ওয়র ওয়র রাওয়ের কবিতাঃ ‘স্বাধীনতার পাখিরা ঠিক উড়ে যাবে’ – সব্যসাচী গোস্বামী
ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে রাষ্ট্র যত ফ্যাসিস্ত হয়ে ওঠে, ততই সংবেদনশীল মানুষরা তার কাছে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। অতি সম্প্রতি ভারত রাষ্ট্রের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে যে এ দেশের শাসকশ্রেণী আর কোনো ভিন্নমতকে সহ্য করতে পারছে না। একের পর এক প্রতিবাদী মানুষকে জেলে বন্দি করা হচ্ছে। অত্যন্ত নগ্নভাবে। ক্রিমিন্যাল-রাষ্ট্রনেতা-পুলিশ-ন্যায়ালয়-জেলখানা যখন হাতে হাত ধরে চলে তখন বহুকথিত ‘আইনের শাসন’ একটা পরিহাসে পরিনত হতে বাধ্য। মোদি-অমিতশাহরা অত্যন্ত পারদর্শীতার সাথে এই কাজটা করতে সক্ষম হয়েছেন। আর এই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন একাশি বছর নিরন্তর জনগণের স্বার্থে নিজেকে সঁপে দেওয়া কবি ওয়র ওয়র রাও। মোদি-শাহ’দের ষড়যন্ত্রে আজ কবি মুমুর্ষু অবস্থায় রাষ্ট্রের প্রহরী বেষ্টিত পরিবেশে জেল-হাসপাতাল-জেল করে বেরাচ্ছেন। পারিবারিক সূত্র থেকে জানা গেল যে অতিসম্প্রতি আবার তাঁর কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়েছে। (একই রোগে আক্রান্ত গুয়াহাটি জেলে অমিতাভ বাগচি, অখিল গগৈ-এর মতো রাজবন্দিরা) কবির উপর এই অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধে জনমত ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। “কবিকে মুক্ত করো” “রিলিজ দ্যা পোয়েট” হ্যাসট্যাগে শ্লোগান সোস্যাল মিডিয়ায় এবং রাস্তায় নেমে নানা কর্মসূচীতে ক্রমশ জোরদারভাবে সামনে আসছে। সি পি আই- সি পি এম-কংগ্রেস সহ নানা সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলিও, যারা কেন্দ্রে বিরোধী দল হওয়া সত্বেও নিজ নিজ শাসনে একইভাবে মিথ্যা মামলায় বিরোধী কন্ঠকে স্তব্ধ করে, দমনমূলক আইনের নীল নকশা বানায়, জনমতের চাপে তাদেরও আজ কৌশলি অবস্থান নিয়ে বলতে হচ্ছে “কবিকে মুক্ত করো”। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই আন্দোলন আর শুধু “কবিকে মুক্ত করো” দাবীর মধ্যে সীমিত থাকছে না বরং তা সমস্ত রাজবন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতে রূপান্তরিত হচ্ছে এবং দেশজুড়ে বন্দিমুক্তি আন্দোলনের প্রেরণা হিসাবে কাজ করছে। কে এই ওয়র ওয়র রাও? তিনি কি একজন রাজনৈতিক কর্মী? একজন প্রতিবাদী কবি? কোন সত্তাটা তাঁর প্রধান, কবি সত্তা না রাজনৈতিক কর্মী সত্তা – যেকোন আন্দোলনের ক্ষেত্রেই যেমন উঠে আসে নানা প্রশ্ন, কবিকে মুক্ত করো আন্দোলনের উদ্দেশ্যেও উঠে আসছে নানা প্রশ্ন। কারোর মনে হচ্ছে এতো কবি সত্তাটা নিয়ে চর্চ্চা হচ্ছে কেন! তিনি তো প্রথমে একজন রাজনৈতিক কর্মী, একজন এ্যাকটিভিষ্ট! কেউ বলছেন তিনি আদৌ তত বড় কবি নন, তবে বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে তাঁর মুক্তির দাবী তোলা অবশ্যই দরকার। কেউ বলছেন তিনি প্রথমে একজন কবি, তারপর রাজনৈতিক কর্মী। প্রশ্নগুলো নিয়ে একটু আলোচনা করার অবকাশে ওয়র ওয়র রাওয়ের কবিতা নিয়ে একটু চর্চ্চা করা, আমার বর্তমান লেখার উদ্দেশ্য।
শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে অবশ্যই প্লেটো, এ্যারিস্টটল, ক্রোচেদের দৃষ্টিভঙ্গীর আছে বিস্তর ফারাক। এই ফারাক হলো মূলতঃ ভাববাদ এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, আধিবিদ্যক পদ্ধতি বনাম বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মধ্যেকার ফারাক। মার্ক্স বলেছিলেন, “চেতনা জীবনের নিয়ন্তা নয়, বরং জীবনই চেতনার নিয়ন্তা।” [দ্যা জার্মান ইডিওলজি, মার্কস]
এই বৈজ্ঞানিক বীক্ষাকে মাথায় রেখে শিল্প-সাহিত্য-নন্দনতত্ত্ব প্রসঙ্গে মার্কসীয় তত্ত্বের মূল দিকগুলোকে যদি আমরা সংক্ষেপে বোঝার চেষ্টা করি তাহলে দেখব মার্ক্সবাদীরা মনে করেন (১) সৌন্দর্যকে এবং সেই সংক্রান্ত চেতনাকে কখনোই শ্রম (উৎপাদন সংগ্রাম) এবং অন্যান্য সামাজিক-রাজনৈতিক সংগ্রাম, শ্রেণী সমাজের ক্ষেত্রে বিশেষত শ্রেণী সংগ্রাম থেকে বিছিন্ন করে দেখলে, সে সম্পর্কে জ্ঞান হবে অসম্পুর্ন। (২) শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উদ্ভব এবং বিকাশে শ্রমের এবং সংগ্রামের (উৎপাদন সংগ্রাম, শ্রেণী সংগ্রাম) ভূমিকাই প্রধান এবং মৌলিক। (৩) যেহেতু বস্তু জগত সতত পরিবর্তনশীল তাই তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিও প্রতিমূহুর্তে বিকাশমান এবং এই বিকাশ সমাজ বিকাশের ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ধারার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
মার্ক্সবাদ যেহেতু দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, যান্ত্রিক বস্তুবাদ নয়, তাই তা একইসাথে মনে করে যে শ্রম যেমন শিল্পের পূর্বগামী, আবার শ্রমই সেই পরিবেশ গড়ে তোলে যা শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির পূর্বশর্ত হিসাবে কাজ করে। ফলে সাহিত্য বা শিল্পের রসাস্বাদনে আমাদের প্রথম ভিত্তি হবে বাস্তব শ্রমজীবি মানুষ। মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে মানুষের মস্তিষ্কে শিল্প-সাহিত্য সংক্রান্ত যে কল্পনা /চেতনা / ভাবাদর্শগুলি প্রতিফলিত হয়, সেগুলো তাদের বাস্তব জীবনপ্রবাহের অগ্রগামী রূপ ছাড়া অন্য কিছুই নয়। মাও সে তুঙ তাই শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গে তাঁর ইয়েনান প্রদত্ত ভাষনে বলেছেনঃ “যদিও মানুষের সমাজ জীবনই সাহিত্যের এবং শিল্পের একমাত্র উৎস এবং বিষয় বৈচিত্রে অনেক বেশি জীবন্ত তবু জনগণ কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে তৃপ্ত নয় তাই তারা সাহিত্য এবং শিল্প চায়। কেন চায়? চায় এই কারনে যে দু’টিই সুন্দর কিন্তু সাহিত্যে এবং শিল্পে যে জীবনের ছবি প্রতিফলিত হয়ে ওঠে তা উচ্চতর পর্যায়ে অধিকতর আলোক সম্পাতিত, ঘনিভূত, বৈশিষ্টে পরিপূর্ন, আদর্শের নিকটতর বলে তা প্রাত্যহিক জীবনের তুলনায় অনেক বেশি সার্বজনীন হয়ে ওঠে এবং হয়ে ওঠা তার উচিত। বিপ্লবী শিল্প-সাহিত্যকে বাস্তব জীবন থেকে বিভিন্ন চরিত্র সৃষ্টি করতে হবে এবং ইতিহাসকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে জনগণকে সাহায্য করতে হবে”।(ইয়েনান ফোরামের ভাষন –শিল্পসাহিত্য প্রসঙ্গে) এককথায় বললে মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী একজন মানুষের কবিসত্তা বা শিল্পী সত্তা কখনোই তাঁর ব্যক্তিগত জীবন চর্চ্চা থেকে বিছিন্ন হতে পারে না, তা সে একজন বিপ্লবী কবিই হোন বা ভাববাদী সামন্ত-বুর্জোয়া শ্রেণীর কবিই হোন। পাশাপাশি মার্ক্সবাদীরা এটাও মনে করেন যে শ্রেনী বিভক্ত সমাজে সব কিছুরই একটা শ্রেণী অবস্থান আছে এবং শিল্প-সাহিত্য এবং শিল্পী-সাহিত্যিক কেউই তাঁর ঊর্দ্ধে নন। কমরেড মাও সে তুঙ বলেছেন,“আজকের পৃথিবীতে সকল সংস্কৃতি, সকল সাহিত্য এবং সকল শিল্পেই বিশেষ শ্রেণীর সম্পত্তি এবং বিশেষ রাজনৈতিক লাইন প্রচার করাই তার কাজ। শিল্পের জন্য শিল্প, শ্রেণীর স্বার্থের ঊর্দ্ধে অবস্থিত বা রাজনীতির সাথে সম্পর্কহীন বা স্বাধীন শিল্প বলে আসলে কিছু নেই।”(প্রাগুক্ত) ফলত যদি মার্ক্সবাদকে মানতে হয়, তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে একজন কবি প্রথমে একজন সামাজিক-রাজনৈতিক মানুষ, তারপরে তাঁর অন্যান্য শিল্প-সাহিত্য সংক্রান্ত সত্তা এবং এই সামাজিক মানুষ হিসাবে অবশ্যই তাঁর একটা শ্রেণী অবস্থান আছে। যে শ্রেণী অবস্থান থেকে ঠিক হয় তাঁর রাজনৈতিক-মতাদর্শিক অবস্থান। ফলত শুধু ওয়র ওয়র রাও-ই নন যেকোন কবিই আগে একজন সামাজিক-রাজনৈতিক মানুষ, যার একটা শ্রেণী অবস্থান আছে ( সচেতন বা অসচেতনভাবে ) তারপর তিনি কবি। কবিরা সমাজ-রাজনীতির ঊর্দ্ধে বিচরণ করা কোনো স্বর্গদূত নন। পাশাপাশি এটাও মনে রাখা দরকার যে ওয়র ওয়র রাও একদিকে যেমন একজন সক্রিয় বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী-সংগঠক, তেমনই তিনি একজন উঁচুমার্গের কবিও। এবং তাঁর এই দুই সত্তা একে অপরের পরিপূরক। তাঁর জীবনের প্রথম কবিতা থেকে বর্তমানের কবিতার সমগ্র যাত্রাপথই তার সাক্ষী। কবিতা চর্চা তাঁর কাছে নিছক ব্যক্তিগত চর্চা নয়, বরং সমষ্টির অংশ।
তাই তো তিনি লেখেনঃ
“তোমার একক প্রচেষ্টার কোনো ফল পাওয়া যাবে না
কিন্তু ফলে নিহিত থাকবে তোমার প্রচেষ্টাও”।
(কাব্যগ্রন্থ – উরেথিম্পু, ১৯৭০ ইংরাজি অনুবাদ কে ভি আর, পেছনে নয় আগে, অনুবাদ – কাঞ্চন কুমার, এবং জলার্ক ওয়র ওয়র রাও সংখ্যা)
সমাজে ঘটমান অন্যায় সম্পর্কে সমাজ সচেতন কবি সপাট ক’টা লাইনই বলে দেবেন কেন তিনি একজন বিদ্রোহের বার্তাবাহক। ১৯৭০ সালে লেখা এই কবিতা যেন মোদি-অমিত শাহের ফ্যাসিবাদী তান্ডবের জমানায় আজো কত প্রাসঙ্গিক!
“অপরাধ যখন নিজেকে করে তোলে স্বেচ্ছাচারী
আর মানুষকে অপরাধী সাব্যস্ত করে তাদের শিকার করে
তখন তারা সবাই, যাদের মুখ আছে
যদি মুখর না হন
তাহলে নিজেরাই
অপরাধী হয়ে যান”।
(বুদ্ধিজীবী, কাব্যগ্রন্থ – উরেথিম্পু, ১৯৭০ ইংরাজি অনুবাদ কে ভি আর, বাংলা অনুবাদ কাঞ্চন কুমার, এবং জলার্ক ওয়র ওয়র রাও সংখ্যা)
কমরেড ওয়র ওয়র রাওয়ের সাহিত্য চেতনাটি ঠিক কেমন? তাঁর নিজের ভাষায় বললেঃ “বিপ্লবী লেখক সংঘের মধ্যে একটা কথা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল যে তিনিই কবি যিনি মেহনতি মানুষের এক পাশে দাঁড়ান। কবি নিজেকে প্রশ্ন করবেন যে তিনি শ্রমিকের একপাশে দাড়িয়েছেন কিনা। যদি দাঁড়িয়ে থাকেন তবে ওপর পাশে দাঁড়ানোটাও আবশ্যিক হয়ে পড়ে”। (বন্দিশালার চিঠিঃ ৭, অনুঃ সেবক মুখোপাধ্যায়, এবং জলার্ক ওয়র ওয়র রাও সংখ্যা)
এই দুটি দিকের একটি যদি হয় সমস্যার কথাকে তুলে ধরা তবে দ্বিতীয় দিকটি হলো সমাধানেরও দিশা দেওয়া। শুধু প্রথম দিকে যিনি দাঁড়ান তিনি হচ্ছেন প্রগতিবাদী কবি। কিন্তু একজন বিপ্লবী কবিকে শুধুমাত্র প্রগতিসাহিত্যের গন্ডিতেই আটকে থাকলে চলবে না, পাশপাশি তাঁকে দিশা দেখানোর কাজটাও করতে হবে এবং যখনই তিনি এই দিশা দেখানোর কাজটি করতে যাবেন, তখন তাকে অবশ্যই জনগণের প্রতিরোধের প্রশ্নটাকেও জোরেসোরে সামনে আনতে হবে। আর ঠিক তখনই তাঁর হাত থেকে সৃষ্টি হবে প্রতিরোধের কবিতা, প্রতিরোধের সাহিত্য। জনগণকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে যা এক আলোকবর্তিকার কাজ করবে। সমস্ত প্রতিরোধ সাহিত্য অবশ্যই প্রগতিবাদী কিন্তু সব প্রগতিবাদী সাহিত্য মানেই তা প্রতিরোধের সাহিত্য, বিপ্লবী সাহিত্য হতেই হবে, এমনটা নয়। ওয়র ওয়র রাও হচ্ছেন প্রতিরোধের কবি, বিপ্লবী কবি। তাঁর মতাদর্শিক অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট এবং তা হচ্ছে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ। তাই সৌন্দর্য সংক্রান্ত ধারণা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি অনায়াসেই সুন্দরের সঙ্গে সংগ্রামকে সম্পৃক্ত করতে পারেন। তাঁর ভাষায় বললেঃ “লেখকদের অপরাধ কোথায়? দার্জিলিঙের সূর্যোদয় কে না দেখতে ভালবাসে, আমার জীবনেও তা এক উজ্জ্বল মূহূর্ত। রাজমুন্দ্রিতে গোদাবরীর রূপ দেখতে যায় মানুষ। গোদাবরীর নাচ দেখতে যাওয়া কবি হিসেবে অন্যায় নয় ; বরং দার্জিলিংয়ের সূর্যোদয় ও গোদাবরীর জলের নাচ কবি হিসেবে আমার দেখা কর্তব্য। সূর্যোদয় নকশালবাড়ির প্রতীক, গোদাবরী জঙ্গল শ্রীকাকুলামের সংগ্রামের প্রতীক। সূর্যোদয়ের সঙ্গে নকশালবাড়ি, গোদাবরীর জঙ্গলের সঙ্গে শ্রীকাকুলাম কৃষক সংগ্রাম পরস্পর সম্পৃক্ত। একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটি হবে কিভাবে!” (সাক্ষাতকার, এবং জলার্ক ওয়র ওয়র রাও সংখ্যা)
বিপ্লবী কবিতা বললে অনেকেই নাক কুঁচকোন। সাধারণভাবে একটা চালু ধারণা আছে বিপ্লবী কবিতা মানেই বোধহয় শ্লোগান; সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদী শিল্প-সাহিত্য মানে বোধহয় তাঁর থেকে রোম্যান্টিকতা বাদ; এগুলি হচ্ছে শাসকশ্রেণীর ভাড়াটে কলমজীবীদের অজ্ঞতা এবং দার্শনিক দৈন্যতারই প্রতিফলন, যা জনমানসকেও কখনো কখনো প্রভাবিত করে। কিন্তু একজন বিপ্লবী তো একই সাথে বাস্তববাদী এবং রোম্যান্টিক। তাই বিপ্লবী কবিতাতেও বাস্তববাদ এবং রোম্যান্টিকতা হাতে হাত ধরে হাঁটবে, এটাই তো স্বাভাবিক! ওয়র ওয়র রাওয়ের কবিতায় আমরা সব পাব। সেখানে সংগ্রামের হাত ধরে চলেছে প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ বেদনা; যন্ত্রনার উৎস থেকে উৎসারিত হয়েছে মুক্ত দিনের স্বপ্ন; জেলখানার প্রবল দমবন্ধকর পরিস্থিতিতেও ঠাট্টার ছলে শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে বিদ্রুপ এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর সাহিত্যে মূল উপজীব্য থেকে গেছে মানুষ এবং মানুষের প্রতি ভালবাসার অসীম প্রতিস্পর্ধা। বারবার এই মানুষের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা, ভালবাসার জন্য তাকে জেলে যেতে হয়েছে কিন্তু তাঁর কন্ঠকে স্তব্ধ করা যায়নি। হাতকে শেকলে বেঁধে রাখলে সেই শেকলই লিখবে কবিতা – মানুষের জন্য কবিতা। বন্দিজীবনে স্বাধীনতার কবিতা। এমনই স্পর্ধা নিয়ে তিনি লেখেনঃ
আগে
ফুটন্ত ফুলের খোশবাই
আমাকে দিয়ে কবিতা লেখাত
এখন
তোমার কাঁড়ি কাঁড়ি নির্জলা মিথ্যা
আমাকে সত্যের কথা লেখায়
আগে
উত্তাল আন্দোলন আর সন্দীপ্ত প্রেরণা
আমাকে টেনে তুলে সম্মুখে চালিত করত
এখন
তোমার বিনিদ্র কয়েদ আর দুর্মদ প্রতাপ
আমাকে রূপান্তরিত করেছে
লৌহমানবে
… … …
দীর্ঘ স্তব্ধ কারাবাসে
লিখে চলেছে শেকল
সুচীমুখ চিন্তায় কলম ডুবিয়েঃ
স্বৈরাচারী শোন।
আগামী দিন মুক্তকন্ঠে
আমি গাইব স্বাধীনতার গান
(এখন লিখে চলেছে শেকল, অনুঃ নিহার রঞ্জন বাগ, এবং জলার্ক ওয়র ওয়র রাও সংখ্যা)
এই স্বৈরাচারী শাসকদের প্রকৃত চরিত্রকে ব্যঙ্গ করে কবি লিখেছেনঃ
প্রজাপতি হওয়ার আগে আমরা ছিলাম
শুঁয়োপোকা
পরে আমরা হয়েছি
ভীমরুল
বিধানসভায় ঢোকার আগে
ছিলাম আগাপাশতলা অসামাজিক
মাংসভক্ষণের সময় বেরিয়ে পড়ে মানুষের স্বভাব প্রকৃতি
যখন আমরা রাস্তায় বেরোই
মানুষেরা বুঝে যায় যে
ব্রহ্মরাক্ষস আর কিছু নয়
স্বয়ং ব্রাহ্মণ
(কাব্যগ্রন্থ, উন্নাদেদো উন্নাটলু;২০০০; মৃত্যু কেকা, অনুবাদঃ নিহার রঞ্জন বাগ, এবং জলার্ক ওয়র ওয়র রাও সংখ্যা)
শৃঙ্খলিত জীবনেও কিভাবে জেল জীবন নিয়ে কৌতুক লেখা যায় এবং সেই কৌতুকের ভিতর দিয়ে শাসকশ্রেণী এবং তাঁর উর্দ্দিপরা গুন্ডাদের সাথে মস্করা করা যায় তাঁর একটা নমুনা আমরা তাঁর জেল চিঠিতে খুঁজে পাব। জেলজীবনের কোনও এক সময় ইঁদুড় এসে রোজ কেটে দিচ্ছে তাঁর যাবতীয় দরকারি কাগজপত্র। প্রথমে কাটল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের জন্য লেখা চিঠি। তারপর কাটল রামপুর মামলার চার্জশিট। এইসব বিড়াম্বনা নিয়ে একটি জেল চিঠিতে তিনি লিখলেনঃ
“এরপর আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলাম এই কেসের কি হবে, ইঁদুর সব কেটে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। মোটের ওপর এই কেস বন্ধ হয়নি, এমনকি বিচারক সমাপ্তির সিদ্ধান্ত নেবার পরেও। আমি তেমন সহজ সরল নই যে ইঁদুর টাডার জাল কেটে আমাকে মুক্ত করে দেবে যেমন ‘মিত্রলাভ’ গল্পে ইঁদুর সিংহকে মুক্ত করেছিল। কিন্তু আমার সামান্য স্বস্তি হচ্ছে এই ভেবে যে ইঁদুর কেবলমাত্র কাগজের অক্ষরের উপর দাঁত বসাতে পারে, এরা কিন্তু নতুন কোনো ষড়যন্ত্র তৈরি করতে বা কেসের ক্ষেত্রে নতুন কোনো সংখ্যা যোগ করতে পারে না।”(বন্দিশালার চিঠিঃ ৩, অনুঃ মনোরঞ্জন বর্মন; এবং জলার্ক ওয়র ওয়র রাও সংখ্যা) শেষের লাইনটায় রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রকে নিয়ে কি নিদারুন রসিকতা!
যেহেতু জেলের শৃঙ্খলিত দিনগুলি তাঁর জীবনে বারবার ফিরে এসেছে তাই তাঁর কবিতায়, জেল চিঠিতেও বারবার এসেছে গোয়েন্দা পুলিশের সেন্সরের কাঁচি চালানোর বিড়াম্বনার কথা। এই প্রশ্নে তাঁদের অসংবেদনশীলতার কথা তো সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিই খুব ভালভাবে বুঝতে পারে। যদিও ব্রিটিশ শাসন থেকে আজ অবধি ভারত রাষ্ট্র তাঁর ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতায় জনগণের নিজস্ব মতের উপর কাঁচি চালিয়ে আসছে। কখনো সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করে, কখনো মুক্ত চিন্তার মানুষদের খুন করে অথবা গ্রেপ্তার করে, কখনো আবার নাটক-সিনেমা-কবিতা-সাহিত্যে কাঁচি চালিয়ে। এব্যাপারে রাষ্ট্রের হাতে আছে গোয়েন্দা পুলিশ, সেন্সর বোর্ডের জ্যাঠামশাইরা কিংবা বজরং দল মার্কা গেস্টাপো বাহিনী। তবে বন্দি জীবনে এই কাঁচি চালানোর সমস্যাটা অনেক বেশী যন্ত্রনাদায়ক এবং প্রকট। সংবাদপত্রকে সেখানে কেটেছেটে নিজেদের মতো করে দেওয়াই রীতি। বই-খাতা-চিঠি-খাবারদাবার-দেখা করার জন্য ইন্টারভিউয়ের দরখাস্ত সব কিছু প্রথমে দেখবে গোয়েন্দা পুলিশ – তারপর দেখবে গেট সিপাই – অতঃপর জেলার / সুপার এবং সব শেষে ওয়েলফেয়ার অফিসার এবং কখনো কখনো তারও পরে সেলে / ওয়ার্ডে ডিউটিরত সিপাই। এদের মধ্যে গোয়েন্দাপুলিশের টেবিলেই সব থেকে বেশি এই দেখা (নজরদারি) দীর্ঘায়িত হয় এবং একেক সময় সেই সব চিঠি/বইয়ের শব্দগুলি গোয়েন্দাদের নানা মনগড়া অর্থ হয়ে, অনুমতি পাওয়ার অযোগ্য হয় যায়। সেইসব নিয়েই ওয়র ওয়র রাও লিখছেনঃ
ধরো
আমি লিখলাম তোমাকে
তোমার বিরহে বুক ভেঙে যাচ্ছে
ভাঙা শুনে তারা বলবে
পার্লামেন্ট ধ্বংসের এ এক ষড়যন্ত্র
আর আমার চিঠি তোমার কাছে পৌঁছাবার আগেই
আতঙ্ক নিরোধ আইনে, দেশদ্রোহিতার চক্রান্তে
গ্রেপ্তার হবো আমি
হয়তো তারা আমাকে গুলি করে মারবে
কেননা আমি অতিক্রম করেছি সীমান্ত (ভালবাসার)
ভালবাসার কবিতা তখন শেষ হবে শোকগাঁথায়
… … … …
আমরা শুধু ভালবাসতাম না, ভালবাসার কথা লিখতামও
ডাকমাশুল না বাড়লেও
আমি তোমাকে লিখতাম না এ চিঠি
কিন্তু আমি বুঝিঃ ভালবাসা গোপনতা চায়
আমরা চেয়েছি শুধু একান্ত সময়, গোপনতা নয়।
আজ তাই আমাদের চিঠি থেকে
গোয়েন্দারা শিখে নিক
ভালবাসা, বন্ধুতা আর মানবিকতার মূল্যবোধ
যদিও এ চেষ্টা বোকামি আমার
কেননা তারা আছেন পড়ার জন্য নয়, নিষিদ্ধ করার জন্য
(পোর্টালমর্টেম, অনুবাদ বলাই মন্ডল; মুক্তকন্ঠম; এবং জলার্ক ওয়র ওয়র রাও সংখ্যা)
জেলগেটের ইন্টারভিউয়ের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। বিশেষতঃ রাজনৈতিক বন্দিদের ক্ষেত্রে (সেক্ষেত্রে তো আবার ঘুষও খাওয়া যায় না)। সপ্তাহে হয়ত একবার। কখনো মাসে একবারও। রাজবন্দিদের মানসিক পীড়ণ করার সচেতন প্রয়াস থেকেই তাঁদের নিজের হোম ডিসট্রিক্টের জেলে না রেখে দূর দূর জেলায়, কখনো ভিনরাজ্যে বন্দি রাখা হয়। ফলতঃ বাড়ির লোক বা বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎকারটার জন্য অনন্ত প্রতীক্ষা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এদিকে বহু প্রতীক্ষার পর সাক্ষাৎকারের সময় এলেই দেখা যায় চোখের পলক ফেলার মতোই যেন সময়টা শেষ হয় গেলো। কবি সেই অনুভূতি নিয়ে অনবদ্যভাবে লিখেছেনঃ
দু’জন দু’জনকে কিছু বলতে পারি না
তাকাতে পারি না দু’জনের দিকে
ততক্ষন …
যতক্ষন না স্টোভের আগুনে হঠাৎ উপচে পড়া দুধের মতো
একটা কটু গন্ধ আমাদের জানিয়ে যায় সময় শেষ।
(এই আলোড়িত বেদনার্ত ভাষা, রাগে দপ্দপ্ করা শব্দ; অনুবাদ সুদীপ বসু, সৌজন্য সংবাদ প্রতিদিন)
পাঠক নিশ্চয় খেয়াল করেছেন উপরের দুটো কবিতাংশের মধ্যেই বিপ্লবী কবির এক রোম্যান্টিক, প্রেমিক সত্তাকে। গোয়েন্দাবিভাগ, জেলকর্তৃপক্ষের নানান বাঁধার পাচিল ডিঙিয়ে অবশেষে দেখা হলো দু’জনের। বহুপ্রতীক্ষিত দর্শনের আড়ষ্টতা কাটতে না কাটতেই ‘সময় শেষ’ ‘স্টোভের আগুনে উপচে পড়া দুধের’ মতো। জেল থেকে চিঠি পাঠানোর ক্ষেত্রেও একদিকে প্রিয় মানুষটির জন্য অদেখার বেদনা এবং আকুল করা প্রেম, অন্যদিকে নিজের দায়বদ্ধতার প্রতি হার না মানা অঙ্গিকার; একদিকে রোম্যান্টিক অনুভূতি অন্যদিকে জেলকর্তৃপক্ষ এবং গোয়েন্দাবিভাগের বিরক্তিকর সন্দেহবাতিকতা এবং চূড়ান্ত অসংবেদনশীল আচরণ – যেন বিদ্রুপ হয়ে ঝরে কবির কলমে।
সম্প্রতি ওয়র ওয়র রাওয়ের মুক্তির দাবীতে “কবিকে মুক্ত করো” বলে যে আন্দোলনটি শুরু হয়েছে – যে আন্দোলনের প্রথম স্বাক্ষরকারী হচ্ছেন কবি শঙ্খ ঘোষ – তাঁরা একটা চমৎকার আওয়াজ তুলেছেনঃ “জনগণের হয়ে কথা বলার জন্য কবি ওয়রওয়রা রাও ও তাঁর সহযোদ্ধারা আজ কারাবন্দী। আজ জনগণ তাঁদের হয়ে, তাঁদের হয়ে সোচ্চারে কথা বলবেন”। সত্যিই ওয়র ওয়র রাওয়ের কবিতায় জনগণ তথা মানুষ সবথেকে বেশী গুরুত্ব পেয়েছেঃ
বই-এর মধ্যে
জ্ঞানের খনি খুঁড়ে তুলে আনা অর্থের মধ্যে
অক্ষরের ফাঁক ফোকরে
আমার চোখ চলে যায়
দীর্ঘ স্বরভঙ্গী, শ্বাসাঘাত
শব্দের ওপর আছড়ে পড়া শব্দ থেকে
ছুটে আসে মানুষ
আমার বুকের উপর ছায়া ফেলে
পুরোনো কাজকর্ম, পুনর্জন্ম
উধাও হয়ে যাই
যখন কপাল থেকে আমি মুছে দিই রক্ত
এই বাসি ঘর্মাক্ত অস্তিত্ত্বের।
… … …
আমার হাড়ের থেকে
জেগে ওঠে মানুষ
তবু পাভলভের কুকুরের মতো
আমি বাঁধা পড়ে আছি
আমার অন্তর্গত ঝরণার সঙ্গে
আমার ভেতরের আগ্নেয়গিরির সঙ্গে
যারা উগরে দেয় আগুন –
তবু আমি
যে, মানুষকে বইয়ের মতো পড়ি
কখনো কি বই-য়ের পাতায় খুঁজে পাবো
মানুষের সঠিক বিকল্প।
(এই আলোড়িত বেদনার্ত ভাষা, রাগে দপ্দপ্ করা শব্দ; অনুবাদ সুদীপ বসু, সৌজন্য সংবাদ প্রতিদিন)
ওয়র ওয়র রাওয়ের কবিতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে টি মধুসূদন বলেছেনঃ“আজকের গদ্যছন্দের কবিদের মধ্যে ওয়র ওয়র রাও প্রথম শ্রেণীর কবি। তিনি গদ্যছন্দকে রক্ষা করেছেন অনুপ্রাস, শুকনো বক্তৃতা, রহস্যময়তা ইত্যাদি বাতিক থেকে। কবিতার শৈলীতে ওয়র ওয়র রাও ব্যবহার করেছেন সাধারণ মানুষের ভাষা, শব্দগুলিকে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যাতে তাদের অর্থবোধ স্পষ্ট ও সম্পূর্ণ হয় এবং তা করতে গিয়ে কোথাও শব্দের অপচয় করেননি তিনি; আবেগ ভাষাকে তরল করেনি”। (টি মধুসূদন, এবং জলার্ক ওয়র ওয়র রাও সংখ্যা)
বস্তুতই তাঁর কবিতা সোজা সপাট। একজন শিল্পীর কর্তব্য নির্দ্ধারণ সম্পর্কে তাই তিনি লেখেনঃ
ছেনির কাজ হল
পাথরকে প্রাণে পূর্ণ করা
কিন্তু প্রাণকে ভাস্কর্যে রূপ দেওয়া নয়
বাক্ধারাটা ঘুরিয়ে দাও, ভয় পেয়ো না
সোজা কথা সোচ্চারে বলো
যা স্পর্শ করে হৃদয় (সোজা কথা, অনুঃ অলকানন্দা, এবং জলার্ক ওয়র ওয়র রাও সংখ্যা)
শিল্প-সাহিত্যের মতো সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে এই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী। পাথরকে প্রাণ দেওয়া কিন্তু প্রাণকে প্রতিমায় রূপান্তরিত করা নয়। আরেকজন সাহিত্য সমালোচক অকসর তাই ওয়র ওয়র রাওয়ের কবিতা প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ “বস্তুরা যেরকম আছে সেভাবেই তাদের পরিবেশন করেন না এই কবি, সচেতনভাবেই তিনি তাঁর কবিতায় এক লক্ষের কথা বলে চলেন, যাতে তা তক্ষুনি আমাদের হৃদয়ে এবং মস্তিষ্কে ছড়িয়ে যায়। আর সেই জন্যই ওয়র ওয়র রাওয়ের কাব্য তাঁর এই নিজস্ব বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী থেকে উঠে আসে, বেঁচে থাকে এবং পুনরুত্থিত হয়। উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদের প্রচলিত বিপ্লবী কবিতার সংস্থান ও অবয়বকে ভেঙে তছনছ করে দেন তিনি। এই কারনেই তাঁর কবিতার বিষয় ও নির্মান এক অনপনয়েনের ছাপ রেখে যায়”। (অকসর, এবং জলার্ক ওয়র ওয়র রাও সংখ্যা)
একই কবিতায় আমরা দেখবো তাঁর স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান।
সীমারেখা টানা হয়ে যাবার পরে
বিশুদ্ধ ঝকঝকে থাকা কঠিন
যখন আলোচ্য নকশালবাড়ি
সহবৎ রক্ষা করাও এমন কিছু ভাল না। (প্রাগুক্ত)
প্রায় ছটি দশক ধরে চলা তাঁর কর্মময় জীবনের মতো, তাঁর সাহিত্য জীবনের অধ্যয়টিও এক বিস্তৃত বহমান নদীর মতো। আবারো বলছি প্রথমে তিনি একজন কর্মময় মানুষ, বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মী, তারপরে তিনি একজন বিপ্লবী কবি। দুটো সত্তাই একে অপরের পরিপূরক। অবিচ্ছেদ্য। তবু যখন তাঁর মুক্তির দাবীতে আমরা পথে নামি, তখন “কবিকে মুক্ত করো” শ্লোগান কেন দিই। কারণ, তাঁর রাজনীতিতে যারা সহমত, তাঁরা তো তাঁর মুক্তির দাবীতে সোচ্চার হবেনই স্বাভাবিক কিন্তু যদি আমাদের তাঁর মুক্তি সহ সমস্ত রাজনৈতিক বন্দির নিঃশর্ত মুক্তির দাবীটিকে সংকীর্ণ গন্ডীর বাইরে নিয়ে এসে ব্যপক গণমানসে ছড়িয়ে দিতে হয়, যদি ব্যপক জনতাকে এই আন্দোলনে সমাবেশিত করতে হয়, তাহলে আমাদের অবশ্যই সেই সব মানুষকেও সেই আন্দোলনে সমাবেশিত করতে হবে যারা রাজনৈতিক কর্মী ওয়র ওয়র রাওয়ের সাথে বহুপ্রশ্নে ভিন্নমত থাকা সত্বেও কবি ওয়র ওয়র রাওয়ের মুক্তির প্রশ্নেই এই আন্দোলনে সামিল হবেন। কিংবা এমনও কেউ কেউ থাকবেন যারা রাষ্ট্রিয় রক্তচক্ষুর চোখারাঙানির পটভূমিতে ‘রাজনৈতিক কর্মী ওয়র ওয়র রাওয়ের মুক্তির’ দাবীর থেকেও ‘কবি ওয়র ওয়র রাওয়ের মুক্তির’ দাবীতে কণ্ঠ মেলাতে প্রাথমিকভাবে স্বছন্দ বোধ করবেন। তাদেরকেও সামিল করাটা আজ সময়ের দাবী। শুধু ওয়র ওয়র রাওয়ের মুক্তির প্রশ্নেই নয়, বন্দিমুক্তি আন্দোলন সহ নাগরিক অধিকার রক্ষার যেকোনো আন্দোলনে এই বহুস্বরের পরিসরটিকে উন্মুক্ত রাখাটা একান্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিপ্লবী কবি ওয়র ওয়র রাওয়ের মুক্তির দাবী ক্রমশঃ শুধু জোরদারই হচ্ছে না বরং তা ক্রমশঃ রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি আন্দোলনের একটা ব্যপৃত পটভূমি তৈরি করছে। প্রথমে যারা এসেছিলেন কবির মুক্তির দাবীতে আজ তারাই সমস্ত রাজবন্দিদের মুক্তির স্বরে স্বর মেলাচ্ছেন। যদিও এত জনমত গঠন হওয়া সত্বেও মোদি-অমিত শাহদের ষড়যন্ত্র বন্ধ নেই। জনমত যত তীব্র হচ্ছে, তাঁরা যেন ততই শারীরিকভাবে চরম বিপন্ন, অশীতপর এই বিপ্লবী কবিকে জেলে আটক রাখার জন্য নির্লজ্জভাবে চক্রান্তে লিপ্ত হচ্ছে। তাঁকে আটক রেখে জেলেই হত্যা করার বাসনায় তাঁরা নানা আষাঢ়ে গল্প ফাঁদতে তৎপর। এন আই এ এখানে তাঁদের হিংস্র দাঁত-নখের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই হীন ষড়যন্ত্র বাহ্যিকভাবে খুব হিংস্র এবং শক্তিশালী লাগলেও একজন অশীতপর কবিকে আটকে রাখার প্রয়াস, শাসকের তাঁর কলমকে ভয় পাওয়াকেই অভিব্যক্ত করছে। এটা আসলে তাঁদের নীতিগত দূর্বলতা এবং ভীরুতারই দিকনির্দেশ করছে। জনমতের চাপের ভয় যেন তাঁদের ক্রমশ গ্রাস করছে। এই অবস্থাটাকে বিবরণ করতে আমরা কবি ওয়র ওয়র রাওয়ের দুটো কবিতার পঙ্তিকে পাশাপাশি বসিয়ে ব্যবহার করতে পারিঃ
স্বাধীনতাকে জেলে ভরতে গিয়েছিল ও
শেষমেশ ভয় পেয়ে গেল শেকলের শব্দে
(মাটিকে ভয়, অনুবাদ – শঙ্খ ঘোষ, এবং জলার্ক ওয়র ওয়র রাও সংখ্যা)
আটকাও যদি পারো
চেইন দিয়ে আটকাও যদি হিম্মত থাকে তোমার
স্বাধীনতার পাখিরা ঠিক উড়ে যাবে
প্রাথনার সঙ্গীতের দিকে।
(এই আলোড়িত বেদনার্ত ভাষা, রাগে দপ্দপ্ করা শব্দ; অনুবাদ সুদীপ বসু, সৌজন্য সংবাদ প্রতিদিন)
Related posts:
Posted in: ARTICLE, September 2020