দেখুন, আপনি আবার ‘রাক্ষস’ নয় তো ? – সৌম্যদীপ চ্যাটার্জী
“সোনা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো,
বর্গি এলো দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে,
খাজনা দেব কিসে?”
ছোটবেলায় আমাদের মায়েরা মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে এই গানটি করতে করতেই ঘুম পাড়িয়ে দিত। ১৯৭৫ সালে যখন ‘সোলে’ সিনেমাটি রিলিজ করলো, তখন মা তার শিশুকে “না ঘুমালে গব্বর এসে নিয়ে যাবে” বলে ভয় দেখাতো, যাতে সে চট করে ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়। এছাড়াও তো হাজারও ডাকাত-রানির গল্প, ভূতের গল্প কিংবা রাক্ষসের গল্প, সেগুলো তো আছেই। মায়েদের কাছে সবসময়ই তার শিশুর দেখভাল সবার আগে-এটাই তো জেনে এসেছি আমরা চিরকাল। মা-ই তো পারেন একমাত্র তার শিশুকে আগলে রাখতে। সোজাসাপটা ভাষায় বলতে গেলে, একজন শিশু তো মায়ের কাছেই সব থেকে নিরাপদ তাই তো? কি ঠিক বলছি?
এই বছরের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা হবে। মেয়েটির মা তার নিজের বোনের বাড়িতে মেয়েকে রেখে দিয়ে এসেছিল লকডাউন পর্ব শুরুর পর্যায়ে, যাতে সে বাড়িতে একা-একা ‘বোরিং ফিল’ না করে। নিজের বোনের বাড়িতে তার মেয়ে যে নিরাপদ নয়, ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি তার মা বা পরিবারের অন্য কেউ। আনলক পর্বের শুরুর সময় যখন মেয়েটি ঘরে ফিরেছিল, বড্ড যেন চুপচাপ হয়ে পড়েছিল বেশকিছু দিন যাবত। পরিবারের সকলে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিল, তার কারণ জানতে। অবশেষে মেয়েটির মা, তাকে চেপে ধরাতে বাধ্য হয়েছিল সমস্ত কথা খুলে বলতে। “আমাকে তোমার বোন আর তার বয়ফ্রেন্ড, দুজনে মিলে প্রায়ই যৌন নিপীড়ন করত। জোর করে প্রতিদিন বন্ধ ঘরে পর্ণগ্রাফি দেখাতো। মা, আমার খুব কষ্ট হতো। কিন্তু লোকের কাছে অপমানের ভয়ে আমি তোমাদের কিছু বলতে পারিনি।” কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি তার উপর অত্যাচারের সমস্ত কথা উগরে দিয়েছিল তার মায়ের কাছে। পুনেতে নিজের বোনের মেয়েকে যৌন নিপীড়ন করার জন্য গ্রেপ্তার হয়েছিল, ২৮ বছরের যুবতী আর তার ৩০ বছরের বয়ফ্রেন্ড।
একজন শিশুর কাছে, তার সবথেকে নিরাপদ স্থান হচ্ছে তার মা, তার পরিবার। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে অন্য আর এক কথা। ২০২০ সালের NCRB-এর খোলা পাতা থেকে তথ্য ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৯৫ শতাংশের বেশী ক্ষেত্রে নিজের পরিবারের লোকেরা বা পরিচিত কোনো মানুষই শিশুটির উপর যৌন নির্যাতনের জন্য জড়িত। তাহলে আপনিই বলুন, আপনার আদরের শিশুটি যে ঘুমের ঘোরে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখলেই যে সে, মা বা বাবা বলে জোরে চেঁচিয়ে ওঠে, কারণ আপনি তার সব থেকে নিরাপদ স্থান। তা আপনি নিজের শিশুটির সুরক্ষা দিতে পারছেন তো ঠিকমত ?
“সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর, রাতে যে এক বোতল বাংলা মদ না খেলে, শরীরটা কেমন যেন আনচান করে জানলেন ! কয়েক মাস যাবত বুঝতে পারিনি। তাই…কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল…।” কথা হচ্ছিল উত্তর চব্বিশ পরগণার বসিরহাটের ধলতিথা গ্রামের আব্দুল চাচার (নাম পরিবর্তিত) সাথে। নিজের ১২ বছরের মেয়েকে পাশে নিয়ে রাত ১০ টা বাজলেই ঘুমিয়ে পড়ত তার মা। রাত ১১ টা নাগাদ মাতাল হয়ে ঘরে ফিরত তার রিকশাওয়ালা স্বামী। কিন্তু গত পাঁচ-ছয়মাস যাবত, শোয়ার জায়গাটা অদল-বদল করেছিল মা। নেশার ঘোরে লোকটি বুঝতে পারতনা যে, তার পাশে নিজের স্ত্রী শুয়ে আছে নাকি নিজের মেয়ে । প্রতিদিন যৌন নিপীড়ন মেয়েটি মুখ বুজে সহ্য করেছিল মাসের পড় মাস। ঋতুচক্র হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়াতে নিজেই গোপনে ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করে জানতে পেরেছিল, যে সে প্রেগন্যান্ট! মুখ ফুটে সে কথা বলতে পারিনি কারুর কাছে। এমনকি নিজের মায়ের কাছেও না। লোকের বাড়ি থেকে কাজ করে ফিরে এসে ঘরের দরজা খুলতেই মেয়ের ঝুলন্ত লাশ দেখতে পেয়েছিল মা । কিন্তু ঘুণাক্ষরেও নিজের বাবার কীর্তি সম্পর্কে একটা ‘নালিশ’ও করে যায়নি অষ্টম ক্লাসে পড়া মেধাবী ছাত্রীটি।
ঘটনাটি খবরের কাগজে প্রকাশ পায়নি চারিপাশে ঘটে যাওয়া আর পাঁচটা ঘটনার মতই। এমন অনেক ঘটনাই আমরা নিউজ চ্যানেল বা খবরের কাগজে দেখিনা বা বলতে পারেন দেখতে চাইনা। কারণ আমরা সব কিছু চেপে রাখতে ভালোবাসি। বা বলতে পারেন লুকিয়ে রাখতে চাই। নিজের পাশের পাড়ার মেয়েটি ঠিক মত স্কুলের পড়াশুনো করতে পারছে কিনা কিংবা পাড়ার বদ-ছেলেদের মাঝে মেয়েটি সুরক্ষিত কিনা, সেই চিন্তা না করে, আমরা ভাবতে ভালোবাসি কোন বড় নেতা কি বললেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে কি পোষ্ট করলে খুব সহজেই অনেকগুলো ‘লাইক’ পাওয়া যায়, সেই খুঁজতেই ব্যস্ত থাকি আমরা সারাদিন। কি ঠিক বলছি?
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এখন মন চাইলেই সব কিছু পাওয়া যায় বা দেখা যায়। আমরা অজান্তেই এমন অনেক ভিডিও বা ছবি দেখি, যেগুলি হয়েতো কোনো শিশুর। নিজের শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য, আমাদের কাছে সেই সমস্ত ভিডিও বা ছবি অত্যন্ত ‘গুরুত্বপূর্ণ’। ভুল বললাম কিছু? একটি অবাক করা পরিসংখ্যান দিই তাহলে। NCRB-এর তথ্য ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র ২০১৮ সালে ৭৮১ টি কেস দাখিল হয়েছে, একজন বা একাধিক শিশুকে দিয়ে পর্ণগ্রাফি করানোর কারণে, যা প্রায় দুইগুণের বেশী ২০১৭ সালের পরিসংখ্যানের থেকে। ২০১৭ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ৩৩১ টি। তাহলে, পরিসংখ্যানগুলি দেখে গা শিউরে উঠছে তো? আচ্ছা যদি ধরুন, আপনার মোবাইলে হঠাৎ করে এরম কিছু ভিডিও দেখলেন যেখানে আপনার ছেলে বা মেয়ের বা আপনার পরিবারের কোনো শিশুকে ‘অপ্রস্তুত’ অবস্থায় দেখা যাচ্ছে এবং যেটি আপনার মোবাইলে স্টোর করা কিছু ‘গোপন’ ভিডিওর মতন। তাহলে? মেনে নিতে পারবেন তো? মনের ভিতর খুব রাগ হচ্ছে তাই না? ভাবছেন যে এইসব পরিসংখ্যান সব ‘জল-মেশানো’? বিশ্বাস না হলে নিজেই দেখে নিন না একবার ! Online Sexual Exploitation of Children বা সংক্ষেপে OSEC নিয়ে সারা বিশ্বব্যাপী তোলপাড় যেখানে, সেখানে আমার আপনার মত মানুষজন নিজের পরিধির বাইরে কিছুতেই বেরোতে পারিনা বা বলতে পারেন চাইনা। আর একটা তো কথাতেই আছে, আমরা যা পরিসংখ্যানে দেখি তার থেকে আরও অনেক বেশী হচ্ছে বাস্তব পরিস্থিত। কি তাই তো?
সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু ‘রহস্য’ কিংবা রিয়া চক্রবর্তী কিভাবে ড্রাগ পাচার চক্রে জড়িয়ে পড়লেন, বা এর সাথে কোন কোন সেলিব্রিটিরা যুক্ত, সেই হিসাবনিকাশ না কষে, না হয় আপনার চারিপাশে কি ঘটছে সেই চর্চাটাও একটু করুন! আমাদের দেশের শিশুরাই তো আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ! কিন্তু তাদের জন্য আমরা কতটুকুই বা কি করতে পারি। না পারি আমরা তাদের সঠিক সুরক্ষা দিতে না পারি তাদের অধিকারগুলিকে সুরক্ষিত করতে। কোনো সরকার পক্ষকেই দোষারোপ করে এক্ষেত্রে লাভ নেই। ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর (NCRB)-এর আরও একটি তথ্য বেশ ভয়াবহ। প্রত্যেক দিন আমাদের দেশে ১০৯ টি শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। আর সেনসেক্সের ওঠানামার মতো, শিশু যৌন নিপীড়নের সংখ্যা কখনই নীচের দিকে নামছে না, বরঞ্চ তা ক্রমবর্ধমান। ২০১৭ সালের শিশু যৌন নিপীড়ন কেন্দ্রিক দাখিল হওয়া কেসের সংখ্যা যেখানে ছিল ৩২,৬০৮, সেখানে ২০১৮ সালের সংখ্যাটি ৩৯,৮২৭। এটা আমার-আপনার কোনো বানানো তথ্য নয়, ২০২০ সালে সরকারের তরফ থেকে প্রকাশিত পরিসংখ্যানই বলছে এহেন কথা। সমাজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পশুরদল বা বলতে গেলে আমাদের মনের ভিতরে বাসা বেঁধে থাকা স্বার্থপরতা কি আমাদের সত্যিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে আমরা না জানতেই কিভাবে অপরাধী হয়ে যাচ্ছি? সময় পেলে একবার অন্তত ভেবে দেখবেন তো, আপনার ভিতরেই সেই ‘রাক্ষস’টি লুকিয়ে নেই তো? আচ্ছা, আপনি কি সত্যিই দাঁত মাজেন? নাকি দাঁত মাজার ভান করেন?
[লেখক – Development Communication পেশাজীবী।]
Posted in: ARTICLE, September 2020 - Cover Story