রাক্ষস তথা রাখালের গল্প : প্রশান্ত গুহমজুমদার

… I WAS IN THE
DARKNESS
SO DARKNESS I BECAME

আমি রাক্ষস। অন্ধকার কী, আমি জানি। যেহেতু আমি-ই অন্ধকার। গোপাল, যার কাছে আমার বসবাস, জানে। একটু অন্য ভাবে। আলোর অভাবকে ও অপছন্দ করে। আলো না থাকলে ও চিৎকার করে। আর আমি, শয়তানি ঠিক কোন পর্যায়ে গেলে সেটা ঠিক আর মানুষের সমাজের মনের মত হয় না, জানি। যেদিন উড়ন্ত এক প্রাণ অন্ধকারে খোলা ছাদে গোপালকে রেখে গেল, আমিও ওর সঙ্গে। আসলে গোপাল আর আমি তো একই! কেবল গোপাল জানে না। কিংবা জেনেছে অনেক পরে। ভিজে দাঁত মাজার ব্রাশ দেখলে কার না ভ্রু কুঁচকে যায়! তাতে যে ক্ষতিটা আমার হয়েছে, সেটা হচ্ছে লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু করার আর দরকার হল না। ওকে আমার ভিতরে ঢুকিয়ে নিলাম। প্রয়োজনে বের করি, ফুরিয়ে গেলে মুখোশ খুলে ঢুকিয়ে দিই। ক্যাঙ্গারুর মত। গোপাল মনে হয় ব্যাপারটা পছন্দ করে না। কিন্তু উপায়ই বা কী! ওর তো কোন পরিত্রাণ নেই।
শৈশব পার হতে তখনো বেশ দেরি। গোপালকে কোলে তুলে মাসি মানে দাই-মা স্নান করাতে নিয়ে যাবে। আমার পছন্দ নয় স্নানের ব্যাপারটা। দিলাম দুটো পা ঝেড়ে। তিন হাত দূরে ছিটকে পড়ল মাসি। আমি মানে গোপালও মাটিতে। ভাগ্যিস কার্পেট পাতা ছিল। বেশ পয়সাওয়ালা বাড়ি তো। মাসি তো হতবাক! এইটুকু বাচ্চার এত পায়ের জোর! যাই হোক, আবার গোপালকে কোলে নিয়ে স্নানে গেল। আমিও আর ত্যাঁদড়ামি করলাম না। কেউ বোধহয় বলেছিলেন, আর যেন কখনও এরূপ না হয়। এমন সব উড়ন্ত বাক্যকে আমি কিছু মান্যতা দিয়ে থাকি। নিজের সুবিধের জন্যই।
গোপালের মাসি মানুষটা খুব ভালো। মানে নির্বিরোধী। সাতেপাঁচে নেই, মুখে এক সাদা হাসি সবসময়য়। এই মানুষটা একদিন বিকেলে গোপালকে নিয়ে যাবে মাঠে। চরাতে। আমার কিন্তু ভালো লাগছে না। গোপাল তখন হাঁটতে পারে। সে-ও চলেছে পিছন পিছন। খুব তিতিবিরক্ত হয়ে মাসিকে দিলাম ঠেলে পিছন থেকে। বেশ জোরেই দিয়েছিলাম। কয়েকটা সিঁড়ি গড়িয়ে নিচে। সে এক রক্তারক্তি ব্যপার। আমার খুব ভাল লাগছিল। রক্ত সিঁড়ি গড়িয়ে নিচে নামছিল। গোপাল চুপচাপ। সবাই দৌড়ে এসে অনেককিছু।
আমি যে রাক্ষস, এই পরিচয় ভুলে যাওয়ার কোন প্রয়োজন আমার ছিল না। এত রাগ, এত শীতল, এত লোভ, এত বিবিমিষা সর্বক্ষণ আমার ভিতরে, ভোলার উপায়-ও নেই।
বেচারা গোপাল। ওর কাল ফাঁসি হবে। যে সময়ে হয়।
গোপাল কখনও লেখাপড়ায় অবহেলা করে নাই। ও যা পড়াশোনা করেছিল, ওর যা বুদ্ধি, মধ্যমানের পদমর্যাদার একটা চাকরি পেতেই পারতো। কিন্তু আমার জন্যেই সেসব ঘটে নি। ওর পরিবারও যে গোপালের ব্যাপারে ক্রমশ খুব হতাশ, সে বোঝাই যায়। শুধু গোপাল বোঝে না। চমৎকার নেশা করে। মিহি, বহুক্ষণের।
গোপাল যে একটু একটু করে রাখাল হয়ে যাচ্ছে, এতে আমার খুব আনন্দ। আসলে ওকে প্রায় পুরোটাই হজম করে ফেলেছি। সামান্য যেটুকু আছে, যেমন, পুরনো শিক্ষককে দেখলেই প্রণাম করা, কোথাও বেরোলে মা-কে যা হোক একটা কিছু বলে যাওয়া, শরতের আকাশ দেখার আকুলতা, এমন সব আর কি, সে সব-ও ঘুচিয়ে দিতে খুব একটা সময় লাগবে না আমার।
রাখালকে কেহ ভালবাসে না। তাতে আমার বয়েই গেল। আমি ওকে রাজনীতি দেখাই। অন্ধকারের ড্রাগ ব্যবসা দেখাই। চোরাই সোনার কারবার দেখাই। মেয়ের ব্যবসা দেখাই। জমির প্রমোটারি দেখাই। ও এ সব দ্যাখে, আবার ঢুকে যায়। কেমন যেন নির্বিকার।
রাক্ষসের কোন নীতিবোধ নেই। থাকতে নেই। এখন গোপাল থুড়ি রাখালেরও নেই। ভারচ্যুয়াল কিছু নয়। এখন ও রেন্ডিবাড়ি যায়। আসলে ও নয়, আমিই যাই। যেমন মনে করি, রাখাল তেমনই করে। নীল বাড়ি, লাল বাড়ি। কিছু একটা খুঁজি আমি। গোপাল খোঁজে। সেটা যে কী, আমরা কেউই জানি না। কিন্তু খুঁজি। মৃদু আলোয়, ঘোড়ার ভঙ্গিমায়, বাহুখাঁজে, রসালো জলে। পাই না। দরজা বন্ধ করি। দরজা খুলি। দাঁত দেখি, নাভিচক্র, যোনির ভাঁজ।
তবু মাঝেমধ্যে এসব থেকে গোপাল রাস্তায় বেড়িয়ে গাড়ি চাপে। আমিও। গোপালকে কেমন বিষন্ন মনে হয়। এটা আমার ভালো লাগে না। একটু সক্রিয় হই। গাড়ি এসে থামে এক নেতার বাড়ির সামনে। রাত্রি হয়েছে। তবু আমরা দরজার বেল টিপি। কিছুক্ষণ পর আলো জ্বলে। জানি, সিসিটিভিতে গোপালকে জরিপ করা হচ্ছে। রাখালকে নয়। দরজাটা খুললো। এখনো এ পাড়ায় গোপালের সুনাম আছে কিছু। তার জেরেই বোধহয় খুললো দরজা। সামনে নেতা। স্যান্ডো গেঞ্জি, পাজামা। চোখদুটো কিঞ্চিৎ লাল।
– কি ব্যাপার গোপাল! এত রাতে? জরুরী কিছু?
– অন্য সময়ে তো আপনাকে ফাঁকা পাওয়া যায় না, তাই। একটু কথা বলতাম। অসুবিধে হবে?
– আরে না না। এসো, ভিতরে এসো।
স্বর সামান্য জড়িয়ে যাচ্ছে।
আমি নেতার ভিতরটা একটু দেখে নিয়ে সামান্য ঘেঁটে দিলাম।
সোফা, সেন্টার টেব্‌ল, দেওয়ালে নকল মাতিস্‌, চমৎকার আলোর ব্যবস্থা। ঘরের কোনায় সমীহ জাগানোর মত একটা আক্যুরিয়াম। ঘরের রঙ হাল্কা পেস্তা।
– বসো। বলো কি খবর?
– আপনাকে দেখতে খুব ইচ্ছে হল। কতদিন দেখা হয় না! আপনার অসুবিধে হচ্ছে না তো?
– আরে না না। আর শোনো তুমি তো এখন রীতিমত সাবালক। দেখতে সুন্দর, কথাও বলো চটকদার। কলেজের একটা বিক্ষোভ সমাবেশে শুনেছিলাম। তোমার মত ছেলেদেরই তো আমাদের দলের দরকার।
– আপনাকে আমার-ও দরকার।
ঐ যে ভিতরটা একটু ঘেঁটে দিয়েছিলাম, রেসিপিটা বদলে দিয়েছিলাম সামান্য, তার গন্ধ বেরোচ্ছে।
বেচারা গোপাল। ওর কাল ফাঁসি হবে। যে সময়ে হয়।
এরপর আর খুব বেশিদিন লাগে নি। গোপাল এলাকার দোর্দন্ডপ্রতাপ যুব নেতা। ওর কথাই শেষ কথা। সেদিন মুরারীবাবুর স্ত্রী এসে অভিযোগ করল, পাড়ার সুশান্ত রাস্তায় বেরোলেই তাকে খুব বিরক্ত করছে। ব্যবস্থা হয়ে গেল। মোড়ের মাথায় কান ধরে সুশান্তর একশো বার উঠবোস। এখন প্রায়ই সন্ধ্যাবেলায় গোপাল থুড়ি রাখাল টুনটুনি মানে মুরারীবাবুর স্ত্রীর কাছে চা খেতে যায়। অনেকখানি সময় ধরে। ওই সময়ে মুরারীবাবু দোকানে থাকেন।
এক দল জনমজুর অভিযোগ করল, প্রমোটারের ম্যানেজার তাদের হাজিরা দিচ্ছে না গত ন’দিন। সে রাত্রেই দুটো ছেলে তুলে নিয়ে এল ম্যানেজারকে। সামান্য পালিশ করতেই সে স্বীকার করল, টাকাটাও দিয়ে দিল গোপালের এক চেলার হাতে। পরের দিন সকালে টেন পার্সেন্ট কেটে নিয়ে মজুরদের টাকা দিয়ে দেওয়া হল।
কাজের চাপ গোপালের বেড়েই যাচ্ছিল। আমি যেমন চাইছিলাম। ওর একটা সেক্রেটারি হলে কিছু সুবিধা হয়। ব্যবস্থা হল। রীতিমত সব পদ্ধতি মেনে। ষোলটি মেয়ে ইন্টারভিউ দিল। গোপাল তো এখন রাখাল। সেরা মেয়েটিকেই ও বেছে নিল। মাইনে মাসে সাত হাজার। কাজে সন্তুষ্ট হলে প্রতি বছর তিনশো টাকা ইনক্রিমেন্ট। বসার ব্যবস্থা হল গোপালের পাশের ডেকোরেটেড চেম্বারে। সেখানেই সব ব্যবস্থা। মেয়েটি সব রকমভাবে ওর বসকে সন্তুষ্ট করে। গোপালও দেয়। পাওনার বেশিই দেয়।
জলা ভর্তি করে উঠছে বিশাল কমপ্লেক্স। করছে বেশ নামী একটা সংস্থা। এলাহী ব্যাপার। নেতাকে এবার আনতেই হল। গোপালকে সব খেতে দেওয়া ঠিক না। নেতার বাড়িতে গিয়ে গোপাল অনুরোধ জানালো। নেতা রাজী। কিন্তু তিনি পরামর্শ দিলেন, স্থানীয় মন্ত্রীকে দিয়ে যেন ফিতে কাটা হয়। উদ্বোধনের দিন হাজির সবাই। মন্ত্রী, নেতা, সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর সপরিবারে। এখানেই কান্ডটা ঘটিয়ে দিলাম। ডিরেক্টরের কলেজে পড়া মেয়ে কেয়ার সঙ্গে গোপালের ঐ টুকু সময়ের মধ্যেই একেবারে মাখোমাখো।
গোপাল এখন পুরোপুরি রাখাল। খেলাটা বুঝেছে। মেয়েটি ওকে একদিন না দেখলেই প্রায় পাগলপাগল অবস্থা। ওর মা বাবার কিচ্ছু করার উপায় নেই। একমাত্র বলে কথা। এছাড়া বিষয়টা গোপালের সঙ্গে। গোপালের নিজস্ব নিভৃত একটা ফ্ল্যাট আছে। সেখানে যতক্ষণ কেয়া গোপালের কাছে, গোপাল পুরোপুরি রাখাল। কেয়াও খুব চটপটে। সব খেলা, সব মজা ও এত তাড়াতাড়ি রপ্ত করেছে, আমিই মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে যাই। রিউইন্ড করে, সবই তো রেকর্ড করা হয়, খেলাগুলো মাঝেমধ্যে রাখাল দ্যাখে আর বোতল শেষ হয়। মাস চারেক পর কেয়া যখন ওর শরীরের কথা জানিয়ে বিয়ের অনুরোধ করলো, রাখাল কেবল হাসলো। অবিকল আমার হাসির মত। আমারই শিউরে উঠল গা। গোপাল যখন রাখাল হয়ে যায়, এ রকম হাসে! কেয়ার চুলে হাত বুলোতে বুলোতে রাখাল বলল শুধু, আর কয়েকটা দিন। ভোটটা হয়ে যাক, তারপরেই। কেয়া আশ্বস্ত হল। সেদিন খেলা যেন আরো দমদার হল।
কয়েকদিন পর কলেজের পিকনিক। মাইথনে। সব মিলিয়ে প্রায় বাহান্ন জন ছেলেমেয়ে। হইচই, দেদার মদ্যপান, কে যে কার সঙ্গে আড়ালে যাচ্ছে, জলে নেমে হুল্লোড়ে মেতে উঠছে, কে খেয়াল রাখবে! ফেরার সময় দেখা গেল, একান্ন জন। কেয়া নেই। আবার একপ্রস্থ চেঁচামেচি, শেষবার কেয়াকে নিয়ে কে জলে নেমেছিল তাই নিয়ে প্রায় মারপিট, থানাপুলিশ। দুদিন পর ডুবুরি খুঁজে পেল বেশ কিছুটা দূরে একটা পাথরের খাঁজে। কেয়া অন্তঃসত্ত্বা ছিল। গোপাল প্রিন্সিপালের কাছে পার্টির ছেলেদের পাঠালো। খুব ভাঙচুর, কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ। রহস্যের কিনারা হয় নি। আমার শুধু সে রাত্রের রাখালের হাসিটা মনে পড়ল।
বেচারা গোপাল। ওর কাল ফাঁসি হবে। যে সময়ে হয়।
গোপাল এখন পুরো রাখাল। নেতার দক্ষিণ হস্ত। ওকে ছাড়া এক মূহুর্ত চলে না নেতার। পারলে গোপালকে উনি পাশবালিশ বানিয়ে নেন, এমন অবস্থা। প্রায় একার জোরেই ভোটে অভাবনীয় ফল। বিরোধী খুঁজে পাওয়াই দায়। সবাই শুটিয়ে দেবে, এই ভয়ে খুব একটা গলা বড় করে নি। ব্যতিক্রম আমিনুল। জেলা থেকে নির্বাচন কমিশন, সব জায়গায় বুথের ভিডিও পাঠিয়েছিল। পার্টি একটু চুপচাপ। দিন কয়েকপর আমিনুলের মাথা পাওয়া গেল আমবাগানের ঝোপে। ওর মটোরবাইক আর শরীর রাস্তার পাশেই। মাথাটা একেবারে নিখুঁত ভাবে বিচ্ছিন্ন। যেভাবে কড়া চিনা মাঞ্জার সুতোতে কেটে যায় মাথা। রাখাল ছাত্র হিসেবে বরাবরই উচ্চ মানের। যেমন বলেছিলাম, হুবহু সেভাবেই নামিয়েছে। যথারীতি হইচই, বিক্ষোভ, বন্ধ, পুলিশের গাড়িতে আগুন। কালো ভ্যান ভরে গেল কালো মাথায়। মহকুমাশাসকের কাছে কয়েকটি ফোন এসেছিল। যা প্রায় স্বাভাবিক। আমিনুলের মেয়েটা তার আব্বাকে আর দেখতে পায় নি। আব্বা তার জন্য পুতুল আনবে বলেছিল। পুলিশ গাড়ির ডিকি থেকে পেয়ে আমিনুলের বাড়িতে পুতুল দিয়ে আসে।

বেচারা গোপাল। ওর কাল ফাঁসি হবে। যে সময়ে হয়।
রাখাল থুড়ি গোপাল আর নেতা ফিরে আসছিলেন জেলা থেকে একটা মিটিং কিম্বা উল্লাসের ভোজসভা থেকে। নেতা বেশ টিপসি হয়ে পড়েছিলেন। বারবার রাখালের ঘাড়ে মাথা। এই সুযোগ আসবে, রাখাল জানতো। কুয়াশায় পথ প্রায় দেখাই যায় না। রাস্তায় অবশ্য খানাখন্দ তেমন নেই। মহেশবাবু তবু আস্তেই চালাচ্ছিলেন। কোটের পকেট থেকে ফাকা সিরিঞ্জ বের করে নেতার ঘাড়ে রাখাল পুশ করে দিলে নেতা সামান্য উঃ ছাড়া আর কিছু বলেন নি। রাখালকে বাড়িতে নামিয়ে মহেশবাবু নেতাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। রাখালের মুখে আবার সেই হাসি।
একটু পরেই ফোন। নেতার স্ট্রোক। রাখাল বাইক নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। ইতিমধ্যেই বেশ ভিড় জমেছে। এসে পড়েছে পুলিশ, আমব্যুলেন্স, মিডিয়ার ক্যামেরা, বুম।৷ রাখাল নয়, গোপালকে দেখে ভিড় এবং পুলিশ এগিয়ে এল। শোকার্ত মুখে গোপাল পুলিশকে বিষয়টা জানতে চাইল। ডাক্তার ময়নাতদন্তের জন্য সুপারিশ করেছে। বডি বেড়িয়ে এলে আমব্যুলেন্স ছুটে বেড়িয়ে গেল। রাখাল কয়েকটি ফোন করলো। পার্টির লোকজন ছুটে গেল হাসপাতালে। এসে পড়ল ফুল, নানান ধরণের মালা, ব্যোকে- কিচ্ছুর অভাব নেই। একেবারে জনারণ্য। নেতার শরীর ময়নাতদন্ত ছাড়াই বেড়িয়ে এল বাইরে। সামান্য পরে মুখটুকু ছাড়া নেতাকে আর দেখা যাচ্ছিল না।

জেলা কোন প্রশ্ন না করেই গোপালকে নেতার আসনে বসিয়ে দিল। পার্টি অফিস একেবারে রঙিন সে রাত্রে। গোপালের চেম্বারের পাশের ঘর আরো টালমাটাল। রাক্ষস থুড়ি আমি থুড়ি রাখাল একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিল বটে। একেবারে একশো ভাগ খাঁটি, পুরো সরেস। ও একাই চারজনকে সে রাত্রে সামলে নিল।

I AM MY DEMONS

বহুদিন আগের খোলা ছাদের সে রাত্রির আর কোন প্রাসঙ্গিকতা থাকলো না। রাখাল এখন নিজেই হয়ে উঠেছে প্রচন্ড এক রাক্ষস। তার লোভ, তার জয়ের ইচ্ছে, ক্ষমতার দম্ভ রাখালকে করে দিয়েছে এক অতিরাক্ষস। সে যা চায়, এ অঞ্চলে তাই হয়। তবু কেউ কেউ মাথা তোলে। নিজের ক্ষমতার জোরেই তোলে, রাখালকে না চিনেই তোলে। এমন একজন ঠিকেদার এই এলাকায় বড় রাস্তার পাঁচ কিলোমিটার রিনোভেশনের ঠিকাদারি পেয়েছিল। সব পদ্ধতি মেনেই পেয়েছিল। ভদ্রলোক একটু নীতিবাগীশ। এবং একরোখা। উপরের দিকে মানে রাজ্যে তার কিছু পরিচিতি, নামডাক আছে। সেই মানুষকে রাখাল একদিন রাত্রে ডেকে পাঠালো তার চেম্বারে।
ঠিক সময়েই এলেন তিনি। রাখাল আর তিন সাগরেদ তখন ঘরে। মেয়েটিকে ছুটি দেওয়া নিয়ে একটু দোনোমোনো করছিল রাখাল। শেষ অবধি ছুটি দেয় নি। ও পাশের আন্টিচেম্বারে কম্প্যুটারে, ওর মতো। টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে স্বাভাবিক ভাবেই নমস্কার করার পর বসতে যাচ্ছিলেন। চিৎকার করে উঠলো রাখাল, এই শুয়োরের বাচ্চা, তোকে বসতে বলেছি? ভদ্রলোক সামান্য থতমত। ক্রমে চোয়াল তার শক্ত হয়ে উঠছে।
– বেশ। কী বলার জন্য ডেকেছেন?
– গত সোমবার তোর কাছে ছেলে পাঠিয়েছিলাম। টাকাটা দিস নি কেন?
– কিসের টাকা দেব! কেনই বা দেব? ধার চাইলে বলুন, এক্ষুনি দিয়ে দিচ্ছি সাধ্যমত।
রাখাল একেবারে লাফিয়ে উঠলো।
– তোর কাছে ধার চাইবো আমি! ভাল চাস তো, কাল বিকেলের মধ্যে টাকাটা এখানে দিয়ে যাবি। না হলে…
– না হলে কী? কী করবেন আপনি? কাজ বন্ধ করে দেবেন? মারবেন আমাকে? নাকি টেন্ডারটাই বাতিল করে দেবেন?
ভদ্রলোকের গলায় বিদ্রুপের সুর।
রাখালের আর সহ্য হল না। টেনে একটা চড় ভদ্রলোকের গালে। চশমা ছিটকে পড়ল। শ্যামলা রঙে আস্তে আস্তে বেগুনি হয়ে উঠলো আঙুলের দাগ।
– এবার যেতে পারি?
– মনে রাখিস, কাল বিকেলের মধ্যে। এইখানে। আমি নিজেই থাকবো।
ভদ্রলোক বেড়িয়ে গেলেন। বাইকের শব্দ ক্রমে মিলিয়ে গেল।
রাখাল শাগরেদদের চলে যেতে বললো।
সে রাত্রে মেয়েটিকে বহুক্ষণ সহ্য করতে হয়েছিল রাখালের অত্যাচার। এমন কি চাবুক পর্যন্ত। একটি কথাও বলে নি। মা নেই, বাড়িতে বাবা কর্কটরোগে শয্যাশায়ী। ছোট দুটো ভাইবোন।
পরের দিন টাকাটা আসে নি। তার দশ দিন পরেও না। জেলা থেকে একটা ফোনে রাখালকে যথেষ্ট ধম্‌কি সহ্য করতে হয়েছে।
ভদ্রলোকের ছোট পরিবার। দুই মেয়ে আর স্বামী স্ত্রী। বড় মেয়ে কলেজে আর ছোটটি এবার মাধ্যমিকে বসবে। সারাদিনই প্রায় টিউশ্যনে যায়। মোটামুটি কাছেপিঠে বলে উনি মেয়ের যাতায়াতের জন্য অন্য কোন ব্যবস্থা করেন নি। সাইকেলেই যাতায়াত করে। একদিন সন্ধ্যায় মেয়েটি ঘরে ফিরলো না। পরের দিনও নয়। থানাপুলিশ, দৌড়ঝাঁপ সব হল। জেলা থেকে তদন্তকারী দল পুলিশকুকুর নিয়ে এল। সেই কুকুরই বের করলো মেয়েটির দ্বিখন্ডিত ছিন্নভিন্ন শরীর। তাকানো যায় না। রাখালের দলবল, রাখাল সবাই হাজির। শরীরের বোধহয় সামান্যতম পরিত্রাণ ছিল না। ক্ষুধার্ত কুকুরেরা একটু রেয়াত করে। আমরা, রাক্ষসরা কেবল রক্তটুকু চুষে নিই। কিন্তু এই কিশোরীর সেই সৌভাগ্য হয় নি। তাবত অত্যাচার, বারবার ধর্ষণ শেষে মেয়েটিকে আড়াআড়ি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। তারপর একটা দেয়ালের খাঁজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই দেহখন্ড। না, আমরা এমন ভাবতে পারি না। খুব রাগ হচ্ছিল। ভয়ংকর ঘৃণা হচ্ছিল। কেউ ভাবতেই পারেন, হুঃ! রাক্ষসের আবার ঘৃণা! কিন্তু আবার বলছি, ক্রসব্রিড না হলে, রাগ হয়। রাখাল তো ক্রসব্রিড! সে জন্যেই এত ভয়াবহ। কুকুর দুটোকে চালিয়ে দিলাম রাখালের চেম্বারের দিকে। জানি তো, কোথায় আছে রক্তমাখা গেঞ্জিগুলো আর লুঙ্গি। পেয়েও গেল। এর পরের গল্প সরল। জেলা বা রাজ্য, কেউই মাথা গলায় নি। এ কোর্ট সে কোর্ট, উচ্চতম আদালত, শেষে রাষ্ট্রপতির কাছে চার জনের ক্ষমাভিক্ষা-কোনটাতেই কিছু হয় নি। আমার আর কী! গোপালের অভাব হবে না এ দেশে। তারপর রাখাল বানাতে যে সময় লাগে। আমার মত হাজার হাজার কাজ করে চলেছে দিনরাত্রি। রাখাল বানানোই যে আমাদের কাজ!
বেচারা গোপাল। ওর কাল ফাঁসি হবে। যে সময়ে হয়।

WE ALL HAVE DEMONS,
I JUST CHOOSE TO FEED MINE
I AM MY DEMONS

—-হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল রাক্ষস কর আমারে

Facebook Comments

Leave a Reply