চাতকপুর : সেঁজুতি দত্ত
গ্রামটির নাম চাতকপুর। স্বাধীন ভারতের ম্যাপে এই জায়গার উল্লেখ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেশভাগের সময় তথাকথিত র্যাডক্লিফ লাইন এই গ্রামটিকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়। তারপর থেকে এই গ্রামের নাম এবং স্মৃতি ভারত বা বাংলাদেশ কোথাও উচ্চারিত হয় না। আবার এও বলা যায় যে এই গ্রামটির কথা এখন আর কেউ জানেই না। পাঠিকা তাই বলে ভাববেন না যে দেশভাগের হেতু গ্রামটি তার সংস্পর্শে থাকা এপার বা ওপারের গ্রামগুলোর সাথে মিশে গেছে। বরং যা হয়েছে তা ঠিক উল্টো। গ্রামটি হারিয়ে গেছে।
চাতকপুরের লাগোয়া অন্যান্য অঞ্চলগুলোও এই গ্রামের কথা আর মনে রাখেনি। ভুলে গেছে বললেই ঠিক বলা হবে হয়ত। আবার এই ভুলে যাওয়াও অদ্ভুত। অনেকদিন কোনো জায়গার নাম উচ্চারিত না হলে যে ধরণের ভুলে যাওয়া তৈরি হয়, এ ঠিক সেরকম নয়। সময়ের সাথে কিছু পুরাতন স্থান যেমন অভিনব হয়ে ওঠে এবং সেই অভিনবত্বের ভারে প্রারম্ভিক অর্থগুলোও চাপা পড়ে যেতে থাকে, এ ক্ষেত্রে সেটিও ঘটেনি। একদিন হঠাৎ করেই সকলের অলক্ষ্যে গ্রামটি হারিয়ে যায়। আর ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে কেউ সেটা খেয়ালও করল না। একটা লোকও হা-পিত্যেস করল না।
এই যে গ্রামটি নেই; একটা গোটা গ্রাম, তার বসতি, মানুষজন, বাজার, বাড়িঘর, কিচ্ছুটি নেই সেদিকে কারো নজরই গেল না। শুধু হঠাৎ একদিন আশেপাশের গ্রামের মানুষজন দেখলেন তাদের পাড়ার কুকুরগুলো বেজায় অস্থির। রাত হলেই এরা ডুকরে ডুকরে কাঁদে। যেন প্রিয়জনের অন্তিম লগ্ন উপলব্ধি করেছে। তাদের কান্নার আওয়াজে পাড়া পড়শির ঘুমের ব্যাঘাত হয়। কেউ ঢিল ছোড়ে তো কেউ শীতের রাতে গায়ে ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেয়, আবার কেউ কেউ লাঠি দিয়ে দোর পিটিয়ে আওয়াজ করে ওদের তাড়াবার চেষ্টা করে। এর মধ্যেও কিছু সজ্জন মানুষ কুকুরগুলোকে আদর করে উঠোনে শুতে দিল, এঁটো ভাত খেতে দিল, কিন্তু এই মরা কান্না আর থামে না।
ওদিকে সব শোকেরই শেষ আছে। নতুন ভাদ্রে মেয়ে কুকুরগুলো পোয়াতি হয়, বাচ্চা দেয়, বাচ্চা গুলোও ধীরে ধীরে বড় হয় এবং তাদের সাথে সাথে পুরনো দেশের কথাও গল্প হয়ে যায়। মা কুকুরগুলো এখন আর অকারণে কাঁদে না। খাবার যোগাড় করে বাচ্চা বাঁচিয়ে রাখাই তাদের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ালো। বাপেরা সব বীরপুরুষ তাই ছানাগুলো বড় হবার সাথে সাথেই লেগে গেল এলাকা দখলের লড়াই। আর সব শেষে যখন স্থিতি আসে, তখন কোনো এক বুড়ো কুকুর মাঝে মাঝে সেই হারিয়ে যাওয়া গ্রামের গল্প বলে নতুন প্রজন্মকে স্বপ্নের দেশে পাঠায়।
এভাবে শুধু কুকুরদের মনের মধ্যেই চাতকপুরের স্মৃতি আটকে থাকে। সময় কাটতে থাকে, বুড়ো কুকুরগুলোও মরে, কিন্তু গল্প থাকে। কুকুরদের জগতে গল্পের মৃত্যু ঘটে না। গল্প বেঁচে থাকে বিশ্বাসে এবং সারমেয়জাত অবিশ্বাস করতে জানে না। এমন ভাবেই দিন কেটে যায়। ছানা কুকুর বড় হয়, আবার নতুন ছানা আসে, ওদিকে গল্পেও নতুন পরত পরে। কিন্তু ওই যে বললাম, ওরা অবিশ্বাস করে না। প্রত্যেকবার সবার অলক্ষ্যে একটু একটু করে গল্প পাল্টায় কিন্তু সেসব নিতান্তই আনুষঙ্গিক তাই কেউ গা করে না। এভাবে কতদিন চলল তা কেউ জানে না। কুকুরেরা তো জানেই না। ও বেচারাগুলো বাঁচেই বা ক’দিন? মানুষের জগতে যখন পঞ্চাশ বছর পার হল, কুকুরদের তখন সেটা যুগযুগান্ত। একটিও বুড়ো এমন মেলে না যে সেই সময় দেখেছে। তাই তারা থাকে তাদের গল্প নিয়ে আর মাঝে মাঝে ভাবে, এই মানুষগুলো কেন চাতকপুরের কথা বলে না? এমনি করেই আসে সেই দিন। ১৫ই আগস্ট ১৯৯৭।
বছর পাঁচেক আগে, লাগোয়া বাংলাদেশি গ্রাম থেকে এক উদ্বাস্তু পরিবার এসে আশ্রয় নেয় এই গ্রামে। এই পরিবারের ভিটেমাটি কিছু ছিল না, কিন্তু পাড়ার লোকে বলে তারা বেশ টাকাকড়ি নিয়ে এসেছিল। গ্রামের আর বাকি পরিবারগুলোর থেকে তারা বেশ স্বচ্ছল। বছর দেড়েকের মধ্যে বাজারে একটি দোকান এবং রেললাইনের পাশে জমি কিনে পাকা বাড়ি করে বেশ জাঁকিয়ে বসায় প্রথমদিকে গ্রামের সজ্জনেরা একটু বিরক্তই হয়। কিন্তু দেখতে দেখতেই সে বাড়ির বউ আর মেয়ে পাড়ায় বেশ মিলেমিশে যায় এবং খুব কম সময়ের মধ্যেই সবাই ওদের আপন করে নেয়। বাড়ির পুরুষটিও বেশ ভালো মানুষ। টুকটাক গ্রামের লোকেদের দরকার-অদরকারে সাহায্য করা, ক্লাবে চাঁদা দেওয়া, পড়শিরা কেউ অসুস্থ হলে ওষুধ কিনে দেওয়া এইসব করে উনিও বেশ খাতির জমিয়ে ফেলেন। ওদিকে ভেতরে ভেতরে চেনাশোনা কাজে লাগিয়ে রেশন কার্ড, ভোটার আই ডি কার্ড, মেয়ের বার্থ সার্টিফিকেট, সবই তৈরি করে ফেলেন ভদ্রলোক।
তারা যখন এপারে আসে তখন মেয়েটির বয়েস বছর তিনেক আর আজকে, ১৫ অগাস্ট ১৯৯৭, তার বয়েস হল আট বছর। দেশ স্বাধীনের দিন জন্মানোয় পাড়ার মা-মাসীরা ওকে আদর করে ডাকে স্বদেশী। এতে বাড়ির আর কেউ কিছু না বললেও মেয়েটির ঠাকুমার বেজায় রাগ হয়। তিনি ছেলেকে বলেন “ওই আবার কী নাম? স্বদেশী কুন নাম হইল? অশিক্ষিতের দ্যাশ একখান। জানস না স্বদেশীরা হিন্দু হয়? তর দাদাজানেরে কুপাইয়া মারসে হারামির দল। তর লিগা যে কী কী আর করবার লাগব আল্লাই জানে।” মেয়ের বাবা এসব শুনে মায়ের হাতে জোরে একটা চাপ দিয়ে চুপ করতে বলে। তা সে বুড়ি শোনবার পাত্রী কই, তিনি বলেই যান। শেষে ভদ্রলোক ঘরের দোর দিয়ে, জানালা বন্ধ করে মাকে বলেন, “হুন, বেশি কথা কইও না। এইহানে সবাই জানে আমরা হিন্দু। তুমি বিধবা মানুষ তোমার ঝামেলা নাই। কিন্তু রুবিনার মায়ে তো শাঁখা সিন্দূরও পরতেসে। ওই দ্যেশে যা হইসে তার পর এইহানে বেশি কথা কইলে হালারা আমাগো কাইট্টা ফ্যালাইবো। তুমি কি ভাবতাসো এইহানে কিছু হয় নাই? এক ঘর মুসলমানও দেখবার পাও? ওইদিকে আমরা কাটসি আর এইহানে অরা। বর্ডারের কাছের গ্রাম, মুসলমানের আত্মীয়ও তো কয়েকঘর ছিল। একটারেও দ্যাখবার পাও? সব শ্যাষ। একখান কইরা হিন্দু বাড়ির আত্মীয় ওই দ্যেশে মরসে আর হালারা এইহানে মোল্লা কাটসে। আমাগো কি কয় জানো? কাটার বাচ্চা। তাই বেশি কথা কইও না। বেশীদিন তো আর এইহানে থাকুম না। একটু টাকা পয়সা হইলেই কইলকাতা জামু। ওইহানে আমাগো কেউ চিনব না। এই জায়গায় আসল নাম কইলেই পরিচিত কেউ বাড়ায় পরব, বুঝ না? শহর থিকা নতুন কাগজপত্র করাইসি। সব আমাগো আসল নামে। এই কয়টা দিন একটু চালায়ে নাও। রুবিনা তো ছুটো ছিল তাই অরে নিয়া কুন অসুবিধা হয় নাই। কিন্তু অর আম্মার এই নূতন নাম, হিন্দু হওয়া কি ভাল্লাগসে মনে কর? কয়টা দিন ছাড়ন দ্যাও, সব ঠিক হইয়া যাইব।”
ঠাকুমা বুড়ো মানুষ, সব বোঝেন। তিনি জানেন তারা এখানে কেন এসছেন। তার একমাত্র ভাই কলকাতায় এসেছিল ব্যবসা করবে বলে। দেশভাগের সময় তিনি ওপারে যেতে রাজি হননি। ১৯৮৮ সালে তার স্ত্রী মারা যান, সন্তানহীন মামা চেয়েছিলেন ভাগ্নে এসে তার সাথে কলকাতায় থাকুক আর ব্যবসার তদারকি করুক। তা আজ যাই কাল যাই করতে করতে দেশে দাঙ্গা লাগল। আশেপাশের কয়েকটা হিন্দু পরিবারে খুন হল, বাকিরা পালিয়ে এল আর ঠিক এই সময়ে রুবিনার আব্বাও এক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল।
দাঙ্গার সময় তাদের পড়শি এক হিন্দু মেয়েকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল বলে পাড়ার ছেলেরা তাকে হুমকি দেয় যে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবে। তিনি নিজে কখনও ঝামেলায় জড়ান না। হয়ত অন্য কোন মেয়ে হলে এতটা ভাবতেনও না। কিন্তু এ যে তার বাবার মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে। মাস্টারকে তারা সবাই শ্রদ্ধা করত, আর তাই না পেরেই, অনেকটা কাঁটা গেলার মতো করে মেয়েটিকে লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু বেশীদিন পারেননি। একদিন রাতে সত্যিই ছেলেগুলো বাড়ির দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে বলেছিল, বাধা দিলে তার বউ আর এক বছরের মেয়ে কেউ বাদ যাবে না। তাই তিনি আর ব্যস্ত না হয়ে ঘরে খিল দিলেন। তার ঠিক দু’দিন পরে মাস্টার তার বউ ছেলে নিয়ে ভিটেমাটি ফেলে এপারে চলে এলেন। মেয়েটিরও কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি আর।
কিন্তু এতে সমস্যা বাড়ল রুবিনাদের। পাড়ার সেইসব ছেলেছোকরা এর পরেও রুবিনার বাবার পেছন ছাড়েনি। তার দোকান থেকে কেউ কিছু কিনতে এলে লোক তাড়িয়ে দিত, তার বউ ঘাটে জল নিতে গেলে টিটকিরি দিত। তাই রুবিনার বাবা ঠিক করলেন গ্রাম ছাড়বেন, মামার কাছে যাবেন। কাঁটাতারের ওপারে সব থেকে কাছের গ্রাম এ’টাই। কিন্তু এখানেও দাঙ্গার আঁচ পৌঁছে গেছে। এখান থেকে দু-চার ঘর মুসলমান যা ছিল সব ওপারে চলে গেছে। টাকাপয়সা যা ছিল তাতে উনি চাইলে বাংলাদেশেই অন্য কোথাও চলে যেতে পারতেন কিন্তু কলকাতার লোভটা সামলাতে পারলেন না। ভিসাপাসপোর্ট ছাড়া ওদেশে যাবার এর থেকে ভালো রাস্তাও আর তার মাথায় এল না। বাড়িতে যদিও মা-বউ এর প্রতিবাদ করেছিল কিন্তু তিনি কান দেন নি। কিছুদিনের জন্য হিন্দু হবেন বলে মাস্টারের পরিত্যক্ত বাড়িতে শেষবারের জন্য গিয়েছিলেন ঠাকুরঘরে কোন ছোট মূর্তি বা পট পরে আছে কিনা দেখতে। কিন্তু কিছুই পেলেন না। হিন্দুদের আচার-অনুষ্ঠান তাদের অনেকটাই জানা তাই বিশেষ সমস্যা হবে না ধরেই নিয়েছিলেন। আর পৌষপার্বণ, নবান্ন এগুলোর তো কোনো ধর্ম নেই।
মাস্টারের বাড়ি খানাতল্লাশি করেও যখন কিছুই পেলেন না তখন এক প্রকার হাল ছেড়েই চলে আসছিলেন, কিন্তু বাড়ি থেকে যেই বেরোতে যাবেন তখন চোখে পড়ল দরজার কাছে আম গাছের নিচে একটা মূর্তি জ্বলজ্বল করছে। হাতে তুলে দেখেন সেটি মাস্টারের পরিবারের অষ্টধাতুর লক্ষ্মীমূর্তি। হয়ত যাবার সময় অসাবধানতায় পড়ে গিয়েছিল। খুব খুশি হয়ে মূর্তিটা তুলে নিয়ে এসে এপারে আসার তোড়জোড় শুরু করে দিলেন রুবিনার বাবা। এর পরের ঘটনাগুলো তো পাঠিকা সবই আন্দাজ করতে পেরেছেন হবে। তাই সে কথায় আর যাচ্ছি না।
এ’বারে আসি চাতকপুরের কথায়। আর এখানেই চলে আসে রুবিনা। আমরা ওকে এখন থেকে স্বদেশী বলেই ডাকবো কারণ পাড়ার কুকুরেরাও ওকে ওই নামেই চেনে।
১৫ তারিখ স্বদেশীর ঘুম ভেঙেছিল একটা কুকুরের ডাকে। পাড়ার এই সাদা কুকুরটা ওদের উঠোনেই ঘুমায়। বাকি কুকুরদের ওর সাথে বেশি বনিবনা হয় না বলে স্বদেশী ওকে বাড়ি নিয়ে এসেছিল। ঠাকুমা কুকুরটিকে ঘরে ঢুকতে দিতে না চাইলেও বাবার প্রশ্রয়ে স্বদেশী ওকে বাড়িতে রাখার অনুমতি পায়। সেদিন ঘুম থেকে উঠে ওর মনে হয়েছিল কুকুরটা যেন মানুষের মতো ওর নাম ধরে ডাকছে। জানলা দিয়ে মুখ বার করে দেখল সত্যিই তো, এ তো কালুই ওকে ডাকছে। স্বদেশী মুখ বার করতেই কালু ওকে বলল, “কাউকে কিছু না বলে আমবাগানে চলে এসো। আমি অপেক্ষা করব।” স্বদেশী প্রথমে একটু অবাক হয়ে গেলেও কৌতূহল চাপতে পারল না। তাই ঘুম থেকে উঠে, হাতমুখ ধুয়ে, সকালের খাবার খেয়েই সে বেরিয়ে পড়ে আম বাগানের দিকে। আম বাগানের পেছনে একটি মোটা গুঁড়ির পাতাঝরা শুকনো গাছ আছে। স্বদেশী গাছটার নাম জানে না। গাছের গায়ে অনেক লাল সুতো বাধা। গ্রামের মহিলাদের সাথে ওর মাও আসে তিথি মেনে গাছটাকে পুজো করতে। বছরের বাকি সময়ে কেউ বিশেষ গাছটির কাছে ঘেসে না। স্বদেশীই মাঝে মাঝে আসে এখানে খেলতে আর কালুও ওর পেছন পেছন এসে বসে থাকে গাছের নিচের বেদীতে।
কালুকে খুঁজতে খুঁজতে স্বদেশী ওই গাছটার কাছে এসে দেখে কুকুরটি ওখানে বসে রোদ পোহাচ্ছে। সে আর কৌতূহল চাপতে না পেরে বলল “তুই কথা কইতে পারস”? কুকুরটি বলল “হ্যাঁ পারি।”
স্ব – তাইলে এতদিন কথা কইস নাই ক্যান?
কা – এর আগে বললে তুমি বুঝতে না।
স্ব – কে কইসে আমি বুঝতাম না? এহন ক্যামনে বুঝি? আমারে বোকা পাইছস?
কা – না। তুমি বোকা আমি তো বলি নি। কিন্তু এর আগে কথা বললে তুমি বুঝতে না।
স্ব – আবার বাজে কথা কয়?
কা – সত্যি বলছি!
স্ব – ঠিক আছে, তোর কথাই যদি সত্যি হয় তাইলে এহন আমি বুঝি ক্যামনে?
কা – সেটা বলতেই তো তোমায় এখানে ডেকেছি।
স্ব – তুই এমন কইরা শহরের লোকের লাগান কথা কস ক্যা?
কা – আমার ঠাকুরদা শহর থেকে এসেছিল। তাই আমি এভাবে কথা বলি। কিন্তু এই গ্রামের বাকি কুকুরেরা তোমাদের মতোই গ্রাম্য ভাষায় কথা বলে।
স্ব – তুই আমারে গাইয়া কইলি? যা তর লগে কথা কমু না।
এই বলে স্বদেশী কালুর দিকে পেছন করে বসে রইল। বেশ কিছুক্ষণ সময় পার হতেই ওর মনে হয় যদি কালুও রাগ করে চলে যায় তাহলে আর কথা বলা কুকুরের রহস্য তার জানা হবে না। কেন সে আজ থেকে হঠাৎ করে কুকুরের সাথে কথা বলতে পারছে সেটা না জানলে তার আর ঘুমই আসবে না। এইসব সাতপাঁচ ভেবে নিজেই আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবে আর তখনই কালু বলে উঠল, “তুমি কি রাগ করেই বসে থাকবে না আমার কথাও শুনবে?।” স্বদেশী ভাবল ভালই হল, নিজে থেকে হ্যাংলার মতো কথাও বলতে হল না আবার গল্পটাও শোনা যাবে। ও বলে, “ক কি কবি।” কালু একটু গলা খাকরানি দিয়ে শুরু করল, “চাতকপুরের নাম শুনেছ?।” স্বদেশী বলল সে শোনে নি। কালু বলতে আরম্ভ করল।
“চাতকপুর একটি গ্রামের নাম। এই গ্রামের সাথেই লাগোয়া একটি গ্রাম ছিল। এখন আর কেউ ওই গ্রামের কথা জানে না। গ্রামটি হারিয়ে গেছে।”
স্বদেশী এখানে একবার কালুকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “গ্রাম কখনও হারায়? তুই নিজে একখান কুত্তা আর তর বুদ্ধিও তেমন।” কিন্তু কালু স্বদেশীর কথায় তেমন আমল না দিয়ে বলে চলল।
“দেশভাগ হবার আগে অব্দিও গ্রামটি ছিল। পনেরো ঘর পরিবার ছিল ওই গ্রামে। দেশভাগের সময় এপার না ওপার কোথায় যাবে স্থির করতে না পেরে গ্রামটি হারিয়ে যায়।”
স্বদেশী আবার বলে ওঠে, “কী সব আজগুবি কথা কস? তর মাথা সত্যিই খারাপ।” কালু যথারীতি পাত্তা না দিয়ে বলে চলে আর স্বদেশী বোঝে ওকে বাধা দিয়ে লাভ নেই। বরং পুরো গল্পটা শুনে তারপরেই কিছু বলা ভালো।
“চাতকপুরে যে পনেরোটি পরিবার ছিল তাদের একটি বৈশিষ্ট হল যে ওই সব ক’টি পরিবারে কোন কন্যাসন্তান হত না। যখনি কোনো মা সন্তানসম্ভবা হত, সবাই জানত যে সেই বাড়িতে ছেলেই হবে আর ঠিক তাই হত। তাই বাড়ির বউয়েরাও বেশ শান্তিতে, আরামে দিন কাটাত। আশেপাশের গ্রামের সবাই চেষ্টা করত যেন তাদের বাড়ির মেয়েদের চাতকপুরেরই কারো সাথে বিয়ে হয়। নিজেদের মেয়ে নেই বলে ওই গ্রামে মেয়েদের কদরও ছিল বেশ। বাড়ির বড়রা ঘটা করে এসে বউ নিয়ে যেত। আর ছেলের মা হবে ভেবে মেয়ের বাপেরাও অনেক যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিত। চাতকপুরে কোন ছেলের বিয়ের বয়স হলেই বাকি গ্রামগুলির মধ্যে ঝামেলা লেগে যেত যে কার মেয়ের সাথে বিয়ে হবে। কখনও কখনও তো গাঁয়ের মোড়ল মধ্যস্ততা করে মেয়ে ঠিক করে দিত।”
স্বদেশী এবার থাকতে না পেরে জিজ্ঞেসা করল, “মধ্যস্ততা মানে কী?” কালু বলল মধ্যস্ততা মানে সে জানে না তবে গল্প এভাবেই বলতে হয়। তাই সে আবার শুরু করল।
“শুধু মাত্র পনেরোটি পরিবার হওয়ায় দু’ বছরে তিন বছরে চাতকপুরে বিয়ের লায়েক ছেলে পাওয়া যেত। এর মধ্যে বলে রাখা ভালো যে শুধু তার মেয়ে ছেলের মা হবে তাই নয়, মেয়ের বাপেরা এও জানত যে চাতকপুরের প্রত্যেকটি পরিবার বেশ ধনি। যার মেয়েই ওই গ্রামে যাবে সে রাজরানী হয়ে থাকবে। এ ভাবেই স্বগর্বে চাতকপুরের দিন কাটতে থাকে।
“ঠিক এমন সময় খবর আসে দেশভাগ হবে। গ্রামের পেট বরাবর কাঁটাতার যাবে। হিসেব করে দেখা গেল কারো বাড়ির উঠোন তো কারো বাড়ির একটা ঘর; এই ভাবে বাড়িগুলি সব ভাগ হয়ে যাবে দুই দেশের মধ্যে। সব শুনে গোটা চাতকপুর জুড়ে কান্নার রোল উঠল। বুড়োরা বলল এ তো অশনি সংকেত। এভাবে তো আর গ্রামটিকে আগের মতো রাখা যাবে না। তাই তড়িঘড়ি সভা ডাকা হল। মধ্য রাতে চাঁদের আলোয় গ্রামের সব পুরুষেরা এক হলেন আর তাদের মধ্যে যে সব থেকে বুড়ো তিনি বলতে শুরু করলেন…”
বুড়োর গল্প ছিল এরকম –
আমি এখন যা বলব তা তোমাদের মধ্যে যারা ছোট তারা জানো না। ৪০ বছর না হলে আমরা এই কথাগুলো কাউকে বলি না। মহিলারা তো কখনোই জানতে পারেন না। কিন্তু এখন ঘোর সংকট, তাই তোমাদের সব বলা প্রয়োজন। তোমাদের মায়েরা এখন বাড়িতে ঘুমোচ্ছে, ভুলেও এখানে যা শুনবে তা তাদের জানাবে না। জানালেই সর্বনাশ। এক মহা পাপের বোঝা আমরা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। এ থেকে আমাদের নিস্তার নেই।
আমাদের গাঁয়ে মা লক্ষ্মীর আশির্বাদ আছে। কখনোই এই গাঁয়ের ভাঁড়ার শুন্য হয় না। তোমরা কখনোই দুর্দিন দেখ নি। কিন্তু আমার ঠাকুরদার বাপ দেখেছিলেন। তাঁর সময়ে এই গাঁয়েরই এক পরিবার, আমি আর তাদের নাম বলব না, এক অন্যায় কাজ করে বসেন। সেই পরিবারের ছেলে এক মুসলমানের মেয়েকে বিয়ে করে। বাপকাকাদের বারণ সত্ত্বেও সে আলাদা দালান তুলে ওই মেয়েটিকে নিয়ে ঘর করে। গাঁয়ের সবার অপছন্দ হলেও এক রকম চলে যাচ্ছিল কিন্তু বাঁধ সাধল আরেকটি ছেলে। সে মুসলমান হয়ে বিয়ে করল এক হিন্দুর মেয়েকে। এটা দেখে গ্রামের বড়রা বেশ রেগে গিয়ে ওদের একঘরে করে দিল। কিন্তু সবারই চিন্তা শুরু হল যে এই যদি চলতে থাকে তাহলে নিজের জাত-ধর্মই টিকিয়ে রাখা মুশকিল হবে। অনেক ভেবেচিন্তে ওই দুই ছেলের বাবাদের ডেকে পাঠালেন গ্রামের মোড়ল। তিনি আদেশ দিলেন যে ওনারা যদি কোন পদক্ষেপ না নেন তাহলে এই দুই পরিবারই গাঁ ছাড়া হবেন। সব শুনে প্রচণ্ড অপমানে দুই বাবা বাড়ির দিকে রওনা দিল। যেতে যেতে কী পরামর্শ করল জানা যায় না কিন্তু তার পর থেকে হিন্দু-মুসলমান, বিবাহিত ওই মেয়ে দুটিকে আর গ্রামে দেখা গেল না। তাদের স্বামীরা পাগলের মতো ছুটতে লাগল, এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল কিন্তু কোথাও তারা তাদের বউ খুঁজে পেল না। প্রথম যে ছেলেটি মুসলমান মেয়ে বিয়ে করেছিল তার এক সাত বছরের মেয়ে ছিল। বাপ পাগল হয়ে যাওয়ায় সে ঠাকুমার কাছেই থাকত। একদিন গ্রামের এক বুড়ো লোক তার ঠাকুরদাকে পরামর্শ দিল যে বেজাতের মেয়ে, ওকে বড় করলে তারই নাম খারাপ হবে। তার ওপরে বিয়ে দিতে গেলেও তো অনেক খরচ। বাড়ির সব টাকাপয়সা নিয়ে সে বেরিয়ে যাবে আর তারা ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে ছেলের পাপের বোঝা বইবেন সারা জীবন। এত কথায় ঠাকুরদা চিন্তিত হয়ে মোড়লের সাথে আলোচনা করতে গেলেন। সব শুনে মোড়ল খালি একটি কথাই বলল “ভেবে দেখব।”
এর পরে কয়েক মাস চলে যায়। গ্রামে যেই চারজন মহিলার বাচ্চা হবার কথা ছিল, তারা কন্যাসন্তান প্রসব করলেন। তা দেখে সারা গ্রামে ঢিঢি পড়ে গেল। সবাই ভাবল গ্রামে বুঝি শনির দশা লেগেছে। সেইরকম সময়ে এক রাতে গ্রামের মোড়ল সব পুরুষদের ডেকে পাঠালেন ঠিক এই ভাবে যেভাবে আজ তোমরা এসেছো। সবাই এসে পৌঁছলে অত্যন্ত গম্ভীরভাবে তিনি জানালেন যে গত রাতে মা লক্ষ্মী তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছেন এই গ্রামের ওপর তিনি অসন্তুষ্ট। যে গ্রামে নিজের ধর্মের লোকেরাই বেজাতের ঘর করে সেখানে তিনি আর থাকবেন না। তিনি মুসলমানদের নিয়ে আলাদা করে কোন খারাপ কথা বলেননি ঠিকই কিন্তু এভাবে হিন্দু মুসলমান বিয়ে হলে যে তাদের ওপরওয়ালাও খুশি হবেন না তার আভাসও মা লক্ষ্মী দিয়ে রেখেছেন। তাই এ পাপের সমূলে বিনাশ করতে হবে। এই বলে তিনি থামলেন।
তারপর বেশ কিছুক্ষণ বিরাম নিয়ে তিনি বললেন যে এই গ্রামে এখনও সেই পাপের এক টুকরো চিহ্ন পড়ে আছে। সেই মেয়েটির আর মাস খানেক পরেই আট বছর বয়েস হবে। এই বলে সে মেয়েটির ঠাকুরদার দিকে তাকালেন। ঠাকুরদা চোখ নামিয়ে ফেললেন।
মোড়ল আবার শুরু করলেন। এবারে আরও জোরের সাথে তিনি বললেন মেয়েরাই যত সর্বনাশের কারণ। কী হিন্দু কী মুসলমান, বাড়িতে মেয়ে হলেই সমস্যা। মেয়েরা স্বর্গে দেবী আর মর্তে রাক্ষসী। তারা নিজের পরিবারের ধন ভেঙে অন্য পরিবারে নিয়ে যায় আর সেটা যদি হয় কোন বেধর্মীর পরিবার সেটা কী মেনে নেওয়া ঠিক? তাই আমি মা লক্ষ্মীর সাথে শলা করে ঠিক করেছি যে এই গ্রামে কোনও মেয়ে থাকবে না। তবে মেয়েরা তো মায়ের জাত। লক্ষ্মীর জাত। তাই আমাদের গাঁয়ে যে লক্ষ্মীমণ্ডপ আছে তার ভূগর্ভে আট বছরের ছোট সব মেয়েদের পুঁতে দেওয়াই স্থির করেছি। ওরা মা লক্ষ্মীর যক্ষী হয়ে আমাদের ধন আগলাবে আর আমাদের আশীর্বাদ করবে। তবে দেখবেন বাড়ির মহিলারা যেন টের না পায়। তাদের থেকে লুকিয়ে এটা করতে হবে। এই গাঁয়ে মোট চল্লিশখানা বাড়ি আর তার মধ্যে আট বছরের কম মেয়ে আছে পাঁচটি আর তাদের মধ্যে একজন হল ওই বেধর্মী। বাকি রইল আরও পাঁচ পরিবার মিলে আটটি মেয়ে, যারা বয়েসে বড়। তাদের মধ্যে দুটি পরিবার মুসলমান। মুসলমানদের প্রতি আমার উপদেশ হবে তোমরা তোমাদের মেয়েদের নিয়ে এই গ্রাম থেকে চলে যাও। পাশের গ্রামেই তোমাদের অনেক শরিক আছে সেইখানে গিয়ে থাকো। হিন্দু ঠাকুরের মন্দিরে নিজের মেয়েদের কি তোমরা পুঁতে দিতে চাইবে? তোমরা হাতে গোনা সাত ঘর আছ এই গ্রামে। বেকার কেন নিজেদেরকে আমাদের সমস্যায় জড়াবে? আর হিন্দু বাড়ির যে বড় মেয়েরা আছে তাদের তোমরা ঘরে বন্ধ করে রাখো। এই গ্রামের কারো সাথে বিয়ে দিও না। ওরা জানুক যে এই গ্রামে সব ছেলেরা ওদের ভাই। এভাবেই দেশে শান্তি আসবে।”
এত কিছু বলার পর মোড়ল সেই দিনের জন্য সভা ভাঙলেন। আর এক সপ্তাহের মধ্যেই দেখা গেল হিন্দু মুসলমান মিলে প্রায় পঁচিশটি পরিবার কোনো না কোনো অজুহাতে চাতকপুর ছাড়লেন। আর গ্রামেও কোন মুসলমান পরিবার বাকি রইল না। কিন্তু সেই যে মেয়েটি ঠাকুমার কাছে থাকে, তার ঠাকুরদা ঠিক এক মাস পরে এক রাতে দুধে আফিম মিশিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় তাকে মা লক্ষ্মীর চাতালে পুঁতে দিয়ে এল। এর পরেই দেখা গেল, যে পনেরোটি পরিবার এই গ্রামে থাকে সেই পরিবারগুলোয় আর মেয়ের জন্ম হয় না। মেয়ে হলেই বাড়ির পুরুষেরা গোপনে সদ্যজাতকে মা লক্ষ্মীর যক্ষী করে দিয়ে আসে। এ গ্রামের মায়েরা এসব জানে না। তারা শুধু জানে কখনও তাদের মরা বাচ্চা হয়েছে।
“এতটা বলে চাতকপুরের সব থেকে বুড়ো লোকটি থামলেন। গ্রামের সবাই চুপ করে শুনছিল। তাদের মধ্যে যারা বড়, পরিবারের মাথা, তারা তো আগে থেকেই জানত আর যারা সদ্য যুবা তারা হতবম্ব। এবার বুড়ো আবার বলে উঠলেন…
এবার এই গ্রামে ঘোর অশান্তি। দেশভাগ হলে গ্রাম ভাগ হবে। এই গ্রামের যে দিকটা বাংলাদেশে পড়ছে সেখানেই আমাদের লক্ষ্মীমণ্ডপ। আমাদের গ্রামের আর মান থাকবে না যদি বেধর্মীর দেশে আমাদের দেবী চলে যান। অনেক কষ্টে, নিজের সন্তান দিয়ে আমরা মা লক্ষ্মীকে এই গ্রামে আটকে রেখেছি এতকাল। তিনি চঞ্চলা, তাঁর আদর না হলে তিনি এক স্থানে বেশীদিন থাকেন না। আমরা এতদিন ধরে তাঁর মন্দিরে যক্ষী দান করে এসেছি আর তিনিও আমাদের ধন আগলে রেখেছেন। আমরা বেঁচে থাকতে ইষ্টদেবতার অপমান হতে দেবো না। তাই আমি ঠিক করেছি, আমরা সবাই মিলে মা লক্ষ্মীর চরণে ঠাঁই নেব। আমাদের মেয়েরা যক্ষী রূপে আমাদের ধন আগলেছে এত কাল। মায়ের কৃপায় তাদের দেবত্ব প্রাপ্তি হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। আমরা আশ্রয় চাইলে তারা আমদের ফেরাবেন না।
“বুড়োর কোথায় কী জাদু আছে কে জানে। পনেরোটি বাড়ির প্রায় ৭০ জন লোক মন্ত্রমুগ্ধের মতো মা লক্ষ্মীর চাতালে মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়তে লাগল। তারপর একে একে ঢুকে যেতে লাগল সেই যক্ষীকুণ্ডের সুড়ঙ্গে। যে সকল মহিলারা, ছেলেরা, যেতে রাজি হল না তাদের খাবারে নেশার ওষুধ মিশিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। শুধু পড়ে রইল বেড়াল কুকুরেরা।
“সবার শেষে ঢুকলেন সেই বুড়ো লোকটা। সুড়ঙ্গের পথ বন্ধ করার দায়িত্ব তিনি নিজে নিয়েছেন। বন্ধ করবার আগে তিনি বললেন – আমার বাপ ঠাকুরদার আশির্বাদে আমি যে মন্ত্র পেয়েছি তার এই বেলা প্রয়োগ করার সময় এসেছে। এই গ্রাম যেন কারো স্মৃতিতে না থাকে ঈশ্বর। আমাদের পাপকর্ম মুছে যাক এই পৃথিবী ইতিহাস থেকে। আজ এই সুড়ঙ্গের পথ বন্ধ হোক আর মানবজীবন থেকে মুছে যাক চাতকপুরের স্মৃতি।”
এতটা বলে কালু থামল। যেন দম নিল খানিকটা। স্বদেশী দেখল দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। কিন্তু তার উঠতে মন চায় না। ওদিকে মা চিন্তা করবে কিন্তু সে জানতে চায় যে এই সবকিছুর মধ্যে তার ভূমিকাটা কী? তাই সে চুপ করে বসে থাকে। সে বুঝতে পারে কালু এখনও কিছু বলবে। কালু বলে –
“তুমি জানতে চাইছিলে যে তুমি আমার কথা আজকে কি করে শুনতে পাচ্ছ? এবারে সেটা বলি। সেই মেয়েটি মনে আছে তো? যাকে তার ঠাকুরদা লক্ষ্মীর চাতালে যক্ষী করে দিয়েছিল? সেই মেয়েটিকে যেদিন পুঁতে ফেলা হয় তার তিন দিন আগে ওর আট বছর বয়েস হয়েছিল। তাকে যখন তার ঠাকুরদা গ্রামের আর তিনটে লোকের সাথে রাতের অন্ধকারে জ্যান্ত কবর দেয়, তার সাক্ষী ছিল এক কুকুর। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় সে শুনতে পায় যে একজন লোক মেয়েটির ঠাকুরদাকে বলছে, “ওর তো আট বছর হয়ে গেছে, মা লক্ষ্মী কি ওকে যক্ষীরূপে বরণ করে নেবে?” তাতে তার ঠাকুরদা বিশেষ আমল না দিয়ে তাদের কাজ করে যেতে বলে। মেয়েটি যেতে যেতে সেই কুকুরটিকে তন্দ্রার ঘোরে বলে যায় যে তার সাথে যা ঘটেছে সেটা যেন কেউ না ভোলে। এরা চেষ্টা করবে তাকে স্মৃতি থেকে মুছে দিতে কিন্তু সারমেয়কুল যেন তাদের কাজ থেকে কখনও বিরত না হয়। সেই থেকে চাতকপুরের সব কুকুর ওই মেয়েটির গল্প বলার চেষ্টা করে। কিন্তু ধীরে ধীরে গ্রাম মেয়েশুন্য হয়। তারপর দেশভাগের সময় গ্রামটিই হারিয়ে যায়। আর আমরা এই গ্রামে চলে আসি। যখনই কোনো মেয়ের আট বছর বয়েস হয় তখন সে একদিনের জন্য আমাদের সাথে কথা বলতে পারে আর আমরা তাদের এই গল্প বলি। আমাদের বিশ্বাস, যে মেয়ে এই গল্প মনে রাখতে পারবে, সেই পারবে ওই প্রথম যক্ষীর আত্মার মুক্তি দিতে। কিন্তু আজ অব্দি সেটা হয়নি। আট বছর পূর্ণ হবার এই একদিন আমাদের গল্প শুনে, পরের দিন ঘুম থেকে উঠেই মেয়েরা সব ভুলে যায়। এমনকি আমাদের সাথেও আর কথা বলতে পারে না। চাতকপুরের সেই বুড়ো মন্ত্রবলে ভুলিয়ে দিয়ে গেছে সেই গাঁয়ের স্মৃতি। কিন্তু আমরা আমাদের কাজ করে যাব। এবারে তুমি দেখো কিছু মনে থাকে কিনা। যদি থাকে তাহলে কাল আবার এসো এখানে।”
সব শুনে স্বদেশীর কেমন একটা ঘোর এসে গিয়েছিল। মন কাঁদছিল সেই প্রথম যক্ষীর কথা ভেবে। বাড়ি ফিরেও সে ভালো করে খেলো না, কথা বলল না। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ল আর মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকল যেন কাল সকালে তার সব মনে থাকে।
পরের দিন স্বদেশীর ঘুম ভাঙে খুব ভোরে। চোখ খুলেই মনটা কেমন অবসাদে ভরে যায়। জানালা দিয়ে মুখ বার করে দেখল কালু ঘুমোচ্ছে। সে মনে মনে হেসে উঠল যে এমন সাদা ধবধবে কুকুরের নাম সে কালু দিল কেন। বিছানা থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে কাউকে কিছু না বলে স্বদেশী আম-বনের দিকে হাঁটা লাগাল। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পৌঁছল সেই গাছটির নিচে। মুখ ঘুরিয়ে দেখল কখন যেন কালুও ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে কালুকে বলে, “জানস কাল রাইতে স্বপ্ন দেখসি তুই কথা কইতে পারস। আরও অনেক কিসু দেখসি কিন্তু সব মনে পড়ে না। মনে হইল তুই আর আমি এইহানে যেন কী করতাসি। তুইও কি একই স্বপ্ন দেখছস নাকি?”
কালু সব শুনে কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে স্বদেশীর দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন মানুষের ভাষা সে কিছুই বোঝে না।
Posted in: September 2020, STORY