কাশবনের ভাস্কর্য : শুভংকর গুহ

“নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে।

কিছুক্ষণের মধ্যে ঘরের এইদিক থেকে সেইদিকে গৃহস্থের সব টুকিটাকি যেন এলোমেলো হয়ে গেল। বড় বড় জিনিসগুলি আগেই ট্রাকে তুলে দিয়েছে সৈনিকরা। ঘরের ভিতরে ঘরটি অসম্ভব দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। সৈনিকরা কয়েকজন, মায়ের নির্দেশ মতো, জিনিসপত্তরগুলিকে চটের বস্তার মধ্যে রেখে বড় বড় সুই দিয়ে সেলাই করে দিচ্ছিলেন। মা বললেন, একটু থেমে থেমে দম নিয়ে কাজ করুন, আমাকে বুঝে নিতে হবে, কোথায় কি রাখলেন আপনারা। নতুন জায়গায় গিয়ে কিছুই মনে থাকবে না। খুঁজে পাব না। হ্যাঁ, হ্যাঁ, এইখানে এইটে রাখুন, হাতের কাছে হাতের জিনিস পত্তর না রাখলে, খুঁজতে গিয়ে সারাদিন আতিপাতি হয়ে যাবে। একজন সৈনিক বললেন, রসুইয়ের সব এই বস্তায় রাখলাম। আমি কালি দিয়ে দাগ দিয়ে রাখলাম। এই দাগ দেখেই বুঝতে পারবেন ভাবিজি।
মা ওদের নির্দেশ দিতে দিতে বললেন – আমাকে চায়ের কেটলি দিন। সৈনিক মায়ের দিকে তাকালেন। মা বললেন, বাঃ রে একটু চা করে দেব না আপনাদের? সেই কখন সকালে এসেছেন।
হাঁ হাঁ থোরি চায় পিনে সে মজা আ যায়েগা ভাবিজি – কথাটি বলল, শিখ সৈনিক মনপ্রীত সিং। বাংলা ভাষা সামান্য বোঝে। কিন্তু বলতে পারে না। সৈনিকরা সাদা কলাইয়ের মগে বিস্কুট চা খায়, সকালে আর বিকালে। ওদের ক্যাম্প থেকে দেওয়া হয়। সবাইকে হাতে মগ নিয়ে খাকি হাফ প্যান্ট পড়ে ক্যান্টিনে চলে যেতে হয়, সেখানে বিস্কুট চা খাওয়ার সাথে সাথে টেবিল, কলাইয়ের মগ থালা বাজিয়ে হিন্দি ফিল্মি গান গাইত সবাই একসাথে। কখনও কখনও সেই গান উল্লাসের মাত্রা ছাড়িয়ে আমাদের কোয়ার্টারেও পৌঁছে যেত।
মা বললেন – গতকাল চায়ের সময় সবাই গাইছিল।
অর্জুন থাপা পাহাড়ি, বলল – শিখ সৈনিক মনপ্রীত গা রহা থা।
মনপ্রীত লজ্জা পেল।
ঠিক আছে, কয়েকদিন পরে আবার আসব, সবার সঙ্গে দেখা করতে। তখন না হয় মনপ্রীতের গান শুনব। আজকে শোনার ভাগ্য হল না।
অর্জুন থাপা পাহাড়ি বলল – মাইজি ফৌজি একবার ঘর ছোড়নে সে, ঠিক নহি রহতা, কহা আজ অউর কহা কল।
মা বললেন – জানি অর্জুন, কিন্তু মনপ্রীতের এত তাড়াতাড়ি বদলি হবে না। আমি জানি। কয়েকদিনের মধ্যে আবার আসব। সবার সঙ্গেই দেখা হবে।
বুঝতে পারছিলাম, আমাদের পরিবারটিকে চটের মধ্যে বন্দি করে সেলাই করে দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমার এখানকার একটি উচ্ছসিত কাশবনের জীবনকে।
শৈশব মানে, শুধু আলো রাত্রি দিন নয়, ঘরের ভিতরে আসবাবেরও একটি ভূমিকা থাকে। ঘরে রাখা স্থায়ী আসবাব বা জিনিসপত্র যখন নাড়ানো হয় বা স্থান পরিবর্তন হয়, তখন আমার ভিতরে অদ্ভুত এক যন্ত্রণা হয়। যেখানে যা কিছু থাকার কথা তা যদি স্থানান্তরিত হয়, তাহলে মনে হয় একটা কিছু ভালো বা খারাপ ঘটতে চলেছে।
বড় হয়ে বুঝেছিলাম, যে কোনো মানুষের বসবাসের জায়গাটি যদি তার স্থির না থাকে, তা হলে তার সর্বপ্রথমে, নিজের বিছানার কথাই মনে পড়ে। কারণ বিছানাই তার প্রথম ও শেষ আশ্রয়। ভাগ্যবান সে, যার বিছানা তার জীবনের সাথে আলাউদ্দিনের চাদরের মতো থেকে যায়। কারণ বিছানা হল মানুষের কল্পনার একান্ত বিচরণভূমি। প্রতিটি মানুষের কল্পনার মধ্যে গহীন আরাম বিলাস ও বেদনা আছে, তার শ্রেণিগত বিন্যাসের কোনই ভেদ থাকে না। জীবনের প্রথম স্বপ্নদোষ যৌনতা ব্যাধি ও বেদনা বিচ্ছেদ ও বিরহ এবং মৃত্যু সব কিছুরই সাক্ষী তার জীবনের বিছানা। কফিন বা শবের খাটিয়া সে তো বিছানাই।
আমি ঘরের মেঝেতে অপাংক্তেয় গড়িয়ে থাকা জিনিসগুলিকে কুড়িয়ে নিজের কাঠের বাক্সের মধ্যে সঞ্চয় করছিলাম। এই কাঠের বাক্সের ভিতরে কাশফুলের ছোটো ছোটো ডগা রেখে দিয়েছিলাম। আমি জানি এই কাঠের বাক্সের ভিতরেই একদিন কাশফুলের জঙ্গল দেখতে পাব। কাশফুলের শুকনো ডগাগুলিকে কাঠের বাক্সের ভিতরে একপাশে সরিয়ে রাখলাম। কাঠের বাক্সের ভিতরে ক্ষয়ে যাওয়া একটি বাদামি রঙয়ের কাঠ পেনসিল, সেই পেনসিলের শিস জিভে দিলে জিভ বেগুনি হয়ে যেত, ভুল ভাবে উচ্চারণ করে বলতাম কপিন পেনসিল। স্ট্যাম্প জমানোর খাতা। নানা রঙয়ের কাঁচের চুড়ির ভাঙ্গা টুকরো, মেঝেতে রেখে কাঁচের আলপনা সাজিয়ে বসে থাকতাম। মা ঘরে ঢুকে ঢুঁ দিয়ে যাওয়ার সময় বলতেন, সাবধানে খেলবে, হাত কেটে যাবে। রঙ্গিন কাঁচের টুকরো জমানোর খেয়ালকে এই প্রবীণেও ভালোবেসে আছি। জিভের ডগায় আচার ফেলে মায়ের ঘরে ঢুকে ঢুঁ দিয়ে যাওয়াকে মনে হত, চমৎকার পর্যটন। একটি রুল টানা খাতা, রবীন্দ্রনাথের ‘সোনারতরী’ কবিতাটি টুকে রেখেছিলাম। কবিতাটি বাবা খুব সুন্দর আবৃত্তি করতেন। গগনে গরজে মেঘ… ঘন বরষা……
নানা রঙয়ের কাঁচের গুলি। এককথায় যাকে মার্বেল বলতাম। ঘুঘু পাখির পালক। খরগোসের ছবি। একটি ডায়েরি। যেখানে একটি ছোটো প্যারাগ্রাফ লিখেছিলাম–‘পানাগড়’। বেস ক্যাম্পের নানান উৎসবের পরে মাঠ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া তামার পয়সা। নানান রকমের সিগারেটের খালি প্যাকেট, তামাকের সুন্দর গন্ধ লেগে থাকত। বাবার অব্যবহৃত ও ফেলে দেওয়া টুপি ও একটি ক্ষুদে আকারের কানপুরী ভোজালি। যাকে বাবা বলতেন খুপরি। এটি আমারও জন্মের আগে, বাবা যখন রাঁচিতে থাকতেন, তখনকার সংগ্রহ। রাঁচির পাহাড়ি পথে যখন বাবা সাইকেল চালাতেন, ওই খুপরিটি সঙ্গে রাখতেন।
কিছুক্ষণ আগে ফুলেশ্বর একজনকে নিয়ে এল, সে বাবার সাইকেলটিকে যেন কান ধরে নিয়ে গেল। এখনও মনে আছে, র‍্যালি সাইকেল। কালো রডের মধ্যে সোনালি দাগ। ব্রাউন হলুদের মোটিফ। ভাবতে খারাপ লাগছিল, আমরা সবাই চলে যাব, বাবার সাইকেলটি অন্য কোনো সাইকেলচারীকে নিয়ে ছুটে যাবে, পানাগড়ের বেস ক্যাম্পের রাস্তায়। সাইকেলটি চলে গেল নতুন আরোহীকে নিয়ে। বাইরের সুরকি বিছানো রাস্তা দিয়ে চলে গেল স্পোকের ও চেনের মিহি শব্দ তুলে। সাইকেলটিকে বাবা ওই লোকটির কাছে বিক্রি করে দিলেন।
ফুলেশ্বরকে মা কি যেন বললেন।
ফুলেশ্বর কথা বলার সময়, নিজের দেশ গাঁয়ের কথার টান দিয়ে যায়। শেষ কথাটির সঙ্গে অদ্ভুত ’ঈ’ যুক্ত হয়। বলল – বাবুজির সঙ্গে পাকা কথা হয়ে গেছে।
জানি, তোমার বাবুজি আমাকে বলেছেন।
আরও বেশ কিছু ঘরের জিনিসপত্র ঘরের বাইরে চলে গেল। যেমন আমি যে তক্তপোষে ঘুমোতাম যেটি একমাত্র আমার নিজের ভুবন ছিল, প্রতিটি কাঠের পাটাতনে আমার শরীরের গন্ধ লেগে ছিল, সেই তক্তপোষটিকে বাইরের উঠোনে রাখা হল, নিশ্চয়ই বিকেলের দিকে কোনো বায়নাদার নিয়ে যাবে। কেন যেন মনে হচ্ছিল বাবার কঠিন পরিশ্রমে গড়ে তোলা, ঘর ভর্তি আসবাবগুলি একপ্রকার ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছিল। ঘরের জিনিস ঘরের বাইরে গেলে, কেন জানি ক্ষয়ে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই সব জিনিসগুলি বড় তাড়াতাড়ি বাইরের হয়ে যায়।
মা একা একা পেরে উঠছিলেন না। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে খুঁজছিলেন। সে রান্নাঘরের ছাদের ওপরে বসে তখন মাছভাজা খাচ্ছিল। আর নিশ্চয়ই সেই ল্যাংরা খাটাশটিকে কাশবনের জঙ্গলের ভিতরে খুঁজে যাচ্ছিল তার দৃষ্টি। মা তাকে ক্রমাগত খুঁজে যাচ্ছিলেন, কিছুক্ষণ পরে মায়ের ডাকে শুনে কাঠের মই ধরে নেমে এসে মায়ের সঙ্গে কাজে জুটে গেল।
তারপরে বলল — আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।
মা বললেন — কোথায় যাচ্ছ ?
সে বলল — আসছি। আমি একটু বালুসাই নিয়ে আসছি। সাথে ডালমুঠ আর পেঠা।
কেন ? ক্যান্টিনে যাবে?
এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো সবাই মিলে একবার বনভোজন করে যাই। আর তো যাওয়া হবে না।
কোথায় বনভোজন করতে যাবে?
রেল লাইনের ধারে, মালগাড়ির ওয়াগনের ভিতরে। দুপুরের পরেই আমরা সবাই যাব। বিকেল ফুরিয়ে আগেই ফিরে আসব।
তুমি কি জানো না খোঁড়া খাটাস ঘুরে বেড়াচ্ছে কাশবনের জঙ্গলে। কয়েকজনকে কামড়েছে। ও ধেয়ে এলে তোমরা সামলাতে পারবে ? আমি ফুলেশ্বরকে বলে রাখছি। ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও।
আমরা লাঠি নিয়ে যাব।
সে যাও। কিন্তু একজন বড় কেউ থাকা উচিৎ বলে মনে করি।
আমি কি বড় নই?
যাওয়ার আগে একটা কিছু বাঁধিয়ে বোসো না।
প্রতিটি কথার সাথে, ঘরের সব খুঁটিনাটি আসবাব ও ঘরের দেওয়াল কলপাড় ও মাধবীলতার মাচা, মাচার নিচে আমার নিজের হাতে গড়ে তোলা শহর ও বাড়ির পিছনের দিকে তারকাঁটার বাউন্ডারির ওপাশে ধু ধু কাশবন বাড়ির সামনের বারান্দা, থামের ওপরে বসে থাকা, বাদামি লাকির তলপেটে কার্তুজ – রক্ত গড়িয়ে পড়া চিতল মাছ ও বুদবুদ বাজারে যাওয়ার পিচের রাস্তা, বাবার কাছারিখানা গ্যারিসন অফিস সব কিছুই আমার জীবন থেকে সরে গিয়ে অন্য এক শহর বসবাস করবে, যার নাম কলকাতার পাশের একটি নয়ানজুলি শহর। বাবা গতকাল সন্ধ্যায় বোঝাচ্ছিলেন দিল্লি রোড ধরে কি করে যেতে হবে ভবিষ্যতের শহরের দিকে।

দুপুর গড়াতে না গড়াতেই আমরা চললাম, রেললাইন ধরে, ভাঙ্গা পরিত্যক্ত ওয়াগনের দিকে। একটি ব্যাগের ভিতরে পানীয় জল, বালুসাই ডালমুঠ লজেন্স আর বিস্কুট। গভীর কাশবনের ভিতর দিয়ে, মাটির সরু ফালি পথ। আমাদের মাথার ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে কাশগাছের ডগা। কিছুদিন পরে যখন ফুল আসবে তখন আমরা এখানে থাকব না। সাদা থোকা থোকা মেঘের মতো ফুল। দূর থেকে দেখলে মনে হবে মেঘ নেমে এসেছে মাটিতে।
দাদা ইচ্ছে করেই মাটিতে সশব্দে লাঠি ঠুকছিল আর জোরে জোরে কথা বলছিল। অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার পরে গবাদির মাঠ। গরু মোষের পিঠের ওপরে বক বসে আছে। শেষ দুপুরের ঘুঘু এমন ডাকে। সঙ্গীকে ডাকে, কাছে আসার জন্য।
ওয়াগনের ভিতরে আমরা বসলাম। বাতাসে উড়ে আসা বালু কণার স্তূপ ওয়াগনের ভিতরে ছড়িয়ে আছে। মুরগির ছেঁড়া পালক। ভাঙ্গা ওয়াগনের ভিতরে কাশবনের বাতাস কেমন গুমরোচ্ছিল। দুপুরের গুমরে ওঠা বাতাসের মধ্যে, যাযাবরের দলের ভ্রমণ থাকে। কখনও কখনও তারা দল বেঁধে পরিত্যক্ত রেললাইন পার হয়ে দূরে মহাসড়কের দিকে চলে যায়। এই দিকটা এমনই। মনে হয়, পৃথিবীর এক প্রান্তের। এক পাশে জনসমাজ, ওই পাশে পৃথিবী আর এই পাশে পরিত্যক্ত রেললাইন আর ভাঙ্গা ওয়াগন। যেন ফিল্মে ধরে রাখা হয়েছে ক্লিক। ডার্ক রুমে ছাপ নিলে শুধুই যেন হারানো দিনের প্রিন্ট।
নোংরা দেখে বললাম, এইদিকে সরে এসো।
দাদা বলল – শেয়ালের।
ওয়াগনের একেবারে দরজার কাছে, যেখান দিয়ে মাল ওঠা নামা করে সেখানে বসলাম। সমস্ত জঙ্গলটাকে যেন উপলব্ধ করা যায়। কেমন একটা বুনো গন্ধ। আমি বোকার মতো বললাম, ভালো করে বসার জায়গা পর্যন্ত নেই।
দাদা হাসতে হাসতে বলল – মালগাড়ির ওয়াগনের মধ্যে মানুষের বসার জায়গা থাকে না।
বালুসাই মুখে দিলাম। মিষ্টি বালু কণার মতো চূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল মুখের ভিতরে। পানাগড়ের বেস ক্যান্টিনের বালুসাইয়ের প্রসিদ্ধি আছে।
দাদা বলল, ভাবো এই বার ওয়াগন চলছে। কান পাতো বুঝতে পারবে লাইনের ওপর চাকা গড়িয়ে যাচ্ছে। আর তোমার মুখের ভিতরে বালুসাই।
সত্যিই ভাবনার মধ্যে অপূর্ব এক ভ্রমণ এল।
পালি থেকে জল গড়িয়ে, আমি মিষ্টি জড়ানো ধরা গলায় বললাম — আমরা চলে যাওয়ার আগে সবাই শেষবারের মতো এখানে এসে গেলাম।
দাদা বলল – কেন আসা হবে না? মনের ইচ্ছে থাকলেই আবার আসা হবে।
আচ্ছা বলো তো আমরা যেখানে যাব, সেই শহর কি এমনই হবে?
সব শহর একরকম হয় না। এখানে কশবন দেখছ। সেখানে হয় তো মানুষ দেখবে। আর যানবাহন। বিদ্যালয়। খেলার মাঠ। বাজার হাট। জলাশয় পুকুর দিঘি হাঁস অন্যরকম অনেকরকম।
আমরা সবাই কেন জানি কি সব কথা বলেছিলাম সেই সব আর মনে নেই। তবে আমরা যে এখান থেকে চলে যাব, সেই যন্ত্রণা আমাদের মধ্যে তীব্রতর হচ্ছিল। পরস্পরের কথাগুলি পরের প্রশ্নের উত্তর যেমন হয় অথবা কথাগুলি সংযোগহীন যেমন হয়। ধোঁয়াশা রেখে বলতে পারি, না জানা বেগুনি রঙয়ের জংলি ফুল, খোঁড়া খাটাসের হাঁস চুরি, কাশবনের পাড় ঘেঁষে পানিঝোরা, ধনেশ পাখির ডিম, ক্যাপ্টেন ব্রজেন মিশ্রাজির এ্যাকোরডিয়ান বাজানোর মিহি শব্দ আর ক্ষেত্রপাল মন্দিরের চাতালে ওঠার পরের পর সিঁড়ি।
একদিন আমার শরীর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের রঙ যখন গভীর কালো তামাটে হয়ে উঠল, এই প্রবীণে এসেও বুঝতে পারি, সেই সময়ের আমার আমিকে আঙ্কল টমসের মতো ভাবতে এখনও এক প্রকার বিলাস অনুভব করি। কেন জানি আমরা অনেকেই কোনো একটি আখ্যানের বিশেষ বা মুখ্য চরিত্র হয়ে উঠতে সবাই কি ভীষণ আহ্লাদ অনুভব করি। তবে নিজেকে সবসময় আফ্রিকানদের একজন ভেবে, নিজের কৃষ্ণবর্ণের মাহাত্মকে একটি মহাদেশের বর্ণময় উচ্ছ্বাস ভাবতে কসুর করি না। আসলে ভারতের মাটির অবলম্বনের সাথে আফ্রিকার খুব একটা পার্থক্য নেই।
ঘুমের মধ্যে কাগজের ওপরে সারাদিন জলরঙ ছড়িয়ে যাচ্ছি, গেলাম সেই কাশবনের কাছে রেললাইনের ঠিক ওখানে, কিন্তু কোথাও নেই রেললাইন আর পরিত্যক্ত ওয়াগন। কাগজ আমার প্রস্তুত ছিল, জলরঙয়ের টিউব ঘাসের ওপরে ছড়িয়ে ছিল, পাশে কন্টেনারে জল, মসৃণ সোনালি হ্যান্ডেলের তুলি আর সামনে সাইকেলের চাকার দাগ ফেলে যাওয়া মাঠ।
একদিন আমার সঞ্চিত পানাগড়ের সব দৃশ্যগুলি বহুদূরে সরে গেল। এই পর্যন্ত বেড়ে ওঠাকে মনে হচ্ছিল একটি দ্রুতগামী ট্রেন। ট্রেনের জানালায় হাত রেখে, শুধু দৃশ্য দেখে যাওয়ার এক সুখকর বেদনা।
আর্মির একটি বড় ট্রাক আমাদের কোয়ার্টারের সামনে দাঁড়াল। ঘরের মালপত্তরগুলিকে ট্রাকে তোলা হচ্ছিল। সকাল থাকতে থাকতেই সব গুছিয়ে নিয়ে, ট্রাকে তোলা হচ্ছিল যাতে আমরা সন্ধে থাকতে থাকতে পৌঁছে যাই কলকাতায়। বাবা এখান থেকেই অনেক কাজ গুছিয়ে রেখেছিলেন, নিজের অনুজের সঙ্গে কথা বলে। নিমেষের মধ্যেই সব কাজ গুটিয়ে নিয়ে আমরা পোশাক পড়ে প্রস্তুত হয়ে নিলাম, একে একে সবাই আসতে থাকলেন। পণ্ডিতজি পণ্ডিতানিজি মেজর চ্যাটার্জী, বাবার আরও অনেক বন্ধুবান্ধব। ফুলেশ্বর এসেছে সেই সকালে, মুখ তার ভারী। কোনো কথা বলছে না।
মা বিভিন্ন হাতের কাজ করতে করতে ফুলেশ্বরকে বলছে মদ গিলে গিলে যমুনাকে তুমি অনেক বিব্রত করেছ। আর ওকে জ্বালিও না। এ সব ছাই পাশ ছেড়ে দাও। জানি এখান থেকে আমি চলে গেলে এই কথা তোমাকে আর কেউ বলবে না। তবুও আমি বলে গেলাম। স্বামী যদি মাতাল হয়, স্ত্রীর শরীরের ও মনের অপমানের জ্বালা তোমরা বুঝবে না।
জানি ভাবিজি, কেউ বলে না। বলবেও না।
বুঝতে পারো না, তোমার মাতলামি দেখে সবাই মজা নেয়। তুমি যতই এমন আচরণ করবে ততই লোক আনন্দ পাবে। যমুনা ঘরের ভিতরে কাঁদবে। তোমরা মাতাল পুরুষ, মেয়েদের মাতাল স্বামী নিয়ে ঘর করার দুঃখ বুঝবে না।
ফুলেশ্বরকে মা কিছু টাকা দিলেন, বললেন, যমুনাকে একটি রূপোর মালা কিনে দিও। বলবে দিদি দিয়েছে। এই টাকা দিয়ে মদ খেও না, যদি খাও তাহলে পরে আমি জানতে পারলে বুঝব তুমি আমাকে অপমান করেছ।
ফুলেশ্বর মাকে প্রণাম করে ডুকরে কান্না করল। ভাবিজি এই বেসক্যাম্পে কেউ আমাকে কোনো দিন এই ভাবে বলবে না।
মা বললেন – ভালো থেকো। যমুনাকে রূপার হার কিনে দিয়ে বলবে, ভাবিজি দিয়েছে।
আপনি আমাকে এত টাকা দিচ্ছেন কেন?
গেল বছর পুজোতে আমি ওকে কিছু দিতে পারি নি বলে, একসাথে দিলাম।
আপনি এখান থেকে চলে গেলে, কেউ আমাকে হুকুম আর আপনার মতো করবে না।

সৈনিকরা দ্রুত কাজ করে ঘরগুলিকে পরিষ্কার করছিল। শেষবারের মতো চেক করে বাবাকে একজন সৈনিক বললেন — বাবুজি ফির সে আউর একবার চেক কর লিজিয়ে?
আমি প্রশ্নকর্তা সৈনিকের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। এই সেই সৈনিক সেইদিন দুপুরবেলায় বহুদূর থেকে নিশানা করে বাদামি কুকুর লাকির তলপেটে কার্তুজ গেঁথে দিয়েছিল। জ্ঞানবন্ত নায়েক।
আমি তাকে চিৎকার করে প্রশ্ন করেছিলাম — কেন? কেন? গুলি করলেন? সেই দিন সে আমার দিকে কি ভীষণ কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। আর আজ বিদায়বেলায় তাকে স্বাভাবিক লাগছিল দেখতে। কি নরম চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে ছিল। সামরিক বাহিনীতে শুধু একটি মাত্র শব্দ পেশার সঙ্গে যুক্ত, আর গভীর সম্মানীয় সেই আদেশ… অর্ডার…
বাবাদের অফিসের কাজটি এমনই কয়েকবছর বা দীর্ঘ কয়েকমাস একসাথে কাজ করে নিজেরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অন্য শহর অন্য ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াতে চলে যায়। আর পরস্পরের দেখা হয় না। নিজেরা কাজের মধ্যে প্রবেশ করে নিজেদের মধ্যে বুঁদ হয়ে যায়। শুধু খোঁজ রাখে নিকট পরিচিতদের কোথায় কোন শহরে আছে।
ফাঁকা ঘরগুলির ভিতরে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম নিজের কিছু ফেলে গেলাম কি না ? ঘরের মেঝে থেকে কুড়িয়ে পেলাম, কতগুলি রঙ্গিন কাঁচের বল। আর জানালার পাশে দেওয়ালের তাকে দেখলাম বাবা যে বইটি একটু একটু করে রোজ পড়তেন সেই বইটি তাকের ওপরে রেখে দেওয়া আছে সেই ভাবেই, যে ভাবে তিনি রোজ রেখে দিতেন। অভিযাত্রী গ্যারিবল্ডির বইটি আমি পড়ব কি করে? পড়ার মতো যোগ্য যে হয়ে উঠিনি।
কিন্তু বাবা রোজ বইটি পড়তেন বলে, বইটির প্রতি এক অদ্ভুত দুর্বলতা ছিল। নিজেই অবাক হয়ে ভাবছিলাম বাবা নিশ্চয়ই বইটি তুলে গুছিয়ে কোথাও রেখে নিতে ভুলে গেছেন। আমি রঙ্গিন কাঁচের বল ও বইটিকে নিজের একটি ছোটো থলিয়ার ভিতরে রেখে নিলাম। আরও কতকিছু যে পড়ে আছে, আমার সঞ্চিত নানান কিছু দেখে নিজেই বিস্মিত হয়ে গেলাম।
পণ্ডিতানিজি এক পরাত মঠ নিয়ে এলেন সাথে অনেক লাড্ডু। মা কিছু বলতে পারছিলেন না। তার চোখ ছল ছল করে উঠছিল। কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারছিলেন না। গাড়ি যখন ছাড়বে তখন প্রায় হন্তদন্ত হয়ে এলেন ক্যাপ্টেন ব্রজেন মিশ্রা।
বাবাকে কিছু জরুরি কথা বললেন। বাবার হাতে একটি জরুরি সাদা খাম তুলে দিলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অনেকক্ষণ আদর করলেন। আমার গাল টিপে দিলেন, ম্যাডাম মিশ্রাজি মায়ের হাতে একটি গিফট প্যাক তুলে দিলেন। বললেন — ক্যাপ্টেন সাহেব আপনাদের নিশ্চয়ই কিছু বলেছিলেন। বিষয়টি একবার ভেবে দেখবেন। আপনার সন্তান সে আমারও সন্তান।
ক্যাপ্টেন মিশ্রাজি মায়ের হাতে দিলেন সেই শঙ্খলাগা সাদা তোয়ালে।
মা বললেন – কেন?
এ আপনার ঘরে থাকাই ভালো। আপনার মঙ্গল হবে। তারপরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন- আমার তো সন্তান নেই।রোজ বিকেলে এ্যাকোরডিয়ান যখন বাজাবো আপনি বিকেল বেলায় তোয়ালের ওপরে হাতে বুলিয়ে নিয়ে আমার কথা মনে করবেন। দেখবেন এ্যাকোরডিয়ান বাজানোর শব্দ আপনার কানে পোঁছে গেছে।
এ্যাকোরডিয়ান বাজানোর অভ্যাস ছাড়বেন না। রোজ বাজাবেন।
আমারও ট্রান্সফার অর্ডার আর কিছুদিনের মধ্যেই এসে যাবে মনে হচ্ছে। আমি মধ্যপ্রদেশ পছন্দ করছি। জানি না, বড় কর্তারা এখন কি করবেন।
মা হাসলেন।
বাবা বললেন – আমি পৌঁছেই আপনাকে চিঠি লিখছি।
পণ্ডিতানিজি বললেন – আমার বেটাকে অচ্ছা সে দেখভাল করে রাখবে বেটি।
রাখব পণ্ডিতানিজি।
মা পণ্ডিতানিজির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। বললেন – কিছু ভুল করলে মাফি করে দেবেন মাইজি। যতদিন থাকলাম, আপনি আমার ছেলেদের দাদির মতো হয়ে গেলেন। আমার মায়ের মতো।
কি বললি বেটি?
নিজের খেয়াল রাখবেন মাইজি।
পণ্ডিতানিজি নিজের খেয়ালে বলে উঠলেন – মাইজি !!!

গাড়ি ছেড়ে দিল। আস্তে আস্তে গড়িয়ে পার হয়ে গেল কাঁটাতারের বেড়া। টায়ারের চাপে সুরকির মিহি কান্নার শব্দ আজও কানে লেগে আছে। জানি না, আমি কি আমার কিশোর জীবনের বাউন্ডারি কাঁটাতারের সীমানা পাড় হয়ে গেলাম কি না, কে জানে? বহুদূরে পরিত্যক্ত রেললাইন আর ভাঙ্গা ওয়াগন, খাতার পাতায় যেমন জলরঙ ছড়িয়ে যায় তেমনিই বিমূর্ত, ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এল। হ্যাঁ, মা তাকিয়ে আছেন গ্যারিসন রোডের ধারে সেই শঙ্খলাগা স্থান চিহ্নটিকে। আমরা সবাই যেন কি ফেলে যাচ্ছিলাম। বাবা তাকিয়ে ছিলেন বহুদূরে যেখানে সবাই দাঁড়িয়ে একসাথে আমাদের ট্রাকের চলে যাওয়ার দৃশ্যটিকে দেখছিলেন। শেষবারের মতো বাবা একবার হাত নাড়লেন।
আমি ট্রাকের মধ্যে এক কোণে বসে দেখতে থাকলাম। বিস্তীর্ণ কাশবন। এখানকার লাল সুরকি বিছানো পথ। পথের ধারে বিস্তৃত মাঠ, উৎসব অনুষ্ঠানের ও দুর্গোপুজোর প্যান্ডেল ভেঙ্গে যাওয়ার পরে আমি প্রতিটি ঘাসের ডগা ধরে ধরে তামার এক নয়া পয়সার সন্ধান করতাম। দূরে রেললাইন আর মালগাড়ির সেই পরিত্যক্ত ভাঙ্গা ওয়াগন। নিজের ভিতরের শরীরের অংশগুলি কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। আর আমি নিজেই একটি আগুনে পুড়ে যাওয়া কাশবন। হু হু করে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। তীব্র ভাবে আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল। খরগোশগুলি তীব্র আতঙ্কে গর্ত ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল অন্যতম বনরেখার সন্ধানে।
সোঁ সোঁ শব্দের সাথে, গাড়ির গতির সাথে পিছিয়ে যাচ্ছিল পানাগড়… বিদায় পানাগড়। আমাদের ট্রাকের পিছনে দৌড়ে আসছিল তলপেটে কার্তুজের গভীর ক্ষত নিয়ে আমাদেরই পরিবারের আরেক সদস্য বাদামি লাকি।

[ক্রমশ…]

Facebook Comments

Leave a Reply