“প্রতিটি ফাঁকে একটি করে প্রশ্ন/ পেচ্ছাপ করে আর জল খায়” : উমাপদ কর

“লোকে বলে বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার
কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যেরও মাঝার।” (ঋণঃ হাসন রাজা, গীতিকার/ নির্মলেন্দু চৌধুরী, গায়ক)।

আমি-টা সুবল মিস্ত্রি। লক্ষ্মীকান্তপুর রেল-স্টেশন থেকে ৪-কিমি, নন্দপুর গ্রামে তার বাড়ি। বাড়ি মানে, ওপার থেকে অনেক উৎপটাঙের সঙ্গে আসা বাবা, উদ্বাস্তু শিবির থেকে এই চারকাঠা জমির ভোগদখল পেয়ে, টালির চাল আর খাপড়ার বেড়া— একটাই ঘর তুলেছিল, ছ’জনের সংসারে। ঠাকুমাকে সুবলের বেশ মনে পড়ে। শনচুল, ফোঁকলা পাঁচ-সাতটা দাঁত, ছেঁড়া থান-কাপড়, কিন্তু হাসিটা মরেনি। হাসলেই ঐ পাঁচ-সাতটার সাদা দেখা যেত, অন্ধকারে কালোমুখটা দেখা না-গেলেও। ঠাকুমা নাইতে গিয়ে বিলের এঁটেল মাটিতে ওগুলো রোজ পালিশ করত। বাবা এরেন্ডার শাদা কষওয়ালা ডাঁটিতে। মা ঘুঁটের ছাই-এ। বোনদের দাঁত মাজতে দেখেনি, হয়তো মার মতোই। আর নিজে মাঝেমধ্যেই দাঁত ঘষতে বাবার পথটাই। ভাইয়ের জন্ম এখানে আসার কিছুদিন পর। ছোটতে অনেকদিন ভাইয়ের দাঁত মেজে দিত, আমপাতায়। সে-সব কবেকার কথা। ঠাকুমা, বাবা-মা, চলে গেছেন একে একে। কিন্তু ঘরটা টালি থেকে টিন হয়নি, খুঁটি আর কখনো-সখনো দু-চারটে টালি বদলানো, আর খাপরায় মাঝেমধ্যে পট্টি মারা ছাড়া কিছুই করা হয়নি তার। ঘরবাড়ি ভালো হয়নি। এ-জম্মে হবেও না বোধহয়।

“আলেকজান্ডার বিক্রি করে–/ দাঁতের মাজন, / ট্রেনের প্রতিটি কামরায়”। (ঋণঃ রুদ্রেন্দু সরকার)।

শিয়ালদা থেকে ফেরার পথে সুবল উসখুশ করে। সুভাষগ্রাম পেরিয়ে গেল, তবু আলেকজান্ডার এলো না দাঁতের মাজন নিয়ে, কী ব্যাপার! পরশুই শেষ, গতকাল নেওয়া হয়নি, আজ নিতেই হবে! এখন পুরোনো অভ্যেসটা ছাড়তে হয়েছে। আলেকজান্ডারের মাজন গুঁড়োগুঁড়ো, ছাই রঙের। আঙুল দিয়ে বেশ ঘষে নেওয়া যায়। ব্রাশ লাগে না। আলেকজান্ডার তারই বয়সী, ৫৬-৫৭। লক্ষ্মীর দু-স্টেশন আগে নামে। কম টাকায় মাজনটা মন্দ নয়। চলে তো যাচ্ছে। ছোটো ছেলেটা উছপিছ করে ঠিকই, কিন্তু মেয়েটা কিছু বলে না। বুঝদার হয়েছে খুব। টুথপেস্ট-ব্রাশ যে ঠিক তাদের জন্য নয়, এটা বুঝতে তার সতেরো বছর বয়সের দরকার হয়নি। বারো-র ছেলেটা আদুরে আর স্কুলে যায়। সুবল ভাবে, ব্রাশ-পেস্ট ওকে কিনে দেবে। কুলিয়ে উঠতে পারে না। এই তো চৈত্র মাস আসছে, ঝড়-টড়ের আগেই এ-বছর খুঁটি পালটাতে হবে। ওই শোনা যাচ্ছে আলেকজান্ডারের গলা পাশের কামরায়।

“কেউ কেউ অবশ্য বলতেই পারে
‘এখানে যে একটা ঘর ছিল!’
আমি তাদের মনে করিয়ে দেব ‘হ্যাঁ ছিল’,
প্রয়োজনে দেখিয়ে দেব টুকরো টুকরো ঘরের অস্তিত্ব
পকেট থেকে থলে থেকে বুক থেকে
ওরাও লাফিয়ে উঠবে
কিন্তু ঘরে ঢুকতে পারবে না সাজাতে পারবে না
আমি ঘর বইতে বইতে নাবিক হতে থাকব…” (‘নাবিক’ শেষাংশ/ আলোর হাঁসুয়া /স্বকৃত)

সুবল নাবিক হতে পারত। থাকে সমুদ্রের কাছাকাছি, কিন্তু হয়নি। হয়েছে কলের মিস্ত্রি। সবাই সুবল মিস্ত্রি বলে ডাকলেও, নিজে জানে সে মিস্ত্রি নয়। কলমিস্ত্রি কেষ্টর হেল্পার। কবে সেই অনন্তকাকার আন্ডারে কাজ নিয়েছিল হেল্পারের! তারপর বেশ কয়েকবার মিস্ত্রি-বদল হয়েছে, কিন্তু সে থেকে গেছে হেল্পারই। তার আর প্রমোশন হয়নি। মিস্ত্রি হতে গেলে যে সামান্য পুঁজিপাটাটুকু দরকার, সেটাও কোনোদিন জোগাড় করে উঠতে পারেনি। এর চেয়ে মহাজনের মাছ-ধরার দলে ভিড়লে মন্দ হতো না। রোজরোজ লক্ষ্মী-শিয়ালদা– জান কয়লা। হয়তো ঘরটাও মজবুত করতে পারত। কী জানি কবে ঘরটা ভেঙে পড়বে! তখন কী করবে সুবল? খুব ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। এই হলো সংসার বওয়া আর বাওয়া। আছে আবার নাইও। বিয়ের পরপরই সুমুর মা বলেছিল, ‘দাদা দিনের পর দিন সমুদ্রে পড়ে থেকে ভালোই কামাই করে’। কিন্তু ততদিনে সুবলের আর কলকাতা ছেড়ে সাগরে পড়ে-থাকায় মন টানেনি। সদ্য বিয়েকরা বউ ছেড়ে সাগরে পড়ে থাকা দিনকেদিন, বয়সটাও ছিল বাড়তির দিকে, ৩৬-৩৭। বাবা মারা যাওয়ার পর গোটা সংসার তার ঘাড়ে ঝপাং এসে পড়ায় বিয়ের ফুলও সময়ে ফোটেনি। অনেক কিছুই সময়ে হয়নি তার। ৭১ সালে বাবা-মার হাত ধরে ৭-৮ বছরের অবোধ সুবল উদ্বাস্তু শিবিরে ঠাঁই পেয়েছিল যেদিন থেকে, সেদিন থেকেই তার সব কিছুতে লেট চলছে। ক্লাস-টুয়ের না-দেওয়া পরীক্ষাটা আর দেওয়া হয়নি। স্কুলেই যায়নি। পিঠোপিঠি বোনটাকে বিয়ে দিতে বাবার কালঘাম ছুটে যেত, যদি না তার কামাইয়ের গোটাটা জুড়ে যেত। পরেরটা অবশ্য ভেগে বেঁচেছিল। আর সবচেয়ে আদরের ছোটো ভাইটাকে পড়াতে গিয়ে সংসারে আর সংখ্যাবৃদ্ধির কথা ভাবতেও পারেনি। ভাই এখন সোনারপুরে প্রাইমারি স্কুলের টিচার। ঘর বানিয়েছে শহরের শেষপ্রান্তে, বউ আর দুটো বাচ্চা। খুব সুন্দর। রোজ সকালে ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজে।

“মন রে কৃষি কাজ জানো না—
এমন মানব-জমিন রইল পতিত
আবাদ করলে ফলত সোনা।” (ঋণঃ রামপ্রসাদ সেন)

কৃষিকাজের জমি ছিল না তাদের। বাবা কী-কী করে যে সংসার চালিয়েছে, বাবাই জানে। কারণ, বাবা তো চাষবাস ছাড়া কিছুই তেমন জানতো না। ঠাকুমা বলতো, বাবা নাকি জমিতে সোনা ফলাত। বেশ কিছুটা জমি ছিল ওদের। বাবাই গোটাটা দেখভাল করে, গায়ে-গতরে খেটে সংসারটা চালাতো। ব্রাশ-পেস্ট হয়তো ছিল না, কিন্তু গন্ধ-তেল-সাবান ছিল। ঠাকুমা আর মায়ের মুখে সব শোনা। দেশভাগের সময় দাদু আসতে চায়নি, জোতজমি ছেড়ে। জমিই তাদের মা-বাপ। মা-বাপ ফেলে যাওয়া যায়! কোনোভাবে ভয়ে-ভক্তিতে থেকে গিয়েছিল। কিন্তু ৭১-এ বাবা আর কোনো রিস্ক নেয়নি। খানসেনা আর রাজাকারের ভয়ে পালিয়ে এসেছিল এই দেশে। ঠাকুমার কথায়— ‘রাইক্ষসগুলান য্যান গিইল্যা খাইব। কী তুড়জুড়! কয়, ধইর‍্যা লইয়্যা গিয়া গুলি কইরা ঝাঁঝরা করব, নয় কতুল করব তলুয়ার দিয়া। আর স্যানারা আইয়া যেদিন মণ্ডলবাড়ির মাইয়্যাগুলাইনরে বেজ্জত করল, তখন তর বাপে সব ফ্যালাইয়া থুইয়্যা রাতারাতি পালাইয়া আইল। বুঝস না, রাজাকরগুলাইন ছিল আসল রাইক্ষস। আমরা পালাইলেই তো হ্যাগোর সুবিধা। জোত-জমি-বাড়ি হগলই দখল করব। রাইক্ষসগুলাইন মরেও না।” ছোটোবেলায় মার মুখ থেকেও শুনেছে জোত-জমির কথা। গেরস্তঘর। পাতপেড়ে ভিক্ষুকরাও খেত পঞ্চাশ-সনে। “তর বাবায় না-করতে পারত না। শ্যাসে আমাগোরই ধানে কম পড়ছিল। হেই তর বাবাই সবদিন ভরপ্যাট খাইতে পায় নাই। লুকটা এমনিই এত তড়াতড়ি গ্যালো গা! হেই খানস্যানারা যখন বাড়ির সামনে দিয়া যাইত, কুথায় যে লুকাইয়াম তা খুইজ্যা পাইতাম না। হ্যারা পারে না এমন কাজ নাই। একেকটা য্যান রাইক্ষস। সব গিইল্যা খাইব। আর গাঁয়ের ক’ট্টি জুড়ছিলো হ্যাগোর দলে। অখন হ্যারাই খাইতাছে হগল। আর আমরা না-খাইয়া মরি। ভগমান এর বিচার করব। করবই।” বড়ো হয়ে সুবল জানে না ওদের বিচার আদৌ ভগবান করেছেন কিনা? কিন্তু আজ রাক্ষসের না-দেখা মুখগুলো তার চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়। বিরাট হাঁ-মুখ, লম্বা দাঁত, কালো কুচকুচে মুখের মধ্যে অতিরিক্ত সাদা, আর কয়েকটা মাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইরের দিকে দৌড়। তার মাথায় খেলে— দাঁত আর নখই ওদের ধারালো অস্ত্র। তা দিয়েই রক্তচোষা, মাংস চিবোনো, মায় হাড়গোড়। আচ্ছা, ওরা কি দাঁত মাজত কখনো? হঠাৎই পকেটের মাজনে হাত চলে যায় তার। সপাটে একটা প্রশ্ন তলপেটে লাথি মারে। পেচ্ছাপ পেয়ে যায়। সত্যিই কি এইসব রাক্ষসরা দাঁত মাজে? যারা মানুষ গিলে খায়, বাড়িঘর জোত-জমি, স্থাবর-অস্থাবর দাঁত দিয়ে চিবিয়ে খায়, তাদের আবার দাঁতের মাজন কী দরকার! দিনমান যা চিবিয়ে খায় তাই তো ওদের দাঁতের মাজন। স্টেশনে নেমে বাইরে বেরিয়েই তাকে একবার পেচ্ছাপে বসতে হবে।

“কাল সকালে কখন সূর্য উঠবে!
কলেরা আর কলের বাঁশি আর গণোরিয়া আর বসন্ত
বন্যা আর দুর্ভিক্ষ
শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ”। (ঋণঃ সমর সেন)

সাইকেলটা আজ আবার আসার সময় পাংচার হয়ে গেছে। আর টানতে পারে না ওটাও। সেকন্ড-হ্যান্ডেরও বয়স হয়ে গেল একযুগ। দীপুর দোকানে লিক্‌ সারাই করতে বলে এসেছে। লিক্‌ না ফেটেছে, কে জানে! শতছিন্ন, কোথায় আর পট্টি লাগাবে? নিমেষে সাইকেলের টিউবটাকে তার নিজের সংসার মনে হয়! কম গতরখাটুনি তো গেল না সেই এগারো-বারো থেকে! কম অপমান আর লজ্জাও না! বাগাল খেটেছে প্রায় দু-বছর। সাত-সকালে যাওয়া, সন্ধ্যার কিছু আগে ফেরা। যাওয়ার সময় শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা পান্তাভাত-পেঁয়াজ-কাঁচালঙ্কা-লবণ আর নামমাত্র সরষের তেল। গিলতে ইচ্ছে করত না রোজ, গিলতে হয়েছে, কথা বললেই চ্যাটাং কথার চাবুক। রোদে-জলে ঘুরে এসে একটু তেল ঘষে পুকুরে ডুবে স্নান, সে জল হোক আর পাঁকই হোক। ভাত এবার শুকনো, ঠাণ্ডা, শক্ত, লবণ, ট্যালটেলে ডাল, যে-কোনো একটা শাক, সেদ্দ-সেদ্দ, আর একটা সব্জি, আলুই আসলি। খেতে হয়েছে দিনের পর দিন। স্বাদ থাকতো না, শুকনো-লংকা-পোড়া ঘষে ঘষে স্বাদ আনতে হতো। সব বাগালদের মধ্যে সুবলের বয়সটা কিছুটা বেশিই। অস্বস্তি একটা ছিলই। তবু বাড়ির ভাতটা বাঁচতো, বড়ো সাশ্রয় বাবার। তাছাড়া দুটো লুঙ্গি-গামছা-গেঞ্জি বছরে, আর একটা আলোয়ান। পরের এক বছর স্টেশনের কাছে মুদির দোকানে কাজ করল। রোদ-জল থেকে বাঁচল। খাওয়া-পড়া দিত না, কিন্তু টাকা দিত। সামান্য হলেও সেটা বাবার কাজে লাগত। গোঁফের রেখা ওঠার সঙ্গেসঙ্গেই জুড়ে গেল কলমিস্ত্রি অনন্ত কাকুর সাগ্‌রেদ হয়ে। হাড়ভাঙা খাটুনি ছিল, অনন্তকাকুর দাঁতখিচুনি ছিল যখন-তখন, ছিল কাজ ছাড়িয়ে দেওয়ার শাসানি, কিন্তু দিনের টাকা দিনেই দিয়ে দিত। আয়ও বাড়ল, কাজটা শেখার নেশাও পেয়ে বসল। কৈশোরে গরুপালের বা মুদিখানার মালিককে বা অনন্তকাকুকে কেন যেন তার কোনোদিনই রাক্ষস মনে হয়নি। কিন্তু যেবারে বান এলো, ঘরদোর হাফ-ডুব, উঠল গিয়ে অঞ্চলের একমাত্র হাইস্কুলের দোতলায়। তখন কিছু রাক্ষসের দেখা মিলেছিল। সরকারি ত্রাণ তাদের জন্যই বরাদ্দ, ত্রিপল, শুকনো খাবার, আর কিছু নগদ টাকা। পেয়েছিল কী তারা? পাঁচদিন ধরে দু-বেলা শুধু খিচুরি আর ঘ্যাট। বমি আসত। সুমন তখন মার কোলে, বেচারা একটু দুধ পর্যন্ত পায়নি। সবাইমিলে বলেও কোনো সুরাহা হয়নি। সব গিলে খেয়েছে ওই অঞ্চলবাবুরা, রাক্ষসগুলো। ওদের দলকেই ভোট-টা দ্যায়, তবুও। নেতাদের বলেও লাভ হয়নি। সাপটে গিলেছে আর নতুন বাড়ি-ঘরদোর বাহ্যি করেছে। চাল-ডাল-তেল-নুন-আটা-বিস্কুট-চিড়ে-চিনি-ত্রিপল আদ্ধেকের বেশি চিবিয়ে চিবিয়ে কপাত গিলেছে, প্রধান না রাক্ষস! নগদ টাকা, তাও দিয়েছে কম। বাকিটা নাকি পার্টিফান্ডে, তা পার্টিটাও কি রাক্ষস? পার্টি রাক্ষস হলে তার আর দাঁত মাজার দরকারটাই বা কী! সেই সুমন বছরখানেক আগে স্কুল থেকে ফিরে বাবাকে বললঃ ‘জানো তো বাবা! আজ স্কুল ফাংসানে হীরেন স্যার কী একটা সংস্কৃতে বলে বাংলায় বলল আমরা মানুষরা নাকি সব অমৃতের সন্তান। বাবা আমরা কি তাই? অমৃতটা কী বাবা?’। সুবল চুপ, সে জানে না অমৃত কী, বিষই বা কী? শুধু এটুকুই জানে, ঐ হীরেন মাষ্টারই প্রধান ছিল, আজও আছে, দলটা শুধু বদলেছে।

“পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে
স্যাটেলাইট আর কেব্‌লের হাতে
ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী
আ হা হা হা আ হা
—– —– —–
ভেবে দেখেছো কি,
তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে
তারও দূরে
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে।
——– ———
ভেবে দেখেছ কি…
স্বপ্ন বেচার চোরা কারবার
জায়গা তো নেই তোমার আমার
চোখ ধাঁধানোর এই খেলা শুধু ভঙ্গি
আ হা হা হা আ হা” (ঋণঃ গৌতম চট্টোপাধ্যায়/ মহীনের ঘোড়াগুলি)

সাইকেলটা সারানো হয়নি। টিউবের একটা জায়গা ফুটো হয়ে গেছে। ‘সুবল’কা এ-তো ত্যানা হয়ে গেছে গো! কী সারাবো? কালই আবার যাবে, টিউবটা পালটে নাও’। টিউবটা সামনে মেলে ধরে দেখালো দীপু। সুবল বুঝল ঐ জন্যই দীপু কী করবে বুঝতে না-পেরে ফেলে রেখেছে। ‘না গো, আজ হবেনি। আজ সাইরে দাও, ও দ্যাখা যাবে পরে। টাকায় কুলোবে না’। বেঞ্চে বসে সুবল। দু-ফোঁটা ঘাম শিরদাঁড়া বেয়ে নামে। দোকানের বোতলে জল খায়। ‘এট্টু বসো দিনি সুবল’কা। হাতের কাজটা… দিচ্ছি তোমারটা’। সুবল দোকানের ছোট্ট টিভিটায় চোখ রাখে। বাড়িতে নেই, দ্যাখার সুযোগও মেলে না। কোলগেট পেস্টের বিজ্ঞাপন চলছে। সঙ্গে ব্রাশ ফ্রি একজোড়া। মুহূর্তে সরে গিয়ে কী একটা মুখেমাখার জিনিস, সরে গিয়ে কাপড়-ধোয়ার সাবান-গুঁড়ো, সরে মোবাইল, সরে গাড়ি। তারপর সিনেমা। চোখ ফেরায় সুবল। সুমুর মায়ের একটাই শখ মেটাতে পারেনি। মাঝেমধ্যে তাই সে দুটো বাড়ির পরেরটায় যায়। বড়ো টিভি, সুন্দর ছবি। সুবল ভাবে, সত্যিই কী এক যন্ত্র! সবাই টিভির গল্প আউড়ায় ট্রেনে, কেউ সিরিয়াল, কেউ সিনেমা, কেউ গান। আরেকজন আছে জীতেনদা, তিনি শুধু দেশ-বিদেশের খবর বলে আলা করে দ্যান পাশের লোকদের। কোনোদিন সুবল কাছাকাছি থাকলে, তার প্রতিটি কথা শোনে গোগ্রাসে। কত দেশ, কত প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্ট-মন্ত্রীর নাম, রাজনৈতিক দলের নেতাদের নাম জীতেনদার ঠোঁটস্ত। বলেও গুছিয়ে। কিছুটা বোঝে কিছুটা বোঝে না। তবে যুদ্ধের গল্পগুলো শুনতে ভালো লাগে। এই তো লোকসভা ভোটের আগে কাশ্মীরের কোথায় যেন ভারতের অনেক সেনা মারা গেছে, পাকিস্তানের চর কতগুলো জঙ্গিদের জন্য। মরার ভয় নেই ওদের, নিজেরাও মরে আবার মারেও। জীতেনদা জমিয়ে বলে। ট্রেনের কামরা তিনচার ভাগে ভাগ হয়ে তর্ক জুড়ে। সুবল কিছু বলে না, জানেই না ভালো করে, বলবে কী? জীতেনদা চুপ মেরে যায়। বুঝতে দ্যায় না, কার সাপোর্টার। কখন যে শিয়ালদা চলে আসে! কিন্তু শিয়ালদা নেমেও কাজের জায়গায় যেতে যেতে একজনের চিৎকার করে বলে ওঠা কথাগুলো ভুলতে পারে না সে— ‘আরে! এটা তো ঘটানো হয়েছে। ভোট আসছে, ব্যাস দেশভক্তির তাসটা খেলে দাও, তাহলেই জয় হেসেখেলে’। সত্যিই এমনও হয়! ভোটের জন্য সেনা খতম! হলে তো এদেরকেও রাক্ষসই বলতে হবে। আর ভাবার ক্ষমতা নেই সুবলের। আনমনা সুবলকে হেঁকে ওঠে কেষ্ট— ‘কী হলো, সুবলদা! একটু জোরে ঘোরাও যন্তরটা, প্যাঁচ কাটতে হবে তো পাইপটায়, এটা পলিথিনের নয়, লোহার’। সুবল পেশির জোর ঢেলে দ্যায়। আজ আবার কথাটা ভাবে। কেমন ধারার মানুষ সব! এত কাছাকাছি থেকেও একেকজন যেন আরেকজনের চেয়ে কত দূরের! মেরে ফেলতে একবারও বুক কাঁপে না। রাক্ষস সব, কোথায় পালবে-পুষবে, নয়তো হাড়-মাস চিবিয়ে গিলছে। রক্ষকই শালা ভক্ষক। দাঁত-নখ দ্যাখা যায় না, লুকিয়ে রাখে, কোথায় কে জানে! দাঁতের কথায় মাজনের প্যাকেটটা পকেটে একবার নেড়েচেড়ে দেখে নেয়। এদের সত্যিই এসবের দরকার নেই।

“মজা কি জানো স্যাঙাৎ, আগুন জ্বালছি, জিইয়ে রাখছি
তুমি আমি, পোড়াচ্ছি পুড়ছি, তুমি আমি আমরা আমাদের।
হেয়ালি নয় দোস্ত, সাচ্‌ বাত। কী চেয়েছিলে, কী চাও?
খেতে পরতে ভালোবাসতে?
——- ——- ——-
নিজের দোষ গুণের মধ্যে বারবার জন্মাতে?
মানে, বাঁচতে চাও? বাঁচতে চাও?
হায় বেরালাল! মাইকদার যাচ্ছে ‘হুকুম নেই, হুকুম নেই, হুকুম নেই’
মনে পড়ছে না, রাম শ্যাম যদু মধু আরও অনেকজনা
তারাও তাই চেয়েছিল। আজ কোথায় তারা?
যমরাজার চ্যালার ডাণ্ডা খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
তোমার আমার নসীবেও ঐ একই পরোয়ানা জারি,
তবু দোস্ত, ডরো মৎ, বুক বাঁধো, এগোও।” (ঋণঃ মণীষ ঘটক)

‘বাপ আমার, তুই সারা। আমি টুকুন আসি’। সুবল বেঞ্চ ছেড়ে এগোয়। অন্ধকারে। দিন কয়েক আগে যাদবপুরের এক ফ্ল্যাটে সারাদিন ধরে জলের লাইনে কাজ করেছে। বাবুর বাড়িতে আরেক বাবু এসেছিলেন। কাজের তদারকির মধ্যে নিজেরা কীসব কথাবার্তা বলছিলেন। সুযোগমতো সুবল শুনছিল। রাজনীতির কথাই হবে। নানা দলের, দেশের সরকারের কথা। অধিকংশই সুবল জানে না। ট্রেনে কিছুকিছু শোনে যাতায়াতে এই যা। দিল্লি না উত্তরপ্রদেশে কোথায় দাঙ্গা হয়েছে। হিন্দু আর মুসলমানে। দাদাবাবু বলছিলেন— “এদের কাজই এই, হয় মন্দির-মসজিদ করো, নয় দাঙ্গা লাগাও। নেড়েগুলো মরুক। হিন্দু-দেশ বানাও। এই তো এখন একমাত্র কাজ। লোকের চাকরি-বাকরি নেই। যাদের ছিল চলে যাচ্ছে। সব সরকারি সম্পত্তি বেচে দিচ্ছে। আর লোক কাজ হারাচ্ছে। কোনো ভ্রুক্ষেপও নেই। এটা কি একটা সরকার? না বেচুবাবু!” সুবল ঠাওর করতে পারে না ঠিক কী বলা হচ্ছে! হিন্দু দেশ বানাও এটা ভালো বুঝেছে। রাস্তাঘাটে এ নিয়ে নানা কথাও শুনেছে। সরকারি জিনিস বেচা, এটাও শুনেছে, তবে ঠিক বুঝতে পারেনি। বেচছে কেন? কুলোচ্ছে না? প্রশ্নের রেশ কেটে যায়। বাবুর বন্ধু বলে ওঠেন— “বেচু বাবু বলছিস কী রে! এ-তো দানব। সব গিলছে। বেচছে কাদের কাছে? সেই তো তার প্যায়ারের ৫-৭ জন পেটুক। ওদের গেলা আর সরকারের গেলা একই। আর কীভাবে গিলছে দ্যাখ, টেলিফোন চিবিয়ে খেল, এরোপ্লেনের হাড়গোড় চিবুতে শুরু করেছে, কয়লা খেল, ব্যাংক-বীমা গেলার সব ছক পাকা, রেলের ইঞ্জিন-কামরা খেতে শুরু করেছে, হ্যাল-সংস্থাটাকে খেয়ে ফোঁপড়া করে দিয়েছে, আর ক’দিনের মধ্যে দ্যাখ না পেট্রল-ডিজেল সব গিলে খাবে। আরে দেশের লক্ষ্মীর-ভাঁড়টা পর্যন্ত ভেঙে খাচ্ছে। ভালো বিলগুলো খাচ্ছে একে একে। এসমা গিলে খেল কপাত্‌ করে। আর কী বাকি রাখল রে!” শুনতে শুনতে চলে যেতে হয়েছিল সুবলকে। কিন্তু অবাক কম হয়নি! টেলিফোন, রেলের বগি, কয়লা, উড়োজাহাজ এসব সব চিবিয়ে খাচ্ছে? তাহলে তো রামপাগল নয় রাক্ষস। ঠাকুমাতো এই গিলে খাওয়ার লোকগুলোকেই রাক্ষস বলত। বলছে পেট্রোল-ডিজেলও গিলে খাবে! মরবে না! কিন্তু ঐ যে বলল ব্যাংক-বীমা-বিল খাচ্ছে, এটা ঠিক মাথায় ঢুকল না। এসমা না আসমা কী একটা বিল, না-হয় বুঝল না! কিন্তু ব্যাংক-বীমার বাড়িঘরদোর টাকা সব খাবে এই ব্যাপারটা ঠিক কী! অন্ধকারে এগোতে গিয়ে মাত্র ক’দিন আগে শোনা এসব কথাবার্তা মনে পড়ল। জীতেনদাকে একবার জিজ্ঞাসা করলে ভালো করে বুঝতে পারবে। তবে এসব খেয়েছে বা খায় যখন, তখন রাক্ষস ঠিকই। আর রাক্ষস হলে তাদের আর দাঁত মাজতে হয় না। হবে কেন? টেলিফোন চিবোলে দাঁতের ময়লা আর কিছু থাকে? আচ্ছা রেলের কামরা চিবোতে গেলে দাঁতগুলো তো নড়ে যেতে পারে, পড়ে যেতে পারে। না না রাক্ষসের দাঁত শক্ত আর ধারালো! যাকগে, আমি ভেবে আর কী করব? মুরোদ তো ঐ দুটো ভোটের। বেশি বলতে গেলে, পার্টির নানা ঝামেলা, হুজ্জোত। ভালো করে একটু বাঁচতেও দ্যায় না! কথানাতায় ডাণ্ডাবাজি।

হঠাৎই মোড় ঘোরে সুবল, এগোয় মুদিখানাটার দিকে। একসময় কিছুদিন এখানেই কাজ করেছিল। বাবু আর নেই, ছেলেটা চালায়। খারাপ না ছেলেটা। গেলে, দাদা দাদা বলে কথা বলে। গিয়ে বিজ্ঞাপনে দ্যাখা পেস্টের কথাটা বলল দিনেশকে। দিনেশ কর্মচারিকে বলে আনিয়ে হাজির করল, সঙ্গে দুটো ব্রাশ। দিনেশ বলল— ‘দাদা এ-দুটোর দাম দিতে হবে না। ফ্রি’। — কত পড়বে? যা বলল, পকেটে তার চেয়ে দশ টাকা কম, তারপর সাইকেলের জন্য দীপুকে দিতে হবে। আমতা আমতা করায় দিনেশ জানতে চাইল— ‘কত কম পড়ছে?’ – কুড়ি টাকা। — ঠিক আছে নিয়ে যান দাদা, পরে দিয়ে দেবেন। –হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা দিয়ে দেব। পেস্ট-ব্রাশ নিয়ে ঝোলায় ঢোকালো। দীপুর দোকান থেকে সাইকেল নিয়ে পড়িমড়ি বাড়ির দিকে। চমকে দেবে ছেলে আর মেয়েকে। কিছুটা হাঁ করে থাকবে সুমুর মা।

“তাকডুম তাকডুম বাজাই
আমি তাকডুম তাকডুম বাজাই
বাংলাদেশের ঢোল
সব ভুলে যাই
তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল” (ঋণঃ গীতিকার- মীরা দেব বর্মন/ কন্ঠ ও সুর- শচীন দেব বর্মন)

সাইকেল আজ যেন ময়ূরপঙ্খী। ছুটছে। কী এক আনন্দে গানটাও একবার গেয়ে নিল সুবল। সাইকেলটা ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে বারান্দায় উঠেই ডাক দিল— ‘সুমিত! সুমু! আয় দেইখে যা’। সবাই বাইরে এলে ঝোলা থেকে পেস্ট-ব্রাশ বার করে একটা ব্রাশ সুমিতের আরেকটা সুমুর হাতে ধরিয়ে বলল— ‘কাল থেকে দুজনেই দাঁত মাজবি এতে’। সুমিতের আহ্লাদ আর ধরে না। আর সুমু মুখে হাসলেও ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করে —‘বাবা! আমিও?’ – হ্যাঁ তুইও। একটা আনন্দের ঢেউ খেলে যাওয়ার পর, সুমুর মা— ‘আজ যে বড়ো এসব নিয়ে আসলে? ছেলেটা কতদিন ধরে বলছিল! টাকা পয়সার কথা মাথায় আছে তো?’ কিছুটা ঝাঁঝের সঙ্গেই সুবল— ‘আছে, আছে! তা বইলে ওরা তো আর রাক্ষস না, যে দাঁত মাজবে না! ওরা মানুষ। মানষের বাচ্চা। ওরা ভালো করে দাঁত মাজবে। তোমার আর আমার মাজন এইটা। আলেকজান্ডারের দাঁতের মাজন। বুইঝল্যা কিনা রাক্ষসরা দাঁত মাজে না। ওদের দরকারই পড়ে না।’ একটানা বলে সুবল একটু দম নেয়। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, অবাক হয়ে।

“করাতকলে পিস পিস কাটা ঘুমের প্রতিটি ফাঁকে একটি করে প্রশ্ন
পেচ্ছাপ করে আর জল খায়” (কারেন্ট আফেয়ার্স- ২৮/ স্বকৃত)

“একটা মামুলি প্রশ্নেই চোখ নষ্ট?
মোল্লা, পুরুত, অধ্যাপক, আমলা, বর্ণহিন্দু, জেহাদি, লিঙ্গ-যোনিহীন,
দেশভক্ত, অনুগত-ভণ্ড, লুচ্চা, যাদুকর, হাফ-সিকি-নেতা,
প্রেমিক, ধর্ষক, কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক কাউকে চিনতে পারছি না!” (কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স-১৬/ স্বকৃত)

Facebook Comments

Leave a Reply