কালোজিরে : তুষ্টি ভট্টাচার্য
কালোজিরে ফোড়নের গন্ধ ভেসে এলো আচমকাই। কিন্তু এই সময়ে কে রান্না করছে? মোবাইলে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, রাত একটা উনিশ। ল্যাপটপে চোখ যেতে দেখি, স্ক্রিনের শব্দগুলো কেমন যেন জড়ামড়ি করছে। চোখ কচলে আবার দেখলাম। নাহ! সত্যিই তাই। ওদিকে কালোজিরে ফোড়নের গন্ধ আরও তীব্র হয়ে নাকে আসছে। নিশ্চই ঘুম পেয়েছে। সারাদিন যা যাচ্ছে…এত ক্লান্ত শরীরে রাতজাগা উচিত হচ্ছে না। বিছানায় তলিয়ে যেতে যেতে ভুলে গেলাম সে রাতের ওই অদ্ভুত ঘটনা নাকি ভ্রম!
পরদিন এক ঘুমে রাত কাবার করে চোখ খুললাম। আলো ফুটেছে সবে। এই সময়টা বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না আমার। জানলা দিয়ে বাইরের যেটুকু দেখা যায়, মানে সদ্য খোলা জানলা দিয়ে একফালি আলো এসে পড়ছে, ঘরের ভেতরে একটা আবছায়া ভাব, কিছু নিয়মিত পাখিদের ডাকাডাকি, এইসব দৃশ্য মনকে যেন আরও শান্ত করে দেয়। ঠিক এই সময়ে মনে হয়, পৃথিবীতে কোথাও কোনো অনিয়ম নেই, দুরাচার নেই, হিংসা, রাজনীতি, কোন্দল, কিচ্ছুটি নেই। আছে জীবনানন্দের এক শান্ত পৃথিবী। একটা মেদুর বিষণ্ণতা আছে, অথচ দুঃখ নেই। খানিক গড়াগড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠেই পড়লাম। ছাদের দরজা খুলে হাঁটি কিছুক্ষণ রোজ। আজও শুরু করেছি সবে, হঠাতই দেখি একজোড়া বুলবুলি মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। চঞ্চল দুজন একবার ছাদের কার্নিশে বসছে, একবার টবের মাটি ঠুকরোচ্ছে, আবারও পিড়িং করে উড়ে চলে যাচ্ছে ওপ্রান্তে। বেশ মজা লাগছিল ওদের দেখে। এই লকডাউনের ফলে ইদানীং পাখির সংখ্যা বেড়েছে এ তল্লাটে। পড়শির গাছে গিয়ে বসল এবার ওরা। পাতার আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে ওদের শরীর। আমি চোখ সরাচ্ছি না, নাহ এখনও উড়ে যায়নি ওখান থেকে। কী করছে এতক্ষণ ওখানে ওরা? সঙ্গম? এই সক্কাল সক্কাল? নিশ্চই ভরপেট খাওয়া হয়ে গেছে ওদের। এখন কি বসন্তকাল নাকি? ওরা তো মানুষ নয়, যে কোনো সময়ে ওই সব শুরু করে দেবে! আজ রোদের তেজ কম। আকাশ ঘোলা হয়ে আছে। ভাদ্রমাসের নিয়মমতো গুমোট গরম এখন থেকেই। চোখ ফেরাতেই দেখি পাতার আড়াল থেকে একটা লম্বা লেজ দেখা যাচ্ছে। আর একটা শামুকখোল বেরিয়ে আসছে ওখান থেকে। যাহ ব্বাবা! বুলবুলি দুটো কোথায় গেল তাহলে? নিশ্চই উড়ে গেছে কোন ফাঁকে। এই শামুকখোলগুলোকে আমার খুব বিচ্ছিরি লাগে। দেখলেই মনে হয় একটা ধূসর কালো জোব্বা পরে, একজন বিচারক হাতুড়ি হাতে রায় দিতে বসবে। নিচে নেমে এলাম এরপর। রোজকার কাজে লেগে গেছি। যত বেলা বাড়ছে, গুমোট গরমে নাজেহাল হয়ে পড়ছি।
কিছুক্ষণ বাদেই আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টি নামল। আহ! কী শান্তি। দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ গেল, একটা উনিশ। আরে! কাল রাতে, ঠিক এই সময়ে কে যেন রান্না করছিল না? নিজেরই হাসি পেল ভেবে। রান্না প্রায় হয়েই গেছিল, কালোজিরের কথা মনে আসায় ভাবলাম, একটু আলু চচ্চড়ি বানাই। আমি এমনিতে খুবই গুছনো টাইপের। চোখ বেঁধে দিলেও হাত বাড়িয়ে যেখানকার জিনিস সেখান থেকে নিয়ে আসতে পারব। কিন্তু এখন ফোড়ন দিতে গিয়ে আমার কালোজিরের কৌটো খুঁজে পাচ্ছি না। কী আশ্চর্য! কে সরাল? সরাবেই বা কেন? এ বাড়ির কারুর প্রয়োজনে লাগবে না আমার কালোজিরের কৌটো। বর যদি কখনও শখের রান্না করেও, সেগুলো সাধারণত মাংসের প্রিপারেশন। তাতে কালোজিরের কোনো ভূমিকা থাকে না। তাহলে? এদিকে কড়াইয়ে তেল পুড়ছে। আপাতত পাঁচফোড়ন দিয়ে কাজ চালালাম। কিন্তু মন থেকে খচখচানি গেল না। ছেলেকে বলতে গেলাম, কানেই নিল না। বর বলল, ‘দেখ কোথায় রেখেছ। বয়স হচ্ছে তোমার’। মাথা গরম করে কোনো লাভ নেই, বরং বৃষ্টির আরাম উপভোগ করা যাক আপাতত।
বিকেলে চা করতে গিয়ে দেখলাম, কালোজিরের কৌটো যথাস্থানেই রয়েছে। এটা কেমন হল? আমি কি দুপুরে তাহলে খেয়াল করিনি? এত ভুল হবে আমার? নিশ্চই তাই। নইলে তো আর একটা কৌটো পায়ে হেঁটে কোথাও যেতে পারে না। আজ সকাল থেকে কী সব হচ্ছে! কাল তো ভাল ঘুম হয়েছে, শরীর ফ্রেশ। আজ কাজের চাপও তেমন নেই। তাহলে? জোর করে এইসব ভাবনা সরিয়ে রাখলাম। নিজেকে বোঝালাম, চারিদিকে কত না কত সমস্যা, আর আমি এই সব তুচ্ছ জিনিস নিয়ে ভাবছি? এই যে এক অতিমারি এসে তছনছ করে দিল আমাদের জীবনকে, টপাটপ মানুষ মরে যাচ্ছে, অসুস্থ হচ্ছে, এসব নিয়ে সতর্ক থাকা বা আতঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর কিছু ভেবেছি? কোনো সুরাহা আমার হাতে নেই যদিও। আচ্ছা রাশিয়ার ভ্যাকসিন কি সত্যিই আগে আসবে? জালি নয়ত? নাকি অ্যামেরিকারটাই ভাল হবে? পুতিন, ট্রাম্প, এরা নিজেদের তৈরি ভ্যাকসিন নেবেন তো? ওঁদের যদি গিনিপিগ করা হত, কেমন লাগত ওঁদের? আফটার এফেক্টের কথা ওঁদের দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো মাথায় রেখেছে কি? নাকি আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে এই ভ্যাকসিন বিক্রি করে মুনাফা কামানোই ওদের উদ্দেশ্য? মনের মধে খচখচানি আরও বেড়ে গেল এইসব ভাবনা এসে। লিখতে বসলাম। লেখায় ডুবে গেলে আর কিছুই মাথায় থাকে না। ফলে সারাদিনের টুকটাক ভুলে যেতে সময় লাগল না। কিন্তু হঠাতই আবার সেই কালোজিরে ফোড়নের গন্ধ ভেসে এলো। এবং ঘড়িতে ঠিক একটা উনিশ। আশেপাশের সব বাড়ির আলো নেভানো। ঘুমে অচেতন পাড়া। তাহলে? রোজ রোজ একই ভুল হবে আমার? রান্নাঘরে ছুটে গেলাম, নাহ! আমার কালোজিরের কৌটো নেই!
ভূতপ্রেত নাকি? রীতিমতো ভয় পেয়ে গেছি এবার। বাড়ির সব আলো জ্বেলে দিলাম। ভূত তো সাধারণত অন্ধকারেই থাকে শুনেছি। কিন্তু কালোজিরের গন্ধ কমছে না কিছুতেই। কাউকে কিছু না বলে শুয়ে পড়লাম। সকালে ছাদে আবারও সেই বুলবুলি দম্পতির দেখা। আবারও সেই একই দৃশ্যের অবতারণা। শামুকখোল পাখিটা বেরিয়ে এলো পাতার আড়াল থেকে। আর আজ সে আমারই সামনে ছাদের আলসেয় বসে ঠকঠক করে নিজের ঠোঁটদুটো ঠুকল। আমি কোর্টরুমের হাতুড়ির শব্দ পেলাম। ভাল করে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি, মাথায় সাদা উইগ পরে আছে সে, আর পায়ের নখে একটা হাতুড়ি ধরে রেখেছে। আমার দিকে কটমট করে চেয়ে কী যেন বলতে চাইছে। আমার কি কোনো শাস্তি হল আজ, এখুনি? কিন্তু কীসের জন্য? জ্ঞানত কোনো অন্যায়, অপরাধ করেছি বলে তো মনে পড়ছে না। নিচে নেমে এলাম ধীর পায়ে। আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? দাঁত মাজতে গিয়ে দেখলাম, ব্রাশটা ভেজা। নিশ্চই ছেলের কাজ। কিন্তু ও তো এখনও ঘুমোচ্ছে। আর আমি এইমাত্র নিচে নামলাম। তাহলে? এও মনের ভুল নিশ্চই। চা খেয়ে কালোজিরের কৌটোটা একেবারে আলমারিতে চাবি দিয়ে রেখে দিলাম কাউকে কিছু না বলে। আলমারিতে কালোজিরের কৌটো রাখতে দেখলে ওরা যে কী বলবে আমায়…ওদের ঘুম থেকে ওঠার আগেই অপারেশন শেষ। এবার দেখি রাতে কৌটো কোথায় পালায় এখান থেকে।
আজ স্থির করলাম, সারাদিন সতর্ক হয়ে সব কাজ করব। হাল্কা রান্না করলাম, এই পচা ভাদ্রের গরমে হয়ত গ্যাস, অম্বল হয়ে এইসব আলতুফালতু ইলিউশন হচ্ছে। রাতে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি। আজ আর লিখব না ঠিক করেই রেখেছিলাম। সত্যিই তো, বয়স বাড়ছে, এবার থেকে আর রাত জাগব না। ঘুম আসতেও দেরি হল না। গভীর ঘুম থেকে কে যেন ধাক্কা দিয়ে ঠেলে তুললো আমাকে। চোখ খুলে দেখি সেই রাত একটা উনিশ। ছুটে আলমারির সামনে গেলাম, দেখলাম পাল্লাটা হাট করে খোলা। না, চোর আসেনি, সব যথাস্থানেই আছে। শুধু কালোজিরের কৌটো উধাও। আর তখনই সেই ফোড়নের গন্ধের তীব্রতা। এবার আর ভয় পেলাম না। আমি নিশ্চিত, এ কোনো ভূতপ্রেতের কাজ। এতদিনের অবিশ্বাস, যারা ভূতে বিশ্বাসী, তাদের নিয়ে এতদিনের ঠাট্টা তামাশা বোধহয় বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে আমার কাছে। আর পরদিন সকালে আবার সেই বুলবুলি, তারপর হাতুড়ি নিয়ে শামুকখোল, তারপর ব্রাশ ভেজা। আজ আবার নতুন এক উপসর্গ পেলাম, চায়ের পাতার সুবাস বদলে গেছে। একটা বুনো জংলা গন্ধ পাচ্ছি চায়ে। কিন্তু ভূত কি দিনে আসে? তাহলে? এবার আর এসব ঘটনা লুকিয়ে রাখার ভরসা পাচ্ছি না। প্রথমে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হ্যাঁ রে, চায়ের ফ্লেবার অন্যদিনের মতো পাচ্ছিস?’ সে উত্তর দিল, ‘কেন আমার কি করোনা হয়েছে নাকি যে গন্ধ পাব না? রোজকার মতোই পারফেক্ট’। আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই কি খুব ভোরে উঠে দাঁত মাজিস আজকাল?’ এবার সে বিরক্তই হল। ‘আচ্ছা মা, তোমার কী হয়েছে বল তো? আমার ভোরে ওঠার অভ্যেস নেই, তুমি জান না?’ সত্যিই তো। ওর সবটাই তো আমি জানি। আর ঘাঁটালাম না ওকে। এরপর আরেকজনের কাছে গিয়ে একথা সেকথার পর কালোজিরের কৌটোর কথা বেমালুম চেপে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা তুমি মাঝরাতে রান্নার গন্ধ পাও রোজ? কে রান্না করে বল তো অত রাতে?’ সেও দেখি বিরক্ত হল শুনে। ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আর যদি করেই কেউ, তাতে তোমার কী?’ চুপসে গেলাম। মাথা খারাপ হল নাকি আমার সত্যিই?
এবার কিন্তু আমি সিরিয়াস। এভাবে বাড়তে দেওয়া যাবে না জিনিসটাকে। একটা হ্যালুসিনেশনের মধ্যে চলে যাচ্ছি আমি। অনেক জার্নাল পড়ে টড়ে, এই সিদ্ধান্তে এসেছি। বিহিত করার একটাই পথ। মনের ডাক্তারের কাছে যাওয়া। আর যেতে গেলে বাড়িতে জানিয়েই যেতে হবে। ছেলে, বর কি হেসে উড়িয়ে দেবে আমার কথা? এমনিতে ওরা কিন্তু আমার মধ্যে অন্য কোনো অ্যাবনর্মালিটি পায়নি, আমি ওদের বাজিয়ে দেখে নিয়েছি। বা আমিও নিজের মধ্যে আর কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ ফুটে উঠতে দেখছি না। শুধু রোজকার খুঁটিনাটি ঘটনাগুলো একটা অদ্ভুত মোড়কে সেজে আমার কাছে আসছে। এ হয়ত আমারই অবচেতন থেকে উঠে আসা কোনো চিন্তাভাবনার প্রকাশ। যেভাবে মানুষ স্বপ্ন দেখে। অবচেতনে যা রয়েছে, তাকেই প্রত্যক্ষ করে। আমি শুধু ঘুমের মধ্যে না দেখে, ঘুমের বাইরে দেখে ফেলছি দৃশ্য পরম্পরা। এইসব ভাবার পরই নিজেকে পিঠ চাপড়ে দিতে ইচ্ছে হল। এই তো! আমি ঠিক লাইনে এগোচ্ছি। আপাতত নাহয় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্ল্যান মুলতুবি থাক। আর কালোজিরে ফোড়ন দিয়ে কেউ যদি রাতে রান্না করেই, তাতে আমার কী? আমিই বা কেন এত উত্তেজিত হচ্ছি? ওই বুলবুলি, শামুকখোল, ভেজা ব্রাশ, ইত্যাদিকে পাত্তা না দিলেই হল! মন শক্ত করে এভাবেই চলব সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। কিন্তু চায়ে জংলা গন্ধটা কিছুতেই বরদাস্ত করা যাচ্ছে না। নেশা কাটছে না, মাথা টিপটিপ করছে। এর কী উপায় বের করা যায় ভাবতে ভাবতে কাজে মন দিলাম। স্নানে গিয়ে দেখি কল থেকে কনকনে ঠাণ্ডা জল পড়ছে। কী আশ্চর্য! এই ভাদ্রে! আবার চোয়াল শক্ত করে মনে জোর আনলাম। যে কোনো পরিস্থিতিতেই এরকম কিছু অদ্ভুত ঘটনা আমাকে প্রত্যক্ষ করতে হবে—এটা মেনে নিয়েছি এখন। গিজার অন করতে হল বাধ্য হয়ে। তবুও গায়ে জল ঢালতেই ছ্যাক করে উঠল। হাড় শুদ্ধু কেঁপে উঠলাম। কোনোমতে স্নান সেরে বেরিয়ে গেলাম ঠাকুরঘরে। অভিযোগ জানানোর মতো ওই কয়েকজন নিশ্চল অপার্থিব রয়েছেন তো আমার! কিন্তু তাঁদের ফুল, জল, চন্দন, মিষ্টি দিয়ে মাথা ঠেকাতে যাব, অমনি গোপাল হাত বাড়িয়ে তার হাতের নাড়ু আমাকে দিতে এলো। আমিও স্মার্টলি বললাম, না বাছা, তুমিই খাও ওটা। আমি এখন ভাত খাব। এসব শুনেটুনে সরস্বতী বীণা ঝনঝন করে বাজিয়ে বায়না ধরল, আমিও ভাত খাব, আমিও ভাত খাব। কতকাল ভাত খাই না। তার দিকে চোখ পাকিয়ে ধমক দিতে যাচ্ছি, সেই মুহূর্তে লক্ষ্মী আর কালী একযোগে আমার দিকে ফুল ছুড়ে মারতে লাগল। উফ! পদ্ম আর জবাগুলো একের পর এক বোমার মতো আমার দিকে ধেয়ে আসছে…আমি দুহাতে তাদের আটকাতে চেষ্টা করছি…শেষে ওই ফুলের স্তূপে আমাকে চাপা দিয়ে ওরা বলল, দ্যাখ্ কেমন লাগে! কোনোমতে হামাগুড়ি দিয়ে পালিয়ে এলাম সেখান থেকে। ঢকঢক করে জল খেয়ে ভাত বাড়তে শুরু করেছি, দেখি ডালের বাটিতে একটা পুরুষ্টু কিন্তু খুদে হাঙর সাঁতার কাটছে। ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ভালই তো। ডাল আর হাঙরের মাংস মিশে হালিম হয়ে যাবে। আমি তোকে কাঁচাই চিবিয়ে খেয়ে নেব। এই কথা শুনেই মাছের বাটি থেকে একটা কিউট ডলফিন লাফ দিয়ে আমার কোলে চড়ে বসল। হ্যাঁগো, আমাকে খাবে না? শুধু ওকেই খাবে? খুব অভিমানী সে আবার। তাই বললাম, আচ্ছা, আচ্ছা, তোকেও খাব রোস্ট করে। নিশ্চিন্ত হয়ে সে এবার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ল।
ভাত খাওয়ার আগেই যা নাটক শুরু হল, ভাত খেতে বসলে না জানি কী হবে! একপ্রকার ভয়, আশঙ্কা নিয়ে ভাত বাড়লাম। মুখে তুলতে গিয়ে দেখি যথারীতি অঘটন। ভাতের বদলে একরাশ জুঁই ফুল আমার পাতে। আহা কী যে সুন্দর দেখাচ্ছে! আর টাটকা ফুলের মোহক গন্ধে মন মাতাল হয়ে উঠছে। কিন্তু খিদে পেয়েছে যে! পেট ভরবে কী করে? অগত্যা, একমুঠো ফুলকেই ডাল দিয়ে মাখলাম। মুখে তুলতে কী যে অস্বস্তি হচ্ছে……এদিকে জেদ ধরেছি, খাবই আজ। একের পর এক এইসব ঘটনাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না কিছুতেই। মুখে চালান করলাম এক গরস। নাহ! নর্মাল ডাল ভাতেরই স্বাদ। জুঁই, টুই পালিয়েছে আপাতত। আর সেই হাঙর বা ডলফিনেরও পাত্তা নেই। নিশ্চিন্তে ভাতঘুম দিয়ে উঠলাম একটা। যাক, মনে হচ্ছে এবার ওরা জব্দ হয়েছে। আমাকে টাইট দেওয়া অত সহজ নয় হে! বিকেল, সন্ধে স্বাভাবিকের থেকেও স্বাভাবিক কাটল। রাতেও তাই। একটা পরম নিশ্চিন্তি আমার স্নায়ুকে শিথিল করে দিচ্ছে এখন। গত কয়েকদিন যা চলছে…মনের ওপর খুব চাপ বেড়ে যাচ্ছিল। এভাবে চলতে থাকলে সত্যি সত্যিই একদিন আমি পাগল হয়ে যেতাম। এগুলো তাহলে আমারই মনের ভুল বা কোনো ইমেজারি, যা অবচেতন থেকে টুক করে বাস্তবে এসে পড়ে আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল। হ্যাঁ কালোজিরের কৌটোও যথাস্থানে। সব, সব স্বাভাবিক রয়েছে আজ। যদি জুঁইফুল ভেবে ভাত না খেতাম, ওরা আরও প্রশ্রয় পেয়ে যেত।
রাতে লিখতে বসেছি, বারবার ঘড়ির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। লেখা এগোচ্ছে না। মন দিতে পারছি না ঠিক মতো। একবার ভাবলাম, ল্যাপটপ বন্ধ করে শুয়ে পড়ি। কিন্তু ওই একটা উনিশ আমাকে টানছে। আজ জেগেই থাকব। দেখি কী হয়! ঘড়ি যেন আজ ধীর গতিতে চলছে। মনে হচ্ছে ওর যেন তাড়া নেই কোনো। আজ আর একটার দিকে এগোবেই না। অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম খুব। নিজের ওপরই বিরক্তি আসছিল। এ কী হল আমার? একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম অন্ধকারে। যা মশার উৎপাত, পালিয়ে আসতে হল ঘরে। বসলাম, জল খেলাম, হাই তুললাম…একটা আর বাজে না কেন রে বাবা! অবশেষে একটা বাজল। আমি চোখ সরাচ্ছি না। ডিজিটাল নম্বর পাল্টাচ্ছে আর আমার টেনসন বাড়ছে। এইভাবে ক্রমশ একটা দশ হল, বারো, তেরো…আঠেরো…আমার হার্টবিটের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে গলা দিয়ে লাফ মেরে হৃদপিণ্ড বাইরে বেরিয়ে আসবে এবার। কিন্তু উনিশ আর হয় না কিছুতেই। হ্যাঁ, ল্যাপটপ, মোবাইল, দেওয়াল ঘড়ি, সবখানেই একটা আঠেরো বেজে ঘড়ি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ কী কাণ্ড! সব একসঙ্গে থেমে গেল? ছেলের মোবাইলে দেখলাম, বরেরটাও…সব জায়গায় একটা আঠেরো বেজে সময় থমকে রয়েছে। এও কি সম্ভব? সময় কি থামে কারুর জন্য? ওই কালোজিরে ফোড়নের গন্ধটা খুব মিস করছি। অস্থির হয়ে পড়েছি এতটাই যে, ঘেমে নেয়ে একশা হচ্ছি এসি ঘরে বসেও। নাহ! আর কোনো উপায় নেই আমার। যে করেই হোক, একটা উনিশে কালোজিরে ফোড়নের গন্ধটা না পেলে আমি মরেই যাব। আমাকে এভাবেই মেরে ফেলতে চাইছে ওরা। আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে ওই গন্ধটা না পেলে। এক ছুটে রান্নাঘরে চলে এলাম। গ্যাস জ্বেলে কড়ায় তেল দিলাম। তারপর কৌটো খুলে এক চামচ কালোজিরে ছেড়ে দিলাম কড়ায়…আহ! কী শান্তি! এই তো নাক থেকে গন্ধটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত স্নায়ুতে। মাথার ভেতরে একটা ঘোর এসে আমাকে রিল্যাক্স করে দিল তৎক্ষণাৎ। চেয়ার টেনে বসে পড়েছি ওখানেই। ঘড়িতে তখন একটা উনিশ। সব ঘড়িই আবার চলছে। আমি হাসছি। আনন্দে আমার দুগাল দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। এই গন্ধটা না পেলে আমি আর বাঁচতাম না। এই গন্ধটা পেলাম বলে আমি বেঁচে গেলাম! আমার হাসি ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। গাল থেকে জল মুছে নিয়ে আমি হাহা করে হেসে উঠলাম। সামনে চোখ গেল এবার। দেখি, ছেলে আর বর বিস্ফারিত চোখ মেলে চিত্রার্পিতের মতো স্থির দাঁড়িয়ে আছে।
Posted in: September 2020 - Cover Story, STORY