অস্তিত্ব এবং অন্যান্য খুঁটিনাটি অথবা নোটস যা জনরাবিহীন – তদোগেন গিরতে
–ঘুমের মধ্যে কে, সন্দীপন ব’লে ডেকে ওঠে– আমি কি ইতর হয়ে যাচ্ছি?
৬.২৮– এলার্ম দেয়া ছিল না। শনিবার। পেচ্ছাপ পেয়েছে। বায়োলজিকাল ক্লক ওয়ার্কিং। ট্র্যাপেজয়েড স্টিফ, কোয়াড্রুসেপ্স স্টিফ।
–ইতর, ক্লাসের ব্যাপার না, একশানে ইতর, ফাংশনালি ইতর। বনভূমিতে কলকারাখানা বানানোর জন্য লং-টার্ম প্ল্যানিং দরকার। বলিউড, হলুদ জামা কালো প্যান্ট, মেটিরিয়াল এম্বিশন। তারপর, এম্বিশান-ড্রিভেন ডিস্প্লেসমেন্ট অফ লোক্যাল পিপল। শহরের বাইরে, চিপায়, ঘুপচিতে তাদের জাস্ট শহর নির্মানের, মেন্টেনেন্সের ওয়ার্কফোর্স করে রাখা। আন্ডারপেইড। নো ডিগনিটি। এরা কি ইতর?
আমার বাড়ির নাম উদাসীনতা। দেয়াল, মেঝে, ছাদ অন্ধকারের—জানলা আলোর—ঘুলঘুলিতে লালন সাঁই, চড়াই পাখি। তার ঠোঁটের কুটোও লালন ফকির। সন্দীপন আমার নাম হতেই পারে।
৬.৩২; কোকো ঘুমোচ্ছে, মশারি থাক। চারশো এমেল জল। বাথরুম, ফ্লাশ। দু’চামচ কফি, আধকাপ জল, মাইক্রোওয়েভ, ৮০০ ওয়াট, ৩০ সেকেন্ড। ব্যালকনি। সিগারেট। পৃথিবীতে একা এখন অমিত দিক্ষিত—বেঞ্চে পা, ঘাসে হাত, ডিক্লাইন পুশ-আপ, ৭-৮-৯। অমিত, দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে, লম্বালম্বি। দু’জন অমিত, চারজন…
এদিকে মানুষ আগে বুকডন দিত, হাতে ভর দিয়ে পিঠ আগে উঠে আসত, তারপর কোমর।
নিওলিবারালিজম আমাদের ঘরে বুগিম্যান পাঠিয়েছে, আমেরিকায় কি কেউ নিশির ডাক শুনতে পায়? উদাসীনতা আমার বাড়ির নাম, আমি বিচলিত কেন? সন্দীপন আমার নাম হলে, বিচলিত হতাম কি?
৬.৪০—বাথরুম, ফেসবুকে মেসবা আলম অর্ঘ্য, সুন্দর একটা পোস্ট, অল্প বিষন্ন, অল্প তীক্ষ্ণ। লাইক দেব না, আমার উপস্থিতি জানানোর প্রয়োজন নেই। প্রিয় মানুষদের নিজের একটা সংসার গড়ে উঠতে দেখলে ভালো লাগে, ও’খানে ঢুকে যাওয়া মানে, নিজের উপস্থিতি দিয়ে একটা ডিস্টার্বেন্স তৈরি করা। সঠিক কথাটা হয়ত, টারবুলেন্স। অর্ঘ্যর কবিতা, একসময় খুব উদাসীন ছিল, এখন তাতে মাঝে-মাঝে জলের ছিটে পড়ে।
৬.৫০—সসপ্যান, এক কাপ ওটস, দু’কাপ জল, ফ্রীজ থেকে বার করা আগের রাতের ডাল এক কাপ– সবুজ মুগ, দু চিমটি নুন, ছ’টা আমন্ড। গ্যাসে দুমিনিট। ডাইনিং টেবল। ফ্যান। কলা কিনতে হবে, আপেল, পনীর, সপ্তাহের মাংস। সুইগি’তে দোকান খোলেনি।
৭.০২—বসার ঘরের ঘড়ি বিকল। বিকল ঘড়ি, দিনে দু’বার সঠিক সময় দেয়। বিকল ডিজিটাল ঘড়ি, ফড়িং-এর সময়, কাচপোকার সময়, বিগ ব্যাং-এর আগের সময়, আয়লান কুর্দির সময়। আমি ওকে, প্রায়ই দেখতে পাই, লাল জামা, নীল ডেনিম, বালিতে মুখ ঢুকিয়ে কাঁকড়া খুঁজছে। খোকা, তুই বড় হবি না? বিয়ে করবি না? পয়সা জমিয়ে ক্রিব কিনবি না? মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে দুধের বোতল ফোটাবি না? আয়লান বলে—কাঁকড়া দেখছি তো। কাঁকড়া ওর চোখের ফোকরে ঢুকে ওকেই দেখে। কে বোঝাবে?
আমাকে কে বোঝাবে ডিসপ্লেসমেন্ট? ধীমা আঁচে নয়, হঠাৎ! আর্কিমিডিস তো নিজেই ইউরেকার ঠেলায়, বাথটাব থেকে ডিসপ্লেসড। এতক্ষণে বাথটবে কর্পোরেট ঢুকে পড়েছে…
৭. ১০—ওটস এখন উষ্ণ, ঈষৎ। দু’চামচ। মেটফর্মিন ৫০০, ওটস। ছোট ব্যবসায়ী ডিমান্ডকে সাপ্লাই দেয়। বড় ব্যবসায়ী, ডিমান্ড-কে ডিফাইন করে, রি-ডিফাইন করে। ক্রাইসিস তৈরী করে, তারপর বিপন্নতার সমাধান…কোনা-ঘুপচি থেকে তুলে আনে পণ্য, যা সে নিজেই একসময় রিজেক্ট করিয়েছিল, মুল্যহীন বলে। রেপসিড তেল, একসময় র্যাশনে আসত। এখন ৫০০ টাকা লিটার, ক্যানোলা অয়েল নামে আসে। সুপার ফুড। তিসি, ফ্ল্যাক্স-সীড। ওটস, ১৮০ টাকা কিলো। কাঠবাদাম, ক্যালিফোর্নিয়ার। এত্ত বড় একটা মেকানিজম। আগে, এক লাখ টাকা শুনলে আঁতকে উঠতাম, এখন ৫০০ কোটি শুনলে মনে হয় এ আর এমন কি? আজকাল পাম অয়েল আসে, পামিটিক এসিড, হাইলি স্যাচুরেটেড, ইনফ্ল্যামাটরি, প্রদাহজনক। আমার তো বাড়ি উদাসীনতার—উদাসীনতা স্যাচুরেটিং, এক লিটার অলিভ অয়েল, দু লিটার সানফ্লাওয়ার, ২ লিটার সর্ষের তেল (সিউরিক এসিডের কারণে পশ্চিমে মাসাজ অয়েল; খাদ্য নয়)। উদাসীনতা স্যাচুরেটিং না স্যাচুরেশানের প্রোডাক্ট? আয়লান, তুই কি উদাসীন, খোকা? অমিত দিক্ষিত?
৭.২০—কোকো ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। আমরা জড়ুমড়ু করি, বলি—আদর, আদর—আমার পচা বাবা, বদবু বাবাটা। সোমালি, কংক, রোরো, বড়ঘরে ঘুমোচ্ছে এখনো, কোকো শিখে গেছে, কারো ঘুম ভাঙ্গাতে নেই। বসার ঘরেই শুয়ে থাকে। এ’ঘরে ঘড়ি বন্ধ। ফলে তিনদিন ধরে সময় আটকে আছে। জানলার বাইরে কাক আটকে আছে, সেগুন গাছ, দেয়ালে টিকটিকি, টিকটিকির মুখে উচ্চিংড়ে…। কোকো’কে বলি—বিস্কুট খাবি? বলে—একটু পরে। শুয়ে থাকে। খোলা জানলা দিয়ে, সময় পার করে বাতাস আসে, ঝলক ঝলক। আমি আজ লিখতে বসব। অন্য ঘরে গেলেই।
পক্ষ
ঘুমের মধ্যে কে যেন ডেকে ওঠে—সন্দীপন! আমি কি ইতর হয়ে যাচ্ছি? জীবনানন্দ এক শার্পনেল। ৩০শের জীবন আর আনন্দের একাডেমিক প্রবাহের মধ্যে একজন স্রেফ ট্রামের ধাক্কায় মরে যাচ্ছে! অবহেলার ধাক্কায় মরে যাচ্ছে! নাকি, আনমনা, মাথায় ভাড়ার সাকিনসুলুক নিয়ে, উপার্জনের অনিশ্চয়তা নিয়ে, চটির স্ট্র্যাপে সজনীর থুতু নিয়ে ঘাড় গুঁজে চলতে চলতে পিঠের চাঁদমারি দিয়ে ট্রামকে প্রলুব্ধ করছে? আয় শালা, মার! শান্ত এক স্থিতির রজনীগন্ধা ধুতি-পাঞ্জাবির ভিড়ে একলষেঁড়ে একজন মুষ্কো মানুষ, ঘাড়ে গর্দানে, হেটো ধুতি, তিতিবিপন্ন, ঈষৎ পাগলাটে।
কেউতো জীবনানন্দ নামেও ডেকে উঠতে পারে, ঘুমের ভেতর। ভিকটিম। কেন সন্দীপন? খোখলা, ফেরেব্বাজ, দুশ্চরিত্র, ওপর-চালাক! নিজেরই পুরীষগন্ধে উত্যক্ত শয়তান। আমি কি ইতর হয়ে যাচ্ছি? এক রাত্রে ট্রেনের কামরায় সন্দীপন, ঘুমন্ত আদিবাসী মেয়েটির গায়ে হাত রেখেছিল। এর পর থেকে আমার ইচ্ছে জাগে। ট্রেনে, বাসে, কনুই নিশপিশ করে ওঠে। কামে নয়, কিউরিওসিটি, মানুষ কি পায়? চালিয়ে উঠতে পারিনি। তখন ১৪, হয়ত ১৫– বাসে বাঁকুড়া থেকে একঝাঁক মেয়ে ওঠে, স্কুল, ভিড়ে আমার ডান কাঁধে এক কিশোরি বুক আটকে থাকে, অস্বস্তি কানে খোঁচায়, গলায়, চোখে– উঠে দাঁড়াই, বসতে বলি। ততক্ষনে যা হওয়ার হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে ডানকাঁধ থেকে এক কাঁকড়া-আপেল গাছ গজিয়ে ওঠে, ন্যুব্জ, ক্রুকেড। লিখতে গেলে আপেল খসে ঘাসে। ধুম টক, অম্ল, অ্যাসিড, পাখিতে খায় না, মাটি জ্বলে যায়, ঘাস পুড়ে সাদা, মরা পিঁপড়ের সারি। কাম-তাড়িত মানুষ যা করে, আমি তা করতে চেয়েছিলাম শুধুমাত্র নিজের কৌতুহল মেটানোর তাগিদে, অপর একজন মানুষকে ব্যবহার করে–অমার্জনীয়।
মানুষ আয়নায় নিজেকে দেখতে ভালোবাসে, ঠিক ভালো হয়ত বাসে না, ফ্যাসিনেশান, বাথরুমে যখন ভাপ জমে, চোয়াল যখন তীক্ষ্ণতা হারাতে থাকে, তার কানের পাশ দিয়ে আঙ্গুরলতা দোল খায়, পিছনে জলপ্রপাতের শব্দ, পাহাড়ি রাস্তায় খচ্চর ঘুরে দাঁড়ায় গাড়ির হর্নে। সে নিজের চোখের কোনা দেখে, ওদিনের থাবা দেখে, দাঁতের ফাঁকে রক্তমাংস দেখে, কানের লতি টেনে দেখে। সে জানে, আয়নার মানুষ সে নিজে যা দেখতে চায় তাই, এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু কেউ যদি অবিকল তারই হুলিয়া নিয়ে, তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে, এমন যে অনেকটা চেনা, কিন্তু তার নিজের ইচ্ছের প্রতিফলন মাত্র নয়, সে ভয় পায়, ঘেন্না বুলবুল করে, ফেটে বেরোতে চায়, খতম করে দিতে চায়। আমি জানি, আমি এখনও ইতর নই, তা’বলে সন্দীপনও যে কিছুটা নই, এ’কথা হলফ করে বলতে পারব না। জীবনানন্দ আমার পোলার অপোজিট, নিজের সমস্ত গদ্যের হিরো সে নিজেই, সন্দীপন নিজের গদ্যের ভিলেন।
Posted in: PROSE, September 2020 - Serial