কুয়োদর্শন: রাহেবুল

হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত নই, তার কথা মনে বা মাথায় নেই। সামনে একটা পাতকুয়ো এসে চুপটি। দেখিনি কো। তাতে হুমড়ি খেয়ে, সামলানোর চেষ্টা করে করেও পড়েই গেলুম। রাজস্থান-মহারাষ্ট্রের কুয়োগুলোর কথা খেয়াল হচ্ছিল। কী গভীর, অথচ জল নেই, জল নেই অথচ কী কষ্টে নামা। জল চাই অথচ কী কামড়াকামড়ি একে অপরে। জাতে-জাতিতে।

কুয়োর ভেতর কোনো কোলাব্যাঙ পেলুম না, কুনো ব্যাঙ-সোনা ব্যাঙের তো দ্যাশই না সেটা। কোলা ব্যাঙ থাকবার কথা ছিল। কুয়োর ব্যাঙ নেই? কুয়োয় ব্যাঙ নেই? ভাবতে পারছিলাম না। অথচ সে কথা আদ্যি থেকে শুনি। তন্ন তন্ন করে পরে পেলুম একটা ব্যাঙ, বিগ ব্যাঙ তার নাম-পরিচয়। আমার তাকে অনেক জিজ্ঞাস্য, পলায়নও জানিতে হবে, পরিত্রাণ পেতে হবে। ব্যাঙ শুরু করিল মা-র প্যাটে ভ্রুণায়িত থাকবার সময়কার ব্যাক-ডেটেড কথা, তার সঙ্গে নাকি আমার মিল। এ কুয়োয় আসাটা, নেমে পড়াটা নাকি কাকের তালে হয়নি, হয়েছিল ভাগতে ভাগতে, দৌড়তে দৌড়তে, জেনেবুঝেই নাকি ভাগছিলাম আমি। পেছনে কেউ বন্দুকের নল ধরে আছিল নাকি (ফেক এনকাউন্টার?), নাকি সামনে থেকে ঝাঁঝরা করার ধান্ধায় ছিল কেউ? কোনো কেউকেটা? মরুদ্যাশে যেমন শুনি। আর সামনেই ছিল পষ্ট, খুড়োর কলে ঝোলানো ক্ষমতা। দে ছুট। ছুটতে ছুটতে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত নই, হাঁটবার/ভাগবার/দৌড়বার কথা মনে নেই বা মাথায় নেই। সামনে একটা পাতকুয়ো এসে চুপটি। তারপর ওই পড়ে গেলুম। হুড়মুড়িয়ে। স্লো মোশনে ভাবতে গেলুম, বেশ নয়নাভিরাম, ইচ্ছে ইচ্ছে লাগছিল…যেমন যোনির ভেতর যোনি, জনন… হস্তে মৈথুন…

ব্যাঙের ভেতরটা, মানে সেই কুয়োর ভেতরটায়/ভেতরটার দর্শন আছে। দেখা হয় আমার। নীল নীল শ্যাওলা, পুরোনো ক্ষয়ে যাওয়া স্যান্ডেল, ভাঙা আর মস্তক বিগড়ানো রোবটের ঠ্যাং, কম্পুর কলিজা, বড়দের বমি, বাচ্চার হাগু-মুতু, চ্যাংড়া-চ্যাংড়ির কন্ডোম, কিছু আদিম আর আধুনিক দন্ত, মোবাইল আর মেয়ে-মহিলার প্যাড। কি-এর প্যাড আর পরনের। দু’একটা পানিজোঁক, পানি নেই তাও বাঁচবার তেষ্টায়। এবং অন্যান্য ইত্যাদিগুলি।

ব্যাঙ শোনালো জিউস আর জিসাসের কথা। টলমল টলমল নুহুর নৌকার কথা। ইসার কথা বলায় কুয়োর ব্যাঙ, মানে সে বিগ ব্যাঙ শোনালো এদের সকলের জন্মের ঠিকঠিকানা, ঠিক ঠিকানা না থাকবার কথাও। অসুরের তাড়ায় ভাগছিলাম বলাতে সে বলিল “দুর্গা কোথা? সেই যে পাজির হাড্ডিরে বাপ। অসুরকে পটিয়ে, তাকে ঠকিয়ে সে যে রানি হতি চাইছিল। দিন বদলেছে, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বদলেছে, হাওয়া বদলেছে, মনুর বাচ্চারা বদলেছে, বিরোধীপক্ষ জোট বাধছে, ঘোট পাকছে, অসুর সব বুঝে গেছে, ধরে ফেলেছে সব, নিজেকে বাদে। ভলতেয়ার ভাঙাতে চাইছিল ভুল, কে বোঝে? সমঝোতাও যে হয় না কখনও সমান সমান। কিংবা সমানে সমানে না হলে হয় না এসব”।

কুয়োয় বন্দি আমি। বোর। বিরক্ত। জেন ইয়ং বলে সহজে ঘাবড়াইনি। হিটলারের নাম শুনেছি ইতিহাসে, বাস্তবে সে রাজার রূপ দেখিনি, ধারণা করতে পারিনা। নিজেতে ধারণ করে বসে আছি নাকি নিজেই? সন্দেহ হয়। সন্ধ্যা নামে। অবশ্য এখানে সারাক্ষণই অনাবশ্যক আলোর অনুপস্থিতি, ভালোই লাগছিল। কুয়োর গায় বেড় দিয়ে গোল গোল করে চক্কর কাটছিল ক্ষুদে গ্রহেরা, যেমন অতীতে কোনো কস্মিনকালে কোনো সার্কাসে বাইকের খেলা দেখেছুলুম। সব কিছু এইখানে মরা মরা, রাম রাম নেই। ফকিরের কেরামতি নেই। জাদুদণ্ড নেই।

অনেক জিজ্ঞাস্য, পলায়নও জানিতে হবে, পরিত্রাণ পেতে হবে এসব পুনরায় মাথায় পড়ছিল। বুড়ো ব্যাঙকে আবারও বললাম নৌকার কথা, সন্তরণের কথা, মইয়ের কথা। মান্ধাতার একটা ভিডিও ক্লিপ বুড়ো দেখাইল: সক্রেটিসের হাতে এক পেয়ালা হেমলক ধরানো। খেলে পরে, কুয়োর পৃথিবীটা সচল হয় (এত এত ক্ষণ কি তবে থেমে আছি, থমকে আছি?)। এমন বলে বুড়ো ব্যাঙ। বলে “সে মহামহিম আন্ধারকে জানিতে হবে বাছা, গায়ার নাম শুনেছ? সেই ব্রহ্ম? পৃথিবী হইতে আসিয়াছ তথাপি পার্থিব জানো কি?” আমি আমাদিগের সরকার-বেসরকারের ন্যায় অসহিষ্ণু হয়ে বললাম “অসুর, রাক্ষস, খোক্কস, দুর্গা, দশমাথা রাবণ, শোষক, শাসক এসব?” হেঁয়ালি করে বলিল “দ্যাখ না রে মন ঝাঁক মারি এই দুনিয়াদারি”। দিয়ে ঘুমোতে বলিল, বলিল জেগে ঘুমাতে। আর কোনো কথা নেই, বলা নেই— দুম করে বুড়ো মরে গেল, বোধয় সাময়িক।

…আলো উঠছিল উর্ধ্বমুখে, ছড়িয়ে ছড়িয়ে, মই ভাবছিলাম, বটপাকুড়ের ঝুরির ঢক সব কিরণরশ্মি । গুমগুম শব্দে, পাক খেয়ে খেয়ে বিগ ব্যাঙের কুয়ো হতে কথারা বড় হচ্ছিল, বাড়ছিল—ছড়িয়ে পড়ছিল দিকে-বিদিকে—

N কোড

আলতো ছিঁড়ে ফেলতে একটা কিসের লিপ, কুটিকুটি।
আর, একটা আমি জন্ম নিলে। রাক্ষস রাক্ষস।
একটা হিডেন করা আমি হঠাৎই প্রকাশ্য খুনোখুনিতে …
ট্যাটুর গায় লিখন চলিল নতুন পেনাল কোডের

Facebook Comments

1 thought on “কুয়োদর্শন: রাহেবুল Leave a comment

Leave a Reply