উদ্বাস্তু হাওয়ার হাহাকার – ৩ : রোমেল রহমান

পাগল

রাস্তার পাশে সৈনিকদের একটা জীপ থামল। ফুটপাতে বসে থাকা এক পাগল উঠে এসে পা ঠুকে স্যালুট করতেই সৈনিকেরা মজা পেলো। সৈনিকেরা পাগলকে নাড়াতে লাগলো…

এই তুই এখনো প্যান্ট পরে আছিস? তোর সাহস তো কম না!
কেন স্যার আর্মি আসলে কি নেংটা হয়ে ঘোরার নিয়ম? দাঁড়ান স্যার আমি এখুনি নুনু বের করে দিচ্ছি!
হা হা হা! [ সবাই হাসে ]
এতো ছোট তোর জিনিস?
না স্যার! বড় হয়! আপনাদের বন্দুকের নলের মতন হয়! দেখবেন স্যার?
কেমনে?
দাঁড়ান দেখাই!
এই বাদ দাও তো! পাগলকে ক্ষেপীয়ে কি লাভ?
মজা পাচ্ছি স্যার! কি করবো বলুন! বিনোদন চাই তো!
এই দেখেন স্যার বড় হচ্ছে! উহহ!
থাক থাক! আর না! মাখিয়ে ফেলিস না।
স্যার একটা প্রশ্ন ছিল স্যার!
কি?
স্যার পাগলদের দেশ কোনটা স্যার? পাগলদের জাতীয়তা কি স্যার?
দুটো প্রশ্ন?
জি স্যার!
তুই না বললি একটা?
স্যার একটা প্রশ্ন আরেকটা ঐ প্রশ্নের নুনু স্যার!
হা হা হা! শালা বদ আছে!
তুই-ই বল? তুই কিছু একটা ভেবেছিস নিশ্চয়ই?
জি স্যার!
বল তোরটাই শুনি! তুই এখন আমাদের স্যার এখন! নুনু বের করা স্যার!
জি স্যার! আসলে স্যর! স্যালুট স্যার!
আচ্ছা আচ্ছা নে বল! আমরা ব্যস্ত!
আমার মনে হয় স্যার পাগলরাই একমাত্র বিশ্বনাগরিক! অন্যদের তো দেশ আছে, উদ্বাস্তু হবার ভয় আছে! পাগলদের এসব নেই!
বাহ! ভালো বলেছিস! আচ্ছা থাক তুই! আবার দেখা হবে!
সৈনিকরা কিন্তু স্যার পাগল হতে পারবে না! তারা পালিত পশুর মতো! হুকুমের গোলাম! সালাম স্যার! আবার দেখা হবে! স্যালুট!
গাড়ি স্টার্ট নেয়। ধীরে এগোয়। ক্যাপ্টেন বলে ওঠে…
লোকটা পাগল না, এজেন্সির লোক!
আপনার এরকম কেন মনে হচ্ছে?
গালি খেয়েও বুঝতে পারেন নি?
মিথ্যে তো কিছু বলে নি!
সাবধান আর কাউকে নাড়াতে যাবে না!
সরি স্যার!

উন্মাদিনী ও রাজাকার

একদল লুটেরার আলাপ…

পাগলিটাকে তুলে নিবি?
ধ্যাত! দেখেছিস কি নোংরা!
কাজ সেরে সাবান দিয়ে গোসল করে ফেল্লেই হল!
এতো উত্তেজিত কেন?
দেখেছিস শরীরটা? টাইট জিনিস!
উফফ! রোজ এতো পাচ্ছিস তবু অরুচি নেই?
কদিন পর আর যদি না পাই সেজন্য খেয়ে নিচ্ছি!
এতো বেশি কিন্তু ভালো না!
তোরা না গেলেও আমি যাবো! আমি নিয়ে যাবো মালটাকে!
যা! বাজারের ঐ দোকানের মধ্যে নিয়ে যা! সাটার মেরে দিস! আমরা বাইরে আছি!

লোকটা পাগলিটার সাথে কথা বলে। হয়তো কিছুর লোভ দেয়! পাগলির মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। লুটেরা লোকটা হাঁটতে থাকে বাজারের দিকে। পাগলি তার পিছুপিছু যায়! অন্য লুটেরারা ঘেন্না নিয়ে তাকিয়ে থাকে।

ওর কোন ঘেন্নাপিত্তি নেই।
নাহ! একটা পেলেই হল!
মাল মাথায় উঠে গেছে!
ওর মতো লোকদের জন্য আমাদের এই ব্যাপার গুলো ওপেন হয়ে যাচ্ছে!
সেদিন রিপোর্ট হয়েছে, এখানে যে রেপ, জুলুম হচ্ছে এইসব নিয়ে!
হুম্ম! উপর থেকে চাপ এসেছে! নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা গালাগাল করেছে আমাদের!
এই সপ্তাহের পর অন্তত খোলামেলা ভাবে উল্টোপাল্টা করা যাবে না!
সারা দুনিয়ার সংবাদকর্মীরা ফুটো খুঁজছে এখানে ঢুকতে!
ভেতর থেকেও ভিডিও চলে যাচ্ছে!
ইন্টারনেট কানেকশন অফ না?
কতো পদ্ধতি আছে!
হুম্ম! সাবধান হতে হবে!
সাবধান হওয়া ছাড়া উপায় নেই! আর কয়েকদিনের মধ্যে অন্য একটা পিরিস্থিতির মুখোমুখি আমাদের হতে হবে! বিশ্ব নেতাদের দেখাবার জন্য হলেও সীমান্ত খুলে দেয়া হবে! নিউজ চ্যানেল, পত্রিকা ওপেন করা হবে! সাবধান না হলে আমাদেরকেই ক্রসফায়ারে দিয়ে দেবে!
ভালো বলেছ!

বিকট এক চিৎকার শোনা যায়! সবাই আতঙ্কিত হয়ে যায়! তারপর গোঙানির শব্দ!
একি ওর কণ্ঠ না?
হ্যাঁ জলদি চল!
হামলা হল নাকি? অস্ত্র হাতে নাও!
দ্রুত!
আধখোলা শাটারের ভেতর দিয়ে দেখা যায় তাদের লুটেরা লম্পট বন্ধুটি কাৎরাচ্ছে মেঝেতে! তার শিশ্নটি নেই! রক্ত ঝরছে ভকভকিয়ে! চিৎকার দিয়ে সে বলে…
মাগিটাকে ধর! ওর মুখের ভেতর আমার ধোন।

সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে যায় আচানক।

বাইজ্জৎ

লুট করতে একটা বড় বাড়ির মধ্যে ঢুকল একটা দল। দলের মধ্যে ঐ গলির এক মুদি দোকানদার, একজন হোটেলওয়ালা এবং একজন রিক্সাওয়ালাও ছিল। যাদের সঙ্গে এই বাড়ির লোকেদের এক রকমের লেনদেন ছিল এক সময়। হই হই করে লুটেরা দল ঢুকে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘরে ঘরে তন্নতন্ন করে খুঁজে কোথাও কাউকে না পেয়ে চুপ্সে গেলো দলটা।

ব্যাপার কি? এরা কি সব পালিয়েছে?
নাহ! আজ সকালের একজনকে দেখলাম ছাদে দাঁড়ানো!
গত রাতে আমিও দেখেছি বারান্দার এক পাশে দাঁড়িয়ে ছোট সাহেব বাইরের হালফিল দেখছে!
তাহলে গেলো কোথায়?
ভোরে পালিয়েছে?
একজন কেউ চিৎকার দিয়ে ডাকল। সবাই দৌড়ে দোতলার এক ঘরের দিকে রওনা হল যেখান থেকে ডাক আসছে…
এদিকে…এদিকে এসো সবাই… এদিক এসো!
সবাই এসে দেখল পুরো পরিবারের ১৭ জন লোক মরে পড়ে আছে!
হায়! একি!
ইসস! মেরে ফেলে গেছে নাকি কেউ?
উঁহু! আত্মহত্যা!
এতো লোক নিয়ে পালাতে পারবে না বুঝে ইজ্জৎ বাঁচিয়েছে!
হুম্ম! কিন্তু মরলো কি খেয়ে?
আজিব প্রশ্ন করো তুমি! তা দিয়ে তোমার কাজ কি?
হায়! ঐ বাচ্চা মেয়েটাকে দেখুন! ঐ ছেলেটা ওর ছোট চাচা, ওর আঙ্গুল ধরে রোজ আমার দোকানে আসতো!
আহারে! মালিককে আমি কতো রিক্সায় এনেছি! বাজার করতে পছন্দ করতো খুব! বড় বড় ব্যাগ ভর্তি বাজার করে আনত!
বেগম সাহেব কে আজই প্রথম দেখলাম!
বোরকা পড়তো?
উঁহু!
আর ঐ যে সুন্দর মতো লোকটা উনি এদের আশ্রিত আত্মীয় আমার দোকানে চা সিগারেট খেত।
এই তোমাদের এই ফিরিস্তি শুনতে কি তোমাদেরকে আমাদের সঙ্গে নিয়েছি?
মাফ চাই ওস্তাদ!
চুপ করে থাকো! এরা মরে বেঁচেই গেছে! নৈলে আমাদের হাতে মরত! আর এতোই যখন দরদ তাহলে তোমরা আসলে কেন? বেঈমানের দল!
বেঈমান বলবেন না ওস্তাদ! এরাও কি কম? এরা পয়সাওয়ালা! আমাদেরকে কি মানুষ মনে করতো?
পয়সা কি তোমার গাড় মেরে বানিয়েছে? এরচেয়েও পয়সাওয়ালাদের বালটাও ছিরতে পারবে না তোমরা!
ঠিক! এই বেঈমান গুলোকে আমাদের সাথে নিয়ে কিন্তু আমাদের নিজস্বতার মধ্যে একটা ঝামেলা লেগে যাচ্ছে ওস্তাদ!
আবার বেঈমান বললে?
চুপ খানকির বাচ্চারা! আর একটা কথা বললে গলা নামিয়ে দেবো!
যাও সবাই লুট করো! ঘরে ঘরে লুটে সব ছামান বাইরে নিয়ে জড়ো করো।

সবাই ব্যস্ত হয়ে হল্লা করে তছনছ করে সারা বাড়ির মূল্যবান আসবাব আর টাকাপয়সা গহনা এক যায়গায় জড়ো করলো!

ওস্তাদ এবার ভাগ করে দেন! আমরা বিদায় নি!
কি আশ্চর্য! তোরা তিনজন কি ভাগ নিয়ে কেটে পরবি এমন হিসেব কষে এসেছিলি?
পার্টটাইম লুটেরা!
হা হা হা!
এই তিনটে বেঈমানকে মেরে ফেল! আর ছামান গুলো একটা ট্রাকে তুলে আমাদের মালখানায় নিয়ে ফেল!
ওস্তাদ এসব কি বলছেন?
যাদের হাতে নিজেদের প্রতিবেশীর ঘর নিরাপদ না তাদের সাথে আর যাইহোক কারবার করা যায় না!
মাফ করে দাও আমাদের! কসম লাগে! আমরা আর আসবো না!
জবাই করে ফেল!
জি ওস্তাদ!
ছাড়ো… ছেড়ে দাও! পা ধরি তোমাদের!
ওরা আত্মহত্যা করে ভালোই করেছে! নৈলে তোদের কাছে ওরাও এমন করতো!

পুণ্য

স্যার এক খোপ মুর্গি ছাড়া এ বাড়িতে আর কিছু নেই! সবাই পালিয়েছে!
মুর্গি গুলো ছেড়ে দাও!
সত্যিই? নাকি নিয়ে যাবো খাবার জন্য!
আর কতো খাবে? একটু পুণ্য করো!

ভয়

ইসস একেবারে বাচ্চা!
লাশটা কি তুলে রাখবো?
কোন দুঃখে? দাফন করার ইচ্ছে আছে নাকি সময় আছে গাধা?
হুড়োহুড়ির মধ্যে হাত থেকে পড়ে গেছে মনে হয়!
উঁহু! ঐ দেখো কুয়োর কোনার দিকে! বাচ্চার মাও ভাসছে! ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মনে হচ্ছে!

ঘোষণা

শুনেছ?
রেডিওতে নাকি কার্ফুর ঘোষণা দিয়েছে!
ঘোষণা দেবার কি আছে? যা অবস্থা তাতে বাইরে বের হবার সাহস আছে কজনের?
আর্মি নামাচ্ছে নাকি! আমাদের নিরাপত্তা দিতে!
ওসব ইয়ার্কি! বাইরের দুনিয়াকে শোনাচ্ছে!

গোয়ালার সংসার

ভাবছি গরু গুলো ছেড়ে দেবো!
কি বলিস!
না হলে খাওয়াবে কি? কাল থেকে হল্লা শুরু করবে খিদেয়!
যতক্ষণ রাখা যায় রাখ! এখনই ছাড়ার দরকার নেই!
কেন?
গাধা হয়ে যাচ্ছিস নাকি বউ?
আমার মাথা কাজ করছে না আর!
আমাদের তো আর কোন সম্পদ নেই! লুটেরার বাচ্চারা যদি আসে ওরা কিছু না পেলে আমাকে মেরে তোকে তুলে নিয়ে যাবে!
সর্বনাশ!
হ্যাঁ! অন্তত গরু গুলো থাকলে দিয়ে দেয়া যাবে!

সেদিন মধ্যরাতে লুটেরারবাচ্চারা হামলা করে গোয়ালা বাড়িতে। গোয়ালা বউকে তুলে নিয়ে যায়।

কবি

ক্রুশবিদ্ধ লাশটা কার?
একজন কবির!
শকুনে খাচ্ছে! বিকট গন্ধ বের হচ্ছে! রোজ এখান থেকে যেতে হয়। সরিয়ে ফেলা যায় না!
না স্যর!
তাজা কারো লাশ লটকে দাও!
হবে না স্যর! ওর লাশটা থাকবে শেষ পর্যন্ত! বিখ্যাত মাল স্যর!
ওর অপরাধ কি খুব গুরুতর?
জি ভয়ানক অপরাধী!
কি অপরাধ?
রাষ্ট্রপ্রধানের মুখে মুতে দিতে চেয়েছিল!

শুদ্ধাত্মা

রাস্তার পাসে সার বেঁধে পড়ে আছে একদল নগ্ন যুবক! তাদের কাঁধ থেকে উরু পর্যন্ত রক্ত জমে কালচে হয়ে গেছে! ঘণ্টা খানেক আগে এদেরকে বিভিন্ন যায়গা থেকে তুলে এনে এখানে দাড় করিয়ে বেত দিয়ে অমানুষিক রকমের পেটানো হয়েছে! কারো দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই! রাস্তা দিয়ে একজন সরকারী ঊর্ধ্বতনের পরিবার যাচ্ছিলো গাড়ি করে! পরিবারটির সঙ্গে তাদের বাচ্চাদের জায়গির মাস্টার লোকটাও ছিলেন। গাড়ি থেকে জায়গির মাস্টার লোকটা চিৎকার দিয়ে বলল…

থামাও থামাও!
কি ব্যাপার?
ইসস! এগুলো কি?
মানুষ! জ্যান্ত মানুষ!
নাকি মরা?
জ্যান্ত! রোজই পিটিয়ে এভাবে ফেলে রাখা হয় বিভিন্ন যায়গায়!
ভয়ের রাজ্য কায়েমের সূত্র!
কেউ ওদের বাঁচাবে না?
বেঁচে তো আছেই!
হাঁসপাতালে নিয়ে যাবে না?
যে যাবে তারও ঐ হাল হবে আগামীকাল!
আপনারা চলে যান! আমি আপনাদের সঙ্গে যাবো না!
উল্টোপাল্টা কথা বোলো না মাস্টার! ড্রাইভার চালাও!
খবর্দার চালাবে না, আমি নামবো!
মূর্খের মতো কাজ করো না! আগে নিজে বাঁচো! ওদের সবার কোন না কোন সমস্যা আছে! ওরা বিদ্রোহী! সৈনিকদের সঙ্গে তর্ক করেছে কিংবা সৈনিকদের চোখে চোখ রেখেছে! সন্দেহভাজন বলেই ওদের এমন শাস্তি দেয়া হয়েছে! শাস্তি দেয়া দোষের কিছু না, মেরে তো আর ফেলে নি। তুমি জড়াতে যেও না!
আমি অন্তত ওদের পাশে শুয়ে থাকতে চাই! আপনারা চলে যান! আপনার বদৌলতে আমি আজ পর্যন্ত নিরাপদে বেঁচে আছি! মাফ করবেন আমাকে!

শেষ সংলাপটা বলতে বলতে লোকটা তার পরনের জামাকাপড় খুলে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে নির্যাতিত আহতদের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে! গাড়িটা ধোঁয়া ছেড়ে চলে যায়!

নদী

এই নদীটার নাম জানো?
হাঁস নদী!
হ্যাঁ।
হাজার হাজার হাঁস নাকি পড়তো এই শান্ত নদীটার বুকে!
সেরকমই শোনা যায়! যদিও আমি দেখি নি! তবে নামের উৎস নাকি ওটাই!
আমি বইয়ে পড়েছি!
আমি কি দেখেছি জানো?
কি?
এই নদী দিয়ে হাজারো নিহতের লাশ ভেসে যেতে!
ইসস! কি বীভৎস!
আমি এই হাঁস নদীর নাম বদলে একটা নতুন নাম দিয়েছি!
কি?
লাশ নদী।

দেমাগী

শহরের ঝলমলে বেশ্যা পাড়ায় আচমকা ভীতি নেমে আসে। উদ্বাস্তু হতে হবে তাদের?

আমাদের কি হবে মাসি?
চ্যাট হবে!
তুমি তো বলেই খালাস চ্যাট হবে! কিন্তু আসলে কি হবে বুঝায়ে বল! তোমাকে তো সরকার দলের বণিক সাহেবরা বাঁচাবে! আমাদের কি হবে?
আমি বাঁচলে তোরা বাঁচবি! তোরা মরেল আমিও মরবো!
তুমি আমাদে মা, অন্তত খোলসা করে বল!
আরে হারামজাদীরা! এতো ব্যাটা পিষে খেলি এখনো বুঝিস না কি হবে? বেশ্যার কোন দেশ আছে নাকি? দুনিয়ায় পুরুষ যদ্দিন আছে তদ্দিন বেশ্যার ভাতের অভাব নেই! ওদের ঐ ঘোড়াটা না পারলেও লাফায়, পারলেও লাফায়! ওটাকে চুবানি দিয়ে বস করে রাখতে পারলেই হল!
ফৌজের লোকেরা কি এখানে আসবে মাসি? তারা যদি আমাদের মেরে ফেলে?
তারা কি মেয়ে মানুষ? নাকি তারা সঙ্গে করে বউ এনেছে?
তাহলে মাসি তুমি অভয় দিচ্ছ?
অভয় না দিলে কি করবি পালাবি? পালালে মরবি নির্ঘাত! এখানে থেকে গেলে বেঁচে যাবার সম্ভাবনাই বেশি!
তাহলে ভয়ের কিচ্ছু নেই বলছ?
আমার ভয় শুধু একদল হারামিকে নিয়ে! যারা এখানকার লোকাল দাঙ্গাবাজ! লুট করছে! এদেকে! এদের বুদ্ধি শুদ্ধি বলতে, মগজ ভর্তি গু আর পেটের নিচে ঘোড়া এ-ই! এরা ঝামেলা করতে পারে! তবে তার ব্যবস্থা নিয়েছি! দেখবি কাল সন্ধ্যেয়! ঠিক মতো পিষতে পারলে বেঁচে যাবো সবাই!
আমি কিন্তু থাকবো না মাসি!
কেন? তোর আবার কি হল লছমী?
কি আর হবে ওর! দেমাগ বেশি! শরীরটা এখনো ছিলার মতো টানটান আছে তো তাই মন ভরা দেমাগ! দেমাগের কলসি!
চুপকর! আমি ওর সাথে কথা বলছি দেখছিস না! মুখে নোড়া দেবো হারামজাদী!
আচ্ছা চুপ গেলাম মাসি! তবে দিন আমাদেরও ছিল! আজ নেই বলে চুপ মেরে আছি!
তোর কি হয়েছে বল তো লছমী?
কিছু না! আমি চলে যাবো!
কোথায়? এই হাংগামার মধ্যে যাবি কই? ঐ রূপ ঐ শরীরটা নিয়ে পালাতে পারবি মনে করিস?
দুচোখ যেখানে যায় যাবো! অন্তত এই লুটেরা হারামখোর আর খোঁজা সৈনিক গুলোর সঙ্গে শোবো না! যারা নিজেদের মাটির মানুষকে মেরে কেটে লুটে খায় তাদেরকে আমি ছুঁই না!
অতো বাড় বাড়িস না লছমী! মুখে লাগাম দে! কথা ছাড়ালে তোর জন্য আমরা কেউ কিন্তু টিকতে পারবো না!
তাহলে ছেড়ে দাও চলে যাই!
যাবি কোথায়? নেবে কে তোরে? যারা নেবে তারা রাত পোহালেই ছেড়ে দেবে! যায়গা আছে যাবার?
আছে!
কোন পাড়ায়?
পাড়াতে না এবার ঠিক যায়গায়!
কোথায় যাবি?
যারা এই শুয়োরেরবাচ্চাগুলোর ফরমান মানে না তাদের ডেরায়!
অ! বিদ্রোহী নাঙ জুটেছে তাই না? কানমন্ত্র দিয়ে মাথাটা খেয়েছে?
না! আমি নিজেই যাবো!
তোকে তারা নেবে না! নিলেও খেয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে!
দিক! তাও ভালো!
পাড়াটাকে বাঁচাতে এগোবি না মা? আমি তোকে বাঁচিয়েছি! রাস্তা থেকে তুলে কাজ দিয়েছি! নাচ শিখিয়েছি! আজকে তোর উপর অনেক কিছু টিকে আছে!
না! আমি চলে যাবো!
শুনবি না আমার কথা?
না!
এই মেয়েরা তোরা ওকে ধর! আটকে রাখ ঘরে! ওকে কাল দাঙ্গাবাজদের লিডারকে ভোগ দেবো! হ্যাঙলা জারজেরবাচ্চাটার সর্দি লছমী মোচড় দেখলেই বেরিয়ে যাবে! অথচ সে খায়েস জানিয়েছে লছমীকে সে চায়! ‘…খোঁড়ার হলে ঘোড়ার রোগ শ্যাটা চোষে মাছির চোখ!’ নে লছমীকে আটকে রাখ ঘরে।

সব মেয়েরা হেসে ওঠে। তারা লছমীকে ধরতে আসে। লছমী হাত ঝাড়া দিয়ে আস্তে হেঁটে এগিয়ে যায়, কাউকে স্পর্শ করতে দেয় না নিজেকে! দরজার হুড়কো বাইরে থেকে দিয়ে দেয়া হয়। পরেরদিন সকালে লছমীর শরীর ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে থাকা বিস্ময়চিহ্নের মতো আবিষ্কার করা যায়।

চা ওয়ালা – রিকশাওয়ালা

চা দোকানে এক রিকশাওয়ালা ঝিম মেরে বসে আছে। চা দোকানদার তার বন্ধু। দুজনের আলাপ…

কি রে ঝিম মেরে আছিস ক্যা? চা ঠাণ্ডা হয়!
যাক!
কি হইলো?
জানি না!
ডলা দিছে নি?
নাহ! কাইল রাইতে…!
কি?
কাইত সারা রাইত এক ভূত প্যাসেঞ্জার টানছি!
কস কি?
হ। সন্ধ্যা থিকা সারারাইত!
করছে কি?
লোকটার বাড়ি নাকি এই শহরে! কিন্তু থাকে অন্য শহরে!
তারপর!
লোকটা তার বাড়ি খোঁজা শুরু করলো! এই গলি থিকা ঐ গলি! ঐ গলি থিকা সেই গলি! কিন্তু পায় না!
তাপর?
আমিও রিক্সা চালাইতে লাগলাম!
কিছু জিগাস নাই?
হ। জিগাইলাম, স্যর এই দুর্যোগের মধ্যে আসছেন ক্যান? সবাই পালাইতাছে! আর আপ্নে উল্টা আসছেন!
লোকটা কয়, আমাদের আসতে কি আর পাসপোর্ট ভিসা লাগে নাকি বাড়া? ওগুলা আমরা বাল দিয়াও পুছি না, পুছি নাই!
আমি বললাম, কিন্তু চারদিকের তাণ্ডব এর মধ্যে আসলেন ক্যা?
কি কইল?
কয়, তুমি বুঝবা না! জন্মভূমি! নিজের ঘর! নিজের আত্মার বসতি থিকা উদ্বাস্তু কইরা দিলেই আমরা মাইনা নিবো? মোটেই না! লড়াই হবে! …লড়াই লড়াই লড়াই চাই!
তারপর?
আমি বললাম, তা আপনার বাড়িটা তাইলে কই?
কি বলল?
কয় সব বাড়িই তো আমার! সব খালি বাড়ি আমার বাড়ি! সব পলাতক লোক আমি! সব উদ্বাস্তু আমার নাম!
আজব লোক!
হ আজব!
আর কিছু বলল?
নাহ!
কেন বলে নাই যে, সে একজন না-মানুষ?
হ কইসে! কিন্তু তুই জানলি কেম্নে?
একটু আগে আমার দোকান থিকা চা খায়া গেছে! কাইল সারারাইত এইখানে বসা! তুই আসার একটু আগেই ভাগলো!
কস কি? কেম্নে? ছিল তো আমার রিক্সায়!
হ! আমি ভড়কায় গেছি! শালা সারা রাইত ধইরা বকবক করলো! তার বাড়ির গল্প, মহল্লার গল্প! আমি বললাম, পুলিশ আসলে বিপদ হবে বাড়ি যান! হে কয়, পুলিশের বাপেরও চোখ নাই আমারে দেখবে! যেমন তোমারে দেখতে পায় না তেমন আমারেও পাবে না! এইস হিলিংবিলিং বলতে বলতে রাইত কাবার! একটু আগে চায়ের বিল দিলো! আমি টাকা ক্যাশে ঢুকায়ে দেখি হাওয়া! গলিতেও নাই, বেঞ্চেও নাই! গায়ের পশম খাড়ায় গেছে!
কিন্তু কেম্নে? ছিল তো আমার রিক্সায়! আমি তো তারে পার্কে নামায় দিয়া তোর দোকানে ডাইরেক্ট আসলাম! ভাবলাম চা – বিড়ি খায়া বাড়ি যাবো!
ঘাপলা আছে কাহিনীতে!
হ! তয় কেমন জানি এই লোকটা!
আমাগোর মতন! হে হে!
ভূত?
উঁহু! উদ্বাস্তু!
আত্মা?
উঁহু! উদ্বাস্তু!
আবার আসবে?
অবশ্যই!
দেশ কায়েম কইরাই ছাড়বে!
কস কি এইসব? তুইও কি অগের দলে?
না! তয় কথা গুলান সত্য! লড়াই ছাড়া উপায় নাই!
হ! লড়াই! ভূমির জন্য… জন্মপরিচয়ের জন্য… দম নেবার জন্য লড়াই!
সেই দ্যাশের নাম কি হবে?
উদ্বাস্তুভূমি!

কাক

কাকেদের সম্মেলন! মহা দাঁড়কাক বক্তৃতা দিচ্ছে কাউয়া সমাজের সকলের উদ্দেশ্যে…

হে আমার পুত্র এবং কন্যাগণ! আজ এক মহা দুর্যোগে নিপাতিত হইয়াছি আমরা! আমাদের কাউয়া সমাজ আজ প্রতি মুহূর্তে তুলকালাম সংকটে আক্রান্ত হইতেছে! তোমরা প্রত্যেকেই হাড়েহাড়ে অবহিত আছো যে, এই মুহূর্তে আমাদের কাউয়া সমাজ ভয়ানক খাদ্য সংকটে ভুগিতেছে! এমতাবস্থায় আমরা বিশ্লেষণ করিয়া দেখিয়াছি, স্থান ত্যাগ বা হিজরত করাই সর্বোত্তম পন্থা! জাতিগোষ্ঠীকে বাঁচাইবার জন্য ইহা ব্যতীত দ্বিতীয় কোন উপায় নাই আমাদে সম্মুখে! তোমরা জানো সকলে, এই শহরে এখন আর মানুষ নাই! আছে আড়াই প্রজাতি! প্রথম প্রজাতি হইতেছে সৈনিকেরা! যারা এই শহরের এই মুহূর্তে অবস্থানরত আমজনতার হইতে সংখ্যায় অধিক! যাহারা ক্যাম্পে খানাদানা করে এবং বাইরে উচ্ছিষ্ট ছড়ায় কম! দ্বিতীয় প্রজাতি হইতেছে যাহারা এই শহরের জনগণ,কিন্তু পালাইতে পারে নাই! আর এই দুই প্রজাতির মধ্যে আরেক প্রজাতি জন্ম নিয়াছে যাহারা মূলত লুটেরা বেঈমান তাবেদার, ইহারা পুর্নাঙ্গ প্রজাতি নহে, ফলে ইহারা অর্ধেক প্রজাতি! এই আড়াই প্রজাতির লোকেরা শেষতক উপযুক্ত পরিমাণে উচ্ছিষ্ট তৈয়ার করিতেছে না যাহা আমাদের খাদ্য যোগানে ভূমিকা রাখেতে পারে! তোমরা উপলব্ধি করিতেছ নিশ্চয়ই, এই উদ্বাস্তু ঘোষণা করা শহরের বুকে এখন নাগরিকের অধিক কাক বসবাস করে! ফলে খাদ্য ভারসাম্যে গাণিতিক টাল খাওয়াখাউয়িই স্বাভাবিক! ফলে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়াছি, অদ্য নিশি হইতে আমরা এই শহর ত্যাগ করিব! যেই শহরের মানুষেরা অন্য মানুষদের অনাগরিক ঘোষণা দিয়া বিতাড়িত করে সেইখানে আমাদের থাকিবার কোন মানে নাই! কারণ আমরা ঐ সকল বিতাড়িত মানুষদের কাছে অন্নঋণে ঋণী!
একখানি প্রশ্ন ছিল লিডার।
বল।
আমরা কেন আমাদের কাউয়া সমাজকে মনুষ্য সমাজের সঙ্গে সঙ্গত করিয়া জীবনচক্র রচনা করিয়াছি?
তুমি পাতি কাউয়াদের মধ্যে ঘেন্টিবাজ একজন! আপাতত এই সংকট মুহূর্তে বাগড়া না বাঁধাইয়া জোটবদ্ধ হও! আগে জীবন বাঁচাও। জীবন না বাঁচিলে প্রশ্ন বাচিবে না! তুমি তোমার এই প্রশ্ন আমাদের আগামী মহা সম্মেলনে উত্থাপন করিবে! এই মুহূর্তে অন্যদের মাথা না খাইয়া আসো যাত্রার প্রস্তুতি লই! হিজরত করাই আমাদের বাঁচার কৌশল আপাতত!
আমি পালাইতে রাজি নই লিডার! আপনি প্রশ্ন পছন্দ করেন না আমি জানি তথাপি চুপ থাকা আর ভুলকে সমর্থন করা সমার্থক বলিয়া আমি বিবেচনা করি! আপনার চিন্তার সঙ্গে আমি সহমত করি না। আমি যাবো না!
বেশ থাকো তবে! তুমি এবং তোমার অনুসারীরা! তবে অন্যদের নিরুৎসাহিত করিও না! যাহারা যাইতে চায় তাঁহারা বাঁচুক! সকল কাকের প্রাণশক্তি তোমার ন্যায় নহে!
আপনারা দ্রোহে বিশ্বাসী নন! ভীতু একদল কাউয়া!
বেশ! মানিয়া লইলাম! এই বিষয়ে ডিস্কোর্স অবশ্যই হইবে! পাকা উত্তর আমিই দিবো! থাকো তুমি তোমার দল লইয়া এই নগরে! আর বিস্ফোরণ ঘটাও!

পরেরদিন থেকে শহরে কাকের সংখ্যা কমে আসতে থাকে। একদল কাক দেখা যায়! যারা সৈনিক দেখলেই তাদের মাথায় এসে হেগে দেয়! কিছুদিনের মধ্যে সৈনিকেরা কাক দেখলেই গুলি করতে শুরু করে! ফলে কাকের সংখ্যা আরও কমতে থাকে। তবে সব কাক মরে না কেনোনা কাকেরা ডিম পাড়ে!

Facebook Comments

Posted in: September 2020, STORY

Tagged as: ,

Leave a Reply