চারকোল বার্নার্স ও মধ্যবর্তী আমি : শংকর লাহিড়ী
‘আমি’ দিয়ে কি আর কোনও ছবি বা লেখা শুরু করা উচিত? না, উচিত নয়। একমাত্র নিজের ডায়েরিতে, একান্তে, শুধু নিজেরই জন্য।– কফির গন্ধে আমি ভাবিয়ে তুলেছিলাম নিজেকেই। রেস্তোরাঁর টুং টাং শব্দ, চীনামাটি ও চামচের অসংলগ্ন কথাবার্তা। বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল।
মনে হয়েছিল, ছবি শুরু হোক ক্যামেরায় একটা দীর্ঘ টিল্ট-আপ শট দিয়ে। যেমন চৌরঙ্গীর একটা বহুতল বাড়ির নীচ থেকে ধীরে ধীরে ক্যামেরা উঠে যাচ্ছে, একেবারে ওপরের আটষষ্টি তলার আকাশ পর্যন্ত। অথবা একটা ওপেন-পিট কয়লাখনির একদম নীচের কালো সিম থেকে ক্যামেরা টিল্ট করে ওপরের দিকে উঠছে, অবশেষে ভূপৃষ্ঠে, যেখানে নানা রঙে সবুজ হয়ে আছে গাছপালা। এই ধরণের দীর্ঘ শটগুলো খুবই মনোটোনাস মনে হতে পারে, কিন্তু এর একেবারে শেষে থাকে একটা অসীমের সন্ধান, একটা মুক্তির উচ্ছ্বাস, যেটা আমার পছন্দ।
পিরামিড আর আইফেল টাওয়ারের রেপ্লিকা থেকে দূরে, বিগ বেন থেকে দূরে, যেখানে ফ্লাইওভারের নাম- ‘মা’। সেখান থেকে আরও দূরে, উত্তরপশ্চিমে, ছাতুবাবুর বাজার, টেরিটি বাজার, ঠনঠনে। প্রাচীন হাইড্রান্টের পাশে গাঁদার মালা চিবোচ্ছে একটা ভারী ষাঁড়। ঝোড়ো হাওয়ায়, লেন্সে বৃষ্টির ছিটে। টম্যাটো সসের পাশে ঠান্ডা হিম কাটলেট ও কবি। -পরবর্তী বইয়ের নামও হতে পারে এটা। গদ্য, নাকি কবিতা, এখনও জানি না। হয়তো মুক্ত গদ্য। কদাপি প্রবন্ধ নয়, জীবনে কখনও কোনও প্রবন্ধ লিখিনি। ও জিনিস লেখা যায় না, বললেন তিনি। রেস্তঁরায় আমরা যখন মুখোমুখি। ফাঁকা টেবিলে হিম কাটলেটের পাশে ছড়িয়ে আছে রক্তাক্ত সস্ আর চকচকে স্টেনলেস ছুরি। টুপি পরা দুটো নীল মাছি দূর থেকে দেখছে তাদের। ক্যামেরা স্লোলি জ্যুম করছে বুঝেও, তারা উড়ে গেল না।
বোদলেয়ার বলেছিলেন- সবসময়েই কবিত্বে থাকবে। যখন গদ্য লিখছ, তখনও। মেয়েটি বললো, যখন কাটলেট খাচ্ছ, তখনও? একথায় পরস্পরে একবার তাকিয়ে দেখলো দুজনেই। -সমীর রায়চৌধুরী যেমন বলেছিলেন, ধরো পথেঘাটে একজন নারীকে দেখে আমি তার দিকে তাকালাম, সেও ক্ষণিক তাকালো। এর মধ্যে একটা থামা, একটা স্থগন রয়েছে। সে যে তোমাকে দেখলো, তার মধ্যে একটা ‘এই দেখলাম’ রয়েছে। এই একটা স্থগন। তুমিও তখন একটা স্থগন রেখে দিলে যে, এই দেখলাম। এটা দিলাম। ওও দিল। একটা স্থগন, যা দুজনে বিনিময় করলাম। এমনটা প্রায়ই হয়। -বোদলেয়ার প্রসঙ্গে আমি বললাম, কিন্তু কী করে বুঝব কোনটা গদ্য আর কোনটা কবিতা, একি সম্ভব নাকি? রূপনারায়ণের কূলে জেগে উঠিলাম তো এতকাল আমি প্রোজ হিসেবেই পড়ে এসেছি।- এটা তো সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের বইয়ে আছে, মেয়েটি বললো।
নতুন কোথায় থাকে, নতুনের কোনও দুঃখ নেই? -নতুনকে নিয়ে কাজ করতে বসে দেখা হয়েছিল জালিম ও জিঘাংসা। মাফিয়া অধ্যুষিত বাংলা বাজার যেন অনুরাগ কাশ্যপের গ্যাংস অফ ওয়াস্যিপুর। কবিতা-আবাস জলে জলময়।
মৃত্যুর বছর খানেক আগে, ব্রহ্মপুরে নিজের বাড়িতে সোফায় বসে, স্মিতমুখ স্থিরদৃষ্টি, হাংরিয়ালিস্ট কবি সমীর রায়চৌধুরী বলেছিলেন- তোমার লেখায় আমি রসদ পাচ্ছি, যা আমাকে ভাবাচ্ছে। যেখানে ওরা ফেল করছে, কিন্তু তুমি ফেল করছ না। আমি ওদের ফর্মুলাটা ধরে ফেলেছি। তুমি ফেল করছ না, কারণ তুমি আমায় ভাবার জায়গাটা অব্দি পৌঁছে দিতে পারছ। বারবার পারছ। একটা আনএন্ডিং জায়গায় নিয়ে গিয়ে থামছ তুমি। যেখানে থামছ, সেখান থেকেও আবার, একটা আল্টিমেট ওপেনএন্ডেড জায়গায় ছেড়ে দিচ্ছ। এই যে ওপেনএন্ডেডনেস, এই নেসটাই হল আসল নেশা, যাতে আমি বুঁদ হয়ে আছি। -আমার মনে পড়লো, সামসিং চা-বাগানের পথে গাড়ি থামিয়ে এক বিশাল বিস্তৃত মেঘ-পাহাড়-সবুজের বিরামহীন প্যানোরামা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল।
*
একজন প্রশ্ন তুলেছিলেন : আপনি কে মশাই, কোথায় ছিলেন অ্যাদ্দিন? -আমি নিরুত্তর ছিলাম। কেননা এমন প্রশ্ন তো উপনিষদেও আছে। কীভাবে বোঝাবো, আমি কে, কোথায় ছিলাম? নাম, পদবী, কোঠি, হাভেলি? জিলা, পঞ্চায়েত, সরপঞ্চ? জন্মের কোনও শংসাপত্র? জন্মের পর হাতে কি বেড-টিকিট বেঁধে দিয়েছিল নার্স? না, কোথাও কোনও টিকিট ছিল না। গ্রামে গিয়ে খোঁজ করে দেখেছি। -ই কা টিক্টোয়া, সাহিব? হমরে গাঁও মে কোই এথি টিকট উকট নহি থা। কভি নহি। -মুখিয়া বলেছিল।
জন্ম হয়েছিল পাহাড়ি গ্রামে, আদিবাসী ধাইমার হাতে। তার চিবুক, নাক, জোড়া ভুরু, চোখের রঙ। ঠোঁটের পাউট। থুতনিতে কাটা দাগ, যা সবার থাকে। আর থাকে ঘুমের ভেতর একটা একা, একাকি। একটা ভোর ভয়ি, ভোরাই। থাকে নিশিজাগরণ, উদাস, মনকেমন, তড়িঘড়ি। সতত নিজেকে সন্দেহ। নিয়ত, প্রথাগত। ব্যক্তিগত, এত ব্যক্তিগত সবই।… স্ক্রিপ্ট লিখতে বসে এবার থামলেন তিনি। বললেন- ‘লক্ষ্য করে দেখুন, এখানেও আমি বা আমার শব্দ দিয়ে কোনও বাক্য শুরু করা হল না’। -অসংলগ্ন কথাবার্তা, বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছিল।
রবীন্দ্রনাথ কিন্তু আমি দিয়ে শুরু করেছিলেন। ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাবো না’… বা, ‘আমার যা আছে আমি সকল দিতে পারিনি’ ইত্যাদি। জীবনানন্দ অধিকাংশ আমিকে রেখেছেন সদর দরজা পেরিয়ে একটু ভেতরে—‘বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি’। বা, ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ’। এই হোল মধ্যবর্তী আমি। এমনকি ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’-ও মধ্যবর্তী, কেননা তার চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন।
উৎপলকুমারকে যে শ্রদ্ধা করি তার আরেকটা কারণ, লিখতে বসে তিনি যারপরনাই আমি ও আমরা-দের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেছেন। যখন তাঁরও ভোর ভয়ি, নিশি জাগরণ, উদাস, মনকেমন। লিখেছিলেন- ‘দু-চার বসন্ত আমি ঘোরালাম সামান্য লেখাকে’। -এই সেই মধ্যবর্তী আমি।
উৎপলদা বেঁচে থাকলে তাঁকে বলা যেত। কয়েক মাস আগে, নাসা যখন তাদের মার্স২০২০ অভিযান শুরু করলো, সেই ‘পার্সিভিয়ারেন্স’ নামক রোভারের গায়ে লেসার বীমে লেখা ছিল আমার প্রথম পরীক্ষামূলক গদ্য ‘আহ, দোজ ট্রাইসাইক্ল্স’-এর নামও, যাকে নিয়ে তৈরী হবে আমাদের ছবি। সেই মহাকাশযান এখন ছুটে চলেছে মঙ্গলগ্রহের পথে। আর আমি ভাবছি, দু’একটা গ্রহ আমি ঘোরালাম সামান্য লেখাকে! …উৎপলদা বেঁচে থাকলে অনেক কিছু বলা যেত। অবশ্য যদি তাঁকে কখনও একা পেতাম। বিখ্যাত মানুষরা সর্বক্ষণ এত সাঙ্গপাঙ্গ দিয়ে ঘেরা থাকেন। একবার তিনি লাইনের প্রথমেই ‘তারপর’ শব্দটা ব্যবহার করেন। ‘তারপর ঘাসের জঙ্গলে পড়ে আছে তোমার ব্যক্তিগত বসন্তদিনের চটি’।
একদিন সত্যিই দেখেছিলাম- ‘একা ময়ূর ঘুরছে খালি দোতলায়’। দূরে ধানকলের শব্দ। বস্তুত, এখান থেকেই পরবর্তী ভাবনাগুলো মাথায় আসে। যেখানে ‘আমি’ দিয়ে শুরু হবে না কিছুই। এমনকি আমি আর মধ্যবর্তীও নয়। একটা ডিট্যাচমেন্ট, দূরত্ব। কিছু অসংলগ্ন দৃশ্য, সুর, কথাবার্তা। কিছু অস্পষ্ট কুয়াশার নেবুলা। অথবা একজোড়া বাইনারি নক্ষত্রযুগলের নিরন্তর আবর্তন। অন্তরালে কোনও এক কৃষ্ণগহ্বর, যা ক্রমশঃ গ্রাস করছে। ইভেন্ট হরাইজন থেকে আলো বাঁক নিচ্ছে ক্রমে। যাকিছু দূরতম, অতিশীতল। যাকিছু পদপ্রান্তে, ফসিলে, মায়া কাজলে। শান্ত চরাচরে সহসা একঝলক তীব্র বিকিরণ রশ্মি। ছায়া কাঁপে। জলাধারে, অলিন্দে, পানপাত্রে, ঝরোকায়। যে শ্বাস ফিসফিস কথা বলে, খিলানে, গম্বুজে।
প্রথমবার উৎপলদার সাথে দেখা হয়েছিল হাওড়ার একটা বিয়েবাড়িতে। দোতলায় ওঠার ভিড়েঠাসা সরু সিঁড়িতে, ঘেঁষাঘেঁষি। জীবনে সেই আমি দৃশ্যতঃ ওঁর সবচেয়ে কাছে, ফিজিক্যালি দু’ইঞ্চির মধ্যে, এসে পড়েছিলাম ; ইন্টারস্টেলার আগন্তুকের মতো। সেই প্রথম। এর অনেক বছর পরে, বিষ্ণুপুর ট্যুরিস্ট লজে, ওঁকে প্রায় একা (সঙ্গে মাত্র একটি তরুণ) দেখতে পেয়ে পরিচয় দিলে, তিনি খুবই প্রীত হন। একে একে আমার সমস্ত লেখাগুলোর কথা মনে পড়ে যায় ওঁর।
সেদিন মনে হোল, পাহাড়তলিতে সন্ধ্যা নামছে। ভূমধ্যসাগর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভারী তেল। পিঙ্গল, শ্বাসরোধী, ভিসকাস। হয়তো আগুন লেগেছে জলে। শংখচিলের ডাক, বালিহাঁস। ঢেউয়ে ভাসছে তৈলাক্ত আলবাট্রস। -এই সেই দীর্ঘ ডানার পাখি। মহান ডানার ভারে অবরুদ্ধ হয় তার চলা। ক্যামেরা দেখছে তাকে। সেই মতো দূরত্ব। ডিট্যাচমেন্ট।
*
গোদার তাঁর শেষ ছবি ‘ইমেজ বুক’ করার ঠিক আগে ‘গুডবাই টু ল্যাঙ্গুয়েজ’ করেছিলেন। ২০১৪ সালে করা সেই গুডবাই ছবিটা ছিল একটা পরীক্ষামূলক রচনা (experimental essay film)। আর ‘আহ, দোজ ট্রাইসাইক্ল্স’ নামক পরীক্ষামূলক রচনাটি (experimental antinarrative story) আমি লিখেছিলাম ১৯৮১ সালে, কৌরব পত্রিকায়। সেই প্রথম। ছবির শট ডিভিশানও লেখাটি থেকে সহজেই বোঝা গেছিল। যেমন-
(১) ‘পরবর্তী দৃশ্যে গ্রেগার সামসার কফিন সরিয়ে ওরা তিনজনে শহরের সবচেয়ে উজ্জ্বল ট্রামে, জানালার ধারে।
(২) প্যান্টোগ্রাফে হিসহিস শব্দ উঠছে। (৩) মেয়েটি বাবা মা-র মাঝখানে। আজ বহুদিন পর তার সরু সিফনের প্রায় কোমরভঙ্গিমা, টানটান হাত-পা ও আঁটোসাঁটো ব্রেসিয়ারটি নজর ক’রে, পরপর স্টপেজগুলো পেরিয়ে, না থেমে (৪) টিনটিন টিনটিন শব্দে ট্রাম ছুটে যাচ্ছে। (৫) কক্ষান্তরে বহুদূরে তার ভাইয়ের নিতান্ত কফিন ক্রমশ ডটপেনে ফুটকির মতো হয়ে আসে, এরকম স্প্রিংসুলভ টান ছিল সেই সকালে। (৬) ফ্লাইট শেষ হলে এয়ার হোস্টেস দুটির একজন আমাকে ‘থ্যাংক ইউ’ বলে, ও আমি স্টিউয়ার্ডটিকে চাপা গলায় ‘এ তো আমি আগেই পড়েছি’ বলে ফেলি। (৭) তখনও এঞ্জিন চালু ছিল, যে কারণ তীব্র হোয়াইন-এ হোস্টেস দুটির আকন্ঠ হাসি আমার স্তব্ধতা মনে হয়। শব্দ কত ডিসেপটিভ্ সেই আরেকবার আমি বুঝি।’
বিখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক গোদার হয়তো বাংলায় লেখা কোনও রচনাই কখনও পড়েননি। কিন্তু আমরা তো তাঁর অনেক ফরাসি ছবি এতকাল ধরে দেখে আসছি। যখন ‘ট্রাইসাইক্ল্স’ প্রকাশিত হয়, ১৯৮১, তখন আমার বয়স একত্রিশ। গোদার তখন ‘প্যাশান’ ছবিটিতে হাত দিয়েছেন, তাঁর বয়স একান্ন। যদি তখনই তিনি ট্রাইসাইক্ল্স পড়তেন, তবে অনেক আগেই হয়তো-বা ‘গুডবাই টু ল্যাঙ্গুয়েজ’ ছবিটা বানিয়ে ফেলতেন, ২০১৪ অব্দি অপেক্ষা করতেন না।- ভাগ্যিস তা হয়নি। তাহলে ওঁর কত দারুণ সব ছবি থেকে আমরা বঞ্চিত হতাম।
এইরকম নানা অসংগতিকে থিম করে তৈরী হতে পারে ছবিটা, যাতে একটা ছোট্ট থিমাটিক সঙ্গীতের টুকরোকে বারবার ব্যবহার করা হবে, একটা লেইটমোটিফের (leitmotif) মতো। হয়তো সেটা কোনও করাতকলের তীক্ষ্ণ শ্রিল শব্দ, অথবা কোনও রুদালিদের গান, অথবা মহাকাশ থেকে ভেসে আসা কোনও ফাস্ট রেডিও বার্স্ট (FRB)। অথবা কিছু অসংলগ্ন কথাবার্তা। বাইরে যখন বৃষ্টি পড়ছিল।
বিখ্যাত ‘এমজি’-গাড়ির উৎপত্তির খোঁজে নেমে আমি জেনেছিলাম, পুরো কথাটা হচ্ছে মরিস গ্যারাজ। প্রায় একশো বছর আগেকার এই কোম্পানি নাকি গাড়ি বানানো শুরু করেছিল তাদের একটা গ্যারাজ থেকেই। যেমন স্টিভ জোবস তাঁর অ্যাপল কম্পিউটারের ব্যবসা শুরু করেছিলেন কালিফোর্নিয়ার লস আল্টোজ-এ, পৈতৃক বাড়ির গ্যারাজ থেকে। আজ অ্যাপল কম্পিউটার বা আইফোন মালিকদের মনে রাখা উচিত এই গ্যারাজটিকেও।

তো, আমাদের ছবিও শুরু হয়েছিল গাড়ি মেরামতির একটা বড় গ্যারাজের চত্তর থেকে। ভাঙাচোরা গাড়ি, ছড়ানো ছেটানো যন্ত্রাংশ। চাকার রিম, টায়ার, রেডিয়েটার, গিয়ার বক্স, ব্যাটারি, ডিফারেন্সিয়াল। স্প্রিং বের করা গদি। ওয়েল্ডিং মেশিন, স্প্রেগান, হাইড্রলিক জ্যাক। খাঁচার ভেতর একটা বয়স্ক Hornbill, ধনেশ পাখি। এসবের পাশে, আরেকটা ফাঁকা শেডের ভেতরে, প্র্যাকটিস করে একটা মিউজিক্যাল ব্যান্ড। তাদের ঝাঁকড়া চুলের সদস্য সাতজন। বেস গিটার, ভায়লিন, স্যাক্সো, করতাল, জগঝম্প। আজ তারা ওই শেডের মধ্যেই সারি বেঁধে বসে, সঙ্গীত সহযোগে, মুন্ডন করিয়েছে। ক্যামেরায় ধরা হয়েছে সেই মেকওভার। তাদের ব্যান্ডের নতুন নাম- ‘দা চারকোল বার্নার্স। সকলেই ন্যাড়া, স্কিনহেড। পরনে বারমুডা, স্নিকার্স। মেঘলা দিনেও সবার চোখে কালো গোল রোদচশমা। এদের প্রিয় গান- অ্যামি ওয়াইনহাউসের ‘রিহ্যাব’।
‘They tried to make me go to Rehab, but I said “no, no, no”.
Yes, I’ve been bad, but when I come back, you’ll know know know’.
বাবা ক্যাব ড্রাইভার, মা ওষুধের দোকানে কর্মচারী। ব্রিটিশ পরিবার। নোরা জোন্স-এর মতো, অ্যামিও নাকি এক রাতে পাঁচ-পাঁচটা গ্র্যামি পেয়েছিল। নিজে গান লিখতো, সুর দিত, গাইতো। জ্যাজ সোল ব্লুজ। সেই অ্যামির মৃত্যু হয় ২০১১ সালে, মাত্র আঠাশ বছর বয়সে, মদ ও মাদকের বশে। আমাকে জানিয়েছিল চারকোল বার্নার্সরা।
…নেড়াদের ব্যান্ড এগোতে থাকে। ক্রমে তারা গ্যারাজের গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে, এখন রাস্তায়। ওদের একজনের ডানহাতে ঝোলানো কাংড়িতে জ্বলন্ত চারকোল থেকে সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। সে-ই লীড ভোকাল। একজনের বাঁহাতে স্লিং-এ বাঁধা পোষা ল্যাব্রাডোর, তার হুয়াম হুয়াম বার্কিং। কাছাকাছি লোক জুটতে থাকে। ক্রমে প্রচুর লোক, একটা বড় ভিড়। এবার ছোট রাস্তা ছেড়ে ফোর-লেনে। গলি থেকে, বাইলেন থেকে ছোট ছোট অনেকগুলো ব্যান্ড এসে যোগ দিয়েছে। ব্যান্ড চলেছে বইপাড়া, ময়দান, ফেরিঘাট। গলায় গাঁদার মালা। হাতে ধরা মাইকে মূলতঃ মিউজিক আর শার্প ডায়ালগস, আর ল্যাব্রাডোরের বার্কিং। সাথে সাথে শহরের ভিশ্যুয়ালস। ময়দানের পথে ট্রাম, ধর্মতলায় শিবের সং, সোনাগাছির গলিতে কুলপিওয়ালা, লঞ্চঘাটে নতুন বৌ, ফিরিঙ্গি চার্চের ফুটপাথে পুরোনো বইয়ের ঝাঁকে শরীরী কবিতা বইটার এক কপি।
কিছুদূর এইভাবে চলার পড়ে ভীড় যখন প্রবল, ফুটপাথে দোকানে হঠাৎই শুরু হয়ে যায় লুটপাট। মশারি, বেডকভার, ছাতা, জুতোর বাক্স, থান কাপড়, ফেসমাস্ক, ক্যারাম বোর্ড। মুহূর্তে শাটার নেমে আসে সারিবদ্ধ দোকানপাটে। ক্রমে র্যাফ, কাঁদানে গ্যাস, ড্রোন। হঠাৎ বৃষ্টি নামলো ঝমঝমিয়ে। ক্যামেরা ঢাকা পড়লো ছাতায়।
অচিরেই মিডিয়া এসে ঘিরে ধরলো। কী ছিল সেই গানের কথায়? কেন এই আক্রমণ? নিরস্ত্র ওরা গাইছিল-
‘যদি মনে হয় সবই অসংলগ্ন কথা
তাহলে জেন বৃষ্টি পড়ছিল।
শীতার্ত আমাদের হাতে ছিল
কাঠকয়লার তীব্র আঁচ,
যখন বৃষ্টি পড়ছিল।
হয়তো তুমি ভিজে যাওনি
হয়তো তুমি গান গাওনি
তবু জেন,
মৃত্যু পরোয়ানা ছিল আমাদের।
যখন পায়ের পাতা জলসিক্ত
যখন সকল কথা অসমাপ্ত
জেন, বৃষ্টি পড়ছিল।’
এখন থানার ভেতরে আধো অন্ধকারে বার্নার্সদের সকলের চোখ কান নাক আর উচ্চতা মাপা হচ্ছে। এই সময়ে ওরা শুরু করলো গণসঙ্গীত। সমবেত কন্ঠে। স্বদেশ সেনের কবিতায় আছে—‘যখন অন্ধকার, অন্ধকারে গণ-সঙ্গীত ধরে গাও’। ক্রমে থানা থেকে মুচলেকা ও মাপজোক শেষে ছাড়া পেলে, রাস্তায় এক সিভিক ভলান্টিয়ার এসে তাদের ‘ময়না গো’ গানটা গাইতে বলে। ও মোর ময়না গো, কার কারণে তুমি একেলা, ইত্যাদি। বার্নার্সদের ল্যাব্রাডোরটি আপত্তি জানালে সিভিক সরে যায়। এই অংশটা অবশ্য ছবির ফাইনাল কাটে রাখা হয়নি।
হঠাৎই ক্যামেরা দেখতে পায়, ট্রামলাইনের পাশে পড়ে আছে ‘চারকোল বার্নার্স’ লেখা দুটো ড্রাম। ছুরি দিয়ে আড়াআড়ি চেরা। তার ভেতরে নেমে পড়েছে কয়েকটা পেটমোটা ইঁদুর। এবং বেস গিটারের ছ-ইঞ্চি পাশ দিয়ে বিদ্যুতের ফুলকি ছড়িয়ে চলে গেল ট্রামের চাকা। হইহই করে উঠলো কবেকার কলকাতা শহর।
এ’শহরকে আমি আর চিনি না। আমার শৈশব কেটেছিল উত্তর কলকাতায়, হরেকৃষ্ট শেঠ লেনে, পুকুরপাড়ের লাল বাড়িতে। সেটা পঞ্চাশের দশক।
ছবির শ্যুটিংয়ে আহত হয়েছিলেন চারজন পুলিশ, একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক, এবং নেড়াদের একজন। আর সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন ভীড়ের মধ্যে আটকে পড়া দুই মৃগনয়নী, আলকাতরা ও কস্তুরীর মিশ্র সুবাস তাদের শরীরে। তরুণীদের কারোরই ডানায় পালক ছিল না, তাই উড়ে যেতে পারেনি।
মনে পড়ে গেল শঙ্খ ঘোষের সেই বিখ্যাত কবিতাটা। ‘মুনিয়া সমস্তদিন বাঁধা ছিল। খুব বারোটায় উঠে চুপি চুপি খাঁচা খুলে উড়ে যা উড়ে যা বলে প্ররোচনা দিতে, আমার বুকের দিকে তুলে দিল ঠ্যাং। জ্যোৎস্নায় মনে হল বাঘিনীর থাবা।’
বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আলেহান্দ্র জোদোরস্কি বলেছিলেন– যেসব পাখিরা জন্ম থেকেই খাঁচায়, তারা উড়ে যাওয়ার ইচ্ছাকে একটা অসুখ মনে করে। -‘Birds born in a cage think flying is an illness’. -যেকোনও ছবি করতে যাওয়ার আগে, এইসবই খুব ভালো করে বুঝে নেওয়া দরকার।
এবং যা কিছু পতিত হয়, যা কিছু হুহু গতিতে নেমে আসে নীচে। আপেল, অথবা ড্রেনপাইপে মুত্রস্রোত। বে-উইন্ডোর দুপাশের প্রতিহিংসা পরায়ণ ভারী পর্দা সরিয়ে আমি যেভাবে দুরকম আলোকে মিক্স করি। রাতে যেভাবে সিএফএলের হলুদ আর সাদা আলোকে মেপে মেশাতে হয়। সেদিন রাতে একতলার কাচের জানালায় টোকা দিয়ে একজন জানালো যে, পাঁচ হাজার পাঠকের মধ্যে একজনের ভালো লাগলেই সে, কবি, চাঙ্গা। এর উত্তরে আমি পর্দা টেনে দিয়েছি, কারণ আমি চেয়েছিলাম পনেরোজন পাঠক। তার চেয়ে বড় কিছু আমি ভাবতেও পারি না।
আমার কবিতার অন্তরালে যা কিছু শব্দ বর্ণ স্রোত। যেভাবে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। ক্রমে সম্পর্কের অভিঘাত। একটা অসংযত ও অসম্ভব জ্যামিতি। ছড়িয়ে পড়ে তার তরঙ্গ মূর্ছনা। ব্রেনের লিম্বিকে যার রেশ থেকে যায় দীর্ঘদিন।
আজকাল ছবিতে বিছানার দৃশ্য দেখলে আপনার ‘দেওয়াল ও বিছানা’ কবিতার লাইনগুলো কিভাবে যেন মনে পড়ে যায়। -মৃগনয়নী আমাকে কানে কানে বলে।
‘…একটি পা দীর্ঘ হয়ে বেরিয়ে আছে বিছানা থেকে।
ডাকছে ওই তাঁবুর ভেতর কয়েকটি পাখি ;
ব্রোঞ্জের তৈরী ডানা, পিপাসা, ও চোখ বিস্ফারিত।’ (বই: শরীরী কবিতা)
ক্রমে আমার ঘ্রাণশক্তি ফিরে আসছে। নাকে আসছে কস্তুরী গন্ধ। …একটা সমাবর্তন উৎসব। কলেজ থেকে ফ্যাশান ডিজাইন পাশ করে সদ্য বেরিয়েছে যেসব মেয়েরা। মৃগনয়নীদের জিগ্যেস করতে একজন জানালো যে, তার বানানো একটা ডিজাইন শুধু তার দিদিই পরেছে, আর সব ম্যানিকিন। অন্যরা বললো, তাদের সব ডিজাইন এখনও শুধুই ম্যানিকিনদের গায়ে। শহরের আর কেউ পরেনি। এইখানে আমি ‘কাট’ বলতেই ক্যামেরা বন্ধ হোল। লাইটবয়টি দায়িত্ব নিয়ে জানালো, উজ্জ্বল হলুদ কটন শাড়ির সাথে হাল্কা পিঙ্ক লিপস্টিক দারুণ কম্বিনেশান। আমার মনে পড়লো কোকো শ্যানেল-এর কথা। ফরাসি, শ্যানেল নাম্বার ফাইভ। বিশ্বের প্রথম অ্যাবস্ট্র্যাক্ট পারফিউম, একজন রাশিয়ান মাস্টারের হাতে তৈরী।
*
অলিম্পিয়ার রাজার রাজত্বে পাহাড় জঙ্গল নদী ঝর্ণার দেশে জন্ম হয়েছিল বালক নার্সিসাসের। নদী-দেবতা সেফিসাসের সাথে নিরালায় এক নীল জলপরীর প্রেম থেকেই তার জন্ম। এরকমই একজন গরবিনী ও অসামান্য সুন্দরী জলপরির নাম ইকো। ওরা দুজনেই কবি, দুজনেই থাকে কসবায়। পরস্পরকে চেনে। ইকো ভালো সাঁতারু। তার প্রিয় ব্রেস্ট স্ট্রোক, আশপাশের বাড়ির ছাদ থেকে দেখা যায়। ফ্লাইওভারের ৪৮ নং পিলারের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা উত্তরদিকে চলে গেছে। কাচের ক্যাবিনেটে থরে থরে পর্কের মাংস, থকথকে চর্বি, সারি সারি শূয়োরের মাথা।
কবি নার্সিসাসকে নিয়ে ছবি করতে গিয়ে দেখেছি, ওর সমস্যাটা জমকালো। একবার রাত জেগে একটা আটপাতার গদ্য লিখে সম্পাদককে মেইল করার পরে, ওর নিজেরই মনে হয় এই লেখাটা আগে যেন কোথায় পড়েছি! বহুদিন আগে কি কখনও? ভাবতে ভাবতে, এঘর ওঘর ঘুরে, একটা পরিত্যক্ত ব্রিফকেসের মধ্যে সে আবিস্কার করে সম্পূর্ণ লেখাটাকে। ইন প্রিন্ট। পনেরো বছর আগে লেখা একটা পত্রিকা। হুবহু আজকের লেখাটাই। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? সে তো এটা কয়েকদিন আগেই লিখল। এডিট করল কতবার। ভেবে ভেবে এখন সে অসুস্থ, বিহ্বল। ডাক্তার দেখে গেছেন। বলেছেন, মধ্যবর্তীরা সকলেই নাকি অসুস্থ।
এইখানে আমি স্ক্রিপ্টে কিছু সংযোজন করতে চেয়েছি। রূপকথাকে বর্জন ক’রে। চেয়েছি নার্সিসাসের সাথে দেখা হোক ইকোর। যা কখনও রূপকথায় হয়নি, তাই হোক ছবিতে।
সবাই জানে, নার্সিসাস আত্মপ্রেমে বিহ্বল হয়ে নিজেকে ছুরিকাঘাতে আত্মহত্যা করলে, প্রবাহিত রক্তস্রোতে ঘাস-মাটি-পাথরে ফুটে উঠেছিল অজস্র বেগুনি-সাদা ফুল। ফুলের নাম নার্সিসাস। কিন্তু ইকোর সাথে নার্সিসাসের দেখা হওয়া খুবই জরুরী ছিল, আমি ভাবি। নার্সিসাস অসুস্থ, নার্সিসিজম একটা রোগ– আমাকে বলেছিলেন পাভলভ হাসপাতালের সেই ডাক্তার।
উত্তরাধিকার সূত্রে একটা বন্দুক আমি দাদুর কাছ থেকে পেয়েছিলাম। ভারী আমকাঠের জিনিস, দাদুর নিজের হাতে বানানো। এতে গুলি ভরার কোনও ব্যবস্থা ছিল না, দৃশ্যতঃ কাক তাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হত। -এসব বাহুল্য কথা অবশ্য স্ক্রিপ্ট থেকে বাদ দেওয়া ভালো। স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে খুব আলগোছে, কয়েকটা কনসেপ্টকে হাল্কা হাতে ছুঁয়ে। কারণ, পৃথিবীতে সব কথাই বলা হয়ে গেছে। শুধু তৈরী করা যেতে পারে কিছু দৃশ্য, যার ফাঁকে ফাঁকে থাকবে কিছু লেইটমোটিফ। যেমন, ‘হেসপারাস, আশ্চর্য নক্ষত্র তুমি এখনও এলে না’। গোদারের মতে, ভালো ছবি করতে গেলে বেশি কিছু তো লাগে না। একজন যুবতী ও একটি বন্দুকই যথেষ্ট।
গোদার কখনও ছবিতে মন্তাজ ব্যবহার করেননি। তারকোভস্কিও নয়। মন্তাজের প্রথম পাঠ আমি পেয়েছিলাম সের্গেই আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’ (১৯২৬) নির্বাক ছবিতে। পরপর একসারি স্থিরচিত্র। হাফ সেকেন্ড পরপর কাট। সেই আগ্রাসী কশাক সেনা, সেই ওডেসা বন্দরের সিঁড়িতে বিখ্যাত ‘ওডেসা স্টেপ সিকোয়েন্স’। সেনাদের হাইবুট, পেরাম্বুলেটরে শিশু, সিংহের মূর্তি, জনতার পলায়ন, চশমার ভাঙা কাচ, সিঁড়ির ধাপ, বেয়নেট…। এইভাবে একসারি স্থিরচিত্রের মাধ্যমে একটা সামগ্রিক অনুভবকে প্রকাশ করতে পারা, দেখিয়েছিলেন আইজেনস্টাইন। প্রায় একশো বছর আগে।
‘শরীরী কবিতা’ বইয়ের একদম শেষ পাতায়, এইভাবেই কিছু বিমূর্ত ফ্রেমকে, কনসেপ্টকে, বই থেকে তুলে এনে আমি পাতা জুড়ে সাজিয়েছিলাম:
জলের হিম চ্ছলাৎ শব্দ – উন্মাদের তীব্র আফটার শেভ – মাঝরাতের সার্ডিন মাছেরা – আঁধার বাজনা -ভঙ্গুর ফ্রুটবোল – মারমুখী পতঙ্গ – শিরাকাটা চিৎকার – উল্কাপিন্ড – কাঁটায় আকীর্ণ বিছানা – বরফের দেওয়াল – হিম গুঞ্জনময় জল – দ্বিধাহীন ন্যাপকিন – প্রবল বারুদ – উন্মাদ ক্যাকটাস – সূর্যমুখী চাকা – ব্রোঞ্জের ডানা – দিব্য কাঁসা – অন্তহীন পেরেক – প্রবল অশ্রু ও আলো…।
সেই কতকাল আগে, আশির দশকে মোটরহোমের পরিকল্পনার সময়ে ফিনান্স করার প্রস্তাব এসেছিল ‘স্কর্পিয়ন্স’-দের কাছ থেকে। সেই নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয়েছিল। ছবির বেলায় ব্যাপারটা সহজ নয়। প্রোডিউসার বোঝেন বক্স অফিস, মিডিয়া, প্রোমো, পুরস্কার। সবচেয়ে মুশকিল হয় আগে থেকে ছবির বিষয়কে ব্যাখ্যা করা। স্ক্রিপ্ট না থাকলে তো কথাই নেই। কিন্তু আগে স্ক্রিপ্ট লিখে ছবি শুরুর কথা তো ভাবতেও পারি না। ‘উত্তরমালা’ ছবিটার স্ক্রিপ্ট যেমন লেখা হয়েছিল পোস্ট প্রোডাকশান পর্বে, এডিটিং টেবিলে। প্রোডিউসার এসব রিস্ক নেবেন কেন। তবে কিছু দেদার পয়সাওয়ালা সহৃদয় মানুষও আছেন, যাঁরা লাভের অংক না কষে টাকা জলে দেওয়ার শর্তেও রাজি। এঁদের কচ্চিৎ দেখা যায়। নগরীর কোনও কোনও অঞ্চলে। জঙ্গলের গভীরে যখন বাঁশগাছে ফুল ফোটে।
গোদার মনে করেন প্রত্যেক ছবির একটা শুরু, মধ্যম এবং অন্তিম পর্ব থাকে। তবে সেগুলো ক্রমানুযায়ী না হয়ে আগে পরে হতেই পারে।
*
এরপর অনেক চেষ্টায় প্রোডিউসারের সাথে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছিল। গড়িয়ার কাছে, সিসিডি-তে। মহিলা জানতে চাইলেন, এটা কি দুঃখের ছবি? আমি কি বলবো- না বুঝেই বললাম, দেখুন দুঃখ তো সর্বব্যাপী। আমরা তো বেদনার সন্তান। প্রশ্ন : কী বলতে চাইছেন ছবিতে? উত্তরে আমি : আপনি একে নানাভাবেই ইন্টারপ্রেট করতে পারেন। সেটাই স্বাভাবিক। আমার কাজ পাঠক ও দর্শকদের জন্য সেই সুযোগটুকু করে দেওয়া। দর্শকদের কিছু বলার নেই আমার, শুধু ভাবানো আছে, নীরবে ভাবা। এবার প্রো একটু ভাবলেন। বললেন, নায়িকা কজন? আমি বললাম, এখনও ঠিক করতে পারিনি। কবিরাও আছেন। কয়েকজন হতে পারে, অন্তত একজন। প্রো বললেন, কোনও পলিটিকাল টিল্ট?… কোনও ঘাস্টলি সিন্স? বুনুয়েলের ‘আন্দালুসিয়ান ডগ’-এর মতো কিছু নয় তো? আমি : একদম না। বুনুয়েল তখন খুবই তরুণ ছিলেন। প্রো : তাহলে কি যৌনতা?… কোনও ধর্ষণের সিনটিন রাখবেন না তো, প্লীজ? অল্প বয়সে আমার…। থামলেন। ইতস্তত করলেন। আমাকে একজন… ধর্ষণ করেছিল। ধীরে ধীরে বললেন। বলতে বলতে ওঁর চোখ ভরে গেল নোনা জলে। টিস্যু পেপার দিয়ে মুছলেন। …একটা পোড়ো বাড়ি …ল্যান্টানার জঙ্গল …একঝাঁক মৌমাছি উড়ছিল।
A Greek saying states that only women who have washed their eyes with tears can see clearly.
একথা সেকথা ও দু’কাপ কাপুচিনোর পরে তিনি স্ক্রিপ্ট দেখতে চাইলে, আমি কী বলবো বুঝে উঠতে না পেরে, গত চব্বিশ ঘন্টায় কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা জানতে না পেরে, আজ সকালের আনন্দবাজার, হিন্দু, প্রভাত খবর, দৈনিক জাগরণ, গ্লোবাল টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, টোকিয়ো শিমবুন, বা প্রাভদার প্রথম পাতায় কী হেডিং হয়েছে তার পরোয়া না করে, ততক্ষণে আকাশে মেঘ গুমরিয়ে উঠে হাওয়া বইতে শুরু করেছে দেখে, ফুটপাথে জীবাণুনাশক ব্লিচিং পাউডার ছড়াতে মেয়র পারিষদ স্বয়ং চলে এসেছেন দেখে, জীবনের আরও একটা দিন হাত ফসকে পালিয়ে যাচ্ছে দেখে, অবশেষে আমার নীল ডায়েরির পেজমার্ক দেওয়া একটা পাতা খুলে মহিলার সামনে মেলে ধরি।
মাত্র কয়েক লাইন টেক্সট। কয়েকটা শব্দসূত্র, ভিশ্যুয়ালস। কফির গন্ধ ঘরময়। ক্যামেরা এবার প্যান করে ঘুরে গিয়ে, টিল্ট ডাউন করেছে ডায়েরির পাতায়। স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে হিজিবিজি লাইনগুলো।
– স্বপ্ন-বাথরুম / ইয়ারানা / বজ্রকীট / কালো প্যান্টি-হোস / জামিনামিনা হে হে (শাকিরা)।
– বোদল্যেয়ারের সমাধিতে আঁধার বাজনা। … ‘আমার কামুক বুকে উঠে আয় বিড়াল সুন্দরী, বক্র নখ ঢেকে নে থাবায়।’
– পাড়াগাঁর পুকুরঘাটে সদ্যস্নাতা মেয়েরা, স্তন ও নিতম্ব থেকে যাদের জল সম্পূর্ণ ঝরে পড়েনি। …হিম গুঞ্জনময় জল – জলের হিম চ্ছলাৎ শব্দ – মাঝরাতের সার্ডিন মাছেরা।
– শিয়ালদহ স্টেশনে, লালগোলা প্যাসেঞ্জার থেকে নেমে আসছেন কয়েকজন তরুণ কবি। তাঁদের মাথায় ছাতিম পাতার মুকুট। …উন্মাদ ক্যাকটাস – প্রবল বারুদ – সূর্যমুখী চাকা।
– কোটালের বানে গঙ্গায় পাড় ভাঙছে শমসেরগঞ্জে। ভাঙা ঘরের পাশে বসে জ্বালানির সঞ্চিত কাঠকুটো বাঁচানোর চেষ্টা করছেন এক বৃদ্ধা। সেই দৃশ্যে, একটু পরেই তাঁর স্বামীর মৃত্যু হবে। …প্রবল অশ্রু ও আলো।
– ‘ফল অফ বার্লিন’ ছবিতে সিউয়ারের কালো জলস্রোতে ভেসে যাচ্ছে মাটির নীচে টানেলে আশ্রয় নেওয়া শতশত ভয়ার্ত নারী পুরুষ। …মারমুখী পতঙ্গ – শিরাকাটা চিৎকার।
– কুখ্যাত ‘আউশুইৎজ-ওয়ান’ কন্সেন্ট্রেশান ক্যাম্পের গেটের মাথায় লেখা : কর্মই তোমায় মুক্তি দেবে (‘Arbeit Macht Frei’)। [এর অরিজিনাল লেখাটা চুরি হয়েছিল ২০০৯ সালে, পরে উদ্ধার করে এনে রাখা হয়েছে মিউজিয়ামে। এখন গেটের মাথায় আছে তারই একটা রেপ্লিকা]
–কাট। আর কিছু লেখা ছিল না ডায়েরির সেই পাতায়। ক্যামেরা থামলো।
প্রো বললেন- যত ভাবছি, বিস্মিত হচ্ছি। ওই পাড়াগাঁর পুকুর ঘাট, জলের হিম চ্ছলাৎ শব্দ। খুব সুন্দর। আমার জরায়ুতে যেন একটা কাঁপন লাগলো।
আমি বললাম- এমনটা হয়। একদিন কবি দেবারতি মিত্র আমায় বলেছিলেন, শংকর, জানো, কদিন ধরেই আমার ভেতরটা কাঁপছে। একটা কম্পন হয়ে চলেছে, ডাক্তারকে বলেছি। মণীন্দ্র গুপ্ত বললেন, দেখো তো, ভালো করে খাওয়াদাওয়া করে না, রোগা হয়ে যাচ্ছে, সেজন্যেই হয়তো। বললাম, এক এক সময়ে আমারও এমন হয়। একটা কিছু কাঁপে ভেতরে। একে আমি ‘গিলভিক সিনড্রোম’ বলি। ফরাসি কবি য়্যুজিন গিলভিকের কবিতায় আছে।
‘যা কিছু পাথরের মধ্যে নেই,
যা কিছু পাথর ও মাটির দেওয়ালের মধ্যে নেই,
এমনকি গাছের মধ্যেও নয়,
যা কিছু সবসময় একটু একটু কাঁপে,
আশ্চর্য্য, তা আমাদের মধ্যে রয়েছে!’ (অনুঃ চিন্ময় গুহ)
সেদিন সন্ধ্যায় আমি প্রো-র বাড়িতে। দুজন বাউন্সার আর একটি ডোবারম্যানকে পেরিয়ে, প্রো সেদিন আমাকে ছাদে নিয়ে গেলেন। রট আয়রনের ঘোরানো সিঁড়ি, যেমনটা আমার ছেলেবেলার লালবাড়িতে ছিল। ছাদের একপাশে একটা ছোট গোল টেবিলে কফির আয়োজন। আকাশে ঝলমল করছে অনেক নক্ষত্র।
প্রো বললেন— আপনি পথ চিনে চিনে ঠিকই তো আসতে পেরেছেন। আমি বললাম—‘অপরূপ মেয়ে-তারাগুলি পথ / দেখিয়ে এনেছে আমাকে, / কারও চুল খুলে হয়ে গেছে খুব বৃষ্টি।’
প্রো বললেন—‘বিনুনির মতো কৌশলে ওরা / এতদিন মহাশূন্যে / কি করে রয়েছে?’
আমি বললাম, আপনি তো সুব্রত সরকারের কবিতাটা বেশ মনে রেখেছেন!
প্রো বললেন— সন্দেহ আর সন্দেহ শুধু সন্দেহ-।
আমি বললাম– আমার সন্দেহ হচ্ছে, এই ছবিতে আপনি আদৌ ইনভেস্ট করবেন কি না।
প্রো বললেন– আরও কয়েকটা দিন সময় চাই। জানাবো।
*
রোগশয্যা থেকে কবি আলোক সরকার আমাকে একবার বলেছিলেন— মাঝে মাঝে আমার ভয়ংকর চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করে যে, আমি কেন আর বেঁচে থাকবো? সব্বাই চলে গেছে। কেউ নেই আমার। -একদিন সকালে তাঁর শয্যাপাশে দাঁড়িয়ে একা আমি সেই হাহাকার শুনেছি ।
-প্রথমে ট্রাফিক সিগনালের পাশে তিন তলা বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে ভেঙে পড়লো আকাশি নীল রঙের বিরাট একটা কাচের প্যানেল। জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর আছড়ে প’ড়ে শত টুকরো হোল। ক্রমে চারপাশের বাড়িগুলো থেকে একে একে ভেঙে পড়লো সব কাচ। জানালা, এলসিডি স্ক্রিন, লন্ঠন, পানপাত্র, বকযন্ত্র, বালুঘড়ি। ক্রিস্টাল গ্লাসের সুদৃশ্য ভারী ফ্রুটবোল। কাচের টিবিয়া, কাচের ফিমার, কাচের পেখম, ঠোঁট ও পাখনা।- ভাঙা কাচের স্তুপ চারদিকে। রাজপথে নানা রঙের কাচের টুকরো, কাচের ধুলো ভাসছে বাতাসে। এখনই এসে পড়বে, আর অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে মাউন্টেড পুলিশ, র্যাফ, জলকামান, ড্রোন। ভাববে। হয়তো তারা ভাববে –
‘কি সুন্দর এইসব অথচ ভঙ্গুর ফ্রুটবোল,
ফলগুলো গড়িয়ে পড়েছে, সব
ফল পড়ে যায়’। (বই : শরীরী কবিতা)
এমন একটি ঘটমান বর্তমান! মর্মাহত, বিস্মিত, পথচারী থমকে দাঁড়িয়েছে। আমরাও বাকরুদ্ধ। দূরে, ল্যাম্প পোস্টের নীচে, একজন টুপি পরা শীর্ণ উজ্জ্বল মানুষ। ওয়াকিং স্টিক। নীচু হয়ে রঙিন কাচের টুকরো বেছে নিয়ে ট্রাউজার্সের পকেটে রাখছেন। তাঁর মাথার পেছনে জড়দেবতার জ্যোতিস্মান থালার মত।
এতক্ষণে প্রো বললেন- আমারও ভেতরে একটা কম্পন হচ্ছে। কোনও গ্র্যাভিটি ওয়েভ থেকে এমনটা হোল না তো? আমি বললাম- না, গ্র্যাভিটি ওয়েভ নিঃশব্দে এসে শরীর ভেদ করে চলে যায়, ভাঙচুর করে না, তবে আত্মায় একটা দোলা লাগতেও পারে। জিগ্যেস করলেন- উনি কে? কন্ঠস্বর আহত ও অভিমানী। আমি বললাম- উনি একজন মহৎ কবি। ওঁর কবিতার অনেক ভক্ত। মঞ্চে, মিছিলে। প্রো বললেন- এত কবি এত কবিতা এত পত্রিকা! ব্যাঙের ছাতার মতো। আমার শ্বাসকষ্ট হয়, বলতেও পারি না। এসময়ে কার্নিসে বেড়াল ও দেওয়ালে টিকটিকি একযোগে ডেকে উঠলো। আমি বললাম, আপনি ব্যাঙের ছাতা—মাশরুম–খান না বুঝি? প্রো বললেন, খাই, তবে বেছে। আমি বললাম, একরকম আলো-ঝলমলে ব্যাঙের ছাতা আছে, ইলেক্ট্রিক মাশরুম। দেখতে সুন্দর, তবে খাওয়ার নয়। খাবেন না যেন। এর একটা প্রজাতি, রোরিডোমাইসিস ফিলোস্ট্যাকিডিস। মেঘালয়ে আছে, খুব রেয়ার।
প্রো কিছুক্ষণ ভাবলেন। বললেন, আলেহান্দ্রো জোডোরোস্কির ‘এন্ডলেস পোয়েট্রি’ ছবিটা দেখেছেন? জোডোরোস্কি মনে করেন, কবিতা হচ্ছে জোনাকি গিলে ফেলা একটি কোলাব্যাঙের আলো-ঝলমলে হাগু। Poetry is the luminous excrement of a toad that has swallowed a firefly.
আলো ঝলমল করে উঠলো। মনে পড়লো, এখন প্রশান্ত মহাসাগরে মেলানেশিয়ান দ্বীপগুলোয় একে একে ভোর হচ্ছে। কুয়াশামাখা শব্দহীন ভোর। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ, ভানুয়াতু, সলোমন আইল্যান্ডস, পাপুয়া নিউগিনি।
আমি বললাম– ভেবে দেখুন, এখন হাওয়াই দ্বীপে রাতের আঁধার ভেঙে জেগে উঠছে ‘মাউনা লোয়া’ নামে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সেই বিশাল আগ্নেয়গিরিটা। তার তপ্ত লাভার উদ্গিরণ। বৃষ্টির মতো ছাই ঝরে পড়ছে, ভাবুন। প্রো বললেন– আমার ভয় করে। ওই আগ্নেয়গিরিটা থেকে অনেক দূরে থাকতে চাই। গরম আমার একটুও সহ্য হয় না।
আমি বললাম– ভেবে দেখুন, ভয়ংকর খাদের ধার ঘেঁষে বেঢপ বেঁকা নড়বড়ে ট্রাইসাইকলস চেপে নক্ষত্রালোকে পোলো খেলছে হাজার হাজার পার্থিব নরনারীরা। প্রো বললেন– আমার বড্ড ভয় করে। স্পর্শ করলে দেখি, তাঁর হাতের আঙুলগুলো হিম।
আমি বললাম, আচ্ছা তাহলে ভাবুন, অ্যামি ওয়াইনহাউস মরেনি, সে ফিরে এসেছে। বঙ্গোপসাগর দিয়ে, জলপথে।
প্রো এবার অবাক হলেন। পরলোক থেকে ফিরে আসছে অ্যামি? কিন্তু জলপথে কেন? আমি বললাম, ওরা অনেক আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রলোক থেকে, যে রাশিতে ওর জন্ম হয়েছিল সেই অঞ্চল থেকে, মহাকাশযানে এসে অ্যামিকে একটা ক্যাপসুলে করে নামিয়ে দিয়ে গেছে। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের কাছে, সমুদ্রে। সেখান থেকে ফুলসাজে সেজে একটা সাম্পানে চড়ে, সাগরদ্বীপ, স্যান্ডহেড, আপার-গ্যাস্কার পেরিয়ে, আজ সে গার্ডেনরিচ লকগেটের কাছে এসে দাঁড়াবে। মনে আছে সেই গানটা? -I’ve been bad, but when I come back, you’ll know know know’! প্রো বললেন, ওর গান আমার খুব প্রিয়।
প্রশ্ন করেছে চারকোল বার্নার্সদের লিড ভোকাল ছেলেটা, যার নাম বেবি। বেবির প্রশ্ন: ছবির শেষে কি আবার একটা সূর্যোদয় দেখা যাবে? ঠনঠনিয়ায়, ছাতুবাবুর বাজারে, আবার কি একটা নতুন দিনের ভোর? মিছিলে কি আবারও গণসঙ্গীত? -বেবি ওড়িশার ছেলে, বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করে। বলেছিল, ওদের গিটারিস্টের পূর্বপুরুষরা জঙ্গল ইজারা নিয়ে কাঠকয়লা বানাতেন। বড় বড় চুল্লি ছিলো কাঠ পোড়ানোর। ঘোড়াগাড়ি ছিল। সেই থেকে চারকোল বার্নার্স। ধুপ শুধু গন্ধ ঢালে, আর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। শীতার্তকে উত্তাপ দেয় না। কাঠকয়লার বেলা তা নয়। কাঠের চেয়েও সে অনেক বেশি, প্রচন্ড তাপ সৃষ্টি করতে পারে। কাঠের খুব নিয়ন্ত্রিত দহণে তৈরি করা হয় কাঠকয়লা। কবেকার এইসব আবিস্কার! গিটারিস্ট বলেছিল।
*
একটা রচনাকে, ছবিকে, সৃষ্টিকে অনেক ভাবেই ইন্টারপ্রেট করা যায়। একটা কাজ, যার মূলে থাকে একটা আইডিয়া, একটা কনসেপ্ট। মেটামর্ফোসিস গল্পের গ্রেগর সামসা-র ইন্টারপ্রিটেশানও অনেকে অনেকদিক দিয়েই করেছেন। ধর্মীয়, সামাজিক এবং মনোস্তাত্বিক- নানা ভাবে। সমসাময়িক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষিতে। কেউ আবার কাফকার পিতার চরিত্রের প্রভাব বিশ্লেষণও করেছেন। ভ্লাদিমির নবোকভ নাকি এসব খারিজ করে দিয়েছিলেন। তিনি কোনও সিম্বলিজমের মধ্যে ঢুকতেই চাননি। বলেছিলেন, আমাকে বরং মুগ্ধ করেছে অস্তিত্বের সংকট নিয়ে কাফকার ভাবনা, তাঁর কলমের কল্পনার রহস্যময় সৌন্দর্য ও লিখনশৈলীর কারুকাজের স্বচ্ছতা।
আজ স্বদেশ সেনের ডায়েরি পড়ছি। লিখেছেন—‘আমরা যেমন কমলালেবু খেয়েছিলাম বরাইবুরুতে, শীত-লাগা এক বারান্দায়। সেই ভোরবেলা, যখন টিলার ঢাল বেয়ে সেগুন জঙ্গলের চোরাপথ দিয়ে গলায় ঘন্টাবাঁধা ছাগলের পাল তাড়িয়ে নিয়ে আনছিল এক বাহাদুর ছেলে, সেই এক মেলানো ঘন্টার শব্দে যেন কি এক পরানিসর্গ জোড়া উলু বাজছিল, সেই তখন আমরা ! …তারপর একদিন দেওয়ালের অন্ধকার ভেঙে আমরা যখন মাঝরাতে সমুদ্রে গিয়ে পড়েছিলাম। সেসব কথা তুমি একদিন লিখো শংকর’।
কখনও আমার মনে হয়, কিছুই আর লেখার নেই। এবং অনেক কিছু হয়তো লেখাও যায় না, যেমন সেই মাঝরাতের সমুদ্র। লিখতে গেলেই চোখের পলক পড়ে, নড়ে যায়, ত্রস্ত হয় রেখা।
পরমা আইল্যান্ড থেকে অনেকটা এগিয়ে, রাজারহাট নিউটাউনের চৌরাস্তার মাঝখানে, মাটি থেকে ১৮০-ফুট উঁচুতে যে আকাশ-রেস্তোরাঁ, তার গোলাকার গ্যালারির একান্তে, একা বসে আছি। রাতের দিকে কিছুটা ভিড় হতেও পারে উচ্চতালোভীদের। যদি ভিড় হয় তবে আমি চলে যাবো। ভিড় ভালো লাগে না। বইমেলা ভালো লাগে না। যে পত্রিকায় দেড়শোজন লেখে, সেখানে লিখতে ইচ্ছে করে না। সন্ধ্যে হয়ে আসছে, আর আমি অপেক্ষা করছি। মানবজীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় কেটে যায় অপেক্ষায়। আজ আসবেন ছবির প্রো, তাঁর সম্মতি অথবা অসম্মতি জানাতে। হলুদ কটন শাড়ি, গোলাপি লিপস্টিক, শ্যানেল নাম্বার ফাইভ। কপালে হাল্কা মেরুন রঙে আঁকা তৃতীয় চোখ। আসবে বার্নার্সদের দুতিনজন এবং সেই দুই মৃগনয়নী। কসবা থেকে আসবে নার্সিসাস এবং ইকো। আর আসবে স্কারলেট ফ্লাওয়ার্স আর গভীর মল্লিকার কবিরা। অ্যামি ওয়াইনহাউস যদি আজ সত্যি আসতো। ছমছম বেজে উঠতো তার কঙ্কণ, নূপুর।
আমাকে অবাক করে গতকাল প্রো বলেছিলেন, যেকোনও ছবি বা রচনার শুধু কনটেন্ট নয়, তার কনসেপ্ট ও স্টাইলাইজেশানেরও কপিরাইট হওয়া দরকার। -ওঁর মনে হয়েছিল। আমাকে আজ ওয়েটার বসিয়ে গেছে বৃত্তাকার আকাশি ব্রীজের একদিকের একটা টেবিলে।
ক্যামেরা রোল করছে। প্লেটে যথারীতি চিকেন কাটলেট আর টম্যাটো সস। আজও টুপি পরা দুটো নীল মাছি দূর থেকে দেখছে এদিকে। যায়গাটা আমার খুব পছন্দের নয়। আমি চেয়েছিলাম মাঝখানে, যেখান থেকে চতুর্দিক দেখা যায়। ওয়েটার বললো, টেবিল ছেড়ে গ্যালারিতে একটূ ঘুরে আসুন, দশদিকই দেখা যাবে। এইতো বাঁদিকে সূর্যাস্ত দেখলেন, ওইদিকেই বেথলা, বরাইবুরু। উল্টোদিকে যান, একটু পরেই চাঁদ উঠেছে দেখবেন। ওইদিকেই চাঁদিপুর, সাগরদ্বীপ, স্যান্ড হেড। আর এইদিকের আকাশে তাকালে আজ ইউরেনাস গ্রহকে দেখতে পাবেন, আমি বাইনোকুলার এনে দিচ্ছি। আর এইদিক দিয়ে উঠে আসবে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি, যার মাঝখানে ব্ল্যাকহোলের নাম গভীর মল্লিকা। দক্ষিণপূর্বে আছে মাউনা লোয়া আগ্নেয়গিরি, দক্ষিণপশ্চিমে গুয়ান্তানামো বন্দিশালা। উত্তরপূর্বে তিয়ানানমেন স্কোয়ার। উত্তরপশ্চিমে শাহিনবাগ, বোধিবৃক্ষ। সব এখান থেকেই দেখা যায়। ওপরের আকাশে পাবেন ক্যাসিওপিয়া, সপ্তর্ষিমন্ডল। আপনি অরুন্ধতিকে চেনেন? সপ্তর্ষির মধ্যে চতুর্থ, তাকেও দেখা যাবে। একটু বাঁদিকে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি। এপাশে কালপুরুষ, অরিয়ন নেবুলা। সবদিকই দেখা যাবে। কোথাও কোনও সীমারেখা নেই। ওপেনএন্ডেড। আপনি এই যে কাফে একান্তে বসে রয়েছেন, এটা ব্রহ্মান্ডের ঠিক মাঝখানে আছে। কাফ্কার প্রাগ শহরটাও ছিল এরকম, ব্রহ্মান্ডের ঠিক মাঝখানে। ভেবে দেখুন, আপনি আছেন বিশাল ব্রহ্মান্ডের একেবারে ঠিক মাঝখানটিতে। আমিও আছি। আমরা সব্বাই। কী ভীষণ সুবিধে, এইরকম ব্রহ্মান্ডের ঠিক মাঝখানে থাকতে পারাটা। সব উত্থান পতন নির্বাণ এইখান থেকে দেখা যায়। ভীষণ সুবিধে। …একটু অপেক্ষা করুন। ঠিক সময়ে ঠিক লোকেরা এসে যাবে। আমি কফি এনে দিচ্ছি।
-কাট।
Posted in: PROSE, September 2020 - Cover Story