মুদ্রা-রাক্ষস : পিয়াল দাস

“Those who have crossed
With direct eyes, to death’s other kingdom
Remember us – if at all – not as lost
Violent souls, but only
As the hollow men
The stuffed men.”

(T. S. Eliot)

বর্ষার দিনগুলো বড্ডো ধীরে কাটে। যেমন জমা জল ঠেলে ঠেলে রিকশা চলে, ঠিক তেমন। ভ্যাপসা গরম, অস্বস্তি, আর আলোছায়ার জাল। অফিস, বাস-ট্রাম, স্টেশন। শহরটা জুড়ে লেপে আছে ঘাম আর কার্বনের একটা প্রলেপ। সুন্দর পোশাক-আশাক পরা নারী পুরুষের সৌখীন ত্বক বা জামা কাপড় থেকেও বেরিয়ে আসছে ঘাম, কারো কারো বৃষ্টিতে আধভেজা শরীর। গরমে গলন্ত মোমের ভাস্কর্যের মতন দেখতে লাগে মানুষগুলোকে।

সৈকতের আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরোনোর কথা। ঠিক ৫’টায় বসের মনে পড়লো সোমবারের কাজগুলো আজই গুছিয়ে দিয়ে যেতে হবে। কারণ বস উইকএন্ডে আউট অফ স্টেশন থাকবেন। ফলে রাতেই তিনি সব গুছিয়ে তারপর বের হবেন। তার মানে আজকেও সৈকতের বাস ধরতে হবে। এই দূরপাল্লার বাসগুলো বর্ষার রাতে রাস্তায় কেমন ভূতের মত চলতে থাকে, সেইজন্য ও বাসে খুব একটা স্বচ্ছন্দ নয়।

সৈকত বসকে চটাতে চায় না। বসকে সঙ্গ দেওয়া, বাজারের প্যাকেট বওয়া, টিকিট বা কুপনের লাইনে দাঁড়ানো – মোদ্দা কথা হলো বসকে তেল মারার কোন সুযোগই সৈকত হাতছাড়া করতে চায়না। তুষারের সাথে এই নিয়ে ঝামেলাও কম হয়না। তুষার ওরই কলিগ। কিন্তু এসব তৈল মর্দন ওর পোষায় না। এতটা বেশি এফর্ট দেওয়ার বিনিময়ে এখনো অব্দি অতিরিক্ত কিছু সুবিধা সৈকতের হয়নি। সেই নিয়ে তুষার অনেক রকম কথা শোনায়। কাজটা যে সৈকতেরও খুব স্বভাবসিদ্ধ তা নয়। বেশকিছু বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে এগুলো শিখতে হয়েছে, বা বলা ভাল শিখতে বাধ্য হতে হয়েছে । এই বাজারে চাকরি টিকিয়ে রাখা এমনিতেই বেশ কষ্টসাধ্য, তাই এসব উপরি সার্ভিস না চাইলেও করে যেতে হয়।

তুষারের কিছু এসে যায় না। বাবা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন – জমানো টাকা, শহরের পুরনো সম্ভ্রান্ত এলাকায় পৈতৃক বাড়ি সবই পেয়েছে। ওর স্ত্রী’ও চাকরি করে। ঝামেলাহীন সুখী সংসার। সপ্তাহের শেষ দিনে বাড়ি যাবার জন্য দৌড়াতে হয় না, দ্রুত পদোন্নতির চিন্তা করতে হয়না। এক কথায় যাকে বলে ঝাড়া হাত পা। কিন্তু সৈকতের ওপর সংসারের সমস্ত ভার। মাকে মফস্বলে রেখে এভাবে দিনের পর দিন যাতায়াত করে ওর পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। তার ওপর মায়ের স্বাস্থ্য দিন দিন ভেঙ্গে পড়ছে। বড্ড একা হয়ে পড়েছে বেচারী। তাকে শহরে নিয়ে আসতে হবে। এদিকে সায়ন্তনীর পিএইচডি প্রায় শেষের পথে, এরপর ওর কপালেও বেশ ভালো একটা চাকরি জুটেই যাবে আশা করা যায়। তবে এই বাজারে শুধু প্রেমের টানে বেশিদিন এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যাবে না সেটা স্পষ্ট। যদিও সায়ন্তনী সবসময় ওকে সাহস যোগায়, বিয়ের জন্য চাপাচাপিও করেনি কোনোদিন। কিন্তু সৈকতের চিন্তা কাটে না।

সৈকত বারবার ঘড়ি দেখছে। বেরোতে সত্যি দেরি হয়ে গেল। অবশেষে যখন বেরোতে পারলো, তখন বাইরে অঝোর বৃষ্টি। চারিদিক ঝাপসা। একটা দুটো প্রাইভেট কার জলকাদা ছিটিয়ে তীব্র গতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে। অটো বা বাস পাবার আশা আর করা যায়না। অন্তত একটা ট্যাক্সিও যদি পেত। হাতঘড়িটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতে হয়েছে, এই বৃষ্টিতে যদি ভিজে যায়, তবেই হয়ে গেলো, এক্ষুনি আবার বাড়তি খরচ। কটা বাজলো কে জানে।

আজ দিনটাই খারাপ। এইসব ভেবে মনে মনে বস কে চার অক্ষরের গালি দিয়ে সময়ের হিসেব কষছে, তখনই সৈকত লক্ষ্য করলো একটা হলুদ ট্যাক্সি, খুব ধীরে এসে কাছেই একটা বহুতলের নিচে থামলো। সৈকত এক হাতে ছাতা এক হাতে ব্যাগ জাপটে ধরে ওই ভারী বৃষ্টির মধ্যেই ছুট লাগালো। অনেকক্ষণ সাধাসাধি করার পর ট্যাক্সিওয়ালা বেশ খানিকটা বেশি ভাড়ায় রাজি হলো।

ট্যাক্সিতে বসার পরেই সৈকতের আরো কয়েক প্রস্থ গালাগালি দিতে ইচ্ছে করলো, এবার অন্য কাউকে নয়, নিজের কপালকে। একদিকে মাসের শেষ, ওদিকে বাড়ি যাবার খরচ। সবমিলিয়ে মনে হল এই জীবনটাই চার অক্ষরে পরিণত হয়েছে। রাতের শহর, ট্যাক্সি চলেছে দুরন্ত বেগে। স্ট্রীট লাইটের হলদে আলো আর বৃষ্টির ছাঁট মিলে সবকিছু কেমন অস্পষ্ট করে তুলেছে। ভাড়া মিটিয়ে যখন নামলো বৃষ্টির জোর তখনও কমেনি। কোনোক্রমে ছাতাটা খুলে ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ালো। শেষ বাস। তার ওপর এরকম বৃষ্টি, ফলে যাত্রী বিশেষ নেই বলেই মনে হয়। কয়েকটা ফাঁকা বাস অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

একটা বাসের ভেতর টিমটিম করে আলো জ্বলছে। সেটাই সম্ভবতঃ যাবে। বৃষ্টির ছাঁট আটকাতে সব দরজা জানালা বন্ধ। ভেতরে যাত্রী আছে কি নেই তাও বোঝা যাচ্ছেনা। সৈকত সেদিকেই এগোলো। সামনের দরজায় ধাক্কা দিতে একটা কম বয়সি ছেলে দরজা খুলে দিল।

জনা কুড়ি যাত্রী বসে আছে, দূরপাল্লার বাসের সিটগুলো সাধারণত একটু উঁচু আর বড়ো হয়, তাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাত্রী বসে থাকলে মনে হয় ফাঁকা। বাস ভর্তি হবার সম্ভাবনাও নেই। সৈকত একটা মাঝামাঝি জায়গার সিট খুঁজছিল, যাতে ঝাঁকুনি কম হয় । সারাদিনের ক্লান্তি, তাতে এমন বৃষ্টি, বেশ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পৌঁছে যেতে পারবে। ঠিক মাঝের সিট না হলেও একেবারে পেছনে সিট পেল না। জানালার ধারে না বসাই ভালো, যদি জল ঢোকে, বৃষ্টির বেগ ক্রমশঃ বাড়ছে । সৈকত একটু গলা বাড়িয়ে বাকি যাত্রীদের দেখার চেষ্টা করলো। সবাই কম বেশি ঝিমোচ্ছে। দিনের বেলায় অফুরান উদ্যম নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোয় যে মানুষ, শেষ বেলায় এসে কেমন জানি চুপসে যায় তাদের অবয়বগুলি। বাসের সামনের দিকের আলো জ্বলছে শুধু, পেছনের দিকটা আলো আর অন্ধকারে মিলে কেমন হরর সিনেমার দৃশ্য মনে হচ্ছে। সৈকত ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলো, সায়ন্তনীর তিন চারটে মেসেজ – বাস পেলো কিনা, কিছু খেয়ে নিয়েছে কিনা – এইসব। রিপ্লাই দিলো। রুমাল বার করে ফোনটা মুছে নিলো সৈকত, মা কে জানিয়ে দিতে হবে যে ভোরের আগে বাড়ি পৌঁছবে না। নয়ত ওই শরীরে সারারাত জেগেই কাটাবে হয়তো। মাকেও ফোন করে দিলো যে আজ বাসে যেতে হচ্ছে।

ইদানীং মা খুব চিন্তা করে। বাবা মারা যাওয়ার সময়ও মাকে এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখেনি। দুঃখ কষ্ট সবই মনের মধ্যে রেখে ওকে আগলে রেখেছিল মা। ইলেকট্রিকের দোকানের ব্যবসা বাবা চলে যাওয়ার পরেই উঠে যায়। মামা বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল ওরা। কিন্তু সেখানেও বেশিদিন থাকা সম্ভব হয় নি। লোকের বাড়িতে রান্নাবান্না আর সেলাইয়ের কাজ করে সৈকতকে স্কুল পাশ করায় মা। ছাত্র হিসেবে সৈকতের সুনাম ছিল, কিন্তু নামী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ানোর আর্থিক সামর্থ্য ছিলো না মায়ের। অনেক কষ্ট করে তাও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিল। যদিও প্রথমে বিশেষ লাভ হয়নি। কপালে জোটে সামান্য রোজগারের ছোটখাটো সেলসম্যানের চাকরি। বেশ কিছুদিন সেসব কাজ করতে করতে অবশেষে এই কোম্পানিতে সুযোগ পায়। মা’র স্বাস্থ্য ততদিনে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বাবার উপর এখনও মাঝে মাঝে খুব অভিমান হয় সৈকতের। এইভাবে পরিবারকে বিপদে ফেলে দিয়ে কেন চলে গিয়েছিলো বাবা?

একটু গুছিয়ে বসার পর দেখলো আরেকজন যাত্রী ওরই পাশের সিটে এসে বসেছেন। চোখে আয়তাকার চশমা, আর পরনে ধূসর শার্ট। চোখগুলো বেশ উজ্জ্বল। চুল আঁচড়ানোর ঢং একটু পুরোনো দিনের চিত্রতারকাদের মতন। এর বেশি আর তাকিয়ে দেখার মতো আগ্রহ নেই সৈকতের। সৈকত একটু বিরক্তই হলো, এত জায়গা থাকতে এখানেই বসতে হবে! সারাদিন শুধু মানুষ দেখে দেখে এখন ওর চোখটা একটু ফাঁকা,খালি জায়গা খুঁজছে। জানলা দিয়ে দূরে একটা দুটো আলো টিমটিম করছে।

হঠাৎ সহযাত্রী ভদ্রলোক সৈকতকে প্রশ্ন করে বসলেন – আপনি কি নিত্যযাত্রী? সৈকতের ভাবনায় ছেদ পড়ায় একটু বিরক্ত হলো। কিন্তু ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা। উত্তর শোনার জন্য সৈকতের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়েই রইলেন।

সৈকত বললো, না ঠিক তা নই, তবে ওই উইকএন্ডে বাড়ি যাই।
ও, তা বাড়ি কোথায়?
সৈকত নাম বলাতে লোকটা খুব একটা আগ্রহ দেখালো না, বরঞ্চ তার বদলে জিজ্ঞেস করলো – বাসে ফিরছেন যে! ট্রেন পান নি?
না মিস করেছি – অপছন্দ হলেও উত্তরটা দিল সৈকত।

পকেটে ফোনটা ভাইব্রেট করছে। সায়ন্তনীর কল। ফোনের কথা বেশিরভাগ হুঁ হা তেই সারতে হলো কারণ ভদ্রলোক খুব অসভ্যের মতন শোনার চেষ্টা করছেন। ফোন রেখে দিয়ে সৈকত একটু কড়াভাবে বললো – আপনি কিছু বলবেন?

বাস এবার চলতে শুরু করেছে অবশেষে।

লোকটা প্রায় ঘাড়ের ওপর মুখ নিয়ে এসেছে, জিজ্ঞেস করলো, তা কি করা হয়? এযুগে এভাবে কেউ প্রশ্ন করে নাকি? লোকটা একটু সেকেলে মনে হয়!

সৈকতের হাসি পেলো, ওই সামান্য চাকরি।

লোকটা আপাদমস্তক ওকে দেখে নিয়ে বললো, প্রাইভেট বোধহয়?

সৈকত অবাক হলো, পোশাকে খুব আলাদা কিছুতো তার নেই, খুবই সাধারণ রোজকার পোশাক। তারপর আবার মোবাইলে মন দিলো। মাঝে মাঝে নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলেও তাতে কাজ বিশেষ হচ্ছেনা। অগত্যা গেমটা খুলে বসলো। খুব অদ্ভুতভাবে লোকটিও ওর ফোনের দিকে ঝুঁকে পড়ল:

গেম বুঝি? আজকাল তো ভয়ানক সব গেম বাজারে এসেছে শুনেছি। এক্কেবারে বাস্তবের সাথে মিল। নিজেকে সেখানে গেমেরই কোনো চরিত্র মনে হয়।

উত্তর না দিয়ে চুপচাপ গেমে মনোযোগ দিলো সৈকত। যতটা পারা যায় এড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু লোকটা যেন একটু বেশীই গায়ে পড়া। সৈকতের মোবাইলটা দেখতে বেশ দামী। সেটা অবশ্য সায়ন্তনীর’ই অবদান। প্রথম ফেলোশিপের টাকায় গিফট করেছিল। ফোনের ওপর সৈকতের সাংঘাতিক কিছু মায়া নেই, আরেকটু মাঝারি দামের স্মার্টফোন নেবে ভেবেছিল। তবে সায়ন্তনীর যুক্তি খুবই হাস্যকর, ওর বক্তব্য আজকাল ওরকম বোরিং ফোন নিয়ে কেউ চললে নিমিষেই তাকে নাকি নিমপাতা মনে হয়, তাই একটু স্টাইলিশ ফোন নিতেই হবে।

বাস যতই জোরে ছুটছে আলোগুলো যেন ততই ঝিমিয়ে পড়ছে। বৃষ্টির বেগও বাড়ছে । সৈকত একটা ভিডিও দেখছিল ফোনে কিন্তু বেশিক্ষণ দেখা গেলনা। সিগনাল ক্ষীণ হয়ে গেছে, এবার ব্যাটারিও শেষের দিকে। ব‌্যাগ থেকে পাওয়ারব্যাঙ্ক বার করে ফোনটা চার্জে বসালো। গায়ের জামাটায় সারাদিনের ঘাম আর বৃষ্টির জল শুকিয়ে অস্বস্তিকর অবস্থা। সৈকত শার্টের বোতামগুলো খুলে জামাটা আলগা করে নিলো। একটু যেন শীত শীত করে উঠলো। নিজের জলের বোতলটার দিকে তাকিয়ে একটু হতাশ হলো, জলটা তলানিতে এসে ঠেকেছে, এখন তো একটা জলও কেনা যাবেনা। সহযাত্রী ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই লোকটা নিজের ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে এগিয়ে দিল। তেষ্টা পেয়েছে তাই সৈকতকে নিতেই হল। লোকটাও বোধহয় সুযোগ খুঁজছিল। সৈকতের জল খাওয়া শেষ হতেই প্রায় হামলে পড়ে বলে উঠলো – আপনাকে একটা ঘটনা শোনাতে চাইছিলাম। গল্পও বলতে পারেন। অনুমতি দিলে বলতে পারি।

সৈকতের এখন না বলার বিশেষ উপায় নেই। ফোনের ব্যাটারি চার্জ হতে সময় নেবে। লোকটাকে বাকি রাস্তাটা সহ্য করতেই হবে মনে হচ্ছে। তাও খানিকটা রুক্ষ ভাবেই বলল – জলের জন্য ধন্যবাদ, তখন থেকে তো গপ্পো ফাঁদার চেষ্টাই চালাচ্ছেন মনে হচ্ছে।

শুনেই দেখুন না, বেশ একটা উত্তেজনা থাকবে গল্পে। হতাশ হবেন না। দামী টিকিট কেটে ওই বড় শপিং মলে যে ছবিগুলো দেখতে যান তার থেকে ভালো বৈ খারাপ না, বুঝলেন কিনা।

বটে! সৈকত একটু ব্যঙ্গের সুরে বলে। লোকটা সেটা গায়ে মাখলো না,যেন গল্প শুনিয়েই ছাড়বে।

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। নেটওয়ার্ক ফিরেছে বোধহয়। বাসটা একটু গতি কমিয়ে দিয়েছে, সামনে কোনো টোল বুথ আছে হয়ত। ফোনটা ধরলো সৈকত। অজানা নাম্বার। ফোন ধরে কথা বলতে বলতে পাশ দিয়ে একটা ট্রাক হর্ন দিতে দিতে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যাওয়ায় অপরপ্রান্তের কথা বিশেষ শুনতে পেলনা। ভাসা ভাসা বুঝলো জনৈক বীমা কোম্পানির এজেন্টের ফোন। এখন রাতবিরেতেও এরা মানুষকে বিরক্ত করতে ছাড়ে না। ওর জীবনবিমা সংক্রান্ত বিষয়ে মহিলা কথা বলতে চাইছিলেন, কোনো একটা প্যাকেজ গছাবার ধান্দা নির্ঘাত। কিন্তু সৈকত ধন্যবাদ, ইন্টেরেস্টেড নই এসব বলে ফোন রেখে দিল।

পাশের ভদ্রলোক বেশ উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছেন, গল্প শোনানোর জন্য। সৈকত এবার সামনের সিটে পা তুলে একটু এলিয়ে বসে বলল, নিন শুরু করুন, তবে বোর হয়ে গেলে থামিয়ে দেব কিন্তু।

লোকটা একটু হেসে, বেশ বেশ ঠিক আছে, বলে গল্প বলতে শুরু করল-

ছোটবেলায় খুব অভিনয়ের শখ ছিল বুঝলেন কিনা। চেহারায় তেমন চেকনাই ছিলনা তাই ভালো কোনো চরিত্র পেতাম না। একবার পাড়ার নাটকে হলাম ডাকাত, ছোট ডাকাত আর কি, বয়স তখন দশ। তারপরে মফস্বলের নাটকে এরকম ছোটখাটো, চোর ডাকাত, চাকরের পার্ট পেতাম। সংলাপ তেমন থাকতো না, আর থাকলেও সমবেত সংলাপ, ওই জয়ধ্বনি টাইপ। একটু বড়ো হয়ে যাত্রাপালাতেও নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে গেলাম, পেলাম মীরজাফরের চরিত্র, সেই চরিত্র নাকি এমন জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছিল, আশেপাশের এলাকার বউ, বাচ্চারা আমায় দেখে রীতিমতো ঘৃণা করতে শুরু করে।

এইখানে লোকটা একটু মুচকি হাসলো।

সৈকতের মনে হলো বাসটা বড্ড ঢিমে তালে চলেছে বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ক’টা বাজবে কে জানে! রাতের বাস যথারীতি ব্রেক দেওয়ার জন্যে থামলো একটা ধাবায়। সকলেই নেমে বাথরুম সেরে নিচ্ছে, সৈকতও নামলো, একটা জলের বোতল কেনা দরকার। সিগারেট খেতে খেতে একটু পা টাও টানটান করে নেওয়া যাবে।

একটা সিগারেট হবে নাকি ভায়া? টানতে টানতে গল্পটা শোনাতাম, বড়ো আরাম হতো, হে হে। লোকটা পেছন পেছন ঠিক চলে এসেছে। অদ্ভুত আবদার !
সৈকত আশ্চর্য হয়ে তাকালো ভদ্রলোকের দিকে – বাহ, আপনি জোর করে গল্প শোনাবেন আবার সিগারেটও আমার কাছেই চাইবেন? লোকটা আক্ষেপের সুরে একটা শব্দ বের করে বললো, আসলে হয়েছে কি ওই বদভ্যাসগুলো হয়ে গেছে যাত্রাপালা আর নাটকের দলে থেকে, কম বয়স থেকেই আর কি! হেঁহেঁ..সে যাকগে, এসব ছাইপাঁশ খাওয়া কোনো কাজের কথা না, বুঝলেন কিনা? তবু একটা যদি….

বলে লোকটা হাত কচলাতে শুরু করলো। সামনেই দোকান একটা, ছোট গুমটি মত, যদিও আধখোলা, তবু সিগারেট পাওয়া যেত, কিসব লোক যে আছে পৃথিবীতে। সৈকত প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট দিল। লোকটা ধরালোনা। হাতে নিয়ে টানার ভঙ্গি করলো মাত্র।

যা বলছিলাম। হলো কি, গ্রামে গ্রামে ঘুরে যাত্রা করি, শীতকালে। বাকি সময় তেমন কাজ নেই। চাকরি বাকরি কোনদিনই আমার ধাতে সইতো না। তবে সংসার চালাতে হবে তো, তাই মফঃস্বলের এক বন্ধুর কথায় তার ব্যবসায় পার্টনার হতে রাজি হয়ে গেলাম। কাজ আমার তেমন বিশেষ ছিলনা। মাঝে মধ্যে ওই শহর থেকে মালপত্র আনা, অর্ডার ডেলিভারি এইসব করতে হতো। বেশীরভাগই ওই বন্ধু খুব দক্ষ হাতে সামলাতে পারতো। কখনও দোকানে গিয়ে বসতাম। হিসেব পত্তরে চোখ রাখতাম। যদিও তার দরকার হতো না, সবটাই বেশ গোছানো ছিল। পুজোর সময় থেকে শীতকাল অবধি আমার কিন্তু ব্যস্ত সময় কাটতো। তখন দোকানে যেতে পারতাম না। সারারাত জেগে অভিনয়। দিনের বেলা ঘুম। বিকাল থেকে আবার রূপসজ্জা। কি দিন ছিল মশাই! প্রথম প্রথম বন্ধুর কাছে একটু অস্বস্তি প্রকাশ করেছিলাম বটে, ব্যবসার কাজে সবসময় সাহায্য করতে পারিনা বলে, কিন্তু ও বলতো তুই শিল্পী মানুষ অভিনয়টা চালিয়ে যা, ব্যবসা নিয়ে অতো ভাবতে হবে না। একরকম ভালই চলছিল। তারপর একদিন বন্ধুও বিয়ে থা করে সংসার পাতলো। এরপর থেকেই আমাদের মধ্যে একটু একটু করে ভাব কমতে শুরু করলো। আমার অনুপস্থিতি নিয়ে এবার ও মাঝে মধ্যেই কথা শোনাতো। আমিও ভেবে পেতাম না প্রত্যুত্তরে কি বলবো। অভিনয় আমার প্রথম ভালোবাসা ওটাকে ছেড়ে থাকা অসম্ভব ছিল।

সৈকত এখনও অবধি লোকটার গল্পে আগ্রহের বিষয় খুব কিছু খুঁজে পাচ্ছেনা। তবুও লোকটার গল্প বলার ভঙ্গিতে একটা আকর্ষণ আছে। নাটকীয়তা জানে তাই পুরোপুরি উপেক্ষাও করা যায় না। এদিকে বাসের হেল্পার ছেলেটা সকলকে ডেকে নিচ্ছে। ড্রাইভার বাসে উঠে পড়েছে। সৈকত সিগারেটের শেষ অংশটা পায়ের নিচে ফেলে উঠে পড়লো বাসে।

লোকটা এবার কিছুক্ষণ চুপ। মনে হচ্ছে একটু দুঃখ পেয়েছে, নিচের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিলো। সৈকত বললো, তারপর?

লোকটা সেই খোঁচায় বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠলো, দ্বিগুণ উৎসাহে গল্পের স্রোত বয়ে চললো:

বন্ধুটি বেশ চুপচাপ গোছের হলেও গোছানো মানুষ ছিল, হিসেব পত্তর, ডিউটি কোনোটাতেই তার ত্রুটি পাওয়া মুশকিল ছিল, আর আমি হলাম ঠিক তার উল্টো। তবে এখন নিজেকে দোষী মনে হয় বটে, বুঝলেন কিনা। বন্ধুর সাথে একবার বেশ মন কষাকষি হলো, আমি অর্ডার আনার ব্যাপারে কখনো সাহায্য করিনা। কথাটি সম্পূর্ণ সত্যি, তবু গায়ে লাগলো।

তারপর…..তারপরেই এলো সেই দিনটা!

ভদ্রলোকের গলায় হঠাৎ আতঙ্কের একটা ভাব এলো, সেটা তার নাটকীয়তার গুনেই কিনা বুঝলোনা সৈকত। কিন্তু কথা বাড়ালোনা, লোকটা বলে যাক। রাতও প্রায় শেষের দিকে। সব যাত্রীরা ঘুমে। হেল্পার ছেলেটাও ঢুলছে। বাসের ভেতর অন্ধকার। আর বাইরে রাস্তায় বৃষ্টির জমা জল কেটে কেটে বাস এগিয়ে চলেছে। শুধু হেডলাইটের আলোয় ভরসা করে। মাঝে মাঝে দু’ একটা ট্রাক দ্রুত গতিতে ওভারটেক করে যাচ্ছে, আর পিলে চমকানো হর্ন দিচ্ছে। সৈকতের’ও আরামে ঘুম আসছে। ঘড়িতে দেখলো সাড়ে তিনটে বাজে। হাইওয়েতে উঠে পড়েছে গাড়ি। আর হয়তো ঘন্টাখানেক।

তারপর বুঝলেন কিনা, শহরের এক মক্কেলের কাছ থেকে একটা মোটা অঙ্কের টাকার অর্ডার আনার কথা। টাকাটা তখন ব্যবসার জন্য খুবই দরকার হয়ে পড়েছিল।
আমার একই সময় শহরে একটা শো ছিল। বন্ধু যেতে না পারায় আমাকে দায়িত্ব দিল। আমিও বুঝে গেলাম এই সুযোগ, কিছুটা দায়িত্ব নিয়ে বন্ধুর চোখে নিজের সম্মান ফেরানোর। শো-এর পর মক্কেলের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চড়ে বসলাম ট্রেনে। ট্রেনভর্তি যাত্রীদের ভীড়। কোথাও একটা বড় মেলা হয়েছিল সেইখান থেকেই ফিরছে সব। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামলো চলতে চলতে। কামরাতে শুরু থেকেই কেন জানি না পোড়া তেলের গন্ধ পাচ্ছিলাম। সন্দেহটা আরও বাড়লো যখন টয়লেটের দিকে গেলাম। কিন্তু ট্রেনে এত ভীড় যে ব্যাপারটায় কেউ মাথা ঘামালোনা দেখলাম। আমিও নিজের ভুল ভেবে চেপে গেলাম। টয়লেট সেরে আবার নিজের সিটে ফিরে এসে বসতেই চোখ লেগে গেল, দুদিনের রাত জেগে অভিনয় করার ক্লান্তি, বুঝলেন কিনা। টাকার প্যাকেটটা নিজের জামার ভিতরে ভরে নিয়েছিলাম নাহলে কে কখন লোপাট করে দেবে ভীড়ের মধ্যে। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না, ঘুম ভাঙ্গলো একটা বিরাট চিৎকার চেঁচামেচিতে। গোটা কামরা জুড়ে তান্ডব চলছে তখন। চারিদিকে সবাই ছোটাছুটি ধাক্কাধাক্কি করছে। কালো ধোঁয়ায় ভরে গেছে কামরাটা। আর আগুনের লেলিহান শিখাও দেখতে পেলাম। বুঝতে বাকি রইল না যে ট্রেনের কামরাটা জ্বলছে। আগুন সম্ভবত ওই তেল থেকেই লেগেছিল। প্রাণের দায়ে তখন ওই কামরা থেকে অন্য কামরায় যেতে গেলাম কিন্তু মানুষের ধাক্কাধাক্কি আর ভীড়ের ঠেলায় ভেস্টিবল অবধি পৌঁছানোই দায় । আতংকে সবাই তখন দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়েছে। ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কতজন চলন্ত ট্রেন থেকেই ঝাঁপ দিল। আগুনের ধোঁয়ায় নিঃশ্বাসও নেওয়া যাচ্ছেনা। টাকার বান্ডিলটা হাতছাড়া করিনি তখনও, নিজের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে দরজার দিকে কোনোরকমে পৌঁছাবার চেষ্টা করলাম। মুখটাতে প্রচুর মানুষ দলা পাকিয়ে। সবাই লাফ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে চাইছে কিন্তু আগুনের হল্কা ঘিরে ধরেছে তাদের। আমার পিঠের দিকটাও তখন আগুন ধরে গেছে, জামা পুড়ে যাচ্ছে, অসহ্য জ্বালা। একটা মরিয়া চেষ্টা করলাম ভীড় টপকে মাথার উপর দিয়ে এগিয়ে যেতে। কিন্তু সম্ভব হলোনা। কেউ একজন পিছন থেকে মাথায় মারলো। জ্ঞান হারিয়ে যাওয়ার সময় বুঝতে পারলাম আগুনের ধোঁয়া দৃশ্যমান সব কিছুকে একটা চাদরের মতন ঢেকে ফেলছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো।

লোকটা চোখ বুজে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো। তারপর শান্ত, খুব শান্ত ভাবে তাকালো, বললো – সেই থেকে অনন্তযাত্রা চলছে। জীবদ্দশায় যে দায়িত্বটা পালন করতে পারলাম না এখনও তার দায়ভার বয়ে বেড়াচ্ছি।

সৈকত অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলল, আপনার স্ক্রিপ্টটা ভালো। প্রযোজক খোঁজা শুরু করুন।

লোকটা এবার একটা ম্লান হাসি দিয়ে বলল, স্ক্রিপ্ট নয়, আমার জীবনের ইতিবৃত্তান্ত। অগ্নিকাণ্ডের খবরটা কাগজে বেরিয়েছিল অনেক বছর আগে। এখনও সেই তদন্ত চলছে শুনেছি।

আপনি সেই ট্রেনেই ছিলেন বলতে চান?

লোকটা মাথা নাড়ে।

রাবিশ!

কেন?

কেন মানে? আমাকে দেখে কি বাচ্চা ছেলে মনে হয় যে এসব বিশ্বাস করে‌ ফেলবো? যতদূর জানি ওই দুর্ঘটনায় যাত্রীরা কেউ বাঁচেনি। গাঁজাটাজা টানেন নাকি?

আহা ক্ষেপে উঠলেন যে, আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা সেটা আপনার ব্যাপার আমি শুধু ঘটনাটা তুলে ধরলাম।

ধুর মশাই যত্তসব গাঁজাখুরি। কাজকর্ম নেই আপনার? মানুষকে বোকাবোকা গল্প শোনান?

লোকটা একটু হতাশ হয়ে বললো, সে আপনি মানতে না চাইলে আমি জোর করবো না।

না মশাই ক্ষমা করুন। অনেকক্ষণ আপনাকে সহ্য করেছি, অনেক মাথা খেয়েছেন, এবার চুপ করুন।

লোকটা মাথা নামিয়ে কিছুক্ষণ মেঝের দিকে চেয়ে রইল। তারপর বললো, বেশ। উঠি তাহলে, আমার নামার সময় হলো।

হ্যাঁ কাটুন, আমারো ঘুম পাচ্ছে।

আপনাকে বিরক্ত করবার জন্য দুঃখিত, বলে সামনেই একটা জায়গায় বাস থামিয়ে নেমে গেল লোকটা।

সৈকত মনে মনে ভাবলো লোকটার খুব সম্ভবত মাথার ঠিক নেই। নাহলে আজকাল এরকম আষাঢ়ে গল্প কেউ বলে বেড়ায় না। গপ্পোটা বেশ চটুল লেগেছে । নির্ঘাত কোনো ফিল্ম বা অন্যের লেখা গল্প থেকে টুকে নিজের নামে চালিয়ে যাচ্ছে। সৈকত যদিও গল্প সাহিত্য খুব বেশী পড়ার সুযোগ পায়নি কিন্তু তাও লোকটার কথা শুনে ওইরকমই মনে হচ্ছে। শুধু একটা ব্যাপারেই খটকা লাগছে সৈকতের। ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা একটা হয়েছিল অনেকদিন আগে এটা সত্যি। লোকটার কেউ হয়তো তাতে মারা যায়, সেই শোক বোধহয় এখনো ভুলতে পারেনি। এরকম মাথা খারাপ লোক কত ঘুরে বেড়াচ্ছে চারিদিকে।

বাসটা আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। পাশের লেন দিয়ে একটা ট্রেলার পেরোবার পর ছাড়ল। খোলা দরজা দিয়ে এক চিলতে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকলো বাইরে থেকে । সৈকতের চোখ বুজে আসছে। মাথাটা সিটে ঠেকিয়ে দিল। সারাদিনের ক্লান্তি তন্দ্রা হয়ে চোখগুলিকে চাপ দিচ্ছে। তন্দ্রার মাঝে বাবাকে দেখতে পেলো সৈকত। বাবার চোখে মোটা কাচের চশমা, সিঁথি কেটে পেতে আঁচড়ানো চুল। হাফ পাঞ্জাবি গোছের জামা, হাতে সিটিজেনের ঘড়ি। সম্ভবত বিয়েতে পাওয়া। সৈকত স্কুল থেকে ফেরার পথে দোকানের সামনের রাস্তা দিয়েই আসতো। ওকে দেখলেই বাবা ডাকতেন, স্কুলে কি পড়া হচ্ছে জানতে চাইতেন আর স্কুলের পড়া পেরেছে জানলে হাতে একটা পঞ্চাশ পয়সার লজেন্স দিতেন। বাড়িতে বড় একটা কথা বলতেন না। বেশিরভাগ সময় কাটতো দোকানেই। ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতির ব্যবসা। লাল তার, সবুজ তার, কয়েল, ফিউজ, সুইচবোর্ড, টিউব, বাল্ব এসব ছোটবেলা থেকেই খুব উৎসাহ নিয়ে দেখতো অনিকেত। বাবা মাকে বলতেন, ওকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবো দেখো।

বাবার আত্মহত্যার কারণটা বড় হয়ে জেনেছিল সৈকত। ব্যবসায় অনেক টাকার লেনদেন নিয়ে গোলমাল হয় একবার। মক্কেল বাড়ি অবধি এসে শাসিয়ে গেছিল। তারপর থেকেই বাবা অন্যরকম হয়ে যান। মানসিক কষ্টে ভুগতেন। মা’কে ও কিছু পরিষ্কার করে বলতে পারেন নি।

বাসে অনেক মানুষের গলার শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। এরা কখন উঠলো কে জানে। আশেপাশের এলাকার লোকজন হবে, আদিবাসী । বাস কোথাও দাঁড়িয়েছিল? অথচ ওর ঘুম ভাঙ্গেনি কেন? বাবারও এক নাটক পাগল বন্ধু ছিল বলে লোকের মুখে শুনেছে সৈকত। কিন্তু মা এ ব্যাপারে কিছু বলেনি কখনও। বাস এবারে বেশ জোরেই চলছে। পাশের সিটের দিকে নজরে যেতেই একটা ব্যাগ খেয়াল করলো সৈকত। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত তো! লোকটা ব্যাগ ফেলে গেলো? এরকম অচেনা অজানা ব্যাগে হাত দেওয়া কি ঠিক হবে?

থাক পড়ে। কেউ না কেউ তুলে নেবে। তারপর ভাবলো দেখা যাক কি আছে ব্যাগে। অনিকেত দেখলো লোকটার একটা ছবি, কাগজের রশিদ কিছু, আর দু ‘বান্ডিল টাকা। এ তো অনেক টাকা! সৈকত ভেবে পেলনা ঠিক কি করা উচিত। লোকটাকেই বা এখন কোথায় পাবে। ব্যাগটা বাস থেকে নেমে থানায় জমা দেবে? তাতে কি লাভ, লোকটা কোথায় নেমেছে সেটাও তো দেখেনি সৈকত।

হঠাৎ মায়ের অসুস্থতা, সায়ন্তনীর মুখ, সব একবারে ভেসে উঠলো চোখের সামনে। টাকাটা রেখে দেবে?

এইসব ভাবছে, হঠাৎ বাস টা তীব্র জোরে বাঁক নিলো, সৈকতের মাথাটা সামনের সিটে ঠুকে গেলো। কি ব্যাপার? ড্রাইভার কি পাগল হয়ে গেলো নাকি? প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে সামনের দিকে এগোলো। মোবাইলের আলোয় অন্ধকার বাস মনে হলো জনমানবশূন্য! একটু আগেই যে সহযাত্রীদের দেখেছিল তাদের চিহ্ন মাত্র নেই। চলন্ত বাস থেকে এতগুলো লোকের নেমে যাওয়া তো অসম্ভব! সৈকত দিকভ্রান্তের মতন হাতের মোবাইলের আলোয় অন্য সিটগুলো দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু বাসের দরজাও বন্ধ! উদভ্রান্ত হয়ে সৈকত দরজার কাছে এগিয়ে গেলো। হঠাৎ কানের কাছে কে যেন বলে উঠলো – সৈকত বাবু আমার অনুরোধ রাখবেন?

চমকে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল সেই সহযাত্রী গল্পবাগীশ লোকটা। পরনে শার্ট আর চশমা। লোকটা হাতজোড় করে অনুনয়ের সুরে বলল – আমার বন্ধুর যদি খোঁজ পান দয়া করে তাকে এই টাকাটা দিয়ে দেবেন। প্লিজ! সৈকতবাবু। বলেই লোকটা কাঁদতে কাঁদতে ওর হাতটা চেপে ধরলো।

কী অসম্ভব ঠান্ডা সেই হাত! সৈকতের শিরদাঁড়া বেয়ে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল।

লোকটার দেহটা চোখের সামনে খুব দ্রুত ঝলসানো কাঠকয়লার মতো মতন ধূসর হয়ে উঠতে শুরু করেছে:

প্লিজ সৈকতবাবু! আমার পাপ থেকে আমায় মুক্তি দিন! চঞ্চল রায় বা তার পরিবারের কারো হাতে…

আর্তচিৎকার করে সৈকত হাত ছাড়িয়ে নিতেই মোবাইলটা ছিটকে গেল। নিজেও টাল সামলাতে না পেরে সামনের সিটের উপর পড়ে গেল।

আবার সব অন্ধকার! শুধু মাটিতে মোবাইলের আলোটা জ্বলছে। সৈকত কি ঠিক শুনলো? কি বললো লোকটা! সৈকতের বাবার নাম!

কয়েকটা পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সৈকত। এগিয়ে আসছে । হাতড়ে হাতড়ে মোবাইলটা আবার তুলে নিলো। মোবাইলের আলো সেই শব্দের দিকে ফেরাতে কাউকে দেখতে পেলো না। অন্ধকার আর সব কিছু ছাপিয়ে ওই শব্দগুলো যেন আরও এগিয়ে আসছে।

সৈকতের চোখের ভিতরটা গরম লাগছে, হাত ঠান্ডা, হৃদস্পন্দন তীব্র, গলার ভিতরে কে যেন ধাক্কা মারছে। দেহের সমস্ত রক্ত ঘাড়ের কাছে এসে জমা হয়ে ঠেলা মারছে মাথার খুলির দিকে। ব্রহ্মতালু যেন ফুলে উঠে ফেটে যাবে বেলুনের মতন। সৈকত খুঁজে খুঁজে জানলা ধরে টান মারলো। হ্যাঁচকা টানে হ্যান্ডেলটা খুলে এলো কিন্তু জানালা খুললো না।

পায়ের শব্দগুলো এবার অনেক কাছে পৌঁছে গেছে। একদম ওর সামনে। প্রচন্ড ভয়ে খাবি খেতে খেতে দরজার সামনে পৌঁছে গেছে সৈকত। বাইরের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার আর তুমল বর্ষণকে দু’ভাগে কেটে বাস ছুটে চলেছে।

বাইরে এত অন্ধকার কেন? কোনো গ্রামগঞ্জের আলোও দেখা যাচ্ছে না। সৈকতের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে। বাসটাকে যেন একটা চলমান কয়েদখানা মনে হচ্ছে। জানলা-দরজা আছে কিন্তু বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। কাদের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। ওর দিকেই এগিয়ে আসছে যেন। একটা মাংসপোড়ার বীভৎস গন্ধ উঠলো কোথাও থেকে! তীব্র আওয়াজ আর ধোঁয়াতে ভরে যাচ্ছে বাসটা। ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত বমিভাব উঠে আসছে নাড়ি পাকিয়ে। দম বন্ধ লাগছে, বাম হাতের দিকটা কেমন অসাড় হয়ে আসছে, চিনচিনে একটা ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে শরীরে। হর্নের তীক্ষ্ম শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। পিঠের উপর একটা ঠান্ডা, অলৌকিক স্পর্শ পেল। হাড় হিম করা একটা স্পর্শ। দরজা টা কি খুলে গেলো? ও কি জ্ঞান হারাবে? যে করেই হোক এর থেকে মুক্তি পেতে হবে। যা থাকে কপালে। সামনে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। শেষবারের মতন একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে ছুঁড়ে দিল তার মধ্যে।

সৈকত জেগে ওঠে,অথবা তার মনে হয় সে জেগে উঠেছে।

বাল্বের ধোঁয়াটে আলোছায়ায় চোখে ধাঁধা লাগছে। বারকয়েক চোখের পলক ফেলার পর খানিকটা সয়ে এলো। অসম্ভব ঠাণ্ডা কোথাও শুয়ে আছে সৈকত। উঠে বসলো। গায়ে অসহ্য ব্যথা। কী হয়েছিল? জামার ভিতরে কি যেন শক্ত একটা কোমরে খোঁচা দিচ্ছে। ভিতরে হাত দিয়ে সেটা বার করে আনলো সৈকত। একটা খবরের কাগজ মোড়ানো প্যাকেট। তার ভিতর মোটা মোটা দু বান্ডিল টাকা। এখানে সে কিভাবে এলো আর সঙ্গে এতগুলি টাকাই বা কি করছে? মনে করতে গিয়ে কিছু মনে এলোনা। যে খবরের কাগজে টাকাগুলো মোড়ানো, তার সামনের দিকে একটা খবর বড় করে ছাপা আছে-

ন্যাশনাল হাইওয়ের কাছে দুর্ঘটনা, কলকাতা থেকে রঘুরাজপুর গামী বাস শেষরাতের দিকে কালভার্টে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায়। ডিজেল বক্স ফেটে যাওয়ায় তৎক্ষণাৎ বাসে আগুন ধরে যায়। বাসের সাতাশজন যাত্রী সকলেই মৃত। প্রাথমিক তদন্তে অনুমান, ড্রাইভার ঘুমিয়ে পড়ার দরুন এবং রাস্তা অতিরিক্ত বৃষ্টিতে পিছল থাকার কারণে এই দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনায় মৃত যাত্রীদের সকলকেই স্থানীয় চাতকপুর মহকুমা হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। লাশ সনাক্তকরণের জন্য মৃতদের পরিবারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে।

খবর দেখে সৈকতের মনে হলো বিশ্বশুদ্ধ সবারই বোধহয় মাথা খারাপ, নাহলে এসব গাঁজাখুরি কে লেখে? খবরের কাগজে গপ্পো ছাপে নাকি? প্রায় ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে সৈকত ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরে প্রচুর লোক, গমগম করছে ঘর। তীব্র ফিনাইল আর ওষুধপত্রের গন্ধ, সঙ্গে মানুষের চিৎকার, আর্তি সব মিলিয়ে গা গুলিয়ে উঠলো তার। অতি কষ্টে ঘর থেকে বেরোতে পারলেও দরজার সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে আরেক দল। মাঝে মাঝে ক্যামেরার ফ্ল্যাশের শব্দ ও শোনা যাচ্ছে। সৈকত খোঁড়াতে খোঁড়াতেই সবাইকে কাটিয়ে বেরোতে চেষ্টা করলো। দমবন্ধ পরিস্থিতি।

বাড়ি ফেরার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। দিনের বেলায় ভ্যাপসা গরমটা বাড়ছে। ভিড় ছাড়িয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করতে করতে দেখলো – যে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসেছে, নীল সাদা সেই বিল্ডিং এর ওপর বড়ো করে লেখা চাতকপুর মহকুমা হাসপাতাল।

Facebook Comments

Leave a Reply