকের দিন সন্ধ্যেতে সে যখন স্টেজে শাড়ি পড়ে উঠল সবাই হো হো করে হেসে উঠল। প্রথমটাতে সামলে নিজের ডায়লগ বলার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসি আরও জোরালো হলো। বিদ্রূপের এক নির্মম হাসি পুরো মাঠে অনুরণন তৈরি করল। সে হাসি চাবুকের মতো বিঁধে তার মন স্বত্বা সব ছিঁড়ে দিচ্ছিলো। সে স্টেজেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো। হাসির থামলো না। শবর সেদিনই ভোর রাতে উঠে বাড়ির চৌকাঠ পেরোলো। আর ফেরেনি। বাড়ির কেউ খোঁজও নেয়নি বোধ হয়। আপদ বিদেয় হয়েছে আরকি।
শবর এদিক ওদিক করে শেষে এই মিত্তিরবাড়িতে এসে উঠছিলো। সেটাও বছর ছয়ের আগে হবে। মিনতি গুরুমা হয়ে তার নামের শেষে ‘ই-কার’ জুড়ে দেয়। বাকি বৃহন্নলাদের মতো নাচ, কথাবার্তা, চালচলন, শাড়ি, সালোয়ার কামিজ পড়া, মেকআপ সব আয়ত্ত করেছে আস্তে আস্তে। আগের নিরীহ শবর আর বাকি নেই কিছুই। শবরীর দলের এলাকা হলো হাজরার মোড় থেকে কালীঘাটের নর্থ অবধি। তাদের এই চত্বরের মধ্যেই একটা রেড লাইট এরিয়া পরে। সেই সূত্রে ওই যাকে বলে ‘ওপাড়া’র বেশ কয়েকজনের সাথেই আলাপ তাদের। আদতে এরা তারা সবাই তো সমাজের পরিত্যক্ত অংশের মধ্যে পড়ে। তারই মধ্যে মুনিয়ার শবরীর সাথে একটু খাতির হয়েছিলো। মুনিয়া ভালো বাংলা জানত না। ওর শুধু মনে আছে ছোটবেলায় ওকে ভোপালের কোনো এক কোঠি-বাড়িতে কেউ রেখে দিয়ে যায়। তারপর ভালো দাম পেলে ওখানকার চাচী ওকে ছেড়ে দেয়। তারপর সাত বছর ধরেই এখানে ছিলো। একটাই বাচ্চা পেটে ধরেছিলো। ভেবেছিলো ছেলে হলে সে তাকে একদিন নরক থেকে বের করবে। মানত ফললো না। মিষ্টি জন্মালো। মিষ্টি ডাকনামটাও শবরীরই দেওয়া। মুনিয়া শবরীকে বলত যে মিষ্টিকে নিয়ে সুযোগ পেলেই পালাবে। কোনো এক এন.জি.ও যদি একটু হেল্প করে বা তা না হলে লুকিয়ে। যেভাবে হোক পালাবে। আর তাও যদি না পারে তাহলে নিজে নিজের মেয়েকে নিয়ে মরবে। মিষ্টিকে তার মতো হতে দেবেনা সে। মুনিয়ার কোনো এক কাস্টোমার নাকি তাকে নদীয়ার দেওয়ানগঞ্জে ইট ভাটার কাজ জুটিয়ে দেবে বলেছে। ওখানে গিয়ে সেই মানব বাবুর কথা বললেই হবে। কিন্তু তাও হলোনা। মিনতির এইডস ধরা পড়ার তিন মাসের মধ্যেই চলে গেল মেয়েটাকে ফেলে।
শবরী মুনিয়ার ঘরের ভিতরে উঁকি দেখে সেখানে এখন অন্যজন এসেছে।
‘আচ্ছা বোন…!’ শবরী তাকে ডেকে মিষ্টির কথা জিজ্ঞেস করতে যাবে, ওই মেয়েটা শবরীকে দেখে ছুটে এসে দরজা দিতে চাইল, ‘এই! পয়সা হবেনি। যাও এখন। ডিস্টার্ব করুনিতো এখন।’
শবরী তার পুরুষ সুলভ হাত দিয়ে জোরে দরজার পাল্লা আটকে জিজ্ঞেস করল,
‘এই! মিষ্টি কোথায়?’
‘কে মিষ্টি?’
‘হুঁ… জানিসনা! যার ঘরে উঠেছিস তার মেয়ে!’, এটা বলে শবরী তার নহলী স্বভাব-বশতঃ তিনটে হাততালি দেয়।
‘ও! সে পিসিকে জিজ্ঞেস করো গিয়ে।’ এই বলে সে ধরাম্ করে দরজা দিয়ে দিল।
শবরী যখন পিসির ঘরে ঢুকল, তখন দেখে ঘর শুদ্ধু লোক। মিষ্টি কে সাজিয়ে গুজিয়ে পিসি একটা চেয়ারে বসিয়ে রেখেছে। কিছু খারাপ কিছু আন্দাজ করে শবরী জিজ্ঞেস করল,
‘পিসি! কি ব্যাপার!…মিষ্টি এরকম সেজেছে কেন?’
‘ও আচ্চা তুমি! সেই মুনিয়ার লাভার!’ এক মুচকি হাসি। ‘তা কেন সেজেছে জানুনি?’ আবার সেই বিদ্ঘুটে হাসি। এরপর একটু রহস্য করে হেসে বলল, ‘সিগন্যালে হাততালি দিয়ে টাকা কামাও আর আজকে পূজো… নতুন জামা পড়তে হয় জানুনি?’
শবরী খুব ভালো করেই ব্যাপারটা বুঝে করুন ভাব নিয়ে মিষ্টির দিকে তার আনা জামাটা দিয়ে দিল। এর পর পিসিকে জিজ্ঞেস করল,
‘কততে রফা হচ্ছে?’
শবরীর চোখে চোখ রেখে একটা ক্রূর পৈশাচিক হাসি নিয়ে পিসি বলল, ‘দেকো, মেয়েটার মুখটা চাঁদপানা। রংটাও পরিষ্কার। গতর হলে ভালোই রেট হবে।তাই…তাই…পঁচিশ হাজার চাইচি এদের কাছে।’ শবরীর শিরদাঁড়া দিয়ে যেন এক অসহ্য হিমেল স্রোত বয়ে গেলো। কিছু মুহূর্তের জন্য শবরী নিস্তব্ধভাবে মিষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কিছু না বলেই বেরিয়ে এলো।
চড়া রোদে থাকা শবরীর অভ্যাস আছে। তবু আজকে হঠাত করে অসহ্য মাথা ধরেছে। হাজরার সিগন্যালের কাছে এসে ফুটপাথের উপর বসে পড়ল সে। আনমনে মিষ্টির কথা ভাবতে ভাবতে, আজ অনেকদিন পর তার খুব মায়ের কথা মনে পড়ছে। তারও যদি মা বেঁচে থাকত, তাহলে তাকে বাড়ি ছেড়ে এসে এখানে উঠতে হতোনা। সে যেমনই হোক, মায়ের কোলে মাথা লুকোনোর ঠিক জায়গা হতো। এই সময় তার মনে হলো কে যেন তাকে পিছন থেকে মা বলে ডাকছে। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। পিছনে তাকিয়ে দেখে একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে পাশেই দাঁড়ানো এক মহিলার কোল থেকে তার চুল টানছে আর তাকে মা বলে ডাকছে। বাচ্চাটার মা এতক্ষণ খেয়াল করেনি। খেয়াল হতেই তার হাত ছড়িয়ে শবরীকে বলল, ‘ও কিছু মনে করবেন না দিদি! বাচ্চা তো! আর ও মা ছাড়া কিছুই বলতে শেখেনি…তাই…’ শবরী কিছু না বলে মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। নিজের অন্তরের স্নেহ মমতাকে যেন সে এখন স্পর্শ করতে পারছে।
শবরী সেখান থেকে তড়িঘড়ি করে মিত্তির বাড়িতে এসে তার ব্যাঙ্কের পাস-বইটা নিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে সব টাকা তুলে নিলো। বারো হাজার মতো। এরপর প্রায় ছুটে ছুটে পিসির ঘরে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘মিষ্টি কই?’ পিসি গম্ভীর মুখ করে বলল, ‘দর ওঠেনি। ও এখানেই আচে। তবে রাখব না। ওর মা’রে এইডস ছিল। কাস্টোমার আসবে না এখানে জানতে পারলে। আর তোমার যকন অত দরদ, টাকাকড়ি ফেল আর মাল’রে নিয়ে যাও।’ শবরী কথা না বাড়িয়ে তার তোলা টাকা থেকে হাসার টাকা রেখে দিয়ে বাকিটা দিলো পিসির হাতে। পিসি থুতু দিয়ে গুনে শবরীর দিকে তাকাল। ‘যা আছে সব দিলুম। আর মিষ্টিকে নিয়ে যাচ্ছি। পিছনে আসতে বারণ করো কাউকে।…’
মিষ্টিকে কোলে নিয়ে হন্ হন্ করে হেঁটে বেরিয়ে এলো। সেখান থেকে একডালিয়া পর্যন্ত হাঁটার পর খেয়াল হলো মিষ্টির চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে।
‘এইতো বাবু! না না! কিচ্ছু হয়নি। আমরা বেড়াতে যাচ্ছি তো। কয়েকদিন থাকবো সেখানে।’
‘কতায়?’, একটু ফুঁপিয়ে জিজ্ঞেস করল মিষ্টি।
‘দেওয়ানগঞ্জ। ইট কিকরে তৈরি হয় আমরা দেখবো সেখানে।’
ইতিমধ্যে 17B বাস এসে পড়ল। শবরী মুখে ভাল করে আঁচল চাপা দিয়ে কনট্রাক্টরকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই! হাওড়া থেকে দেওয়ানগঞ্জ যাওয়ার ট্রেন পাব?’
‘হ্যাঁ দিদি! নবদ্বীপ এ নেমে বাস ধরবেন। উঠুন! উঠুন! সিট খালি।’
শবরী মুখটা ভালো করে আঁচলে ঢেকে বাসের ভিড় ঠেলে পিছনের সিটে চলে গেল। এখন বেলা এগারটা কুড়ি। সপ্তমীর পূজোর লগ্ন সদ্য সদ্য পড়েছে। একডালিয়ার পূজোর প্যান্ডেলে তখন মাইকে বাজছে ‘ইয়া দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা…’
Posted in: October 2020, STORY