ঘানি : উলুল অন্তর
মোবাইলফোনে কলেজ পড়ুয়া পুত্র তারেকের কাছে ক্ষমা চেয়ে আমজাদ প্রামাণিক এক রৌদ্রস্নাত দুপুরে ধানে ভরা জমির আইলে এসে দাঁড়ালো। পরনে তার শতছিন্ন পাঞ্জাবি আর পুরনো লুঙ্গি। লুঙ্গির কাছায় আকিজ বিড়ির একটা প্যাকেট, আর দেয়াশলাই। বৈশাখের হলদে দুপুরেও আমজাদ প্রামাণিকের দৃষ্টি ও কল্পনায় সবকিছুই নিকষকালো ঠেকে। সামনের ধানি জমি, আরও দূরে দিগন্তের আকাশ হঠাৎই কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। মহররমের দিনে সবাই যেন কারবালার শোকে কাতর হয়ে কালো সামিয়ানার নিচে আশ্রয় নিয়েছে। এমনকি আমজাদ প্রামাণিকের সাদা লুঙ্গিটা পর্যন্ত ছাইরঙা হয়ে গেছে। সালমার নিত্যদিনের ব্যবহৃত ব্লাউজটাও কি ময়লার আস্তরণে ঢাকা পড়ে কালো হয়ে যায়নি?
বেশ কয়েকদিন হল সালমা এই এক ব্লাউজই পড়ছে। গোসল করার সময় সে এক কৌশল অবলম্বন করে। ভরদুপুরে মোল্লাদের পুষ্করিণী নির্জন হয়ে পড়লে সালমা ধীরে ধীরে পানিতে নামে আর সতর্ক চোখে এদিক ওদিক তাকায়। তারপর ঘ্যাচাং করে ব্লাউজটা খুলে ফেলে পাড়ে রেখে ঘারে গামছা জড়িয়ে হঠাৎ শিকারীর কোঁচ দেখতে পাওয়া মাছের মত ডুব মারে। এভাবেই তিন ডুব দিয়ে গামছা দিয়ে উর্ধাঙ্গ মুছতে মুছতে পাড়ের কাছে এসে ব্লাউজটা আবার গায়ে জড়ায়। কিন্তু এভাবেও কি ইজ্জত ঢাঁকা সম্ভব? সেদিন ত আমজাদ প্রামাণিকের কাছেই ধরা পড়ে সালমা।
পাড়ে দাঁড়িয়ে আমজাদ দেখতে পায় তার স্ত্রীর উন্মুক্ত উর্ধাঙ্গ। বয়স বেশি না হলেও শরীরটা বুড়িয়ে গেছে। স্তনদুটো কয়েক বছর আগেও ছিল ডাবের মত সুগোল, সেগুলো এখন চুপসে গেছে। যেন লবণের সমুদ্রে ডুবিয়ে কেউ বের করে নিয়েছে ভিতরের
প্রাণরস। স্ত্রীর শরীরের এই হাল দেখে আমজাদ প্রামাণিকের প্রথমে কষ্ট হয়, বউয়ের ভরণপোষণে ব্যর্থ নিজেকে তুচ্ছ মনে হয় ক্ষণিকের জন্য। পরক্ষণেই মাথায় রাগ উঠে যায়।মাগী এভাবে গোসল করছে কেন? আমজাদ প্রামাণিকের টাকা পয়সা না থাকতে পারে, কিন্তু বউকে একটা ব্লাউজ যোগাড় করে দেওয়ার সামর্থ্য ত আছে! তা না হলে আবার কিসের মরদ? মাগী আজ যেমন আমজাদের চোখে ধরা পড়ল, এভাবেই লুইচ্চা শুক্কুরের চোখে কি আটকা পড়তে পারে না? অনাহারে অনাদরে সালমার মাই যতই নেবে যাক না কেন, লুইচ্চা বুড়া শুক্কুর নিশ্চয়ই তাতেই মধু খুঁজে বেড়াবে।
আমজাদের মনে পড়ে সালমাকে বিয়ের পরের এক ঘটনা। তেরো বছর বয়সী সালমাকে সবে বিয়ে করে এনেছে। এক দুপুরবেলা হাট থেকে ফেরার পর বাড়ির সামনে এসে দেখে তার রান্নাঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভিতরে তাকিয়ে আছে শুক্কুর। আমজাদ কাছে গিয়ে তার ঘাড়ে হাত রাখতেই সে চমকে ওঠে।কিন্তু চোখের কামাতুর দৃষ্টিটা ঢাকতে পারে না। শুক্কুরকে থাপ্পড় মেরে তাড়িয়ে ভিতরে ঢুঁকে আমজাদ দেখে সালমা ঘর্মাক্ত শরীরে ভাত রাঁধছে, শাড়ির আঁচল শরীর থেকে নেমে মাটিতে লুটিয়ে আছে। সেদিনই প্রথমবার সালমার গায়ে হাত তুলেছিল আমজাদ।
ঘটনাটা মনে পড়তেই আমজাদের রাগ সপ্তমে উঠে। মনে পড়ে যায় গু খেউক্কা শুক্কুরের নোংরা, লোভাতুর সেই চাহনি। পুকুরপাড়ে সালমাকে কিছু না বললেও সেই রাতে তার সাথে ব্লাউজ নিয়ে একচোট হয়ে গেল আমজাদের।
সালমার সেই ব্লাউজের রঙ ছিল লাল, সেটাও এখন কালচে হয়ে গেছে।
আমজাদ প্রামাণিকের একমাত্র পুত্র তারেক জেলা শহরের কলেজে অনার্স পড়ছে।তাকে মেসে থেকে পড়াশুনা করা এবং খাওয়ার জন্য মাসে হাজার চারেক টাকা পাঠাতে হয়। কিন্তু প্রতি মাসে চার হাজার টাকার ঘানি টানা কি চাট্টিখানি কথা? এদিকে বড় কন্যা ফাতেমার বিয়ে হচ্ছে না যৌতুকের টাকা যোগাড় হচ্ছে না বলে। বিয়ে হবেই বা কেন, ফাতেমার গায়ের রঙটা যে বড্ড কালো, শরীরটাও বেঢপ। এই মেয়ে কিনা সালমার মত পরীর পেটে ধরেছে! তারই বা কি দোষ! কালা রঙটা ত এসেছে আমজাদের কাছ থেকে।
এত সমস্যা সত্বেও আমজাদ প্রামাণিক কিন্তু তারেককে প্রতি মাসে ঠিকই টাকা পাঠায়। পুত্র তার মত মূর্খ কৃষক হবে না এইটুকুই চাওয়া।
কিন্তু এ মাসে আমজাদ পড়েছে মহা বিপদে। শুধু আমজাদ কেন, দেশের সব কৃষকই অন্ধকার কুয়ায় পড়ে খাবি খাচ্ছে। আর আশা করে আছে, কেউ হয়তো আসবে তাদের উদ্ধার করতে। কোনো ঈশ্বর কিংবা কোনো অলৌকিক ব্যবস্থা যা উপর থেকে লম্বা হাত বাড়িয়ে তাদের টেনে তুলবে। কিন্তু দিনকে দিন সেই আশার প্রদীপ নিভে আসছে, কৃষ্ণ গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে তারা।
কৃষকরা এই বিপদে পড়েছে ধানের দাম না পেয়ে। আমজাদ প্রামাণিক তিন বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছে। চাষ শুরু করার আগেই জমির মালিককে বিঘা প্রতি সাত হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। এছাড়া বীজ, সার, সেচের খরচ ত আছেই। এই পুরো টাকাটা আমজাদ প্রামাণিক এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছিল।
ধান কাটার মৌসুম এলে আমজাদ প্রথমে পড়ে কিষাণ সংকটে। গাঁয়ের চ্যাংড়া ছৈলপৈল এখন লাটসাহেব হয়ে গেছে।কেউ আর কামলা খাটতে চায় না। কেউ কেউ হয়তো রাজি হয়, কিন্তু একেকজন দৈনিক সাতশো থেকে হাজার টাকা ডিমান্ড করে বসে।
উপায়ন্তর না দেখে ফাতেমার বিয়ের জন্য জমানো টাকা দিয়ে কিষাণ যোগাড় করে আমজাদ প্রামাণিক এক বিঘা জমির ধান কাটে। ইচ্ছা ছিল এই ধান বিক্রির টাকা দিয়ে আবার কিষাণ লাগিয়ে বাকী দুই বিঘাও কেটে ফেলবে।
কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না। আমজাদ প্রামাণিকের হিসাবটা গোলমাল পাকিয়ে মাকড়সার জালে পরিণত হল।পায়ের নিচের সবুজ জমিনটা দুলে উঠল। ধান যে আর বিক্রি হয় না। এক মণ ধানের দাম কমে নেমে আসছে চারশো আশি টাকায়। এই টাকায় ধান বেচলে আর বউ বাচ্চা নিয়ে কৃষকদের আর খেয়েপড়ে বাঁচা লাগে না।
এক বিঘা জমিতে আমজাদের খরচ হয়েছে তেরো হাজার টাকার মত। সেখান থেকে ধান পাওয়া গেছে চৌদ্দ মণ। এই ধান সাড়ে চারশো টাকায় বেচলে বিঘা প্রতি লোকসান হয় প্রায় ছয় হাজার টাকা। ধান জমিতে পঁচলে লস, কিন্ত কাটলেই সর্বস্বান্ত!
ধানের দাম কমার কারণ আমজাদ প্রামাণিক বোঝে। এমন না যে দ্যাশটা চাউলে ভরে গেছে। কিন্তু চালকল মালিকরা ধান কিনবে না। খানকির বেটারা ধান ওঠার সময় না কেনার ভান করবে। ভাবখানা এমন যে ধানের কোনো দরকার নাই। আর ফড়িয়া হারামজাদারা বলে বেড়াবে, সরকার এইবার বিদেশ থাইকা বহু ধান আমদানি করছে।গুদাম ভইরা গেছে , তাই এবার ধান-চাল বেশি কিনবে না।
এইভাবে তারা দামটা কমায়। এদিকে এনজিও থেকে প্রতিদিন কৃষকের বাড়িতে ঋণ শোধের তাগাদা আসে। বাধ্য হয়ে তারা লোকসান মেনে নিয়ে ধান বেচে।
এই লোকসান সহ্য করার ক্ষমতা আমজাদ প্রামাণিকের নাই। চোখের সামনে আরও দুই বিঘা জমিভর্তি ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তা কাটার কথা আমজাদ কল্পনাও করেন না। কয়েক মাসের পরিশ্রম শুধু জলেই যায়নি, বরং অভিশাপে পরিণত হয়েছে। বিবি বাচ্চা নিয়ে এখন না খেয়ে মরার যোগাড়।
অথচ আমজাদ প্রামাণিকের ঘরের অবস্থা চিরকাল এমন ছিল না। ছোটবেলায় দেখেছে গোলাভর্তি সোনালী ধান। বাপ, চাচারা দিনরাত খেটে ধান বস্তাবন্দী করে হাটখোলায় গিয়ে বিক্রি করতেন। বেলা শেষে লুঙ্গির কাছায় টাকাপয়সা বেঁধে মোষের মাংস কিনে বাড়ি ফিরতেন। আহারে কি দিনই না ছিল তখন! সেই আমজাদ বড় হতে হতে সব শেষ হয়ে গেল। নিজেদের কয়েক বিঘা জমি চলে গেল পরের হাতে। আমজাদ বাপের চেয়ে কম পরিশ্রম করেনা, সেও ঘর্মাক্ত শরীর নিয়েই বাড়ি ফিরে, কিন্তু হাতে ব্যাগভর্তি সদাই থাকে না, চোখেমুখে শ্রমের মূল্য প্রাপ্তির আনন্দ ঝিলিক দিয়ে ওঠে না। ক্লান্ত বদনে থাকে শুধু অমাবস্যার নিকষ কালো রাত্রি।
অথচ রইস চোরের বেটা ইসমাইলকে দেখ! শালার বাপডা সারাজীবন অন্যের বাড়িতে সিঁদ কাটলো। টাকাপয়সাও কোনোকালে তেমন কিছু করতে পারেনি। কিন্তু ইসমাইল্লা এখন দুটা চালকলের মালিক। চলাফেরায় তার আভিজাত্য উগলে পড়ে। এবার নাকি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও দাঁড়াবে। কোন যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়ায় আল্লা ইসমাইল্লাকে এত কিছু দিল? আর এত পরিশ্রমী আমজাদ কেন কিষাণই থেকে গেল?
আমজাদ প্রামাণিক শত অনুসন্ধানেও এই প্রশ্নের খুঁজে পায়নি। শেষমেশ মেনে নিয়েছে সবই ভাগ্যের লীলাখেলা। নদীর এপার ভাঙে ওপার গড়ে–এইতো নদীর খেলা, সকাল বেলা ধনীরে তুই ফকির সন্ধ্যাবেলা।
সারা জীবন দুর্ভাগ্যের ঘানি টানা আমজাদ প্রামাণিক চায় না তার পুত্র তারেকও একই ভাগ্য বরণ করুক। তাই কষ্টের উপার্জনের সবটুকু দিয়ে তারেককে শিক্ষিত বানাচ্ছে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তাও যেন জেদ ধরেছেন, আমজাদের গোটা গুষ্টিকে কিষাণই রাখবেন। তাই যখনি আমজাদ উঠে দাঁড়াতে চায়, তখনি তার মাথায় ফেলে দেন পাহাড়সম বোঝা।
সারাদিনে একটি দানাও না পাওয়া আমজাদ প্রামাণিকের পাকস্থলী মোচড় দিয়ে উঠল। বাড়িতে গেলে হয়তো পান্তাভাত আর একটা কাঁচা মরিচ পাওয়া যাবে। কিন্তু আমজাদ প্রামাণিকের অনুতপ্ত মন পেটের কথা শুনতে চাচ্ছে না।
খানিক আগেই রাসেলের দোকান থেকে তারেককে এক হাজার টাকা পাঠিয়ে ক্ষমা চেয়ে এসেছে আমজাদ। তার নিজের ফোন নাই। রাসেলে মোবাইল থেকে পুত্রকে বলেছে, হামাক মাফ কইরা দেস বাপ, এই মাসে আর টাকা পাঠাবা পারমু না।
তারেক অবুঝ ছেলে নয়, পিতার কষ্টার্জিত উপার্জনের মূল্য সে বোঝে। তাই বাপকে স্বান্তনা দিয়ে বলেছে, সমস্যা নাই আব্বা। এই মাসে হামার কোনো পরীক্ষা নাই।শহরে থাকলে খালি খরচ।মেসের ভাড়া দিয়া হামি কালই বাড়ি চইলা আসমু।
কিন্তু আমজাদ প্রামাণিক নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে কই? পিতা কখন পুত্রের কাছে ক্ষমা চায়? জগতে এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা কি আছে?
আমজাদ প্রামাণিক শক্ত মানুষ, জীবনে অনেক প্রতিকুলতা সে মোকাবেলা করেছে। কিন্তু আজ যেন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। কোনো এক অজানা শত্রুর উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। ইচ্ছা করছে সেই শত্রুকে ধ্বংস করে দিয়ে নিজের গলাতে ছুরি চালাতে। না, আমজাদ প্রামাণিক তার দুর্দশার জন্য দায়ী কাউকে খুঁজে পায় না।
আমজাদ শেষ বিড়িটা ধরিয়ে সামনে তাকায়। ধানের শীষগুলো হেলে পড়েছে। জমিভর্তি ধান নিয়ে কি করবে সে? লোনের টাকাই বা শোধ করবে কীভাবে? এই জমিটাই কি তাকে সর্বহারা বানালো? তা নয়তো কি! কৃষিকাজ ছাড়া আমজাদ জীবনে আর কিছু শেখেনি। তাই সবকিছু দিয়ে সে জমিতেই বিনিয়োগ করে। আর সেই জমির ধানই কিনা বেইমানী করে বসলো।
অকস্মাৎ অদৃশ্য শত্রুটাকে সামনে দেখতে পেয়ে আমজাদ প্রামাণিক ক্ষেপে উঠল। তার কাঁপতে থাকা হাতটা স্থির হয়ে গেল। কিছু একটা ভেবে কিংবা না ভেবেই আমজাদ জ্বলন্ত বিড়িটা সামনে ছুঁড়ে মারে। তারপর দেয়াশলাই হাতে নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়ল জমিতে।
রবি কামারের তাতানো লাল থালাটা তখন পশ্চিমে ডুব দিচ্ছে। বিদায়লগ্নে তার পরাক্রমশালী রশ্মি স্নিগ্ধ রূপ নিলেও আমজাদ প্রামাণিকের দুই বিঘা জমি তখন হাবিয়া দোযখ। অগ্নিসমুদ্র বাতাসের গতিতে সবকিছু গ্রাস করে ফেলছে। দূর থেকে চেঁচাতে চেঁচাতে সেলিম, আক্কাস, ফারুকরা ছুটে আসছে। অথচ আমজাদের কোনো বিকার নাই। শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে সে আগুনের স্রোত দেখছে। তার অমানিশা কি কেটে গেল?
Posted in: September 2020, STORY