কড়ি ও কোমল : পৃথা কুণ্ডু

গোধূলিবেলা। ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে অল্প আলো আসছে। সোফায় বসে আছেন এক ভদ্রমহিলা। চোখেমুখে উদ্বেগ, হাতের আঙুল মটকানিতে অস্থিরতা স্পষ্ট। ইজিচেয়ারে আধশোয়া আর একজন। স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মহিলার দিকে।
মহিলা আর থাকতে না পেরে বলে ওঠেন, ‘আপনি কিছু বলুন? চুপ করে বসে থাকবেন!’
ভদ্রলোক আস্তে আস্তে সোজা হয়ে বসেন। শান্ত গলায় বলেন, ‘শুনলাম তো সব। তুই কি চাইছিস বল?’
‘আমি এভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছি। গাইতে পারছি না, পাগল পাগল লাগছে। আমায় বাঁচান – যে ভাবেই হোক।’
‘একটু মাথা ঠাণ্ডা কর । আমি দেখি কি করা যায়। অসীমের সঙ্গে একবার…’
ভদ্রলোকের হাতটা চেপে ধরেন মহিলা, ‘না আপনি ওকে বলবেন না। তাহলে আমি তো আপনাকে না বলে আরও দশটা লোককে বলতে পারতাম।’
‘সবার সঙ্গে ঝামেলা বাধিয়ে রাখলে চলবে? আচ্ছা দেখি…’
‘আপনি আগে কথা দিন!’
একটু হেসে, খুব আলতোভাবে হাতটা ছাড়িয়ে নেন ভদ্রলোক, ‘ফোনের তারটা খুলে রাখিস না। জরুরি ফোন তো আসতে পারে। এখন উঠি, একটা রিহার্সাল আছে ।’
উঠে দাঁড়ান তিনি, সামনে পা ফেলতে গিয়ে সামান্য টাল খেলেও সামলে নেন । ভদ্রমহিলা একটু অবাক হন, চোখ পড়ে তাঁর পায়ের দিকে। দেখেন, গোড়ালির খানিকটা ওপরে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধা।
‘কী হয়েছে পায়ে?’
‘আর বলিস না। কাল স্টেজ থেকে নামতে গিয়ে চোট, বাঁশের সিঁড়িটা নড়বড়ে ছিল।’
‘তো… এই অবস্থায় আপনি এলেন…? একটা খবর দিলে আমিই নাহয় যেতাম।’
‘ফোনটা বন্ধ রেখেছিস তো! যাক, চলি।’

স্নেহাংশু সেন আর সুলেখা রায়। বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী সুলেখাদেবীর পারিবারিক বিপর্যয়ের সময় অনেক সাহায্য করেছিলেন গায়ক-সুরকার স্নেহাংশু, কাজের জগতে তো অবশ্যই, ব্যক্তিগত জীবনেও – এটা জানে আহির। সংস্কৃতি জগতের অনেকেই জানে। সেই স্নেহাংশুর চরিত্রে অভিনয় করছে সে। দৃশ্যটা এরকম – স্নেহাংশু সুলেখার বাড়ি এসে তাঁর ব্যক্তিগত সমস্যার কথা ধৈর্য ধরে শুনছেন। এর মধ্যে তিনি কিছু ব্যবস্থাও করে রেখেছেন সুলেখার জন্য – একটা ফোন আসবে পরের দৃশ্যে, সুলেখা একটা বড় কেরিয়ার ব্রেক পাবেন। স্নেহাংশুর সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে তিনি গাইবেন ‘এ কী শ্যামল সুষমা’ আর আধুনিক ‘তোমার চিঠি আমার কাছে পৌঁছে দেবার পথ’ – সে সময়কার বিখ্যাত গান। রোমান্টিক গানে জনচেতনার হাতছানি, তাও আবার ডুয়েটে। এর হিন্দি ভার্সনটাও খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। অথচ এ কথাটা স্নেহাংশু নিজে বলেননি সুলেখাকে, সরাসরি ফোন করিয়েছিলেন ভারতবিখ্যাত প্রযোজককে দিয়ে। যাতে সুলেখাদেবীর সম্মান বজায় থাকে। কিন্তু এই দৃশ্যে কিছুতেই অভিব্যক্তি ফোটাতে পারছে না আহির। কীভাবে তাকাবে সে তানিয়া অর্থাৎ ‘সুলেখা’র দিকে? কীভাবে বলবে কথাগুলো? চিত্রনাট্যে একটা ইঙ্গিত আছে, একটা সম্পর্কের ইঙ্গিত – কিন্তু সেটা কী, সে ঠিক ধরতে পারছে না। চরিত্রটা খুব ভাবাচ্ছে তাকে।
আহিরের কাছেও স্নেহাংশু সেনের বায়োপিকে তাঁর চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাওয়া একটা বড় কেরিয়ার ব্রেক। ছেচল্লিশ বছর বয়স হল, অনেকেই তার অভিনয়ের প্রশংসা করে মুখে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত ‘গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্র’ ছাড়া আর কোন রোলে কেউ ভাবেনি তাকে। পরিচালক তূণীর মিত্র হঠাৎ তাকে ডেকে এই অফারটা দিলেন। আহিরকে কিছু হোমওয়ার্কও করতে হয়েছে এ জন্য – স্নেহাংশু সেন সম্বন্ধে অনেকের স্মৃতিচারণা, তাঁর আত্মজীবনী, এসব সে পড়েছে। স্মৃতিচারণায় নানা জনে নানা কথা বলেন, তার মধ্যে গরমিল আছে অনেক, আবার একটা নির্দিষ্ট জীবনচর্যার ধারাও পাওয়া যায়। মূলত এই ধারাটাকে ধরেই চিত্রনাট্য সাজানো হয়েছে। আত্মজীবনীতেও সাদামাটা কিছু কথা – তাঁর পরিবার, তাঁর আত্মপ্রতিষ্ঠার যাত্রা, তাঁর নান্দনিক অনুভূতির একটি দুটি ঝলক – কিন্তু এর মধ্যে আসল মানুষটা কোথায়? অভিনয় করতে গিয়ে পদে পদে সে অভাব টের পাচ্ছে আহির।
এই চরিত্রটা সে করছে শুনে ফোন করেছিল তার প্রাক্তন স্ত্রী, শ্রেয়া। বলেছিল, ‘কনগ্রাচুলেশনস। এতদিনে তোমার একটা বড় চান্স এল।’
তিক্ততা মরে নি এখনও, ছেলের কাস্টডিও সে পায়নি। ফোনটা পেয়েই মাথা জ্বলে গিয়েছিল আহিরের। অনেকগুলো কথা শুনিয়ে দেবে ভাবল, কিন্তু রাগে ফেটে পড়ার আগেই শ্রেয়া প্রবল ন্যাকামি করে কয়েকটা গা জ্বালানি কথা বলে ফোন রেখে দিল।
ফোনটা রাখার পর মনে হয়েছিল, তেড়ে গালাগালি দিয়ে মুখে ঝামা ঘসে দিতে পারলে সে শান্তি পেত। কিন্তু এখন এসব করতে গেলে তারই মানসিক স্থিতি নষ্ট হবে, কাজে মন দিতে পারবে না সে।
আচ্ছা, স্নেহাংশু এক্ষেত্রে কি করতেন? আহির শুনেছে, রাগ হলে চুপ করে যেতেন। মাথা ঠাণ্ডা হলে তারপর কথা বলতেন। আবার একজন বলেছেন, একবার নাকি রাগ করে হারমোনিয়াম ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। কথাটা অবশ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। আগের দিনই একটা দৃশ্যের শুটিং করতে গিয়ে এক শব্দযন্ত্রীর কাছে শোনা একটা কথা তাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। হারমোনিয়াম ধরে শট দিতে বসেছিল সে। হঠাৎ – বেহালায় যিনি বসেছিলেন – ভদ্রলোক বয়স্ক, স্নেহাংশুর সঙ্গে বাজিয়েছেন তরুণ বয়সে – বলে উঠলেন, ‘একটা কথা বলব?’
একটু কৌতূহলী হয়েই আহির বলেছিল, ‘বলুন বিমানদা?’
‘ওভাবে না, উনি হারমোনিয়ামটা ধরতেন অন্যভাবে।’
হারমোনিয়াম আবার অন্য কেমন ভাবে ধরে মানুষ? যেভাবে সবাই ধরে সেভাবেই তো ধরেছে সে! আহির অবাক হয়ে তাকায় পরিচালকের দিকে।
তূণীর ইশারায় তাকে থামিয়ে বিমানকে জিজ্ঞেস করলেন – ‘আপনারা তো কাছ থেকে দেখেছেন, কীরকম একটু বলুন।’
‘ঠিক বোঝাতে পারব না, মানে… যেভাবে একজন মা কোলের কাছে শিশুকে ধরেন, অনেকটা সেইরকম। আগলে রাখার মত।’

ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হল না। শুনলে একটু হাস্যকরও লাগে। ওরকম লম্বাচওড়া ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন পুরুষ হারমোনিয়াম ধরেন নাকি মায়ের মত!
স্নেহাংশুর চরিত্রটাকে নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা করার আছে। সেটা অভিনেতার চেয়ে অনেক বেশি করার কথা পরিচালকের। কিন্তু তূণীর কি সেভাবে ভাবছেন এটা নিয়ে? নাকি এটা শুধুই বায়োপিকের এই বাজারে পুরনো দিনের একজন নামী শিল্পীকে নিয়ে একটা পিরিয়ড পিস বানিয়ে বাহবা কুড়োনোর ইচ্ছা? চিত্রনাট্যে স্নেহাংশুকে দিয়ে বলানো হচ্ছে ‘খেলো জিনিস করব না, কিন্তু এমন কাজ করব যার দাম দেবে সাধারণ লোকেও। নিজের খেয়ালে গাইতে হলে তো হিমালয়ে বসে বেদ গাইতাম।’ শুনলে মনে হবে, হিমালয়ে বসে গান গাওয়া – কথাটার মধ্যে একটু ব্যঙ্গের আভাস আছে। অথচ সেই হিমালয় নিয়েই কী অনবদ্য কাজ রেখে গেছেন! ‘তপোভঙ্গ’ ছবিতে টাইটেল সং ছিল কুমারসম্ভবের প্রথমদিকের কটা শ্লোক। আর ছবির ক্লাইম্যক্সে মদনভস্মের অনুষঙ্গ। পরিচালকের নাকি সংশয় ছিল, কুমারসম্ভব থেকে ছবির শেষদিকেও আবার অতখানি স্তোত্রপাঠ রাখবেন কিনা। লোকে বুঝবে তো? এমনিতেই খুব সিরিয়াস ছবি। তিনি চেয়েছিলেন, ভাবটা নিয়ে বরং গান লিখে দিক প্রসূন মল্লিক। সঙ্গীত পরিচালক স্নেহাংশু বলেছিলেন, ‘পুরোটা না হোক, কয়েকটা শ্লোক গাইতে দিন। আইডিয়াটা ঠিক আসবে না নইলে।’ সুর দিয়ে গাইলেন – মহাদেবের চোখ খোলার মুহূর্ত, উমার চোখে চোখ পড়া থেকে জ্বলে ওঠা, মদনের ছাই হয়ে যাওয়া, প্রকৃতি আবার শান্ত, বিষণ্ণ – মধ্যসপ্তকে শুরু করে, তারসপ্তকে উঠে শেষ করলেন গভীর খাদে। হিমালয়ের ওই অটল গাম্ভীর্যের ভাব ফোটালেন, তার মধ্যেই চূড়ান্ত নাট্যরস জমিয়ে দিলেন শুধু গলার আওয়াজে আর তারসানাই, মৃদঙ্গের আবহে! খুব ভাল সমালোচনা হয়েছিল, আর সাধারণ দর্শকও বেশ নিয়েছিল ব্যাপারটা।
অনেক বৈপরীত্য মানুষটার মধ্যে। একদিকে চূড়ান্ত হিসেবি, পেশাদার, আবার অন্যদিকে প্রায় বৈরাগী। অ্যাডভান্স ছাড়া কোন কাজে হাত দেবেন না, আবার কেউ একান্তে তাঁকে কষ্টের কথা জানালে অবলীলায় সব বিলিয়ে দেবেন, কেউ জানতেও পারবে না । রীতিমত বাস্তববাদী, আত্মসম্মানী, পেশাদারি জীবনে অত্যন্ত কড়া, অথচ কাজের বাইরে – অন্তরঙ্গ, সহজসরল, অমায়িক, কারও বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে একপায়ে খাড়া। একটা ঘটনা – চিত্রনাট্যে দেখানো হয়নি, কিন্তু আহির পড়েছে এক জায়গায়। গ্রামের দিকে একটা অনুষ্ঠান সেরে ফিরতে ফিরতে, চা খেতে নেমে একটা ধু ধু মাঠের ধারে কতগুলো পোড়ো বাড়ি দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন স্নেহাংশু, স্থানীয় লোকদের কাছে একটু গল্প শুনলেন। সেদিনই রাতে সুর করতে বসলেন ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ – অথচ তখন অন্যান্য কাজ, ব্যস্ততা তুঙ্গে। ‘আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে’-র অমন অসাধারণ সুর, পড়েই ছিল অনেকদিন। ঘরোয়া অনুষ্ঠানে কেউ অনুরোধ করলে গাইতেন। একেবারে শেষ বয়সে কোম্পানির চাপাচাপিতে রেকর্ড করলেন – ভালই বিক্রি হয়েছিল, তবু শুনলে আপসোস হয়, আরও আগে কেন করলেন না? ‘জন্ম দিয়ে এত মায়া পড়েছিল, বেটিকে সবার সামনে ছাড়তে ইচ্ছে হয়নি, তাই আগলে রেখেছিলাম’, বলে হাসতেন।
শুটিং সেরে বাড়ি ফিরে স্ক্রিপ্টটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইল আহির। হচ্ছে না, তার অভিনয় হচ্ছে না। সে নিজেই বুঝতে পারছে। কিন্তু চরিত্রটার প্রতি একটা টান অনুভব করছে সে। তার সঙ্গে কোথাও কি মিল আছে মানুষটার? নিজের সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে গ্রুপ থিয়েটার করা, অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে অভিনয়ের লাইনেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া, স্বীকৃতির জন্য লড়াই – এগুলোর সঙ্গে স্নেহাংশুর কিছুটা মিল আছে ঠিকই, তবে এগুলো তো অনেক শিল্পীর জীবনেই থাকে।
ভাবতে ভাবতে আর ভাল লাগছিল না, ডিনার সেরে শুয়ে পড়বে ভাবল আহির। স্ক্রিপ্টটা টেবিলে রাখতে গিয়ে ক্যালেন্ডারটার দিকে চোখ পড়ল তার। হায়, আজকের দিনটা সে বেমালুম ভুলে গেছে! আজ তার ছেলের জন্মদিন। যতই ব্যস্ততা থাকুক, সকালেই ফোন করা উচিত ছিল। তাড়াতাড়ি শ্রেয়াকে ভয়েস কল করল সে। কেউ ধরল না। অগত্যা একটা মেসেজ করল, ‘বুম্বুকে উইশ করতে চাই।’
চটপট ডিনার সেরে এসে অধীর আগ্রহে ফোনটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল আহির। শ্রেয়া দেখেছে মেসেজটা। তাও উত্তর দিচ্ছে না? মাথা গরম করে লাভ নেই, আবার সে লিখল, ‘প্লিজ একবার বুম্বুকে দাও। আজকের দিনে একটু কথা বলতে চাই।’
এবার উত্তর এল, ‘ভেরি সরি, ও কথা বলতে চাইছে না। ও এখন বড় হচ্ছে, উই শুড রেস্পেক্ট হিজ উইল।’
ফোনটা হাতে নিয়ে আহির হতভম্বের মত বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর চোখের ওপর হাতখানা ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়ে। বুম্বু কথা বলতে চাইছে না? নাকি এসব শ্রেয়ার শেখানো? গত মাসে বুম্বুর সঙ্গে একদিন দেখা করেছিল সে, খুব ছাড়া ছাড়া ভাবে কথা বলছিল ছেলেটা। হয়ত শ্রেয়া এমন ভাবে গড়ে তুলছে ছেলেকে, যাতে সে তাকে ঘৃণা করতে শেখে। তাহলে সেদিন নিজে ফোন করে উদারতার নাটক করার কি দরকার ছিল? অভিনন্দন জানানোর ভদ্রতা – শয়তানি যত সব! এতদিন যে আহির বড় কিছু করে উঠতে পারেনি, সেটাই মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিল আর কি!
কিন্তু বুম্বু? সে কি তার বাবাকে সত্যি অপছন্দ করার সিদ্ধান্তটা নিজে নিজে নেওয়ার মত বড় হয়ে গেছে? দোষ তো তারও আছে – আজ সারাদিনে সে একটা ফোন করতে পারল না? আর শুধু আজই বা কেন, এতদিন ধরে মাঝে মাঝে দেখা করা আর গিফট দেওয়া ছাড়া সত্যি তো সে সন্তানের প্রতি যথার্থ দায়িত্ত্ব পালন করতে পারেনি কোন। অথচ সে কিন্তু চেয়েছিল, ভালবাসতে চেয়েছিল সন্তানকে, পরিবারকে। যে পরিবেশ থেকে সে উঠে এসেছে, সেই মধ্যবিত্ত পরিমণ্ডলে সবাইকে নিয়ে থাকা, সবার খেয়াল রাখা, এগুলো তো তার মানসিকতার দিক থেকেও অস্বাভাবিক কিছু ছিল না! তবু কেন পারল না সে?
ছটফটিয়ে উঠে পড়ে আহির। আজ গলায় বেশ খানিকটা তরল না ঢাললে মনে হয় সে সুস্থির হতে পারবে না। ফ্রিজটা খুলতে গিয়ে আবার থমকে যায়। কাল সকালেই আবার শুটিং আছে। বেশি পান করে ফেললে যদি কিছু গোলমাল হয়? তাছাড়া তার ডাক্তার বন্ধু রাজর্ষিও বলেছে, স্ট্রেসের সময় যতটা পারা যায় কন্ট্রোলে থাকতে।
রাজর্ষিকেই একটা ফোন করে আহির। অনেকক্ষণ বাজার পর ফোন ধরে সে, ‘কি হল, এনি প্রবলেম?’
‘ঘুমোতে পারছি না। স্লিপিং পিল কিছু খাব?’
‘এমনি, না কিছু হয়েছে?’
‘হবে আবার কি, দ্যাট ব্লাডি…’
থেমে যায় আহির। একটা সংলাপ, একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস তার মাথায় ধাক্কা দিচ্ছে। সংলাপটা দুদিন আগেই বলেছে সে – ‘আমি পারব না বীথি… হ্যাঁ আমার খুব খারাপ লেগেছে, হয়ত ওরও – ও ভাবছে যে ও-ই ঠিক। …আর যাকে এত ভালবেসেছি, আপনজনের মত দেখেছি, তার দেওয়া আঘাতটাও তো আমারই একান্ত ব্যক্তিগত। এ নিয়ে আমি একটা কথাও বলব না। আমাদের ঘরেও তো কতকিছু হয়, বাইরে বলেছি কোনদিন?’
চিত্রনাট্যের স্নেহাংশু বলছেন স্ত্রীর কাছে – তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু, অভিনেতা মৈনাক ব্যানার্জি সম্বন্ধে। একটা সময় চিড় ধরেছিল তাঁদের সম্পর্কে। ঘনিষ্ঠজনেরা অনেকরকম কথা বলে থাকেন এর কারণ নিয়ে। প্রবল মৈনাক-ভক্তরা বলে, নিজের দোষের কথা আর কোন মুখে বলে বেড়াবেন স্নেহাংশু! যাই হোক, তিনি নিজে নীরব ছিলেন বরাবর।
আহিরও পারবে না। শ্রেয়া বুম্বুকে ফোন ধরতে দেয়নি, আজ জন্মদিনে সে ছেলেকে উইশ করতে পারল না… এ কথা রাজর্ষিকে বলা মানে তো নিজেকেই ছোট করা।
রাজর্ষি জানতে চায়, ‘কাকে গালাগাল দিচ্ছিস? কী হয়েছে?’
‘আরে, একটা সিরিয়ালের কাজ নিয়ে ঝামেলা… আমার সম্বন্ধে যা তা রটিয়েছে। এমনিতেই এখন বড় কাজটা নিয়ে চাপে আছি…’
‘অ। এগুলো নিয়ে এত ডিসটার্বড হোস কেন, তোদের লাইফে দিজ আর সো কমন!’
‘হতে চাই না। তবু,… তোর টাইম খাব না বেশি, একটা ওষুধ বল না!’
‘ওষুধ এখনই খাস না। আলো নিভিয়ে, চুপচাপ – লিসন টু সাম মিউজিক। সুদিং কিছু। তাতেও ঘুম না এলে হোয়াটসঅ্যাপ করিস, বলে দেব।’
রাজর্ষির কথাই শোনা যাক তবে। স্নেহাংশুর গানই চালাল আহির। এই গানগুলোয় তাকে লিপ দিতেও হবে। প্র্যাকটিস করবে বলে সব একটা ফাইলে ভরে রেখেছে সে।
প্রথম গান ‘অমিয়মথন’ ছবি থেকে, ‘চকিতে চাহিয়া তোমারে হে কানু/ দেখিনু কি দেখি নাই/ বুঝিতে পারিনা এ কি মরীচিকা/ তবু হায় কাঁদিলাম/ কেঁদে বড় সুখ, ভাসে সেই মুখ/ হিয়া মাঝে রাখিলাম।’
কীর্তন ঘেঁষা সুর, তার সঙ্গে আধুনিক মেজাজ আর খুব হালকা ক্লাসিক্যালের মিশেল। আহির শুনেছে, এ গানের প্রথম লাইনদুটো নিজেই নাকি লিখে দিয়েছিলেন স্নেহাংশু। বাকিটা লেখেন গীতিকার নির্মল অধিকারী। আহির গান খুব ভাল যে বোঝে তা নয়, তবে সে সাহিত্যের ছাত্র ছিল, কথা আর সুরের মিল না ঘটলে কানে লাগে। এ গানটা সত্যি অসামান্য। রাধাভাবের একটা গান এইরকম করে গাইতে পারে একজন পুরুষ, ওই ব্যারিটোন গলায়! অনেকে বলে, গানের কথার সঙ্গে, সিচুয়েশনের সঙ্গে, যে গাইছে সেই চরিত্রের সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে মিশে যেতেন স্নেহাংশু গান গাওয়ার সময়, কিন্তু মুখের রেখায় তেমন কোন অভিব্যক্তি ফুটত না। এই লোকের চরিত্রে লিপ দেওয়া মুশকিল।
‘আমি হিয়া মাঝে রাখিলাম…’ সঞ্চারীতে আবার ফিরে আসছেন গায়ক। আর একটা গানের কথা মনে পড়ে আহিরের। স্নেহাংশুর গলায় খুব পরিচিত এক রবীন্দ্রসঙ্গীত। ‘আমার মন মানে না’। আগের গানটা শেষ হতেই এটা চালায় আহির।
‘সে সুধাবচন সে সুখপরশ / অঙ্গে বাজিছে বাঁশি…’ যেন অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে প্রিয়তমকে অনুভব করছে এক নারী। কোন মহিলা শিল্পীর গায়নেও এই ভাব পাওয়া দুষ্কর। গানটা আগেও শুনেছে আহির কিন্তু এভাবে ব্যাপারটা মাথায় আসেনি।
আচ্ছা, সুলেখা রায়, অনিন্দিতা মুখার্জি, সুনয়না পারেখ – এঁদের জন্য যে সব গানে সুর করেছেন স্নেহাংশু, এত অসাধারণ হত কী করে? অন্য সুরকারদের সুরেও এঁরা তো অনেক হিট গান গেয়েছেন, কিন্তু স্নেহাংশুর সুরে যেন একটা আলাদা ব্যাপার আছে। কী সেটা?
আর একটা গান চালায় আহির। ‘চণ্ডালিকা’র গান – ‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা’। স্নেহাংশু বলতেন, ‘চণ্ডালিকা আমার পুরো মুখস্থ, একাই টেনে দিতে পারি – মা, মেয়ে সব…’

শুটিং প্রায় শেষের মুখে। আর দু তিনদিনের কাজ বাকি। আচমকা আজ একটা দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়ে ফ্লোরে। সুলেখাদেবী আর নেই। স্টুডিয়ো থেকে অনেকেই শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিল। আহির তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বাড়ি চলে এসেছিল। একটা অদ্ভুত সমাপতন, স্নেহাংশুর বায়োপিকের কাজ চলতে চলতেই মারা যেতে হল ভদ্রমহিলাকে! অবশ্য বয়স হয়েছিল সাতাশি, ভুগছিলেন… ব্যাপারটা এমনিতে স্বাভাবিক। তবু আহিরের একটু কেমন লাগছে। হয়ত স্নেহাংশুকে নিয়ে বড্ড বেশি ভাবনাচিন্তা করার ফল।
ফোনটা বাজছে। হাতে নেয় আহির, ওপারে মলয়। সাংবাদিক।
‘হ্যালো, কী ব্যাপার?’
‘কেমন আছ, তোমার শুটিং-এর কী খবর?’
‘চলছে।…ফোনটা কি তুমি আমার খবর নিতেই করেছ?’
‘কিছুটা ঠিক ধরেছ। ওই… সুলেখা রায় চলে গেলেন তো, বিশিষ্ট লোকদের বক্তব্য নিচ্ছি, তাই তোমায়…’
‘আমি আবার বিশিষ্ট হলাম কবে? আর আমি গানের জগতের লোক নাকি? হ্যাঁ ওঁর গান শুনেছি, খুব বড় মাপের শিল্পী… আর তোমায় তো বলেছিলাম, এই শুটিং-এর আগে ভেবেছিলাম ওঁর সাথে একবার দেখা করে আসব। অসুস্থ ছিলেন, সেটা আর হল না। খবরটা শুনে দুঃখ পেয়েছি। এটুকুই বলব।’
‘আরে তুমি এখন স্নেহাংশু সেনের ছায়া। তোমার কাছ থেকে এইটুকু?’
‘ফাজলামি কোর না। আমি জাস্ট অ্যাকটিং করছি। কাটো দেখি এবার।’
মলয়ের সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ার্কি মারা যায়। কিন্তু এবার একটু গুরুত্বের আভাস তার গলায় –
‘তোমায় কিন্তু একটা জিনিস দেবার ছিল…’
‘কী?’
‘সুলেখাদেবীর একটা কনভারসেশনের অপ্রকাশিত রেকর্ডিং পেয়েছি।… কিন্তু ওটা ট্রান্সক্রাইব করে ছাপা যাবে না। খুব কনফিডেন্সিয়াল। তোমাকে যদি দিই, তুমি ওটা শুনে একটা ছোট বক্তব্য দিতে পারবে? একটু কায়দা করে লিখতে হবে, বুঝতে পারছ?
‘তুমি পাগল হলে? লিখব…আমি!’
‘আরে, এটায় স্নেহাংশুবাবুকে নিয়েও কিছু কথা আছে। আর তুমি তো কমপারেটিভ লিটের স্টুডেন্ট ছিলে। তিনশো সাড়ে তিনশো ওয়ার্ড লিখতে পারবে না? নেহাত না পারলে মুখেই বোল। বাট তোমার ইম্প্রেশনটা চাই।’
স্নেহাংশুর চরিত্রাভিনেতাকে দিয়ে প্রয়াত সুলেখাদেবীর সম্বন্ধে লেখাতে চাইছে মলয়। পত্রিকার পাবলিসিটি পলিসি। সবটাই বোঝে আহির। তবু স্নেহাংশু সম্বন্ধে নতুন কিছু শোনার লোভ সামলাতে পারে না। বলে, ‘পাঠিয়ে দাও, দেখি।’

‘লোকে আমাদের নিয়ে অনেক কিছু বলত, অনেক রকম… কিন্তু আমি তো জানি, স্নেহাংশুদা কী ছিলেন আমার জীবনে। দাদা বলতাম ঠিকই, কিন্তু উনি যেন আমাকে দেখতেন …
রেকর্ডিংটা অস্পষ্ট এখানে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করে আহির। তারপর আবার শোনা যায়,
‘… মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। সেদিন রেকর্ডিং ছিল। শুধু বলেছি, একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন। বললেন, সেরে নে, তারপর কোথায় যাবি বল, পৌঁছে দিচ্ছি। মন্দিরে গেলাম, সঙ্গে উনিও। সন্ধ্যারতি দেখে, বসেছি সিঁড়িতে। লোকজন খুব কম ছিল সেদিন। উনি গান ধরলেন, ‘সন্ধ্যা হল গো ও মা…’ যতবার করে ‘মা…’ গাইছেন, আমার যে কী হচ্ছে! শেষ হলে বলেছি, আজ এই গানটা গাইলেন! উনি বললেন, ‘দিনটা আমার মনে আছে রে।’ ভাবো, কতজনই তো ফুলটুল নিয়ে এসেছিল, কিন্তু উনি মনে রেখেছেন… শুনে আমি আর পারলাম না।… আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘আমারও তো মা চলে গেছেন ক’বছর আগে। মেনে নিতে হয়।…কাঁদিস না। আমি আছি।’
রেকর্ডিংটায় আরও অন্যান্য বিষয়ে কথা ছিল। কিন্তু আহিরের আর কানে ঢুকছিল না কিছু। তার মাথায় ফিরে ফিরে আসছিল কয়েকটা শব্দ আর ছবি – হারমোনিয়ামটা কোলের কাছে আগলে ধরা, বেটি, জন্ম দিয়েছি, চকিতে চাহিনু…, মা…
হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত কয়েকটা কথা মনে পড়ে যায় তার – ছাত্রজীবনে শোনা। অধ্যাপক বলছিলেন,
‘একজন স্রষ্টা, একজন প্রকৃত শিল্পী নিজের মধ্যে ধারণ করেন প্রকৃতি ও পুরুষকে। আমাদের নন্দনতত্ত্বে আছে, দর্শনে আছে – পাশ্চাত্যেও কলাবিদ্যার কোন কোন তাত্ত্বিক বলেছেন, আ ট্রু আর্টিস্ট শাইন্স ইন আ কাইন্ড অব ডিভাইন অ্যান্ড্রোজিনি। এ নিয়ে বিতর্ক অনেক আছে, এটা হয়ত বাস্তবে খুবই বিরল, খুব কম শিল্পীর মধ্যেই হয়ত আমরা সেই দিব্য যুগলসম্মিলন দেখতে পাই …’

‘অ্যাকশন!’ হারমোনিয়ামটা পরম মমতায় কাছে টেনে নেয় আহির। শিশুশিল্পীর চরিত্রে যে অভিনয় করছে, তার দিকে তাকায়, নরম করে বলে – ‘শুনে শুনে তোল, আমি ধরছি।’ চিত্রনাট্যে, জীবনীতে, বহুলোকের স্মৃতিতে নানা দিকের কথা যা-ই থাক, যেমনই থাক – সে নিজের মত করে বোধহয় কিছুটা বুঝতে পেরেছে – কীভাবে তাকাতে হবে, কীভাবে বলতে হবে কথা, কীভাবে আঙুল চালাতে হবে – রিডগুলোকে আদর করে। স্নেহাংশু সে নয়, হতেও সে পারবে না। কিন্তু অভিনয় তো করতে পারবে। সেও তো একজন শিল্পী। অন্তত এই শেষ কটা শট নিজের সবটুকু ঢেলে অভিনয় করবে সে।
স্নেহাংশুর গান – ‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী…’
ঠোঁট মেলায় আহির। আজ আর তেমন অসুবিধে হচ্ছে না।

Facebook Comments

Posted in: September 2020, STORY

Tagged as: ,

Leave a Reply