জুয়েল মাজহার-এর কবিতা

মৃতের চোখের নিচে

সর্প আর বৃশ্চিকের ভাবাশ্রয়ে কেটে যায় বেলা
মনোহ্রদতলদেশে জমা হয় অশেষ গরল

মেঘে মেঘে বিভীষিকা
ঢেকে যায় আকাশের তারা

মৃত্যুহিম চূড়া থেকে অবিরাম তুষার-চমকে
নেমে আসে পাষাণের পুঞ্জীভূত স্বপ্নভস্মসার;

খুনে লাল অগ্নিগিরি
রক্তমুখ পিপাসার অসীম বিস্ফার

রাত্রি এক ঘন আত্মরতি
অন্ধকার মায়াবনে স্মৃতিহারা পাখির কাকলি

পার্বতিক জনপদে পায়ে-পায়ে হিংস্র শিকারিদল আসে;
সর্প ও বৃশ্চিক আসে
রক্তে, বিষে ভরে দিতে প্রাচীন পৃথিবী

ডাকিনীকে ভালোবেসে
ডাকিনীর রক্তপদতলে
দৈত্য তার হৃৎপিণ্ড দিয়েছে অঞ্জলি;

তবুও বিফল! তার হাহাকারে
ভরে ওঠে আকাশের নম্র নীল পট

তারপর কোনো এক ভোরে
অনাথ কিশোরী তাকে আঁচলে কুড়িয়ে নেয়
অচেনা ফুলের কলি ভেবে

প্রেমিকের এই অভিজ্ঞান
ভোরের নদীর জলে
ঢেউ তুলে অগোচরে ভাসে

এই দৃশ্য নিরঞ্জন;

মৃতের চোখের নিচে
জ্বলে কতো অমর জোনাকি

ঘুম মার্চেন্ট

১.

কতোদিন ঘুম খাই না
ঘুমের অভাবে তাই হাঁউ-মাঁউ দাঁত ও করোটি

যারা চান শুষ্ক হতে
সেসব সাধুর মতো হতে চেয়ে
দেহ চায় ঘুমের সাধন

ক্লান্ত করুণ লাল ফ্যাকাশে ঘুমের পাতাগুলি
নাগালের বাইরে দোলে
ধরা দেয় না ; যেন আছে, তবু যেন নেই

২.

আমার ভেতরে, আমি টের পাই,অসংখ্য ফেরারি ঘুম
ঘাপটি মেরে আছে; আর আমি
মা-কাঁকড়াটি যেন। অপত্যের টানে আত্মক্ষয়ী;

ঘুমেরা আমার ছেলেপুলে;
তারা ক্রমে বড় হচ্ছে
আমাকে ভেতর থেকে খেয়ে তারা একদিন সুদূরে পালাবে;

হয়তো খেলবে তারা দূরে বসে নানাবিধ পাশার ছলনা;

তবু চাই, এ-ডাগর রাতটির চোখ ভরে থাকুক কাজলে

৩.

পাতা ঝরছে ঝিরি ঝিরি
ঝরে পড়ছে মনে ও বিকেলে;
হাওয়ার রোদন বাজে ঝাউয়ে আমি শুনি!

ঝাউয়ের বনের পাশে দেহ ফেলে উড়ে চলে বাজ;

আর আমার গোল করোটির
চাঁদি ফেটে ঘিলু ছিটকে পড়ছে মাটিতে

৪.

নীরব শ্মশানঘাট। অপার্থিব ছমছমে জলে
ঘাই মারে রক্তচক্ষু অশরীরী মাছ

না এসে উপায় নেই বলে
ছায়াছায়া-দেহ নিয়ে নিঃস্বর, নীরবে আসে
এইখানে একা কিছু লোক;

কতোকাল আগে তারা মৃত
বিনষ্ট ফলের মতো করুণ, পতিত

অথচ আশ্চর্য তারা ছিল ফুল্ল
ছিল গাঢ প্রণয়ে জীবিত;

—- তারা আজ পঞ্চভূতে
একাকার নিরাকার অনঙ্গ বিভূতি

নিজেকে বানিয়ে শ্যাম
নিজসঙ্গে খেলে বসে পাশা

৫.

আজ তারা পথে-পথে ঘুম খুঁজছে।
নাম ধরে ডাকছে তারস্বরে

শিশুকে নির্ঘুম রেখে, কপালে কাজলটিপ দিয়ে উদাসীন
ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি চিতাসরনির পথে চলে গেছে হেঁটে

৬.

আমার নিয়তি আমি জেনে গেছি তবে!
অনিবার্য চির অনুদ্ধার!!
আমার কপাল ফুঁড়ে গজিয়ে উঠবে কোনো
একচক্ষু ইবলিশের বক্র-তীক্ষ্ণ শিং

আমি খল, আততায়ী
আমি বিলজিবাব

খর নীল লকলকে জিভে
প্রণয়ীকে হত্যা করি আমি

দ্রৌপদীর বস্ত্র ধরে যে টেনেছে
আমি সেই মূঢ় পাতকী

অর্থহীন মৃগয়ায় কিরাতের মতো
অপরের বুক আমি ভেদ করি বিষমাখা তীরে

সহমরণের সাথী দুই চোর। তারা জানে
ক্রুশবাক্যে গেঁথে নিয়ে যিশুকে আমিই বধ করি!

৭.

আজ ভাবি, আমারও ঘুমের প্রয়োজন
করাল হৃদয় থেকে রক্ত আর পাপ ধুয়ে নিতে;

আমি তাই ঘুম কিনতে থলেহাতে
ঘুমের বাজারে চললাম ।

ঘুম-বেচা দোকানে গিয়ে দেখি:
আমি নিতান্ত নিরীহ লোক বলে
আমার ঘুমের হিস্যা কিনে নেয় লোভী ও বণিক!

৮.

এইবার টের পাচ্ছি
টের পাচ্ছি থেকে-থেকে
টলছে মেদিনী

আমার উপরে- নিচে
দোলনায় কারা দ্যায় দোলা?

যদি নিচে পড়ে যাই? পা-হড়কে উল্টে যদি পড়ি?

কে আমাকে কোলে তুলে নেবে
কে আমাকে প্রকাণ্ড জঘনে দেবে ঠাঁই?

৯.

নাগালের বাইরে বাতাসে কতো
উড়ছে-উড়ছে , দ্যাখো, ঘুমের রেশম

১০.

বাতাসকে পটিয়ে এবার
দু’তিন পাঁইট ঘুম আমি
আজ রাতে কিনতে বেরোলাম

Facebook Comments

Leave a Reply