রাক্ষস কি সত্যিই দাঁত মাজে না? : নীতা বিশ্বাস
মানুষের মধ্যে যেমন অনেক রকম বৃত্তি (জীবিকা), তেমনই অনেক রকমের প্রবৃত্তি (অভিরুচি, স্পৃহা) থাকে, যাকে তার প্রকৃষ্ঠ মনোবৃত্তি বলতে পারি। এই মনোবৃত্তিতেই কেউ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, কেউ রামকৃষ্ণ দেব, বিবেকানন্দ, আবুলকালাম আজাদ, কেউ জিন্না, দাউদ ইব্রাহিম, উমিচাঁদ মিরযাফর এবং ৫৬ইঞ্চির ছাতির চালাকি।
‘দাঁত মাজা’ যদি সিমবলিক ধরা যায়, তবে স্পষ্টই বোঝা যায় কে দাঁত মাজে, কে মাজে না। কার জাতমনোবৃত্তি কি রকম। বেশ বোঝা যায় কারা স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে দাঁত মাজে আর কারা টুথব্রাশ-পেস্ট কিনে বাক্সে রেখে দেয়, অবরে-সবরে দায়ে পড়ে মাজে, আর কে কোনোদিনই দাঁতমাজার তোয়াক্কা করে না। নিজেকে মাজা-ধোওয়া করার পরোয়া করেনা। কিন্তু তারা ধাতের কলার উঁচিয়ে বা ধাতের আঁচলের কোনা বের করে রাখে না। দেখাতে চায় না তাদের ধাতের নামাবলি বা চরিত্র। সেইভাবে তিন তরফই চরিত্র লুকিয়ে চলে। এগুলো তাদের কৌশল। কিন্তু চন্দন আর আঁস্তাকুড়! প্রকাশ ঠিকই হয়ে পড়ে। এখন করোনাকালীন সময়ে কেউ যদি গলা তুলে গায়, ‘ফুলে গন্ধ নেই/ সে তো ভাবতেও পারিনা, তো তাকে সবাই সঙ্গে সঙ্গে অচ্ছুৎ বলে তাড়াবেন—বুঝতে পেরেছি, আপনি মোশাই হানদ্রেড পার্সেন্ট কোভিড-পজেটিভ। কাজেই কোনোরকমের স্যাম্পেল ভুলেও গান গাইবে না।
#
অভিধানও দ্যাখো কম চোট্টামী করে! রাক্ষসের অর্থ লিখেছে নিশাচর। নিশায় চরে কি শুধু রাক্ষস! হা হা হা। অভিধান এও বলছে কুবেরের ধন রক্ষা করে যে, সে রাক্ষস। আবার যে প্রিয় ছেলেটা অত্যধিক ভোজন করছে, তাকে লোকে আদরের চাপড় মেরে বলে ‘রাক্কোস একটা’। বলে না?
এখানে একটা সত্যি গল্প না বলে পারছি না। মানে সত্যিটা ঠিক গল্পের মতো। বিশ্বাস করো! আমাদের পাশের টাটাকোম্পানির কোয়াটার্সটা পেয়েছিলেন একজন হিন্দিভাষী লোক। নিজের বাড়ি থাকার কারনে তিনি কোয়াটার্সটা ভাড়া দিয়েছিলেন দুটি অন্য লোককে। তাদের একটি করে ঘর ও বারান্দা একেকজনের ভাগে। যিনি সামনের ঘর-বারান্দা-বাগানের অধিকারী ছিলেন, তিনি জুবিলি-পার্ক যাবার রাস্তায় ঠেলাবোঝাই বাদামভাজা বিক্রি করতেন। এটাই তাঁর বৃত্তি বা জীবিকা। তিনি মানূষটি বামন। তিন বা সাড়ে তিন ফিট। সাদাকালো কদমছাঁট চুলে একটা টিকি। ঠেলার ওপর তাঁর মুখটাই দেখা যেত। আশ্চর্যের ছিল তাঁর দাঁতগুলো। দেখলে চোখ টানবেই। শরীরের অনুপাতে দাঁতের দৈর্ঘ অবাক করে দেয়। কারো দাঁত এত হলুদ ও তাতে বারোয়ারি কলতলার ছ্যাৎলা, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তিনি মাসে একদিন দাঁত মাজতেন। যেদিন দাঁত মাজতেন সে এক দেখার মতো দৃশ্য। অপূর্ব। তাঁর বউটি তাঁর থেকে হাত-দেড়েক লম্বা হয়েও নিরিহ-গোবেচারি। (বেচারি শব্দটার সাথে ‘গো’অক্ষর যুক্ত করার অর্থ আমি আজও বুঝতে পারিনি ( এর সাথে গো সম্প্রদায়ের কোনো যোগ আছে কি? পাঠক আমাকে জানাবেন)।দাঁত মাজার দিন সকাল বেলায় নিরিহ স্ত্রী একটি একটি করে মাজন এনে সামনের বারান্দায় এনে রাখতেন লাইন করে। ছাই দিয়ে শুরু। তারপর নুনের মধ্যে একটু সরষের তেল মেশানো একটা বাটি। পর পর নিমদাঁতন, সোডা, একটুকরো পাতিলেবু, ডাবর লাল দন্তমঞ্জন আর সব শেষে বাদাম-ওয়ালার ফুলছাপ টিনের স্যুটকেস থেকে বেরোতো একটি টুথব্রাশ আর কোলগেট টুথপেস্ট। তার বৌ আর আমরা অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম সেই দৃশ্য দেখতে। বাগানে একটা শিরিষ গাছের তলায় একটা মোটাসোটা লোটাভরা জল নিয়ে ঘন্টাদেড়েক ধরে চলতো এই মঞ্জন তথা মার্জনা পর্ব। শেষ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে এক ঝলক হাসি দিতেন বাদামওয়ালা। যেন দেবতার মতো হাসি। তারপর আমাদের দু ভাই-বোনকে দু বাটি বাদাম উপহার দিয়ে আমদের খুশির হাসি দেখে তাঁর সমস্ত মাজনপর্বটি শেষ হতো। দাঁত মাজলে মানুষটার মন বড় হয়ে যেত। খানিক বড় হয়ে মনে হয়েছে রোজ দাঁত মাজলে (সবদিক থেকে পরিমার্জিত রাখলে) রাক্ষসও উচ্চমার্গের প্রাণী হয়ে উঠতে পারে। আসল কথাটা হচ্ছে স্বচ্ছতা। পরিষ্কারness! শরীর মার্জনায় মনও মার্জিত হয়। আর মনে হয়েছহিল, দেশের তথাকথিত নেতারা যারা সদলবলে নেতাগিরিকেই দেশপ্রেম বলে ভাবে ও সকলকে ভাবাতে চায়, তারা একদিনও দাঁত মাজে না। মিথ্যেপ্রতিশ্রুতি, লাশ ফেলার হুমকি, কাটমানি খাওয়া, ত্রাণের টাকা ঝেড়ে দেওয়া, অন্যের প্লট লোপাট (তা সে বাড়ির প্লট হোক বা গল্পের)করা, দাঁত কোনোদিনও মাজলে এসব করা যায় না। এবং এরা বেশ সফল নেতা। সফলতা এত সোজা রাস্তায় পাওয়া গেলে মাজামাজির প্রয়োজনটা কিসের!
#
মুশকিল হচ্ছে আমরা এখনও ভীষণাকৃতিকেই রাক্ষসের সঠিক সংজ্ঞা বলে ভাবি। এখন আমরা কেউ কেউ জেনে গেছি মনের পৈশাচিক প্রবৃত্তিই রাক্ষসের আসল রূপ। আরে, ছোটবেলায় ওই যে কবিতাটা না বুঝেই পড়েছিলাম, মুখস্থ করেছিলাম,–মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক মানুষেতে সুরাসুর।’ সুরাসুর কথার মানে বুঝেছি না কি তখন! বড় হয়েও কি সবাই তেমন বুঝেছে! বুঝতে একটা ‘বোধ’ দরকার। তো সেটা যখন আসে তখন বুঝতে পারা যায়। যদি বুঝতাম যারা শরীরে রাক্ষস তারাই প্রকৃত রাক্ষস, তাহলে তেমন কোন সমস্যা থাকতো না। তারা দাঁত না মাজলেও সাধারণের কোন সমস্যা নেই। স্থির নিশ্চিৎ হয়ে তাদের পিঠে-বুকে রাক্ষস স্ট্যাম্প মেরে নিশ্চিন্ত হয়ে তাদের থেকে দূরে থাকা, তাদের না-ঘাঁটানো, তার এরিয়ায় না যাওয়া, তার মেয়েমানুষের দিকে নজর না দেওয়া ইত্যাদি মেনে নিজেকে সেফ জোনে রাখা যেত। কিন্তু রোগ যেমন চেনা উপসর্গবিহীন হলে চেনা যায় না, এখনকার রাক্ষসদের রাক্ষসজনোচিত উপসর্গ গুলো দেখা যায় না। লুকানো থাকে। কি কৌশলে সেসব পৈতের ভেতর লুকোনো থাকে আমরা বোকাসাধারণরা হঠাৎকরে বুঝতে পারি না। তাদের মিষ্টিকথার মিথ্যে ফাঁদে পড়ি। মুক্তমঞ্চে ওরকম বাহ্যিক উপসর্গ লুকানোদের গলাকাঁপানো ‘বন্ধুগণ’ কিংবা ‘মিত্রোঁ’ শুনে আমরা অভিভুত হয়ে পড়ি এবং তলিয়ে যেতে থাকি। ঘ্যাঁটের তরকারির মধ্যে বিষঝাল সবুজ কাঁচালঙ্কাটি যেমন সকলের সঙ্গে মিলেমিশে… সুবিধে বুঝে বিষ ঢালে…
বিশ্বাস করুন, আমি জানি এরা দাঁত কেন, শরীরের মনের কিছুই কোনোদিনও মর্জন করে না। মাজা ব্যপারটার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই। ব্রাশ-পেস্ট ওদের মুখের ভেতর যদি কোনোরকমে প্রবেশ করানো যায়ও, দাঁত ওদের অমার্জিতই থাকে।
#
তো শুচিতা (শুচিবায়ুতা) ধুপধুনো, পুজো-পার্বণ, সদা হাস্যমুখ এরা এখানে-সেখানে টাকা ডোনেট (অবশ্যই ডবল উসুল করার ফন্দিতে),করা—এরাই কায়দা মাফিক জনগণের জন্য দেওয়া সরকারী ত্রাণ বাঁ-হাতে খেয়ে ফেলে, ব্রিজ বানাবার টাকায় কারচুপি করে, বোকাসাধারণকে ক্ষেপিয়ে দাঙ্গা বাধিয়ে ফায়দা লোটে, কোন সভায় চোখের জল ফেলতে হবে আর কোনকানে মধুর হাসি বিলিয়ে দিতে হবে—সব অঙ্ক কষে ঠিক করে রাখে, তাকে কোন গোষ্টিতে ফেলা যে ফেলা যায়, হায়! এরা কি ইবলিশের বাচ্চা না আরো অন্য কিছু! যুগে যুগে এদের পরনের কাপড় ধোপার বাড়ি যায়না! এদের দাঁত দাঁতের মাড়ি, মুখের কথা, সততার মুখোশ, নিয়মিত তিনবেলা দাঁত মাজার পরেও দুর্গন্ধ লোকে ঠিক টের পেয়ে যায়। এরা কি ইশপের গল্পের সেই নীলবর্ণ শৃগাল! এসব ভাবতে ভাবতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়, বুকে যন্ত্রণা হয়, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। পড়শিরা এসে বলে, এ তো কোভিড ১৯ এর ছোবল। মূহুর্তে আমি অস্পৃশ্য সাব্যস্ত হই, দাঁতমাজা রাক্ষসের মদতে আমার পাড়া ছাড়ার হুমকি আসে। আমি ফিরে নাও আসতে পারি সে বন্দোবস্ত চুপচাপ হয়ে যায় এবং কষ্টেসৃষ্টে বানানো আমার বাড়িটা এই অবসরে প্রোমোটারের পাল্লায় পড়ে যায়।
একালের রাক্ষসরা দাঁত মাজে। একবেলা নয় তিনবেলা করেই দাঁত মাজে। মিরZIফর যেমন! দু’শো বছর ধরে বাংলাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোলাম বানাবার হকদার ও ছকদারের বিরুদ্ধে দাঁত না মাজার কোন কানাঘুষো কোনোদিন কেউ শুনেছে?
Posted in: PROSE, September 2020 - Cover Story