গল্প লিখতে গিয়ে : রঙ্গন রায়
-“তুমি কার ছেলে গো?”
-“আমি মায়ের ছেলে।”
-“তা মায়ের নামটা কি শুনি?” ভদ্রমহিলা খিলখিল করে হেসে উঠলেন। শিশুটি মুখ গম্ভীর করে বলল,
-“মায়ের নাম বলতে নেই।” এবার আর এক প্রস্থ হাসির পালা। ততক্ষণে শিশুটির মা চলে এসেছেন। প্রবল আনন্দে ভদ্রমহিলার হাত ধরে বললেন, “আরে ল্যাঠা! তুই! কখন এলি? দরজা কে খুলে দিলো?”
-“কেন? মায়ের ছেলে!” ভদ্রমহিলা হেসেই চললেন। শিশুটি এতক্ষণে ভারি লজ্জা পেয়ে ছুটে ভিতরের ঘরে চলে গেলো। “তোর ছেলে যে খুব লাজুক হয়েছে দেখছি অ্যাঁ! খুব শিখিয়েছিস বস্তাপচা কনসেপ্ট গুলো! মায়ের নাম বলতে নেই… ধুর! তুই কিরে রীনা?
-“থাক তোকে আর এসে এসেই বক্তৃতা দিতে হবে নাকো। এসেছিস। একটু জিরো। চুটিয়ে আড্ডা মারি। তা না, তোর ঐ সব বক্তৃতা মঞ্চেই ভাল্লাগে।”
কথার মাঝে শিশুটি আবার ফিরে আসতেই ল্যাঠা উঠে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর ভ্যানিটিব্যাগ থেকে একটা ক্যাডবেরি চকলেট বার করে দিতেই শিশুটির মা অর্থাৎ রীনা বলল, “আন্টিকে নাম বল।”
-“অতলান্ত ভৌমিক” মুখ গোমড়া করেই শিশুটি বলল।
-“তুমি কি হাসতে জানো না? আর এত শক্ত নাম কে দিয়েছে তোমায়?”
এবার একটু হাসি হাসি মুখ করে শিশুটি বলল, “ঠাকুদ্দা।”
… গল্পটার এই পর্যন্ত লিখে আবার তার কেটে গেলো। এগুচ্ছে না। কি হবে? সকাল থেকে মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করেছি। অনেক দিন গল্প লেখা হয় না। কয়েকটা কাগজ লেখা চেয়েছে। সব জায়গাতেই গল্প চায়। আমি গল্প লিখতে বসলে সর্বদা একটা জগাখিচুড়ির সৃষ্টি করে ফেলি। গল্প লেখা কি সোজা কথা? প্রথমত গল্পের রান্নাটা আগে মাথার মধ্যে করে নেওয়াটাই বেজায় শক্ত। তবে যারা পেশাদারি গল্প লেখেন তাদের ব্যাপার অবিশ্যি আলাদা। ওঁদের দেখে আমার বিস্ময় জাগে যে কিভাবে ওঁরা এত এত গল্প নিয়মিত পত্রিকা গুলোতে যোগান দিতে পারেন! আমার তো একটা গল্প লেখার পর বেশ কয়েকদিন, কখনো কখনো কয়েকমাস অব্ধি খরা চলে। এই উদ্দাম খরায় সুশীতল এক টুকরো বৃষ্টির মতো কবিতাকে আঁকড়ে ধরি। কিন্তু একটা সময় আসে যখন সবাই ছেড়ে চলে যেতে চায়। এমনকি স্বর্নালীও। আজ যেমন সকাল থেকেই টেবিল চেয়ারে বসে পড়েছি। টেবিল ফ্যানের আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। এক মনে লিখছি। হঠাৎ কারেন্টটা চলে গেলো। চারিদিক থেকে দুপুর বারোটার সাংসারিক আওয়াজ টুকরো টুকরো ভেসে আসতে শুরু করল। আমি একমনে লেখার মধ্যে থাকার চেষ্টা করছি। জানালাটা আর একটু খুলে দেব? বড্ড গরম লাগছে। এত গরমে কি লেখা যায়? ঠিক তখনই কানে এলো একটি শিশুর ঘ্যানঘ্যানানি। ‘দাওনা – দাওনা – দাওনা’ বলে একভাবে, একই স্কেলে সে ঘ্যানঘ্যান করে যাচ্ছে। মাঝে ‘দাওনা’টা চিৎকারের সমতুল্য হয়েই পূর্বাপর পরিস্থিতিতে ফিরে আসছে। কেউ হয়তো জানেই না যে এই মুহূর্তে ঐ শিশুটির মা ঐ ঘ্যানঘ্যানানিকে কান না দিলেও আমার মত পাবলিক এক মনে শুনে যাচ্ছে তা। বেশ উপভোগ্য ছিল সেই ঘ্যানঘ্যানানি। মনে মনে হাসি পাচ্ছিল। তারপর একসময় এক মহিলার বাজখাঁই গলা এবং শিশুটির ঘ্যানঘ্যানানি একটানা কান্নায় বদল হয়ে যেতে বুঝলাম শিশুটিকে তার মা পিটালেন। ধীরে ধীরে কান্নাও স্তিমিত হয়ে এলো। বাইরে পাখি ডাকছে। পাশের বাড়ির এক কেশো বুড়ো দিনরাত কাশতে থাকে। মাঝে মাঝে হাতা খুন্তি নাড়ার শব্দ পাচ্ছি বিভিন্ন বাড়ি থেকে। আজ আমি বাড়িতে একা। তাই বেশি আনন্দ। একা থাকলে অনেক কিছু করা যায়। যেমন আমি এখন সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে গেলাম প্রচণ্ড গরমে। কে আর দেখতে আসছে? জানালায় একটা চড়ুই পাখি উড়ে এসে বসলো। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভিতরটা দেখছে। তারপর এক পা সাহসী পদক্ষেপে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। কি একটা ঠুকরে মুখে পুরলো। তারপর কিচকিচ করে উড়ে পালিয়ে গেলো। আমি লেখা ছেড়ে দিয়ে এসব অবাঞ্ছিত দৃশ্য দর্শন ও শব্দ শ্রবণ করে যাচ্ছি। কেন? এতে আমার লাভটা কি? পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, অনেকদিন এসবও তো দেখা হয়নি। যেমন আজ অনেক দিন স্বর্নালীকে দেখা হয় নি। ছোটবেলায় মামাবাড়ি গেলেই চাবাগানের রাস্তায় ওর পাশে হাঁটার জন্য বুকের ভেতর কিরকম আকুলিবিকুলি করত। এখনো ভুলতে পারবো না। এই আঠারো বছর বয়সে এসেই কেমন যেন বদল হয়ে গেলো সব। ওর সাথে খোলামেলা কথা বলতে কেমন একটা আড়ষ্টতা বোধ করি। ওর বাবা-মাও যেন কেমন চোখে তাকায় ওর সাথে কথা বলতে গেলেই। এখন তো মামাবাড়ি যাওয়াও কমেছে, ওর সাথে দেখা হওয়াও। চড়াইটা আবার ফিরে এসেছে। সাথে আর একটি চড়াই। ওরা কি স্বামী-স্ত্রী? হতেই পারে। এবার একটু লজ্জা লাগলো। একটু আগেই চড়াইটা আমার নগ্নতা দেখে গেছে। এখন কি ওর স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে আমার নগ্নতা দেখানোর উদ্দেশ্যে? ওরাও কি আমাদের শরীর দেখতে ভালোবাসে? যাহ! যতসব উটকো চিন্তা। তবে এবার আর সম্পূর্ণ নগ্ন থাকলাম না। লজ্জা বোধটা ঢুকে গেছে। বারমুডাটা তার থেকে নামিয়ে পরে ফেললাম আবার। লোকে শুনলে হয়তো হাসবে যে আমি একটা চড়াই দম্পতিকে লজ্জা পাচ্ছি। বারমুডা পরে আমি জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। চড়ুই দুটি উড়ে গেলো। আমার যদি সিগারেটের নেশা থাকতো তবে নির্ঘাত এইসময় আমি জানলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতাম আর আমাদের আমগাছের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে কিছু একটা ভাবতে থাকতাম। কিন্তু আমি গল্পটা শেষ করতে পারছি না বলে প্রচণ্ড খারাপ লাগছে।
সেদিন সারাটা ২৪ঘন্টা আমি কষ্ট পেয়েছি। কোথাও মন বসাতে পারছিলাম না বলে। কেউ আমাকে বুঝতে চাইছিল না বলে। এমনও হতে পারে যে সবাই আমাকে বোঝার চেষ্টা করছিল, আমিই গোঁয়ারের মত ভুল ভাবছিলাম। রাগের মাথায় আমাদের কুয়ো পাড়ে গিয়ে পাগলের মত মাথায় বালতির পর বালতি জল ঢেলে, কুয়োর গায়ে লাথি মেরে পা কেটে তবে কিঞ্চিৎ রাগটা কমানো গেছে। এখন যেমন মনে হচ্ছে আমি সুস্থই আছি, তখন কি অসুস্থ ছিলাম? মানুষ যখন রেগে যায় তখন কি সে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে?
ঘড়ির কাটা টিকটিক করতে করতে ১টা হয়ে গেলো। চান করে নেওয়া উচিৎ এখন। কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যে গল্পটা শেষ না করে চান করবো না। এসব প্রতিজ্ঞা অবশ্য নিজের মনে মনে। ভাঙলেও কেউ এসে দোষ দেবেনা বা হেয় করবে না, কিন্তু আমি আবার এগুলো খুব মানতে পছন্দ করি। জানালা দিয়ে আমাদের ৫কাঠা জমি দেখা যায়। শহরের মাঝেও এতটা জমি দেখে অনেকে এখনো চোখ টাটায়। কিন্তু আমি ওসব গ্রাহ্য করি না। আমাদের হার্ড ক্যাশ থাকতে পারে প্রচুর কিন্তু লিকুইড মানি অতি সামান্য।
কিছুক্ষণ একভাবে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ব্যথা হয়ে গেলো। ফিরে টেবিলে এসে বসলাম। গল্পটা কিছুতেই নামছে না। কারেন্টও আসছে না। ভ্যাপসা গরম। মাথাটাও আবার গরম না হয়ে যায়, তাহলেই সাড়ে সর্বনাশ।
কিছু দিন আগে পায়ের যেখানে কেটেছিলাম সেখানে একটা মাছি এসে অনেকক্ষণ ধরে জ্বালাতন করছে। এবার হাত দিয়ে এক চাপড় বসাতেই পুরনো ঘা দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরুতে শুরু করলো, আর মাছিটাও ভাগলবা। উফ, কি ব্যথা হচ্ছে! আচ্ছা আজ কি সবাই মিলে আমাকে জ্বালানোর জন্যই প্রত্যয়বদ্ধ নাকি!
চারদিন পর হোস্টেলে ফিরে যেতে হবে। তার আগেই যদি গল্পটা শেষ না হয় তবে খুব চাপ হয়ে যাবে। আর মাত্র ৫দিনের মধ্যে লেখাটা জমা দেওয়ার কথা। হঠাৎ হস্টেলের কথায় গার্লস হস্টেলের কথা মনে পড়ে গেলো। আহ্! প্রিয়াঙ্কা এখন কি করছে? শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে নাকি টিভি? আচ্ছা ওদের পাড়ায় কারেন্ট আছে এখন? আমাদের পাড়াতেই যে কেন নেই? ওদেরও না থাকলে তো প্রিয়াঙ্কারও খুব গরম লাগছে! আচ্ছা ও কি আমার মতই বাড়িতে একা আছে? আমি যেমন একা বাড়িতে গরমের তেজে উলঙ্গ হয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ, ও কি তাই করেছে? উফ! ওকেও কি কোন চড়ুই কিংবা শালিক দেখে নিয়েছে এক ঝলক? খুব হিংসে হতে লাগলো সেইসব পাখিদের উপর যারা প্রিয়াঙ্কাকে নিরাবরণ দেখবার সৌভাগ্য মণ্ডিত। ধুর! কিসব ভাবছি! প্রিয়াঙ্কা কি আর আমার মত অসভ্য! ওর নগ্ন হতে বয়েই গেছে। প্রিয়াঙ্কাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। এখন আর গল্প লেখায় মন বসবে না। চারিদিকের আওয়াজ, প্রকৃতি, কিছুই ভাল্লাগছে না। প্রিয়াঙ্কাকে চাই। প্রিয়ঙ্কর ঘাড়ে এক ফোঁটা ময়লা নেই। প্রিয়ঙ্কর কটা চোখের সৌন্দর্য — আহা! স্বর্নালীরা বাল্য প্রেমের মত সরে যাচ্ছে আঠারো বছর বয়স থেকে। আমার এই আঠারো বছর বয়সে তোমাদের অবদান শুধু লেখনী। আমার মনে দুর্দান্ত সব স্বপ্ন নেমে আসছে। একদম রঙিন স্বপ্ন। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখার ব্যাখ্যাও কি ফ্রয়েড করে গেছেন? নাহ অত পড়াশোনা নেই।
হঠাৎ সব রোদ নিমেষে হারিয়ে গেলো। একটা কাক আমার জানালায় উড়ে এসে বসেছে এবার। দাঁড়কাক। কুচকুচে কালো। হযবরল’র কুচকুচেশ্বর হতে পারে। এই কাক এখন খুব কম দেখা যায়। অনেকদিন পর দেখলাম। কিন্তু আমার দিবাস্বপ্নে এরকম বিশ্রী কা-কা আওয়াজ আমার পছন্দ হয়নি। পেপারওয়েট তুলে ছুঁড়ে মারলাম। গ্রিলে বাড়ি খেয়ে পেপারওয়েটের কাঁচ টুকরো টুকরো হয়ে মেঝেতে পড়ে রইলো। কাকটার একটা পালকও বাঁকা হয়নি। আমার মনে হল ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে উড়ে যাচ্ছে আমগাছের ডালে, আর বলছে, ”ব্যাটা ব্যর্থ প্রেমিক – ব্যর্থ লেখক!”
এবং সাথে সাথে ধা করে হঠাৎ সেই ফেমিনিষ্ট মহিলা ল্যাঠার কথা মাথায় এসে গেলো। গল্পে ঢুকে পড়লাম। সেই গল্পেও এখন একজন কাকের আবির্ভাব হয়েছে।
Posted in: September 2020, STORY