অজানা দেশের না জানি কী : শুভঙ্কর দাশ
অজানা দেশের না জানি কী ১
এক যে ছিল অজানা দেশ। তা এত বড় যে কেউ জানত না কত বড়। জানবে কীকরে, কারণ দেশটা কখনো বড় হতো কখনো কুঁকড়ে গিয়ে একটা শহর হয়ে যেত। তাই সে দেশের অর্থমন্ত্রী জানতে পারেনি কীকরে মাসে লাখ টাকার কম রোজগার করে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে! ওরা মানুষতো? হাত, পা থাকলেই তো আর মানুষ হয় না। কিন্তু ওদের মুখ আছে। ওদের আবার নাকি খিদেও পায়। তা মন্ত্রী গিয়ে জানালো এসব কথা। তা সম্রাট তখন ব্যস্ত মানুষকে গল্প শোনাতে। আসলে সম্রাট ভালোবাসত গল্প শোনাতে। সে নিজেও গল্প শুনতে ভালোবাসত কিনা!
অজানা দেশের না জানি কী ২
তো সেই সম্রাট গল্প শোনাতে ভালোবাসত। কোনোমতে একটা স্টেজ পেলেই হলো। টিভি, রেডিয়ো, ছবির পোস্টারে গল্প নিয়ে হেসে হেসে তাকিয়ে থাকত শ্রোতাদের দিকে। গল্প তো আসলে সত্যি নয় কিন্তু লোকজন ভাবত, কে বলেছে সত্যি নয়, এমনতো হতেও পারে! তাই তাঁকে বিশ্বাস করে আকাশের দিকে টর্চ জ্বেলে লোকজন বসে থাকত রাতের পর রাত। সেই আলো ধরে হয়ত নেমে আসবে ঈশ্বর বা কোনো এলিয়েন। এতো জানা কথা যে সাহেবটা কী বলেছিল! বলেছিল যে দেবতা আসলে গ্রহান্তরের মানুষ। তাই বলা যায় না যদি উড়ন্ত চাকি নিয়ে চলে আসে ঝাঁ করে। অথচ সত্যি এলে যে কী করবে কেউ জানে না। সম্রাট জানায় নি তাদের।
ওই যদি আসে এই আশায় আশায় অন্ধকার করে দেওয়া শহরে, গ্রামে, বন্দরে জ্বলে উঠত টর্চের আলো, মোমবাতি, ঘিয়ের প্রদীপ। সে এক মহা সাররিয়াল ব্যাপার স্যাপার। আসলে তারাও না জেনেই তখন ঢুকে পড়েছে সম্রাটের বলা এক গল্পের ভেতর। আর তাই দেখে সম্রাটও মহা আনন্দ পেয়ে আরো হাসছে। তার চোখের দামী চশমা চিকচিক করে উঠছে। সম্রাট তো আর সস্তা চশমা পরতে পারে না। তাহলে সে আর সম্রাট হবে কীভাবে?
অজানা দেশের না জানি কী ৩
গল্প বলা এত সোজা নাকি! লোকে যে কেন বোঝে না। আছে কিছু বিটকেল। সারাক্ষণ বসে আছে খুঁত ধরবে বলে। শালাদের সবকটাকে দেশ থেকে বার করে দিতে হবে গাধার পিঠে চড়িয়ে। তবে যদি মাথায় ঢোকে গুরুত্বের কথাটা খানিক।
সক্কালবেলা তার দেওয়াল জোড়া আয়নায় প্র্যাক্টিস করতে করতে এসব ভাবছিলেন সম্রাট। গল্প তো সবাই বলতে পারে ওইরকম প্যাঁচাপানা গম্ভীর মুখে বললে কেউ শুনবে? দায় পড়েছে শুনতে। আরে বাবা উত্তমকুমার কী আর এমনি এমনি উত্তমকুমার হয়েছিল নাকি? উত্তমকুমারের সিনেমা দেখে শেখো, একটা স্মিত হাসি লেগে থাকত তাঁর ঠোঁটে সব সময়। দাঁত কেলিয়ে দিলে হবে না। তার জন্য প্র্যাক্টিস দরকার। মানুষ তোমাকে যে বিশ্বাস করে গল্প শুনতে বসবে তার জন্য দরকার একটা ইমেজ। আর একটা স্মিত হাসি মুখ। আর তা করতে হবে ধীরেসুস্থে।
অজানা দেশের না জানি কী ৪
হারুণের বাবা রশীদও ভালো গল্প বলতে পারত। হারুণ ভাবত বাবা কেন যে এইসব মিথ্যে গল্পগুলো বলে চলে সমানে। শুনে বাবা বলত – কী করব বল, আমি এ ছাড়া তো আর কিছুই পারি না। এই গল্প বলে দু পয়সা কামাত রশীদ। কিন্তু তার বউও একটুও খুশি ছিল না। একটা অকর্মার ধাড়ি। কিস্যু পারে না। এইসব বলে ঝগড়া করতে করতে সে পালাল আরেকজনের হাত ধরে। যার মাথা শুধু বাস্তবতায় ঠাসা। কোনো গালগল্প নেই সে মাথায়।সেই থেকে গল্প আর বলতে পারত না রশীদ। মুখ হাঁ করে থাকত শুধু। সম্রাট এ গল্পটা জানেন, তাই বাস্তব পৃথিবীতে কী চলছে অন্তত তার অজানা দেশে কী ঘটছে তার খবর রাখতেন তিনি। তিনি তো আর রশীদ নন, তাঁর লোকলস্কর পাইক বরকন্দাজ আছে। তারা ঠিক খবর এনে দেয় তাঁকে।
অজানা দেশের না জানি কী ৫
এই অজানা দেশে অনেকগুলো স্বপ্নের কারখানা আছে। সেখানে স্বপ্ন দেখার ট্যাবলেট বানানো হয়। আর সেইসব কারখানার চিমনি দিয়ে একরকম গ্যাস বেরোয় যার গন্ধ মিষ্টি। সেই গ্যাসের গন্ধ একবার নাকে গেলে বা যে একবার সেই গন্ধ শুঁকেছে সেই জানে তা কেমন। একবারে জিভ অবধি মিষ্টি হয়ে যায়। মানে জিভটা যদি চমচম হয় তখন কী আর তা বেশিক্ষণ ভালো লাগে। তখন লোকজন বেশি হইচই করলে চাবি ঘুরিয়ে একটু অন্যরকম গ্যাস ছেড়ে দেয় কারখানার মালিক। যা শুঁকে লোকজন যে যেখানে আছে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। সে এক ঝামেলার ব্যাপার। সবে বৌদির সাথে একটু লাপটা লাপটি করেছে কি করেনি এসে গেল মরণের ঘুম। সে এক ঝামেলার ব্যাপার তো বটেই। যদি ঘুম কাটে তখন তো আরেকটা গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়তে হবে, যদিও সবাই গল্পের পাত্র মিত্র আমানত মাত্র।
অজানা দেশের না জানি কী ৬
এধার ওধার ছেড়ে সেধারে যাওয়ার কথা ভাবলেন সম্রাট। যেখানে জল জমে দুধ হয়। যেখানে মাহেন্দ্রক্ষণে নাকি মহাদেবতার আরতি করতে আসেন ছোটো দেবতারা। এইসব এক সাধু মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল একবার। সেসব কথা বইয়ে লিখেছিল কেউ। আরো কত গল্প তিনি শুনে আসছেন সেই ছোটোবেলা থেকে। এই তীর্থের প্রতিষ্ঠা নাকি করেছিলেন এক মহাসাধক। সে করুকগে কিন্তু কথিত আছে ওখানে গেলে নাকি সব পাপ আর রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। সম্রাটেরও তো বয়স হচ্ছে তাই একথাটা তার মনে ধরেছিল।
এখন বললেই তো আর যাওয়া যায় না। নাগক্ষেত্র বলে কথা। গুহা পেলেই তো হলো না, দেখতে হবে সেখানে সাপখোপ যাতে না থাকে। সাধুদের মতো যেখানে সেখানে আসন পেতে ধপাধপ বসে পড়লেই তো হলো না। এ বাবা সম্রাটের পাছা তার একটা আদর নেই। তারপর তো আছে ড্রেসার, মেকাপ ম্যান, ক্যামেরা ম্যান আর কত কী। তা শেষে পাওয়া গেল গুহা যেখানে তপস্যায় বসবেন সম্রাট। চটজলদি ইলেকট্রিকের ব্যবস্থা হলো। এলো নতুন গদি চাদর। সম্রাটের ব্যবসাদার বন্ধুরা ওটাকে মন দিয়ে সাজালেন যাতে পরে সম্রাটের এই ব্যবহার করা গুহা ভাড়া দিয়ে দুটো পয়সা কামানো যায়। কে আর ফ্রিতে আজকাল টাকা পয়সা খরচ করতে চায়। কিন্তু সম্রাট জানে এই দেশ কেমন দেশ। এই কিছুক্ষণ তপস্যার জন্য তার ইমেজ বাড়বে বই কমবে না।
অজানা দেশের না জানি কী ৭
হারুণের বয়স কম। তাই তার স্মৃতির ভার কম, নস্টালজিয়া কম। কুয়াসা বা বৃষ্টি দেখে সে রশীদের মতো উদাস হয়ে পড়েনা। অসহায় হয়ে পড়ে না। এত উদাস হওয়ার কী আছে সে ভাবে? সে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে না। লোকটা কেমন যেন মাথা নামিয়ে চুপ করে থাকে আজকাল। তার গল্প বলা থেমে গেছে।
মা এমন করে চলে যাওয়ায় তার একটা যন্ত্রণা আছে বটে কিন্তু তার থেকে বেশি আছে রাগ। মায়ের ওপর, ওই লোকটার ওপর যে মাকে নিয়ে চলে গেছে। আর সব থেকে বেশি রাগ হয় বাবার ওপর। কেন লোকটা মিথ্যে গল্প বলে কাটিয়ে দিলো এতটা জীবন?
আসলে হারুণকে কেউ বলে নি গল্পের সত্যি মিথ্যে হয় না। গল্পটা গল্পই। মাঝে মধ্যে তা ম্যাজিক ডালপালা মেলে দিতে পারে। গ্রামের দালানে বসে হারকিনের পলতে নামিয়ে বড়মার সেসব গল্পের মতো। বাঁশ পাতার সিরসিরে বাতাসের মতো। যা রশীদ শুনেছে বাবু হয়ে বসে, দিনের পর দিন।
অজানা দেশের না জানি কী ৮
বড়মার নামের মতোই তাঁর চেহারাটা ছিল বড়। বিধবা বলে একটা সাদা থান ঘোমটা দিয়ে পরতেন। তখন ব্লাউজের চল ছিল না এখনকার মতো। তার ধবধবে ফর্সা হাত দুটো দেখে রশীদ ভাবত – আচ্ছা গ্রামে তো সবাই কালো-কুলো অথচ বড়মা এত ফর্সা হয় কীকরে? এই ফর্সা রং- এর টানও কি একটা ব্যাপার ছিল? কে জানে। সন্ধ্যে নাগাদ থেলো হুঁকায় টান দিতেন বড়মা। তখন রশীদের তাঁর কাছে যাওয়া ছিল মানা। রশীদ তো ছিল গল্প পাগল তাই সে সারাক্ষণ ঘুর ঘুর করত বড়মার কাছে।
কী বড়মার আঁচল ধরে যে ঘুরিস সারা দিন। বড় হ। তার বাবা বলত। কিন্তু গল্পের এমনই টান যে রশীদ ভালো ছেলে হলেও সে কথায় কান দিত না। যেন একটা সাপ তাকে বশ করেছে। আর তার টানে সে অবস। তার কিচ্ছু করার নেই বড়মার কাছে যাওয়া ছাড়া।
সেদিন রাতে বড়মা তাকে বলল- জানিস সন্ধ্যবেলা ঈশান কোণে দেখি একটা ডাইনি আলোর ঝাঁটায় চেপে সাঁ করে চলে গেল।
রশীদ আর বড়মাকে বলেনি সে সন্ধ্যেবেলা শহর থেকে আনা একটা রকেট – বোম ছেড়ে দেখছিল ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়। সে কথা অবশ্য সে বেমালুম চেপে গেছিল সেদিন।
অজানা দেশের না জানি কী ৯
অজানা দেশটা আসলে পুরোটাই গ্রাম। যে কটা শহর আছে তা পত্তন করেছিল কারখানার মালিক, জমিদার, আলুর আড়তদার ইত্যাদি সব লোকজন মূলত ফুর্তিফার্তার জন্য। চন্ডু, মদ, মাগি, রসের নাচাগানা, খাওয়া দাওয়ার সে এক মহা হুল্লোড়। সঙ্গে একটু মন্দির মসজিদ চার্চ ইত্যাদি। মানে পাপ ধোয়ারও তো জায়গা চাই নাকি? আর এসব কাজ করার জন্য গ্রামের বোকা লোকজনের দরকার হয়ে পড়ল। চাষের কাজে এমনিতেই ধারকর্জ এত বেড়ে যাচ্ছিল যে লোকজন আর সামলাতে পারছিল না। দেশটা কুঁকড়ে গিয়ে সব কিছু হয়ে উঠলো যেন শিহরণ, একটার পর একটা শহর আর আরো ফুর্তির জায়গা। কাঁহাতক আর জমিদারের বাঁধানো পুকুর ঘাটে বসে আড্ডা মারা যায়। এর ওর গাছ থেকে ফল-পাকুড় চুরি করতে ভালো লাগে। সেই শহুরে শিহরণ এতে নেই। তারাও আর অতটা বোকা রইলো না হয়ত কারণ কথিত আছে শহরের জল একবার পেটে পড়লে মানুষ অন্যদিকে ধায়। ভালোছেলে রশীদও একদিন গিয়ে পড়ল সেই শহরে। আর দেখল গল্প শুনিয়েও বেশ টাকাকড়ি পয়দা হয়। আর কাজটায় একটা শিহরণ তো আছেই।
অজানা দেশের না জানি কী ১০
কত অজানা দেশই তো আছে যা ছোটো হয়, বড় হয়। যেখানে এমনকি সময়ও থেমে থাকে মাঝে মাঝে কিন্তু তাই তাকে জ্ঞানগঞ্জ ভাবলে ভুল হবে। কারণ এই অজানা দেশগুলোয় কেউ চন্দ্রবিজ্ঞান, সূর্যবিজ্ঞান শেখায় না। শেখায় না লেন্স দিয়ে সূর্য রশ্মির আলোক রশ্মিকে ভেঙে তার মধ্যে থেকে প্রলয় আর সৃষ্টির আলোক রশ্মিকে আলাদা করার কৌশল। এসব গল্পেরও কিন্তু আলাদা কিতাব আছে। আলাদা মানুষজন আছে। এবং তাও লোকে শোনে হাঁ করে। যেভাবে সম্রাটের গল্প আমরা শুনি। বিশ্বাস করি। আসলে গল্পে চমক থাকতে হয়। গুলিয়ে দিতে হয় বাস্তব অবাস্তবের ফারাকগুলো। না হলে তাতো নিতান্তই ম্যাড়মেড়ে এক ধিনিকেষ্টর গল্প হবে মাত্র। সম্রাট তা কখোনো চান নি। আর কেউতো জানে না এত গল্প তাঁর মাথায় আসে কীভাবে। তবে কি তাঁর পোষা কোনো জিন আছে যে তাঁর কানে এসে ফিসফিস করে বলে দিয়ে যায় নতুন গল্পগুলো। কিন্তু তাও বা কীকরে থাকবে তিনি তো আবার এসব ব্যাপারে খুব গোঁড়া। অবশ্য গল্প পাওয়ার জন্য তিনি কী করেন কেউ সঠিক জানে না।
অজানা দেশের না জানি কী ১১
এখন হয়েছে কী এক রাক্ষুসি এসে গপাগপ খেয়ে ফেলছে লোকজন। সম্রাট এত করে বলছেন লোকজনকে – ঘরে থাকুন, বেঁচে থাকুন। তা লোকজন কান করলে তো। সেই চা খেতে বেরোবেই। ঘরে যেন চা বানানো যায় না আর।
আর রাক্ষুসি পারেও বেছে বেছে পয়সাওয়ালাদেরই খাচ্ছে এখন। ওরকম নধর শরীর কি সে ছাড়তে পারে। কিন্তু ভয় ছড়াচ্ছে চারদিক। রাস্তাঘাট শুনশান রাক্ষুসির ভয়ে। রাক্ষুসি যাকে পারবে তাকেই নাকি খাবে। অথচ মুখে মুখোশ পরে লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে যাতে রাক্ষুসি তাদের চিনতে না পারে। তবে কি রাক্ষুসি বেছে বেছে খাচ্ছে। কেউ জানে না সে কথা। কেউ রাক্ষুসিকে দেখেও নি। শুধু মাঝে মাঝে লোকজন উধাও হয়ে গেলে লোকে টের পাচ্ছে ওই আরেকটাকে টেনে নিয়ে গেল। যেন বাঘ বেরিয়েছে। ভয়ে কল কারখানা দোকান অফিস কাছারি সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সম্রাট দিকে দিকে বার্তা পাঠাচ্ছেন – যে এই রাক্ষুসিকে মারতে পারবে তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টেই টাকা পাঠানো হবে। সে নাকি অনেক টাকা। কেউ জানে না কত।
অজানা দেশের না জানি কী ১২
এত দূর পড়ার পর এক নারী আমাকে চেপে ধরেছে মেয়ে মানেই কি শুধু রাক্ষুসি নাকি? মেয়ে মানে কি শুধু পুতুল যাকে দিয়ে ঘর সাজানো হবে? তাদের মন, হৃদয় থাকতে নেই? আর এই শহর না হলে মেয়েরা কখনো ভাবতে পারত শুধু গোয়ালে বাচ্চা পাড়া নয়, রান্না ঘর শুধু সামলানো নয়, তাদেরও একটা স্বাধীন জীবন হতে পারে? তারাও অফিস কাচারি করতে পারে? খানিকটা ফেমিনিস্ট মার্কা শোনালেও কথাটা তো ভুল নয়।
আচ্ছা অজানা দেশের সম্রাট কী ভাবতেন এ নিয়ে? বা রশীদ? অবশ্য রশীদ আর কী ভাববে। কী আসে যায় সে কী ভাবে তা নিয়ে। সে মিথ্যে গল্প বলে বলে, আর কিছু তেমন পারে না বলে, প্র্যাক্টিকাল নয় বলে তার বৌ তো চলে গেলো কোথায় কে জানে? যার সাথে গেল সে কি পারে রশীদের মতো ভালোবাসতে। কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করলে – তারপর? সে বলে না তার আর পর নেই। শুরু করে আবার গল্প বলতে। সে নারী তাকে কেন ছেড়ে গেল? কেন সাথে করে নিয়ে গেল তার গল্পগুলো? এবার সে গল্প বলতে উঠে যদি গল্প বলতে না পারে আর? ভয় করছে রশীদের। এরপর তো ওরা গল্প না বলতে পারলে তার জিভ টেনে ছিঁড়ে দেবে। পয়সা ফেরত দিয়েও বাঁচা যাবে না হয়ত।
অজানা দেশের না জানি কী ১৩
নানান দেশে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন সম্রাট। আর দেশের লোক হাঁ করে বসে থাকত কখন এসে সম্রাট নতুন গল্প শোনাবেন। সেই শিহরণের অপেক্ষায় দিন গুনত তারা। কিন্তু এই রাক্ষুসির জ্বালায় কী বাইরে বেরোবার জো আছে নাকি। কতদিন যাওয়া হয় না অন্য কোথাও। তাঁর স্মিত হাসি এখন ঢাকা পড়েছে মুখোশের আড়ালে। যদিও তা মাঝে মাঝে নেমে আসছে গলায় মাফলারের মতো। এতদিনের এত প্র্যাক্টিস সব জলে গেল গো। আর কেউ তো এগিয়েও আসছে না রাক্ষুসিকে বধ করতে।
হুহু করে কলকারখানা বন্ধ হওয়ার জন্য শ্রমিকেরা বেরিয়ে পড়েছে বাড়ি যাবে বলে। তাদের আর তর সয় না। আর অজানা দেশের রাস্তাঘাট ক্রমাগত বড় হচ্ছে। আর তাদের বাড়িঘর সমানে দূরে চলে যাচ্ছে। তাদের হাত পা আছে। মুখ আছে। আবার খিদেও নাকি পায়। এই হয়েছে এক জ্বালা। কে বলেছে তোদের বাড়ি যেতে। হাঁটা লাগাতে। আর কেউই তো জানে না এরা মানুষ কিনা। অর্থ মন্ত্রীও তো জানে না। মরুক গে যাক গে।
অজানা দেশের না জানি কী ১৪
বাবার কথা ভাবছিল হারুণ। আমার বাবাটা তো ভালো মানুষ। তাই মনে হয় তার বৌ পালিয়ে গেল। আচ্ছা সব ভালো মানুষেরই কি বৌ পালিয়ে যায়? নাকি আসলে সে অতটাও ভালো নয়? হয়ত বাবা নিজের কাছে ভালো কিন্তু মায়ের কাছে নয়। আচ্ছা সে নিজে, এই হারুণ, যে ভাবে খারাপের বিরোধিতা করাই ভালো হওয়ার লক্ষণ, সেটা তো নাও হতে পারে? তাহলে কী হবে? সব কেমন গুলিয়ে যায় হারুণের। তাহলে কি সে খারাপ হবে?
আসলে হারুণের বয়স কম। অভিজ্ঞতা কম। তাই সে জানে না সে যা চায় তাই হতে পারা সহজ নয় মোটেই। ওই দেওয়াল ঘড়িটার মতো যা আসলে শুধু ঘুরপাক খায়। কোথাও এগোতে পিছোতে পারে না। দেওয়ালে ঝুলে থাকা একটা ঠাট্টা মাত্র।
অজানা দেশের না জানি কী ১৫
গল্প বলার সময় টিপ্পনী সহ্য হয় না সম্রাটের। আরে বাবা গল্পটা বলছি মন দিয়ে শোন। তারপর ভাব মন দিয়ে। তা না খালি বকবক। সম্রাট তাই ঠিক করলেন এই বক্কিলদের ঠোঁট সেলাই করে দেওয়া হবে। সিনেমার সুটিং-এ যেমন সাপের মুখ সেলাই করে দেওয়া হয় যাতে তারা কামড়াতে না পারে। স্রেফ জিভটুকু বের করার ফাঁক রাখা হয় মাত্র। নাহলে তো মনে হবে নকল সাপ। এদেরও তাই করতে হবে। বকবক থামানোর ওষুধ। মাঝে মাঝে খাওয়ার জন্য খুলে দেওয়া হবে কিনা তা তিনি পরে ভেবে ঠিক করবেন। এদের তো আবার সব সময় খাইখাই। আরে বাবা গল্পের থেকে তোদের খাওয়া বড় হলো? রাক্ষুসির জ্বালায় তো জমিয়ে বসে গল্প শোনানোরও জো নেই। কেল্লা থেকে তো বেরনোই যাচ্ছে না। তারপর আছে মন্ত্রীদের গুজগুজ ফুসফুস। না খেতে পেয়ে পেয়ে নাকি এমন হয়েছে রাস্তায় যা পাচ্ছে তাই নাকি খেয়ে ফেলছে এরা। রাস্তার কুকুরও বাদ যাচ্ছে না। আপনি ওদের সামনে যাবেন না সম্রাট বলা তো যায় না কিছু।
সম্রাট এ গল্প শুনে খানিকটা দমে গেলেও বললেন – যাহ্, সে আবার হয় নাকি। আমি ওদের সম্রাট।আমাকে ছাড়া ওদের চলবে নাকি?
কিন্তু মনে মনে ভাবলেন রাক্ষুসিটাই আসলে কাল করেছে।
অজানা দেশের না জানি কী ১৬
রাক্ষুসিটা হয়ত খেয়ে ফেলবে আমাদের সবাইকে। তারপর মাঠে ঘাটে হেগে রাখবে ভড়ভড় করে। আমাদের বাঁচাতে আসবে না কোনো পাঁচ ভাই। কোনো তরবারি খাপ খোলা চমকাবে না আকাশে সূর্যের মতো। সেই পাঁচ ভাই যারা তাড়া করেছিল বরফের ভেতর সেই ষাঁড় যে বরফে ঢাকা একটা গর্তে ঢুকে পড়েছিল। পাঁচ ভাইও গিয়ে ঢোকে সেই গর্তে। কিন্তু গিয়ে দেখে সেই গর্তে পড়ে আছে একটা মরা ষাঁড়ের দেহ। অথচ কিছুক্ষণ আগেও সেটা ছিল জীবন্ত। তারাও ভাবতে থাকে এই ধঁধাঁর উত্তর। যে ভাবনা এখনও শেষ হয়নি তাদের। এইসব সাতপাঁচ ভাবে রশীদ। ওরাতো চিরদিনই ব্যস্ত থেকেছে নিজেদের নিয়ে। ওদের কারো নাক কামড়ে যদি না দেয় রাক্ষুসি ওরা কি আর দৌড়বে তার পিছু পিছু। আচ্ছা ভাবনাও কী মানুষের আয়ুক্ষয় করে যেভাবে দিদিমারা বেশি কথা বলতে বারণ করত সেভাবেই? আর তাছাড়া সম্রাট এখন তো আদেশ জারি করেছেন চুপ থাকতে। নাহলে ঠোঁট সেলাই করে দেবে পাইকেরা। আর এখন তো গল্পও তাকে ত্যাগ করে বোবা বানিয়ে ছেড়েছে। মুখ হাঁ করলে আ, কা ছাড়া কিছুই বেরোয় না আর। আচ্ছা এমনো তো হতে পারে রাক্ষুসির হাগা থেকে আমরা ফের জন্ম নিলাম। এইসব ভেবে একা একা হাসে রশীদ। হারুণ চুপচাপ দেখে বাবার কান্ডকারখানা। মুখে কিছুই বলে না সে। বাবার কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল মায়ের জন্য? ভাবে আর ফুঁসতে থাকে রাগে।
অজানা দেশের না জানি কী ১৭
আজ থেকে ১০ বছর আগে কী ঘটেছিল বা ২০ বছর আগে বা ৫০ বছর আগে তা প্রায় কারোর মনে নেই, মনে থাকারও কথা নয়। তাই সেই একই জিনিস তারা ফের করে চলে। করে যেতে থাকে। কেউ জানে না সম্রাট ৫০ বছর আগে কী করত। সে যা বলবে তাইতো লোকে বিশ্বাস করবে। কারণ অতীত বলে কিছু নেই তাদের। অবশ্য মনে ধরাতে হবে সেই সব আজব কাহিনী। ধরা যাক সম্রাট যদি বলে সে আসলে চায়ের দোকানে কাজ করত। তখন লোকে ভাববে – ভাবো আমাদের সম্রাটও অতি সাধারণ ছিল একদিন আমাদের মতোই। ওতো আমাদেরই লোক। কারণ ও তো সেই একই কষ্ট পেয়েছে যা আমরা পাই রোজ রোজ। আহারে। আবার কেউ কেউ ভাবে – তাহলে আমাদেরও হয়ত একদিন সময় আসবে সম্রাট হওয়ার। আমাদেরও সময় আসবে একদিন ওই কেল্লার নরম পালঙ্কে শুয়ে আরামে রাত কাটানোর। খোলা মাঠে শুয়ে গুনতে হবে না আর তারাদের। স্বপ্নের কারখানার ট্যাবলেট তারাও তো খেয়েছে। স্বপ্নই আসলে বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের। আধপেটা খেয়ে তাই তারা ভালোবাসে এইসব স্বপ্নের গল্পগাছা যা তাদের শোনায় সম্রাট। আরেকটা নতুন স্বপ্নের জন্য উশকে দেয় তাদের।
ওই তারারা হয়ত নেমে আসবে আকাশ থেকে একদিন। নেমে আসতেই পারে কারণ ওরা তো ওদেরই আত্মীয় স্বজন যারা মারা গিয়েও সমানে জ্বলজ্বল করে তাদের দিকে চেয়ে আছে। যে আলোয় মাখা আছে ভালোবাসা শুধু। কোনোরকম চাহিদা নেই সে আলোর। রশীদের বৌয়ের মত বলে না – তুমি কিছুই পারো না। অকর্মার ধাড়ি একটা।
আসলে ভালোবাসা থাকলে হয়ত মানিয়ে নেওয়া যায় সব কিছু। ভাবে রশীদ। আর না থাকলে সরে যেতে হয় দূরে আরো দূরে। সেটাই দস্তুর।
অজানা দেশের না জানি কী ১৮
ভালোবাসা ভালোবাসা করে তোমাদের এই হেঁদিয়ে মরার কী যে মানে কে জানে? ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সেই ফেমিনিস্ট। কখন যেন চলে এসেছে আবার। মানে? আমি বলি। ভালোবাসা বলে কিছু নেই নাকি?
সে উত্তর দেয় – আছে। কিন্তু সবটাই দেনা পাওনার ব্যাপার। আরে বাবা রশীদ গল্প শোনায় সে না হয় বুঝলাম কিন্তু বৌকে কতটা সময় দেয়? বিছানায় কতটা পারদর্শী সে? যৌনতা ভগবানের মতো। তার জন্য আরাধনার প্রয়োজন। সময় দিতে হয়। শুধু গল্প বললে হবে। অকর্মা আসলে ঠিক কিসে সেটা বোঝা প্রয়োজন। শুধু মেয়েটা খারাপ বলতে পারলে তোমরা পুরুষেরা বর্তে যাও। তলিয়ে দেখ না আসলে ঘটনাটা ঠিক কী?
কিন্তু রশীদকে এখন এসব জিজ্ঞাসা করা সঠিক হবে কী? ভাবি আমি। বেচারা গল্প হারিয়ে ভেঙ্গে পড়েছে একেবারে। গল্প ফিরে এলে পর তখন না হয় একদিন সুযোগ বুঝে ঠাট্টার ছলে প্রশ্ন করা যেতে পারে। এখন সে সময় নয়।
মুখে হুঁ বলি। জবাবে সেই ফেমিনিস্ট বলে – তোমারও দেখি রশীদের অবস্থা। আ-কা-হুঁ এসব বেরোচ্ছে কেবল। বলে গটমট করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। তার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে ভাবি – তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু এ মেয়ে কি আরো কিছু চায় আমার কাছে? নাকি এ ভাবনাটাও বড্ড পুরুষ মার্কা হয়ে যাচ্ছে?
অজানা দেশের না জানি কী ১৯
সম্রাটের প্রধানমন্ত্রী ভাটিং শাহ্-র কথাবার্তায় বড় পারুষ্য কারণ তিনি এসেছিলেন পারস্যদেশ থেকে। এরকম কথা লোকে বলে। কারণ হয়ত তা নয়। শোনা যায় নিজের দেশে বেশ কিছু খুনজখম করে পালিয়ে আসেন এই অজানা দেশে। সম্রাটও চাইছিলেন একজন শক্তপোক্ত লোক যে শক্ত হাতে সামলাতে পারবে সব কিছু। আর তাছাড়া গল্প তো আছেই।
রাক্ষুসির তাণ্ডবে সম্রাটের গল্প বলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর চারদিকে নানান গোলমাল ভাটিং শাহ্-এর কানেও আসছে রোজ রোজ। তাই সেদিন তার মন্ত্রণাকক্ষে একটি গোপন সভা বসেছে। কী করা হবে আর কী করা হবে না তাই নিয়ে। সম্রাটের ছেলেপিলেও নেই। তাই সম্রাটের পর তাঁর চেয়ারে বাধ্য হয়ে বসতে হবে ভাটিং শাহ্কে। সবাই সেই কথা বলছে এখন। সে নিয়েও তাঁর চিন্তা তো কম নয়।
-আপনি সম্রাটকে অনুরোধ করুন তাঁর গল্পের ঝাঁপি ফের খুলে বসতে। রাক্ষুসিকে ভয় পেয়ে কেল্লায় লুকিয়ে থাকলে আর চলবে না।
কিছু উত্তর না দিলেও ভাটিং শাহ্ মনে মনে খুশিই হন। সম্রাট হওয়ার সাধ তো তাঁর বহুদিনের। তাছাড়া তাঁর ছেলেপুলের মুখ চেয়ে কিছু একটা করতে তো হবে। সেদিনের মতো সভা ভঙ্গ হয়। তিনি তাঁর তরবারিতে ধার দিতে থাকেন একা একা।
অজানা দেশের না জানি কী ২০
সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল আকুল। সদর দরজার সামনের সিঁড়ির ধাপে বসেছিল রশীদ। জুতো খুলে পায়ের পাতাটা সে মেলে দিলো বৃষ্টিতে। বৃষ্টি এসে চুমু খেতে লাগল তার পায়ের পাতায়। সারা শরীর জুড়ে একটা শিহরণ টের পাচ্ছিল রশীদ। আস্তে আস্তে সে আরো খানিকটা পা বাড়িয়ে দিলো। যাতে বৃষ্টির আদর আরো খানিক টের পেতে পারে। তারপর কখন জানি সে নেমে গেছে বৃষ্টির ভেতর। সারাটা শরীর যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে এক অদ্ভুত আনন্দে। মনে হচ্ছে গল্পরা আবার ফিরে আসছে তার কাছে। ধরা দিচ্ছে ফের। হারুণ উঁকি মেরে দেখছিল বাবার কান্ড। রশীদ তাকে দেখতে পেয়ে চোখ ইশারা করলো যেন সে বলছে – আয় ভিজতে আয়।
হারুণ কিছুটা কিন্তু কিন্তু করে নেমে পড়ল বৃষ্টিতে। তারপর বাপ বেটায় সেকি ছপ ছপ আর আনন্দ। জামা কাপড় থেকে জল গড়ানোর কথা তাদের মনেই রইল না। ঠিক এইসময় জলের মধ্যে ছপ ছপ করতে করতে ভিজতে ভিজতে এসে দাঁড়াল রশীদের বৌ। বাপ বেটার নাচ থেমে গেল, অবাক বিষ্ময়ে তারা তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ তারপর হারুণ ডেকে উঠলো – মা।
মা এসে জড়িয়ে ধরল হারুণকে।
ওই লোকটাকে রাক্ষুসি টেনে নিয়ে গেছে। আমাকে কি তুমি ঘরে নেবে?
রশীদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল – যাও ঘরে যাও। হারুণের ঘরে যাও।
অজানা দেশের না জানি কী ২১
সকাল থেকে উঠে কোমরে কাপড় টাইট করে জড়িয়ে মা রান্নাঘর পরিষ্কার করতে বসেছে। এখন রান্নাঘরের ধারে কাছে যাওয়া মানেই বকা খাওয়া। হারুণ তাই গিয়ে বসে বাবার পাশে। রান্নাঘর থেকে মার স্বগতোক্তি শোনা যায়- বাপ ব্যাটা দুটোই অকর্মার ধাড়ি…… রান্নাঘরটাতে এমন নোংরা করে রেখেছে…যেখানে খায় সেখানেই হাগে…
কথাগুলো যেন শুনিয়ে শুনিয়ে বলা। না হলে এত জোরে লোকে নিজের সাথে কেন কথা বলবে? ভাবে হারুণ। কিন্তু দেখ বাবা কেমন মিচকি মিচকি হাসছে। রাগ ওঠে না?
বাবা ওকে কাছে ডেকে পিঠে হাত বোলায়, বলে – জানিস কাল রাতে কী হয়েছে?
কী? জিজ্ঞাসা করে হারুণ?
-সে অনেক রাত। ঘুমটা হঠাৎ ভেঙ্গে গেল আমার। ঘরের খোলা জানালা দিয়ে দেখি একটা ঝলমলে আলো ঘরের ভেতর এসে ঢুকছে। ব্যাপার কী দেখার জন্য বিছানা থেকে উঠে পড়ে জানালার কাছে যাই আমি। দেখি কেল্লার উপরের আকাশটা আলোয় আলো হয়ে আছে। সে আলো পাক খাচ্ছে মাঝে মাঝে। কত রকমের রঙ সে আলোর।
আবার বাজে গল্প শুরু হলো ভাবে হারুণ। কিন্তু সে বিরক্ত হওয়ার বদলে খুশিই হয়। যাক বাবা, আবার গল্প ফিরে এসেছে বাবার কাছে। নাহলে লোকটা থাকত কী নিয়ে!
অজানা দেশের না জানি কী ২২
অজানা দেশটা আসলে তো গ্রাম। অনেক পয়সাওয়ালা অবশ্য কিছু শহর গড়েছে মূলত ফুর্তিফার্তার জন্য। আর সেই ফুর্তির জন্য টাকা পয়সা আসে নানান ব্যবসা আর ধান্দাবাজি আর ফন্দিফিকির থেকে। গ্রামে যেমন মোড়ল থাকে এখানেও আছে পাড়ায় পাড়ায় সব মোড়ল। আর তারা কেউ বুড়ো-হাবড়া নয়। রীতিমত ব্যায়াম করা সুগঠিত শরীর। বিচার করে তৎক্ষণাৎ চড় থাবড়া দিয়ে দেয় তারা। দরকারে অণ্ডকোষ গুণ ছুঁচ দিয়ে ফুটো করে ডিম দুটো বার করে দিতেও তারা পিছপা হয় না। তাই তাদের সমিহ করে লোকজন। লোকে বলে এরা আসলে ভাটিং শাহ্-এর নিজস্ব লোক। এদের না ঘাঁটানোই ভালো।
তো সেদিন বেশ রাতে মোড়ল রশীদের ঘরের দরজায় এসে উপস্থিত। দামী মদের একটা হাল্কা গন্ধ পায় রশীদ।
-কী রশীদের পো শুনেছ তো ঘটনা?
-কী ব্যাপার?
-তেমন কিছু না, সম্রাটকে কাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
-সে কী!
-তোমার কী মনে হয় বলতো রশীদ? তুমিও তো গল্পটল্প শোনাও শুনেছি। এই গল্পটা ঠিক কী বলে তোমার মনে হয়?
-আমি তো সামান্য মানুষ কত্তা। হয়ত সম্রাট কোথাও বেড়াতে গেছেন। যেমন উনি যান মাঝে মাঝে। তাছাড়া সম্রাটের খেয়াল কি সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে, আপনিই বলুন?
মোড়ল মুচকি হাসে। তার চকচকে চোখ দুটো আরো তীক্ষ্ণ হয়ে রশীদকে মাপে। রশীদের বুকটা ভয়ে ছ্যাঁত করে ওঠে। কিন্তু সে বোকা বোকা মুখ করে মোড়লের মুখের দিকে তাকায়। যেন মোড়লই জানে সব প্রশ্নের উত্তর।
-হ্যাঁ আমরা এখন দিকে দিকে লোক পাঠিয়েছি। দেখা যাক। তুমিও কিছু যদি জানতে পারো আমাকে খবর দিও। বলে মোড়ল। তারপর রশীদকে আরেকবার মেপে হাঁটা দেয় বীরের মতো বুক ফুলিয়ে।
অজানা দেশের না জানি কী ২৩
রাতে ভালো করে ঘুম হয়নি রশীদের। এরকম তো তার হয় না। বিছানায় পড়লেই হলো একবার। শুরু হয়ে যায় তার বিখ্যাত নাক ডাকা। যার জন্য কতদিন তার বৌ মাথার বালিশ নিয়ে উঠে গেছে অন্য ঘরে। যেখানে হারুণ শুয়ে আছে দ হয়ে। এবার কী গল্প শোনাবে সে লোকজনকে। এই একটা চাপা ভয় থেকে কোন গল্প মুক্তি দিতে পারবে অন্তত কিছুক্ষণ, ভাবে রশীদ।
এদিকে দিন গড়িয়ে সপ্তাহ। সপ্তাহ গড়িয়ে মাস। সম্রাটের খবর আর পাওয়া যায় না। তিনি তো আর সাধারন মানুষ নন, তিনি সম্রাট। তাই অনেক গল্প বাতাসে ভাসতে লাগল। ভাসতে ভাসতে তার কিছু রশীদের কানেও এসে পৌঁছল।
প্রথম গল্প হলো এরকম যে সে রাতে আকাশ আলো করে এক ভিন গ্রহের উড়ন্ত চাকি নেমে এসেছিল কেল্লার ছাতে। তাদের গ্রহেও নাকি মানুষজন সম্রাটের গল্প শুনতে অধির। তাই তারা সম্রাটকে বহু আলোকবর্ষ দূরে তাদের গ্রহে নিয়ে গেছে। আর ওদের সময়ের সাথে অজানা দেশের সময়ের তো কোনো মিল নেই। ওদের একদিন হয়ত এখানের এক বছর বা আরো বেশি হতে পারে। আর কেউ কেউ নাকি দেখেছেও আলোর সিড়ি বেয়ে সম্রাট উঠে যাচ্ছেন একটা অদ্ভুত আলোর ভেতর। অতয়েব ভয়ের কোনো কারণ নেই। সম্রাট ঠিকই ফিরে আসবেন গল্প শুনিয়ে। আরো নানান নতুন গল্প নিয়ে।
দ্বিতীয় গল্প হলো সে রাতে ভাটিং শাহ্ নাকি সম্রাটের মুণ্ডু ধড় থেকে আলাগ করেছে। কেউ কেউ নাকি শুনেছেও সম্রাটের আর্ত চিৎকার। তারপর কেল্লার কোনো এক অন্ধকূপে ফেলে দিয়েছে সম্রাটের মৃতদেহ। এ গল্পটা অবশ্য খুবই চাপা শ্বরে বলছে লোকজন।
তৃতীয় গল্প হলো, না না এসব কিছু না রাক্ষুসিটাই কেল্লার ছাতে উড়ে এসে মুখে করে নিয়ে গেছে সম্রাটকে। কেউ কেউ নাকি দেখেছে সম্রাটের পা থেকে রত্ন খচিত নাগরা ঠাশ পড়ে যাচ্ছে কেল্লার ছাতে।
রশীদ বুঝতে পারে না কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক গল্প। যেটা শুনতে সব থেকে ভালো লাগছে সেটাই কি সঠিক তাহলে?
অজানা দেশের না জানি কী ২৪
এটা ঠিক যে কেল্লার ছাতে পড়েছিল সম্রাটের রত্ন খচিত নাগরার জোড়া। আর কিছু নয়। তাই লোকে ভাবছিল সম্রাট যদি বেড়াতেই যাবেন তাহলে জুতো খুলে কেন গেলেন? তবে কী কোনো গুহায় চলে গেলেন তপস্যা করতে ফের। কিন্তু ক্যামেরা ম্যান, মেকআপ ম্যান, ড্রেসার ছাড়া তিনি তো কোথাও যান না। তবে?
তেজ হাওয়া ভাটিং শাহ্-এর কানেও ফিশফিশিয়ে বলল- হাওয়ার বেগ খুব বেশি। পাগড়ি সামালো। তা ভাটিং শাহ্ খানিক মাথা চুলকে একটা সোনার থালায় নাগরা জোড়া নিয়ে রাখলেন সম্রাটের সিংহাসনে। আর তার পাশে পিড়ি পেতে বসলেন। অমায়িক ভাটিং শাহ্কে এ অবস্থায় দেখে সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল। ভাবা যায়, কী অসাধারন মানুষ। নির্লোভ এমন মানুষ আজকাল দেখা যায় না।
সভায় জড়ো হওয়া সবাইকে ভাটিং শাহ্ বললেন – আমরা এভাবেই সম্রাটের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাব। তার জুতো জোড়া থাকবে আমাদের পথ দেখানোর জন্য। আপনারা সবাই থাকুন আমার সাথে এই সংকটের মুহূর্তে। আমরা এক হয়ে এই দেশকে আরো উন্নতির পথে নিয়ে যেতে পারব। সম্রাটের নাগরা আমাদের আশীর্বাদ করবে এই কাজে। তাই না?
সে তো একদম ঠিক কথা। চারদিকে জয় জয়কারে ভরে গেল।
এই আইডিয়াটা কোন গল্প থেকে ভাটিং শাহ্-এর মাথায় এসেছিল তা আমরা জানি, কিন্তু বলব না। বলা বারণ।
তারপর ভাটিং শাহ্ বললেন এই শুভ্ সময়ে আপনারা সবাই যার যা আছে তাই বাজিয়ে উৎসব করুন। আর – ও সভা গায়ক সারাদিন তো হয় তানপুরা পিড়িং পিড়িং করছ না হয় তো সা-পা টিপে বসে আছ। ওই সকাল সন্ধ্যের রাগ বাদ দিয়ে একটা নতুন রাগ বাঁধো যার নাম হবে আম-রস রাগ। যা হবে আমের রসের মতই গলানো সোনা যেন আর সেই তার মধুর মিষ্টি স্বাদ যা মুখ থেকে পেট অবধি অবশ করে রাখবে মানুষকে। আর জানো তো সম্রাট আম ভালোবাসতেন খুব।
অজানা দেশের না জানি কী ২৫
এই যখন অবস্থা তখন হঠাৎ এক দিন রাক্ষুসি প্রেমে পড়ল ভাটিং শাহ্-এর। কোনো মানে হয়। এই অবস্থায় পরকিয়া। আসলে হয়েছে কী রাক্ষুসি ঠিক টের পেয়েছে ভাটিং শাহ্ আসলে মানুষের খোলে একটা ছুপা রাক্ষস। কেউ বুঝতে না পারলেও রাক্ষুসিরা ঠিক টের পায় রাক্ষসের গন্ধ। তা সে যতই ডিয়ো, আতরে শরীর মোড় না কেন বাবা। গন্ধ যাবে কোথায়। সেই মন কাড়া গন্ধে রাক্ষুসি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। প্রেমের টানে সোজা এক রাত্তিরে ভাটিং শাহ্-এর বিছানায়। তারপর আদর করে ভাটিং শাহ্-এর পাছায় দিলো এক কামড়। নিশ্চয়ই দাঁত মাজেনি নাহলে ভাটিং শাহ্ পরদিনই পাছু দেখাতে বদ্দিখানায় দৌড়োয়!
Posted in: PROSE, September 2020 - Cover Story