মহাকাশ, মহাবিশ্ব : শংকর লাহিড়ী
[বিস্ময় আর খোঁজ মানুষের এই দুটো গুণই ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে মানব সভ্যতার। নিজের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ও তারই মাঝে নিজের আপাত অবস্থানকে চিনে নিতে চেয়েছে সে চিরকাল। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পেরেছি আমাদের পৃথিবীকে, তারপর পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ, মহাবিশ্ব। কত অজানা খবর, কত আবিষ্কার ঘটে চলেছে দিনের পর দিন। সেই সমস্ত কথা নিয়েই এবার কলম ধরলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, চিত্র-পরিচালক ও প্রকৌশলী শংকর লাহিড়ী। কসমোলজি নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ও জ্ঞানের কথা অনেকেই জানেন। যে দক্ষ শৈল্পিক ভঙ্গিতে তিনি এই সমস্ত জটিল তত্ত্ব ও আবিষ্কারের কথা লেখেন তার সাথে ইতিমধ্যেই অনেক পাঠক পরিচিত। শুরু হলো অপরজনের নতুন ধারাবাহিক বিভাগ – “মহাকাশ মহাবিশ্ব”।]
৪
যে দেশে রজনী নেই মা :
বাঙালি কবি এমনই গান লিখেছিলেন, কোনকালে। কিন্তু আমার মনে পড়ছে মায়ের কথা। আমার মামার বাড়ি ছিল জামশেদপুরে। মা সেকালের ম্যাট্রিক পাস। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে, ওখানকার ‘ডি এম ম্যাডান’-স্কুল থেকে মা ম্যাট্রিক পাশ করেছিল, সেটা বোধহয় ১৯৪৬ সাল। তার বেশি আর পড়া হয়নি, বিয়ে হয়ে গেছিল। মার সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ছিল ভূগোল, আর চিরদিন সঙ্গের সাথী ছিল পৃথিবীর মানচিত্রের রঙীন বই।
কর্মজীবনে আমি যখনই দেশবিদেশে গিয়েছি, মা বসে যেত মানচিত্র নিয়ে ; দেখত আমি কোন পথে কোন পাহাড় নদী সমুদ্র শহরের ওপর দিয়ে চলেছি। মার কাছে আমি পেয়েছিলাম জলবায়ুর প্রথম পাঠ, কখন কেমন বায়ুপ্রবাহ, জলস্রোত, কাকে বলে গর্জনশীল চল্লিশা, কোথায় আছে কর্কটক্রান্তি আর মকরক্রান্তি রেখা। পৃথিবীর অক্ষরেখা একদিকে ঝুঁকে থাকার জন্য কিভাবে ঋতু পরিবর্তন হয়, প্রকৃতিতে শীত আসে, গ্রীষ্ম আসে, মেরু অঞ্চলে ছমাস ধরে আলো থাকে রাতের আকাশে।
মা ঠিক বলে দিত বছরের কোন সময় দিন সবচেয়ে বড় হয়, আর কখন দিন রাত সমান সমান। মাত্র কদিন আগে, এবছর ২২ সেপ্টেম্বর ছিল তেমনই একটা দিন, যাকে ইকুইনক্স বলা হয়, যেদিন সূর্য থাকে বিষুবরেখা অর্থাৎ ইকোয়েটরের ঠিক মাথার ওপরে। বছরে দু’বার-আসা ইকুইনক্সের সেই তারিখদুটোয় (সাধারণতঃ শরৎকালের ২২ সেপ্টেম্বর ও বসন্তের ২১ মার্চ) দিন ও রাতের দৈর্ঘ্য সমান সমান। পৃথিবীর গতিবেগ ও চলার ছন্দের হেরফেরে, প্রতি বছর অবশ্য সামান্য তফাত হতে পারে তারিখ দুটোতেই।
আর জুন মাসের ২১ তারিখে আমাদের এই উত্তর গোলার্ধে হয় দীর্ঘতম দিন (summer solstice in the northern hemisphere)। সূর্য তখন উত্তরায়নে, পৃথিবীর অক্ষরেখা তখন সূর্যের দিকে হেলে থাকে। দুই ইকুইনক্সের মাঝে সেই দীর্ঘকাল, প্রায় ছ’মাস, উত্তরমেরু অঞ্চলের দেশগুলোকে সারারাত রৌদ্রালোকিত দেখা যায়। আর্কটিক সার্কেলের উত্তরে তো বটেই, এমনকি তার দক্ষিণের কানাডা, নরওয়ে, সুইডেন, আলাস্কার দেশগুলোতেও কিছুটা। দীর্ঘ ছ’মাস ধরে সেসব দেশে সত্যিই রজনী নেই।
নীচের লিঙ্কে ভিডিওতে দেখা যাবে, উত্তর গোলার্ধের গ্রীষ্মকালের সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্য, যখন মেরু অঞ্চলে প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই দেখা যাচ্ছে সূর্যকে। পৃথিবীর উত্তরে আর্কটিক সার্কেলের কাছে কানাডার ফেয়ারব্যাঙ্কস শহরে পুরো একদিনের ছবি। দেখা যাচ্ছে সূর্যাস্তের পরেও সারারাত ধরে দিনের আলোয় ভাসছে দিগন্ত। ‘রাত’ শেষ হলে আবার সূর্য উঠছে।
নীচে স্থিরচিত্রে, আর্কটিক সার্কেলের কাছে আলাস্কায় মাঝরাতের রেলগাড়ি ; সারারাত আলোয় ভাসছে প্রকৃতি!
এর পরবর্তী ছ’মাস আবার উত্তরমেরু অঞ্চলে শীত নেমে এলে শুরু হয় দীর্ঘকালীন রাত্রি। ডিসেম্বর মাসের ২১ তারিখে উত্তর গোলার্ধে দিন হয় সবচেয়ে ছোট এবং রাত দীর্ঘতম (winter solstice in the northern hemisphere)।
মহাকাশ ও মহাবিশ্ব নিয়ে ধারণাকে একটু স্পষ্ট করতে হলে কিছুটা ত্রিমাত্রিক জ্যামিতি ও তার দৃশ্যকল্পকে আয়ত্ত করা দরকার। এই ভিশুয়ালাইজেশান করতে পারাটা সহজসাধ্য নয়। বস্তুতঃ শুরুতেই সৌরমন্ডলে বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহের অবস্থান, এবং সূর্যকে ঘিরে তাদের গতিবেগ ও কক্ষপথকে একটু ভালোভাবে বুঝে নেওয়া অত্যন্ত জরুরী। এটা না হলে, মহাকাশের বিভিন্ন বিষয় বুঝতে ও আলোচনা করতে অসুবিধে হবে। এই বোঝাবুঝির জন্যে কিছু ছবিকে মনোযোগ দিয়ে দেখা যাক। বিষয়টি আমার কাছেও জটিল। প্রতিদিনই বিজ্ঞানীরা জানতে পারছেন নতুন অনেক কিছু। সেভাবেই নতুন করে রূপরেখা তৈরী হচ্ছে ব্রহ্মান্ডেরও।
আমাদের সৌরমণ্ডল যে নক্ষত্রপুঞ্জ বা গ্যালাক্সির মধ্যে অবস্থান করছে, তার নাম ছায়াপথ বা, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি, যাতে প্রায় চল্লিশ হাজার কোটি নক্ষত্রমন্ডল আছে। এটা একটা ঘুর্ণায়মান স্পাইরাল গ্যালাক্সি, যার মধ্যখানে একটা অংশ চকোলেট বারের মতো, তাই একে বারড স্পাইরাল গ্যালাক্সি (Barred Spiral Galaxy) বলা হয়। এর মধ্যের অংশটি কিছুটা স্ফীতকায় (bulge)। এর সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় ১৩৫১ কোটি বছর আগে, অর্থাৎ ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির শুরুর দিকে, মাত্র তিরিশ কোটি বছর পরেই। এর আয়তন একটা ঈষৎ গোলাকার ডিশের মতো, যার ব্যাস প্রায় ১,০৫,০০০ আলোকবর্ষ, যার কেন্দ্রে আছে একটা অতিকায় কৃষ্ণ গহ্বর। ওই ডিশটাও ঠিক সমতল নয়, ওর মধ্যেও একটু ওয়ার্প আছে। একটা পাশ একটু নীচের দিকে, এবং অন্য পাশ একটু ওপরের দিকে বাঁকানো। এই ঘূর্ণায়মান ডিশকে বলা হয় ‘গ্যালাক্টিক প্লেন’। এর ওপরে ৯০ ডিগ্রি লম্বরেখা টানলে গ্যালাক্সির অক্ষরেখা পাওয়া যায়, যাকে ঘিরে সম্পূর্ণ গ্যালাক্সিটা ঘুরছে। এই রেখার ওপরের দিকে হচ্ছে গ্যলাক্সির উত্তর মেরু, আর নীচের দিকে দক্ষিণ মেরু। এই ডিশের ভেতরে অনেকগুলো বাহু আছে, (Spiral Arms) তার মধ্যে একটি ছোট বাহু, যার নাম অরিয়ন, তারই মধ্যে রয়েছে আমাদের সমগ্র সৌরমন্ডল। গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে অরিয়ন বাহুতে স্থিত আমাদের সূর্যের দূরত্ব প্রায় ২৬,০০০ আলোকবর্ষ।
এই ঘুরন্ত গ্যালাক্সির মধ্যের ‘বার’ অংশটা নিজের অক্ষে একবার পুরোটা ঘুরতে সময় নেয় প্রায় ১২ কোটি বছর। আর গ্যালাক্সির সেই অক্ষকে একবার সম্পূর্ণ ঘুরে নিতে আমাদের সৌরমন্ডলের (ছবিতে লাল রঙের বিন্দুটির মধ্যেই আছে সমগ্র সৌরমন্ডল) সময় লাগে প্রায় ২৪ কোটি বছর।
মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি নিয়ে পরে আরও আলোচনা করা যাবে। এবার বরং নজরে রাখা যাক আমাদের প্রিয় সৌরমন্ডলটিকে। গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে ঘিরে সৌরমন্ডলের এই ঘোরাটাও তাহলে সহজ বৃত্তাকার পথে নয়, সে চলেছে ওপরে-নীচে ওঠানামা করতে করতে, যেন একটা ঢেউয়ের তরঙ্গে ওঠানামা করে ভেসে চলেছে। এই ওপরে-নীচে ওঠা নামা করার মধ্যে দূরত্ব প্রায় একশো আলোকবর্ষ।
এবারে তবে কল্পনা করা যাক যে, ছাব্বিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরের একটি কেন্দ্রবিন্দুকে ঘিরে ঘুরে চলেছে আমাদের সূর্য, যে আবার নিজের অক্ষের চারপাশেও ঘুরছে। এবং একটা বলের মতো ওপর-নীচে লাফিয়ে লাফিয়ে সে ঘুরে যাচ্ছে, গ্যালাক্সির অরিয়ন বাহুতে অবস্থিত হয়ে, অন্যান্য কোটি কোটি নক্ষত্রের মধ্যে সেও একজন। আর এই সূর্যকে ঘিরে, একটি তলে থেকে, যাকে বলে এক্লিপ্টিক প্লেন, ঘুরে চলেছে পৃথিবী ও সৌরমন্ডলের অন্য সব গ্রহ উপগ্রহরা। সূর্যের যাত্রাপথকে স্ক্রুর মতো পেঁচিয়ে তারা নিজ নিজ কক্ষপথ ধরে ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে চলেছে। নীচের ছবিটা থেকে বোঝা যেতে পারে কিছুটা।
তবে এর চেয়েও সঠিক ছবিটা আমি এঁকেছি নীচে, যেখানে সূর্যের নিজের ওপরে-নীচে ওঠানামাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এবং তাকে ঘিরে ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে চলেছে অন্যান্য গ্রহরা, একটা স্ক্রুয়ের প্যাঁচের মতোই।
তবে আপাততঃ আলোচনার সুবিধের জন্যে আমরা এক্লিপ্টিক প্লেনে ফিরে আসি। যেখানে সূর্য রয়েছে প্লেটের মধ্যিখানে, আর তার চারপাশে উপবৃত্তাকার পথে ঘুরছে প্রধানতঃ আটটা গ্রহ। সূর্য থেকে পরপর, ক্রমশঃ দূরে রয়েছে চারটি গ্রহ, তারপর কয়েক লক্ষ গ্রহাণু, এবং তারপর বাকি চারটে গ্রহ। এরা সূর্য থেকে বহু দূরে আছে বলে হিমশীতল, এবং প্রধানতঃ গ্যাস জায়ান্ট, তাই মানুষের কখনও সেখানে অবতরণ করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, সূর্য থেকে শুরু করে পরপর আছে– বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, গ্রহাণু বলয়, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন। মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যে যে প্রধান গ্রহাণু বলয় (Main Asteroid Belt), তার মধ্যে সবচেয়ে বড় বামন (Dwarf) গ্রহটির নাম সেরিস (Ceres), যার ব্যাস প্রায় ৯৩৯ কিলোমিটার। এই বলয়ের মধ্যেই আছে পন্ডিত যশরাজ নামের ছোট্ট গ্রহটিও (Small/Dwarf Planet), যার কথা আগে লিখেছি। আছে এমন আরও অনেক ছোট্ট গ্রহ, যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে অনেক দেশি বিদেশী বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞের নামে। এছাড়াও আছে সিক্সটিন সাইকি নামের সেই বহুমূল্য ধাতব গ্রহাণু এবং রাইউগু নামের সেই ক্ষুদ্র গ্রহাণুটি, যার কথা আগের পর্বে লিখেছি, যার ওপরে সম্প্রতি জাপানের একটি মহাকাশযান অবতরণ করে মাটিপাথরের নমুনা সংগ্রহ করে, এখন পৃথিবীর পথে রওনা দিয়েছে। সৌরমন্ডলের শেষ প্রান্তে আছে আরও অনেক বিস্তৃত এক বিশাল বলয়, যাকে বলা হয় কাইপার বেল্ট (Kuiper Belt)। সেই অতিদূর ও হিমশীতল বলয়ে রয়েছে কয়েক কোটি গ্রহাণু ও ধুমকেতু, যারা প্রতি চার-পাঁচ হাজার বছর পর একবার এসে দেখা দিয়ে যায় পৃথিবীর আকাশে।
নেপচুনের পরে প্রান্তসীমায় অবস্থিত প্লুটোকে যে আর নবম গ্রহ বলা হয় না, তার একটা কারণ প্লুটো আছে নেপচুনের কক্ষপথ পেরিয়ে, এই কাইপার বেল্টে, যেখানে তার মতো আকারের আরও অনেক গ্রহাণু (TNO : Trans Neptunian Objects) রয়েছে, যাদের গ্রহের মর্যাদা দেওয়া যায় না। কারণ এদের চালচলনও ঠিক গ্রহের মতো নয়। সূর্যকে প্রধান আটটি গ্রহ প্রদক্ষিণ করে চলেছে যে কক্ষপথগুলোতে, তারা সবাই প্রায় একটা সমতলে রয়েছে। এর মধ্যে পৃথিবী যে কক্ষপথে ঘোরে, তারই তলকে বলা হয় এক্লিপ্টিক প্লেন (Ecliptic Plane)। অন্যরা সবাই প্রায় এই তলেই আছে। কিন্তু প্লেটো যে কক্ষপথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, তা একটা লম্বাটে দীর্ঘ উপবৃত্ত, যা সূর্য-পৃথিবীর এক্লিপ্টিক প্লেনকে প্রায় ১৭ ডিগ্রী কোণে ছেদ করেছে।
নীচে ছবিতে আছে প্লুটোর মতোই অন্য ছোট্ট গ্রহরা, যারা ডোয়ার্ফ প্ল্যানেট। তারা প্লুটোর মতো, তাই এখন থেকে তাদের ‘প্লুটোয়েড’-ও বলা হয়। এরা আছে কাইপার বেল্টে, যা প্রায় একটা চ্যাপ্টা ডিস্কের মতোই। এক্লিপ্টিক প্লেনের মতো একই সমতলে রয়েছে সেও। এটা চওড়ায় প্রায় ৩০০ কোটি কিলোমিটার, যার প্রান্তসীমাটি রয়েছে সূর্য থেকে ৭৫০ কোটি কিলোমিটার দূরে (৫০ সূ-পৃ / 50 AU)। নীচে ছবিতে সেই কাইপার বেল্ট।
একে দূর থেকে দেখে বেশ ঘন সংবদ্ধ মনে হলেও, এর এক একটি গ্রহাণুর মধ্যে রয়েছে প্রায় কয়েক লক্ষ কিলোমিটারের ব্যবধান, যার মধ্য দিয়ে স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারে পৃথিবী থেকে পাঠানো ভয়েজারের মতো কৃত্রিম উপগ্রহরা।
নীচের ছবিতে রয়েছে পাঁচটা ডোয়ার্ফ প্ল্যানেটের ছবি ও তাদের আয়তন ইত্যাদি। পাশে রইল পৃথিবীর ছবি, যাতে তুলনা করতে পারা যায়। এখানে সেরিস বাদে আর সবাই প্লুটোয়েড, তারা রয়েছে কাইপার বেল্টে। কিন্তু সেরিস আছে মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝখানে মেইন অ্যাস্টোরয়েড বেল্ট বা গ্রহাণু বলয়ে।
কাইপার বেল্টের পরে, সৌরমন্ডলের (Heliosphere) সীমার বাইরে আছে আরেকটি সংগঠন, যাকে বলা হয় ঊর্ট ক্লাউড (Oort Cloud)। এটা একটা বিশাল পুরু গোলক, যা ঘিরে রেখেছে সমগ্র সৌরমন্ডলকে। অতি শীতল (প্রায় -২৫০ ডিগ্রি) বরফের টুকরো দিয়ে গঠিত এই গোলক, যার মধ্যে সম্ভবত রয়েছে অনেক ধুমকেতুও। প্রচন্ড ঠান্ডায় মিথেন, জল ও অ্যামোনিয়া জমে খন্ড খন্ড পাথর হয়ে তৈরি করেছে এই গোলক। সূর্য থেকে আনুমানিক ৭৫ হাজার কোটি কিলোমিটার দূরে শুরু হয়ে, শেষ হয়েছে ১৫ লক্ষ কোটি কিলোমিটার দূরে। একটি অতীব হিমশীতল বিশাল গোলক এই ঊর্ট ক্লাউড, যার কেন্দ্রে অবস্থান করছে সমগ্র সৌরজগত। ঊর্ট ক্লাউডকে সরাসরি কোনও টেলিস্কোপে দেখা যায়না, তবে বিভিন্ন ধুমকেতুর আচরণ ও কক্ষপথ দেখে এর অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছেন বিজ্ঞানীরা (নীচে ছবি)।
১৯৭৭ সালে নাসার উৎক্ষিপ্ত ভয়েজার-১ উপগ্রহটি সম্প্রতি আমাদের সৌরমন্ডলের প্রান্তসীমা (হেলিয়োস্ফিয়ার) পার হয়ে প্রবেশ করেছে ঊর্ট ক্লাউডের একটি অংশে। একে সম্পূর্ণ পেরিয়ে যেতে ভয়েজারের লেগে যাবে আরও অন্তত তিরিশ হাজার বছর। তারপরে সে প্রবেশ করবে আন্তর্নক্ষত্র জগতের (Intergalactic Space) মুক্তাঞ্চলে।
*
তবে বিজ্ঞানীদের অনেকদিন ধরেই মনে হয়েছে, নবম গ্রহ থেকে প্লুটোর নাম কাটা যাওয়ার আগে থেকেই, যে আরেকটা বড় মাপের গ্রহ বোধহয় রয়েছে কোথাও এই সৌরমন্ডলে, যাকে আমরা কেউ খুঁজেই পাচ্ছি না, যদি পাই তবে সে-ই হবে প্রকৃত নবম গ্রহ। কিন্তু এমনটা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মনে হয়েছে কেন?
প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বে, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে আছে বিখ্যাত কয়েকটি অবজারভেটরি। এখানকার টেলিস্কোপ দিয়েই প্রথম জানা গিয়েছিল কাইপার বেল্টের কথা। এই কাইপার বেল্টের দিকে দীর্ঘদিন নজর রেখে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছিলেন কিছু গোলমেলে ব্যাপার। দুজন বিজ্ঞানী, কনস্টান্টিন বেটিজিন এবং মাইক ব্রাউন, ২০১৬ সালে নজর করেন ওই কাইপার বেল্টের ১৫-১৬ টি গ্রহাণুর বিস্ময়কর চালচলন। তাদের কক্ষপথ দেখে মনে হয়, যেন ভীষণ কোনও মাধ্যাকর্ষণ বল তাদের চালিত করছে, ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে বিচিত্র পথে। তাদের কেউ কেউ খাড়া উলম্ব অথবা কৌণিক কক্ষপথে ঘুরছে, যা সৌরমন্ডলের এক্লিপ্টিক তলের মতো নয়। এদের মধ্যে কেউ আবার সূর্যমুখীও নয়। তাদের কক্ষপথ বিপরীত দিকে অর্থাৎ, কাইপার বেল্টের বাইরের দিকে প্রসারিত। বিজ্ঞানীরা মনে করলেন, নিশ্চয়ই ওদের কাছেপিঠে রয়েছে কোনও বিরাট একটা নবম গ্রহ, যার আকর্ষণেই এমনটা ঘটছে। কারণ প্রচন্ড মাধ্যাকর্ষণ বল ছাড়া তো এমনটা হতেই পারে না। কিন্তু সেই নবম গ্রহকে তাহলে দেখা যাচ্ছে না কেন? নীচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, কাইপার বেল্টের অনেকগুলো গ্রহাণুর এমনই বিচিত্র কক্ষপথ। যাকে কেন্দ্র করে তারা ঘুরছে, সে তো সূর্য নয়, অন্য কোনও বড় শক্তিধর। সে কি তবে কোনও নবম গ্রহ ?
মাত্র কিছুদিন আগে, ২০১৯ সালের শেষদিকে, বিজ্ঞানী জেমস আনুইন এবং জাকুব শোলজ জানিয়েছেন যে খুব সম্ভব এই নবম গ্রহটি আসলে একটি আদিম কৃষ্ণ গহ্বর (PBH : Primordial Black Hole), যে আছে পৃথিবী থেকে আনুমানিক ৮০০০ কোটি কিলোমিটার দূরে, কাইপার বেল্টের ওপারে। আকারে সে হয়তো একটা ছোট্ট টেনিস বলের মতোই, কিন্তু তার ভর প্রায় দশটা পৃথিবীর সমান, তাই তার মাধ্যাকর্ষণ প্রবল। এমন ছোট ছোট ব্ল্যাকহোল সারা ব্রহ্মান্ড জুড়ে কোটি কোটি ছড়ানো আছে, সৃষ্টির প্রায় শুরু থেকেই।
এতক্ষণে আমাদের সৌরমন্ডলের আয়তন এবং মিল্কিওয়ে-ছায়াপথে তার অবস্থান কিছুটা বোঝা গেল। এবার আরেকটু জটিলতার মধ্যে ঢুকতে হবে। যদি স্থানাঙ্ক জ্যামিতি এবং ত্রিমাত্রিক স্পেসের কল্পনাশক্তি একটু ভালো হয়, তাহলে বোঝা সহজ হতে পারে বিভিন্ন গ্রহের চালচলন। বোঝা যাবে কীভাবে ঋতু পরিবর্তন হয়, জোয়ার ভাটা খেলে সমুদ্রে, নদীতে ; কীভাবে গ্রহণ লাগে সূর্যে, চাঁদে। এই নিয়ে আগামী পর্বে আলোচনা করা যাবে।
Posted in: PROSE, September 2020 - Serial