মেরিলিন ও মনস্টার : শুভ আঢ্য

ফর্ম্যাল পড়াশুনো করা গেছে সেই ২০১১ সালে। মানে বই নিয়ে, খাতা নিয়ে, নোট টুকতে টুকতে পড়া মুখস্থ করে পরীক্ষা থেকে পরিত্রাণ না পেয়ে দায়ে পড়ে পড়া বলতে যা বোঝায়। তার পর থেকে পড়া – খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, টিভি নিউজের স্ক্রল, ফেসবুকের টাইমলাইন আর সামান্য কিছু বই’য়ে আটকে গেছে, যেভাবে অনেকখানি চিনি খাবার পর একটা ডেও পিঁপড়ে চিনির বয়ামে আটকে পড়ে, আর সেখান থেকে বেরোনো হয়ে ওঠে না তার, সেরকম। মধ্যে আসে বিজন, বিজনের রক্তমাংস, মজ্জা, হাড়, তার ওপর লাগানো সামান্য চর্বি, তরুণাস্থি – এইসব। চিবানোর কথা বললে মোগলাই বা কলকাত্তাইয়া হলুদ চাউমিনের পাশাপাশি এসবের কথাও মনে আসে। আয়না টায়না আর ফেমাস উপন্যাসের কথা যতটুকু মনে পড়ার দরকার, ততটুকু মনেও যে পড়ে না, এমন নয়। তবে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার মতো পরপর ক্রোনোলজিক্যালি সাজানো দাঁতের কথা মনে পড়ে না। এবড়োখেবড়ো দাঁতের ওপর লাগানো সেট করা স্টিলের তারের ভেতর দিয়ে তার ঠেলে বেরিয়ে আসা ক্যালসিয়ামের আধিক্যের ব্যাপারেই চোখ যায় বেশী। আর মেয়ে হলে গজ দাঁতের কথা আসে। গজদাঁত এমনই একটা ব্যাপার যা সাজানো ক্রোনোলজির বাইরে একটা চিহ্ন। খেয়াল করলে তা চোখে গেঁথে যায়। এমনও ধরা যেতে পারে একটা টমেটোর ওপরে পরপর দাঁতগুলো সাজানো হয়েছে, আর গজ দাঁতটি সেখানে সামান্য এগিয়ে বসেছে একাসন। এখানে বিজনের শারীরিক কম্পোনেন্টগুলোর ওপরেও প্রেম, যৌনতা চাগিয়ে বসেছে ভেবে নেওয়া যেতে পারে, যদিও কোনো কিছু ভেবে নেওয়ার ভেতরেই কোনো কারণ নেই। চিন্তক শুধু চেতনার ভেতরেই বেড়ে উঠবে, এমন চেতাবনি অর্থহীন। তা অবচেতনের ভেতরেও ডাল ও পালা বিস্তারে অপারগ এমন ভাবনা, মানসিক অন্তরায় ছাড়া আর কিছু না।

এখন, একটি বাচ্চার কাছে দাঁতের খাবার বলতে যা বোঝায় তা মূলত চকোলেট। এটা খানিকটা হেজিমনি তো বটেই। কুকুরদের চকোলেট খেতে খুব বড় একটা কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না। তেমন, মেরিলিন মনরোকে খেয়ে দাঁত মাজছেন, আর মুখ থেকে ফেনা উথলে আসছে এমন দৃশ্যও কল্পনা করা কঠিন। তবে করা যেতে পারে। ধরা যাক, একটি পিকনিকের দৃশ্যে মেরিলিন বেতের ঝুড়িটি পাশে রেখে ঘাসে পেতে রাখা চাদরের ওপর আধশোয়া হয়ে আছেন। বেতের ঝুড়ি থেকে পৃথিবী আকারের কমলালেবু গড়িয়ে চলেছে ব্ল্যাকহোলের দিকে। স্বদেশ সেন তার বেশ কিছুদিন পরে লিখে উঠবেন সেই লাইন, “আপেল ঘুমিয়ে আছে, তুমি ওকে দাঁত দিয়ে জাগাও”, যদিও কমলালেবুটি রাখা হয়েছে যথাস্থানে। এমনও ভাবা যেতে পারে পরাবাস্তব দালি তাঁর ছবির বাঘটিকে লাফাতে দেবার জন্য পেনসিলে শান দিচ্ছেন। বাঘটিও তার দাঁত যথাসম্ভব ক্রুঢ় করে তুলছে। স্থান-কাল-পাত্র সবসময়একই ডায়ামেনশানে থাকতে হবে, এটা গণিত। শিল্প গণিতের ভেতরে থেকে সে গতিবিধিকেই চ্যালেঞ্জ করে, বা তার করা প্রয়োজন।

ব্রাশ একটি বাহ্যিক উদ্দীপক। দাঁত আদতে অচেতন, কারণ সেখানে শিরা, ধমনী নেই। মাড়ির সাথে তার সংযোগস্থলে সেটুকু শিরা প্রোথিত হয়ে আছে, সেটুকুই। ততটুকুই আমরা সে ব্যথার মালিক। আসলে সেভাবে দেখলে সে পরম ব্যথাটুকুও আমাদের আপনার নয়। ব্রাশ সেই চেতনার গোড়ায় আমাদের ডলে দেয়। জানিয়ে দেয়, দালির বাঘটি আকাশের কোবাল্ট ব্লু ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে, সামনে হোয়াইট – অ্যাণ্ড – ব্ল্যাক আপট্রন টিভির প্লাইউড শাটার। শাটারের ভেতর এখনও শেষ না হওয়া পিকনিকের কমলালেবু গড়িয়ে টিভির পিকচারটিউবের দিকে চলে গেছে, এখানে সেটিই সূচীছিদ্র ক্যামেরা বা ব্ল্যাকহোল। আমাদের জানা প্রয়োজন যে কোনো মুহুর্তে দালির সেই জানোয়ারটি একটি চকোলেট খণ্ডের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে… এখানে তরমুজ আর ছুরির প্রসঙ্গ নিয়ে আসলে খাবার কথাও এসে পড়ে। এসে পড়ে সেই ড্রেস বাঁচানোর অমোঘ ছবির কথা। এসে পড়ে মাথায় থাকা সোনালি চাউমিনের কথা, যা গোটা টেরিটি বাজারে ব্রেকফাস্টে কেউ খায়নি আজ অব্দি। আর দাঁত মাজা তো দূর অস্ত!

অথচ ব্রাশের প্রতিটি থ্রেড এক একটি উদ্দিপনা বহনকারী অপেক্ষক। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্যালেট থেকে রঙ গোটা ক্যানভাস, ক্যানভাস হয়ে চেতনা… তাদের সম্মেলনেই কিছুটা বিপ্লব, গণসঙ্গীতের আদলে তারা জড়িয়ে রয়েছে একটি কাঠের ডগায়, একটি স্টিল বা কোনো না কোনো মেটালের আধারে। শিল্পী তাকে সংখ্যা দিয়ে চেনেন। তার নং ৪ বা ৬ বা ১২। এখানেই শিল্পের সাথে গণিতের আপাত কোনো শত্রুতা চোখে পড়ে না, যেভাবে বিজ্ঞান্সম্মতভাবে গড়া বিশ্বের তাবড় ভাস্কর্য। মনে পড়ে শেষ দশ ক্লাসে খাদ্যের উপকরণ, তার প্রয়োজনীয়তা, ভিটামিন, মিনারেল, যৌগিক, শৃঙ্খল এতকিছু। তারও বহু আগে, ঠাকুমার ঝুলি… বাড়িতে থাকা আধবুড়ি পিসির কাছে খোক্কসের গল্প। দাঁত মাজার পর আবার শুয়ে পড়া সেসব অনন্তদিন।

রাক্ষস দাঁত মাজেনি। তারা দাঁত মাজেনা। বেসিক্যালি বিজন একটি আবহাওয়া যা’কে আমরা খেতে পারি না, তার রক্তমাংসের সামনে বসে থাকলেও সেখানে ঠোঁট ছোঁয়ানো প্রায় অসম্ভব। আমরা জানি রাক্ষস চকরাবরকরা আলখাল্লা পরা এক প্রাণি যা কেবল শুভর বিপরীতেই থেকে গেছে, আয়নার পিছনের পারাটুকু হিসেবে। তাকে রাখার কারণেই ডিসকোর্স দেখানো সম্ভব। তাকে রাখার প্রয়োজনেই জানা যায় হয়তো বা কখনও কোনো চকোলেট বা মার্জারিন কোম্পানি কোনো সুবেশী মহিলাকে পণ্যের অ্যাম্বাসাডার হিসেবে দেখিয়ে উঠতে পারবে। আর টুথপেস্ট কোম্পানি বলে উঠতে পারবে সারা রাতের শেষে আপনার মাড়ির ব্যাকটেরিয়াগুলিকে ধ্বংস করার জন্য তাদের পণ্যটিই একমাত্র উপযুক্ত। আসলে তাকে বধ হতে হবে, সেই প্রাগৈতিহাসিক নিয়তি। এখানে স্ক্রিপ্টের চেঞ্জ এখনও দাঁত মাজা সোপ-অপেরা খেকো মানুষ হজম করে না।

পড়াশুনো ছাড়া গেছে ২০১১ সালে। তখনও রাক্ষস দাঁত না মেজেই আমাদের কেরিয়ার চিবিয়েছে। তখনও কিছু কিছু জিনিস চিবিয়েছে আমাদের মাথা, বলে আমাদের ধারণা এখন শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছে এই সময়ে। তবে ভাবা যেতে পারে, একটি আয়নার সামনে কোনো বাচ্চা সাধের রাক্ষসটিকে এঁকেছে। তার গায়ের রঙ সবুজ, দাঁতের রঙ হলুদাভ সাদা, সামনের দুটি দাঁত ড্রাকুলার মতো, বাম স্ট্রোকারের বইয়ের প্রচ্ছদে যেমন দেখা যায়। পুরু ঠোঁট। অসমান রাস্তার মতো গাল। গোলাপি মাড়ির ভেতর থেকে ইইইইইইইইইইইইইই করে দাঁত বের করে হাসছে। বাচ্চাটি এখনও শেখেনি, কিছুদিন পর থেকে রাক্ষসকে দেখে তাকে ভয় পেতে হবে; সে জানেনি, ধারণা তার ভেতর যেভাবে সেঁধিয়ে দেওয়া হবে, সেভাবেই অন্তত প্রথম কিছুদিন সে ভেবে ও দেখে উঠবে। বাচ্চাটির ছবিতে ডিটেলড টয়েলেটারিস। একটি পাত্রে রাখা হয়েছে খানকতক ব্রাশ। একটি ফেনাওলা টুথপেস্ট, টাং-ক্লিনার। আর একটি টুথব্রাশে ভর দিয়ে সাদা ফেনার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে রাক্ষসের মুখ। তার মুখের ভেতর অন্ধকার কমে আসছে। পিপারমেন্টরঙা সাদা আলোয় ভরে উঠছে তার মুখ, সেখানে অনেক অনেক কোকো গাছ। তার নিচে তারই মতো বাচ্চারা খেলছে। সুতরাং দাঁত মাজা একটি ঘটনা ও ভ্রম, উভয়তই। তবে বস্তুত পিপারমেন্ট সত্য। তার ফ্রেশনেস সত্য, ক্ষণিকের। আর এত কিছুর আধার রাক্ষস? সে’ও খানিক সত্য।

Facebook Comments

Leave a Reply