রাবণের মুখ : স্বপন রায়

দশ মাথা। এই এক সমস্যা। ভোরে। একটা শিরদাঁড়া ধরে রাখে তো! মুখ ধোয়ার সময় রাবণ যে ভংগীতে দাঁড়াতো, তাকেই আজকাল সাবধান বা অ্যাটেনশন বলে। শিরদাঁড়া শক্ত করে ধরে রাখতে হয় দশটা মাথাকে।
রাবণের টুথব্রাশ এক কাল্পনিক অভিজ্ঞতাময় প্রস্তুতি। মুখের দূরত্বানুযায়ী দশটা পাথর কেটে বানানো স্টিক। মুখের কাছে লাগানো থেঁতো নিমডাল, ব্রাশসুলভ,পরে যা ব্রাশ হিসেবে আবির্ভূত হবে। এবার দাঁতে লাগাবার মার্জনটিকে রাবণ ব্রাশে লাগাবার আগে দেখা যাক মিশ্রণের উপাচারগুলি।
১. নিমের রস
২. কাঁচা হলুদের থেঁতো অংশ
৩. সামান্য দুধ
৪. লবংগ থেঁতো
৫. সামান্য নুন
৬. এক চামচ কারণবারি
৭. তুলসির রস
৮. গোলাপ জল
৯. মৌরির জল
১০. পেঁপের বোঁটা থেকে নেয়া রস
রাবণ, এই মিশ্রণের পুরো প্রক্রিয়াটা নিজে দেখে। কারণ মিশ্রিত ওই মার্জনের অভিঘাতে তাকে সুরে পায়। রাবণাহাট্টা টেনে নিয়ে তারে সুর লাগায়। এই রাবণাহাট্টাই আজকের বেহালা’র পূর্বসূরি। হনুমান এটিকে যুদ্ধান্তে নিয়ে আসেন উত্তর ভারতে। যা পরে রাজস্থানের আবশ্যিক বাদ্যযন্ত্র হয়ে ওঠে।
তো, শিবভক্ত রাবণ, মার্জনার প্রস্তুতি দেখে শিবস্তুতির সুর লাগাচ্ছে পিড়িং পিড়িং করে। সংবাহক দক্ষহাতে একটি শ্বেত পাথরের বাটিতে বানাচ্ছে মার্জনাটিকে।
আজ যা টুথপেস্ট নামে বিখ্যাত। পরে রবীন্দ্রনাথ এই প্রক্রিয়ারই রেশ টেনে লেখেন, কিছু পলাশের নেশা / কিছু বা চাঁপায় মেশা। বলিউড, যারা অনুপ্রেরিত বরাবরই, তারাই বা ছাড়বে কেন? গান তৈরি হয়ঃ সোখিয়োঁ মে ঘোলা যায়ে ফুলোঁ কা শবাব/ উস মে ফির মিলায়ি যায়ে থোড়িসি শরাব/ হোগা ইউঁ নশা যো তৈয়ার/ উও প্যার হ্যায়….

এই যে দন্তমঞ্জন, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা কী পঞ্চান্ন ইঞ্চি ছাতির রাবণ জানত? মহারাজ রাবণের রাজত্বে শ্রী লংকায় এবং মহারাজ দশরথ ও রামের রাজত্বে ভারতের জি.ডি.পি কিন্তু ফেলনা ছিলনা। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং চীন দুটো প্রাচীন সভ্যতার রাজতন্ত্রে অনুমান করা যেতেই পারে যে ‘গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট’ বা ‘জিডিপি’র হিসেবে এই দুটো অঞ্চল দুনিয়ার সেরা ছিল।পাল্লা দিত মিশর। বাকি দুনিয়া তখনো অনেক পিছিয়ে। মোগল আমলে ভারতের জিডিপি সবাইকে ছাপিয়ে যায়। তবে সাধারণ মানুষের মাথা পিছু আয় সব রাজার আমলেই ছিল নিম্নস্তরের, সে রাজা বা বাদশা যেই হোক না কেন! কিন্তু রাবণের সঙ্গে, তার দাঁত মাজার সঙ্গে ‘জিডিপি’র সম্পর্ক কী?
রাবণ গুনগুন করে দাঁত মাজছে।ওর গুনগুনও দশমাথার দৌলতে কোরাস।
এর ভেতরে জিডিপি কোথায়?
জিডিপিটা কী একটু দেখে নেওয়া যাক।
GDP = C + I + G + (X – M) or GDP = private consumption + gross investment + government investment + government spending + (exports – imports)। ফর্মুলা দিলাম। রাবণের রাজত্বে সরকার ছিল না। বেসরকারও ছিল না। আয় আর খরচ, দুটোরই মাধ্যম রাজা, রাজতন্ত্র। তাহলে ব্যাপারটা এরকম ছিল GDP=Royal consumption+gross royal investment+royal spending+(royal exports-royal imports)। রাবণের সময়ে অর্থাৎ আনুমানিক তিন হাজার বছর আগে, ব্রোঞ্জ যুগের সময়ে ‘বার্টার সিস্টেম’ই চালু ছিল। রামায়ণ এবং মহাভারতে কোনও কারেন্সি বা মুদ্রার উল্লেখ নেই। মূল্য হিসেবে প্রাণীসম্পদ, জমি, রত্নরাজি আর শস্য ইত্যাদির বিনিময় প্রথা ছিল। যাইহোক, রাবণের দশটি মাথার জন্য তৈরি মার্জনা থেকে টুথব্রাশ, এসবই ছিল রাজকীয় খরচের অন্তর্ভুক্ত, ‘জিডিপি’ বৃদ্ধির সহায়ক। এই সময়ের নিরিখেও প্রত্যেকটি মানুষের যে কোন খরচই যেমন, জন্ম, বিয়ে, অসুখ বিসুখ, বিবাহ বিচ্ছেদ, মৃত্যু ইত্যাদি সবকিছুই ‘জিডিপি’ বাড়াতে সাহায্য করে!
তবে আমাদের সমস্যা ‘জিডিপি’ নয়, রাবণ।
রাবণ কী রাক্ষস?
রাক্ষস কী দাঁত মাজে?
রাবণ তো মাজতো।
রাক্ষস বা অসুর এই শব্দটা এমনকি আর্যাবর্তের মনুবাদী বর্ণাশ্রম অনুযায়ী যে জাতিগত কুবিন্যাস রয়েছে তাতেও রাবণের সঙ্গে যায় না।
রাবণ তাই মুখ ধুয়ে, ফলের রস পান করে পুষ্পক রথে চলল পিতা ঋষি বিষর্ভের সঙ্গে দেখা করতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘ওয়ারিপোলা’র বিমান অবতরণ ক্ষেত্রে ‘পুষ্পক’ পৌঁছে গেল। পিতা বিষর্ভ ঠাকুর্দা ঋষি পুলস্ত্য’র সঙ্গে পাশা খেলছিলেন।
রাবণ সরাসরি গিয়ে জিগগেস করল, আমি কে?
বিষর্ভ আর পুলস্ত্য অবাক।
পাশার চাল থেকে বিরত হলেন দুজনেই।
বিষর্ভ বললেন, কী হয়েছে রাবু?
রাবণ কিছুটা বিষণ্ণ, বলল, আমি কে পিতা? কী আমার পরিচয়? আর্যাবর্তে আমায় বলা হচ্ছে রাক্ষস, অসুর। কেন পিতা?
বিষর্ভ আর পুলস্ত্য মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।
পুলস্ত্য বললেন, দেখো দাদু, তুমি লঙ্কার অধিপতি। কুবেরের ধন তোমার হস্তগত। তোমার পাণ্ডিত্য অতুলনীয়। তুমি চতুর্বেদ আর ছ’টি উপনিষদ গুলে খেয়েছ, সঙ্গীতে তোমার মত পারদর্শী আর কে আছে? তুমি ‘রাবণ সংহিতা’ লিখে প্রমাণ করেছ চিকিৎসা শাস্ত্রেও তুমি অতুলনীয়। অন্যদিকে জ্যোতিষবিদ্যায় তুমি পারদর্শী আর পার্থিব জগতের চৌষট্টি কলায় তোমার অবাধ যাতায়াত। তাই তুমি ঈর্ষার পাত্র। আর্যাবর্ত তোমায় ঈর্ষা করে। তবে তোমায় সাবধানে থাকতে হবে। আমি তো জানি তোমার একটাই মাথা। ওই একটি মাথা দশটি মাথার বুদ্ধি ধারণ করে প্রবল হয়ে উঠছে। নিজেকে সংশয়ে রেখো না। অহং’কে প্রশ্রয় দিও না।
রাবণ বলল, রাক্ষস এই শব্দটা ওরা আমার জন্য তৈরি করেছে। অহংকারী কে? আমি না ওই আর্যাবর্তের মনুবাদীরা?
পুলস্ত্য, ব্রহ্মার দশটি মানস সন্তানের একজন, সপ্তর্ষির অন্যতম কী বলবেন ভেবে পেলেন না। বিষর্ভ একটু বিভ্রান্ত হয়ে বললেন, রাবু মায়ের কাছে যাও, তিনি পায়েস করেছেন তোমার জন্য…

এতটা পড়ে, প্রডিউসার বাবুলাল বলল, রাইটার সাব রাবণ তো একবার ভি হা হা করকে হসাঁ নহি। রাবণ মাইনাস হসিঁ হোতা হ্যায় ক্যা?
বললাম, ও ঘুসা দুংগা
বাবুলাল – আউর রাবণকো রাবণ য্যাসা বনাও। ইয়ে তো রাম য্যাসা হো গয়া।
আমি – তুলসিদাসজী কো ছোড়কে রামায়ণকা তিনশো সে জাদা ভার্সন হ্যায়
বাবুলাল – (হেসে) কাউবেল্টমে রাইটার সাব এক হি ভার্সন চলতা হ্যয়, তুলসিদাস।আউর অব পলিটিক্স ভি রামসে জুড় গয়া। তো, তাগড়া জয় শ্রীরাম টাইপ স্টোরি বনাইয়ে। মেরা বাজেট পতা হ্যায় না আপকো? মেগা বাজেট। রামলীলা, গানাবাজানা, ডিজিটাল ইয়ুধ ইয়ে সব ডালিয়ে। আউর এক দো আইটেম সং। আপকো ১ কড়োড় দেনেওয়ালে হ্যায়, ইয়ে ভেজ রামায়ণ নহি চলেগা স্যারজী!

আরব সাগরে সন্ধ্যা নামে। আমি বাবুলালকে দোষ দিই না। তেলকল, চিনিকল থেকে প্রোডিউসার। খুব ইতিহাস প্রেম। পিরিয়ড মুভি করার সখ। রামায়ণ দিয়ে শুরু। নেক্সট সিকন্দর আউর পোরাস। মাল খায়। মাংস খায় না। রাবণ চায় তুলসিদা্সি। একদিন বলেছিল, রাবণ তো অসুর থা, রাখ্‌সখস(রাক্ষস)। উও দন্তমঞ্জন ইস্তেমাল কিঁউ করেগা? শালা, আমি রাবণ, আমিই রাবণ, গান্ডুটা জানে না। আমার রাবণ হওয়াটা কোনও জাদু বাস্তবতা নয়। আমার স্বপ্ন, জীবনের লক্ষ্য রাবণ হওয়া। ঠিক তাও নয়, আমিই রাবণ।

– তুই রাবণ?
আমি হেডস্যারের দিকে তাকিয়ে বললাম, হ্যাঁ স্যার!
– হেসে দেখা
– রাবণ হো হো হা হা করত না স্যার
– তাই,তাহলে কী হারমোনিয়াম বাজাতো?
– বীণা বাজাতো স্যার, আর রাবণাহাট্টা
– অ..ক্লাস নাইনেই এতকিছু জেনে ফেলেছিস, দেখিস বড় হয়ে সীতা হরণ করিসনি যেন!
– সীতা রাবণের মেয়ে ছিল স্যার
– কী, ইয়ার্কি হচ্ছে, রাবণের মেয়ে ছিল সীতা, তুই তো ডেঞ্জারাস রে, কাল বলবি আমি তোর বাবা..মানে ইয়ে যা সব দিচ্ছিস, এটাও বলে দিলে অবাক হব না!
– বিশ্বাস করুন, আমি ঠিক জানি, সীতার বাবা ছিলাম আমি
– ক্কী? কী বললি, তুই সীতার বাবা?
– আমিই তো রাবণ স্যার, জৈন রামায়ণ পড়ুন। ওখানে সীতার বাবা যে রাবণ মানে আমি স্পষ্ট লেখা আছে।
হেডস্যার ফ্যালফ্যাল।
অনেকক্ষণ পরে বললেন, ক্লাসে যা, তোর সুমতি হোক।

আমি রাবণ। উড়তে ভালবাসি। পুষ্পক রথ একমাত্র এই রাবণেরই আছে, সারা দুনিয়া জানে। আমি বেদজ্ঞ। শিবভক্ত। সেই আমি আজ উতলা। মা কৈকেশি শিব্ দর্শন করতে চান। নানাবিধ পুজা, যজ্ঞ ইত্যাদি করেও শিবের মন পাওয়া যাচ্ছে না। আজ মা কৈকেশি পায়সান্ন দিতে দিতে কাঁদছিলেন। তিনি শিবকে দেখতে চান। একবার।
আমি অনেকটা উঁচুতে এখন। পুষ্পক উড়ছে।

কয়েক বছর আগে এরকমই এক উড়ানে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।কঠিন সিদ্ধান্ত। মা, শিব দর্শনের জন্য ব্যাকুল। আমি গিয়েছিলাম মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। ফেরার সময় মন খারাপ চরমে। আর চটজলদি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। শিবের ওপর রাগ করে মনে মনে বললাম, মা আমি যাচ্ছি শিবকে আনতে, দেখি মহাদেব কী ভাবে ফেরায় আমাকে?। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। পুষ্পক’কে উত্তরমুখি করে কৈলাসের দিকে উড়িয়ে দিলাম। শিবকে যদি আনতে না পারি তো কৈলাস পর্বতই তুলে নিয়ে আসবো লংকায়। মা, তোমার রাবু তোমার মুখের হাসি আবার ফিরিয়ে দেবে..

– ইয়ে সব ক্যা হ্যায়, শ্রী রাম কা কোই অতাপতা নহি, খালি রাবণ! আরে ভাই সাউথ সে ভিলেন লাউংগা। পহেলা চয়েস প্রকাশ রাজ। লেকিন উসকা কুছ পলিটিকাল ঝামেলা হ্যায়। নহি মিলা তো সায়াজি সিন্ডে। রাবণ দারু পিতে পিতে অপ্সরায়োঁ কি আইটেম সঙ দেখ রহা আউর তাকিয়া পে লেট কর খুদ ভি নাচ রহা হ্যায়, কাহাঁ হ্যায় এয়সা সিন? রাইটার সাব, এক কড়োর কা মামলা হ্যায়। শ্রী রাম হ্যায় হিরো আউর রাবণ ভিলেন। অগর লিখ পাওগে তো লিক্ষো, নহিতো ছোড় দো..
আমি রাবণ। আমায় এই শালা তেল আর চিনি কলের বেনিয়া জ্ঞান দিচ্ছে?

তো, সেবার কৈলাসের পায়ের নিচে পুষ্পক নামালাম।
বাইশ হাজার ফুট ওপরে, কৈলাসের মাথায় শিব, পার্বতীর সংসার।আমি কৈলাসের নিচে, মানস সরোবরের পাশে ধ্যানে বসলাম।

‘নাগেদ্র হারায়া ত্রিলোচনায়া, ভাশমাঙ্গে রাগায়া মহেশ্বরায়া, নিত্যায়া শুদ্ধায়া দিগমবারায়, তাসমৈ না কারায়া নমহ শিবায়
মন্দাকিনি শলিল চন্দ্রায়া চার্চিতায়া, নন্দিশ্বারয়া প্রমথা নাথ মহেশ্বরায়া, মন্দ্র পুষ্প বাহু পুষ্প সুপজিতায়া, তাসমৈ মা কারায়া নমহ শিবায়।
শিবায় গৌরি বাদানা যা বৃন্দ, সূর্য দকশ ধোওয়ারা নশকায়া, শ্রী নীল কন্ঠ বিষ ধরায়, তসমৈ শ্রী কারায়া নমহ শিবায়
বশিষ্ঠ কুম্ভদ ভাবা গৌতম আচার্য মুনিন্দর দেভা আর্চিতা শিখারায়া। চন্দ্র আর্ক বৈষবানারায় লোচনায়, তসমৈ ভা কারায় নমহ শিবায়
ইজানায়া স্বরুপায়া জাটা ধারায় পিনাকা হাস্তায় সনাতনায়, দিব্যা দিবায় দিগম্বরায়া তসমৈ কারায়া নমহ শিবায়’

আমি রাবণ। আমার কণ্ঠস্বর ব্যারিটোন। মন্ত্র পড়ার সময় পুরো কৈলাস চত্ত্বর গমগম করছে আমার উচ্চারণে। বেশ কিছুক্ষণ পরে শিব মানসনেত্রে দেখা দিলেন। এখন যাকে ভিডিও কনফারেন্স বলা হচ্ছে, তখন এটাকেই বলা হত ‘মানসনেত্র সম্মেলক’ কার্যক্রম।
শিবের গলা শুনেই বুঝলাম খেপে গেছে।
– রেবো, তুইতো আচ্ছা বাঁদর। বারবার গগনভেদী হুংকার দিয়ে ডাকছিস, এদিকে আমার নন্দু (নন্দী, শিবের ষাঁড়) তো ভয়ে সারা। ডাকছিস কেন?
– প্রভু, প্রবলেম তো এক হি আউর উও আপকো পতা হ্যায়
– এই হিন্দি বলবি না
– উত্তেজিত হোনে সে বের হয়ে যাতা পরভু
– পরভু? আবার হিন্দি!
– আব্বু লিস, আর হবে না। কিন্তু এবার যে যেতেই হবে। মা একবার আপনার পায়ে মাথা ঠেকাতে চান
– রেবো, চালাকি করবি না। মা’কে তোর ওই উড়োজাহাজে করে আনলি না কেন?
– মায়ের হাই অল্টিচিউড সিকনেস আছে, মানে উচ্চতাজনিত অসুখ, তাই আপনাকেই যেতে হবে স্যার!
– আমি তোকে আশীর্বাদ আর বর দিয়েই ভুল করেছি। হিন্দি বলছিস, ইংরেজি বলছিস। এই গল্পটা যে লিখছে সে বাঙালি। ওর কথা ভাববি না হারামজাদা?
– তাহলে যাচ্ছেন তো?
– আগে তুই বল, ওই অতবড় অং বং চং মন্ত্র গাঁক গাঁক করে পড়লি কেন? ভয়ের চোটে নন্দীটার জ্বর চলে এসেছে। আমায় ওই বামুনদের বানানো সংস্কৃত মন্ত্র পড়ে ডাকবি না। আমি সাধারণের ভোলানাথ। ভোলে বাবা। তোরা বামুনরা সব কিছুতেই আড়াল দিতে চাস, আমি ব্রহ্মা বা বিষ্ণু নই। ওরা অভিজাত। আমি গাঁজা খাই। ধুতুরার বিচি খাই। নেশা ভাং করি। গলায় সাপ ঝোলাই। গলার ভেতরে তোদের দেওয়া বিষগুলো ধরে রাখি। আমায় অংবংচং দিয়ে ডাকবি না। আমি অলংকার পছন্দ করি না।
– ঠিক আছে, ভোলে নাথ। আমি আর মন্ত্র পড়বো না। কথা দিচ্ছি। তাহলে এবার মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে আসুন। এই যাবো আর এই আসবো। পুষ্পক তৈরি। মা আপনার মাথায় পা ঠেকালেই ঘর ওয়াপসি।
– আবার হিন্দি!
– দুঃখিত। আর হবে না। তাহলে চলুন।
– আমার শরীরটা ভাল নেই। ম্যাজম্যাজ করছে। মাঝে মাঝে তোদের বিষগুলো খেতে হয়।কাল খেয়েছি, বেশ ক’দিন শরীর বশে থাকবে না। তুই ফিরে যা।
আমার রোখ চেপে গেল। আমি রাবণ। মা’কে কথা দিয়েছি শিবকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবো। আর শিবকে দেখো, ফালতু বাহানা দিচ্ছে!
বললাম, দেখো ঠাকুর আমি তোমায় নিতে এসেছি, খালি হাতে ফিরে যাবো না
– যাবো না, কী করবি কর!
আমি কৈলাস পর্বতকে ঝাঁকাতে আরম্ভ করি। পর্বত কেঁপে উঠতেই শিবের হুংকার, রেবো তোর মতলবটা কী?
– কৈলাস ওপড়াবো। তুমি আর মা পার্বতী সপরিবারে মাথায় বসে থাকো। একটু ঝাঁকুনি লাগবে। পরে পুষ্পকের সঙ্গে গেঁথে দেবো কৈলাসকে। সাঁ করে লংকায়। মা আমার তোমায় একটিবার সশরীরে প্রণাম করবে। তারপর ধাঁ করে আবার এখানে। প্রভু, প্লিজ কিছু মনে করোনা, গুস্তাখি মাফ
শিব খেপে লাল। পার্বতীকে বললেন, এই রেবোটাকে নিয়ে আর পারা যাবে না
– তুমিই তো বর দিয়েছিলে
– আমি আশুতোষ। দিয়েছিলাম। এবার লাথাবো।
বলেই শিব পা নামিয়ে মাথায় আণবিক শক্তিতে ভরপুর একটা টোকা দিলেন রাবণের মাথায়।
রাবণ, মানে আমি, জাস্ট উড়ে গেলাম মানস সরোবর পেরিয়ে। আর একটা টোকা। এবার মাটি বিদীর্ণ হতে লাগল। জল বেরিয়ে আসছে মাটি থেকে। চারদিকে জল আর জল। আমি জলমগ্ন।
শিব বললেন, বাড়ি যা রেবো। আমি ঘুমবো এবার।
আমি জলের ভেতর থেকেই আমার অভিষ্ট দেবতাকে বন্দনা করতে শুরু করলাম। এবার নিজের একটা হাত ছিঁড়ে নিয়ে জলের তরঙ্গ দিয়ে তার বানিয়ে ছেঁড়া হাতটায় বাঁধলাম। আমার সুর সেই জলের প্রবল আক্রোশ ছিঁড়ে বেরোতে লাগল। বেরোতেই লাগল। কতদিন, কত বছর জানি না। একদিন শিব এলেন মানসনেত্রে। বললেন, ফিরে যা। তোর সুর আমার রাগ নিভিয়ে দিয়েছে। আয়, জল থেকে উঠে আয়। আমি উঠে এলাম। দেখলাম মানস সরোবরের পাশে আর একটি বিশাল সরোবর।
শিব বললেন, ওটার নাম আজ থেকে সুরতাল।
আর্যাবর্ত ধীরে ধীরে যাকে অসুরতাল থেকে রাক্ষসতাল করে তুলেছে।

স্ক্রিপ্টটা পণ্য হয়ে উঠছে না। সিনেমার প্রায় পুরোটাই এখন পণ্য। রাবণ যাবতীয় খারাপ কাজ করবে, এটাই মশলা। সীতাকে অপহরণ করবে। হা হা করে হাসবে। দশটা মাথায় খেলে যাবে ক্রুরতা। অথচ আমি, রাবণ, আমি লংকার রাজা ছিলাম ২৫৫৪ খৃঃ পূঃ থেকে ২৫১৭ খৃঃপূঃ অবধি। সুশাসক ছিলাম। ওই যে জিডিপি’র গল্প এখন চালু করা হয়েছে, আমার সময়ে তুঙ্গে ছিল। প্রজারা খুশি ছিল। আমি আয়ুর্বেদের সাতটা গ্রন্থ লিখেছি। কুমারতন্ত্র হল এখনকার পেডিয়াট্রিক বা শিশু চিকিৎসার প্রথম আকরগ্রন্থ আবার ব্রাহ্মণ হলেও আর্যদের পছন্দানুসারে জীবন যাপন না করায়, বর্ণভেদ বিরোধী হওয়ায় আর্যরা আমায় দুনিয়ার যাবতীয় নেতিবাচক চারিত্রিক দোষ দিয়ে গড়ে তুলেছে। সীতা আমার মেয়ে, আমি রাজনৈতিক কারণেই সুপাত্র রামের ওর সঙ্গে ওর বিয়ে দিই। যাতে দুটো সভ্যতার একটা মিলমিশ হতে পারে। সংঘাত আর যুদ্ধ এড়িয়ে মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারে। ওই ছোকরা লক্ষণ সব বিগড়ে দিল। শূর্পনখা, লংকার তখনকার নিয়মানুযায়ী একজন স্বাধীন নারী। লংকায় নারীদের প্রেম নিবেদন করার অধিকারও আমি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। লক্ষণকে শূর্পনখা প্রেম নিবেদনইতো করেছিল। লক্ষণ সব সভ্য নিয়মনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে ওকে অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করল। এতো মহাপাপ! সীতা নিজের পিসির এই অবস্থা দেখে নিজেই আমায় খবর দিয়ে রামকে না জানিয়েই চলে এসেছিল অথচ আর্যাবর্তের মহাকবি বাল্মীকি আমায় নারী অপহরণকারী বানিয়ে দিল। অশোকবন ইত্যাদি বানিয়ে আমি নাকি সীতাকে বিবাহপ্রস্তাব দিয়েছিলাম এমন অনাচারের কথাও লিখে দিল। আজ রাবণ একা। যাকে তোমরা ‘ডিসকোর্স’ বলো, সেই ডিসকোর্সে রাবণ একা।
রাবণের একটাই গল্প।
তার দশটা মাথা। সে হা হা হা। সে রাক্ষস।
রাবণ বলিউডের প্রোটোটাইপ ভিলেন।
তেলকল, চিনিকলের মালিক রাবণকে নয়, রামকে বেচতে চায়। ঠিকই আছে। বেচাকেনাতেই যাবতীয় জিডিপি। শরীর হোক বা স্বপ্ন, আদর্শ হোক বা ধর্ম, বেচে দাও। এখানে রাবণ রাক্ষস, রাবণ দাঁত মাজেনা। রাবণের মুখে নরকের দুর্গন্ধ। জিডিপিও আর্য, অনার্যের বাইরে নয়। রাবণ দাঁত মাজলে, পুরো দ্রাবিড়দের দাঁত মাজা মেনে নিতে হয়। তাদের উন্নত সভ্যতাকে মেনে নিতে হয়। দশটা মাথার, কুড়িটা চোখের, দ্রাবিড় মস্তিষ্কের কোটি কোটি বিলিয়ন সক্রিয় নিউরনকে স্বীকৃতি দিতে হয়।
যা, আর সম্ভব নয় এই আর্য ন্যারেটিভ মেনে নেওয়া ভারতবর্ষে। এইতো আমি, আমি রাবণ, আমিই যখন নিজেকে স্ক্রিপ্টে নিয়ে এলাম, কিছু কমিক এলিমেন্ট রাবণের চরিত্রে রাখতেই হল আমাকে! রাবণ, আমার হাতেও মিথমিশ্রিত হয়ে গেল। সীতাকে অপহরণ না করলে রাবণের ভিলেনত্ব দাঁড়ায় না। ব্যতিক্রম শুধু জৈন রামায়ণ, যেখানে সীতাকে আমার সন্তান হিসেবে দেখানো হয়েছে। জৈন বা বৌদ্ধ ন্যারেটিভ এদেশে আনুমানিক ১০০০ খৃষ্টাব্দ ঘটে চলা হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদী পুনর্জাগরণের সময় থেকেই মুছে যাচ্ছিল। প্রথমে বৌদ্ধ তারপরে জৈন ধর্ম ভারতবর্ষে প্রান্তিক হয়ে পড়ে। আমি রাবণ হয়েও, দশটি মাথার বুদ্ধি দিয়েও ইতিহাসের চাকাকে উল্টোদিকে নিয়ে যেতে পারবো না। আরব সাগরের জলে ভাসিয়ে দিলাম আমার স্ক্রিপ্ট।
নাম দিয়েছিলাম রাবণের মুখ।

এখন দাঁড়িয়ে আছি একটা ফ্লাইওভারের ওপরে।
বিকেল নামছে মুম্বইতে।
দেখলাম একটা বিশাল মিছিল আসছে। হাজার হাজার মানুষ। গ্রামের হত দরিদ্র কৃষক। তারা পুরো দেশকে খাদ্য যোগায় কিন্তু নিজেদের ভাঁড়ার শুন্য। অর্থাভাবে, অপুষ্টিতে, আত্মহত্যা করে,  বিনা চিকিৎসায় অন্নদাতারা কেন মরছে? তাদের মুখের শ্লোগানে, হাতের প্ল্যাকার্ডে এরকমই সব প্রশ্ন। তারা এগিয়ে যাচ্ছে সরকারের দিকে।
যাক।
আমি মহারাজা রাবণ। আমি আমজনতায় মিশে যেতে পারিনা।
একা হওয়াই আমার নিয়তি।
একা একাই আমার অপেক্ষা। নিবিড় মৃত্যুমুখি অপেক্ষা। আমি আবার দাঁড়িয়ে গেলাম মহাকালের রাস্তায় একাকী।
বিজয়া দশমী অবধি আমার অপেক্ষা।
আমি পুড়বো। হাততালি দেবেন আপনারা।

Facebook Comments

Leave a Reply