“ব্যাপারটা কি!” : মেখলা সেন

দুশো বাইশ নম্বর পাতার রোমহর্ষক ক্লাইম্যাক্সটা পড়তে পড়তে শীতের রাতেও আপনার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আপনি গল্পে পড়ছেন, রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ একটা দোতলা বাড়ীর জলের পাইপ বেয়ে উপরে উঠে এসেছে খুনী। যুবকটির ঘরে এসে গুটি গুটি পায়ে খুনী ঘুমন্ত যুবকের বিছানার সামনে এসে চাকুটা বের করতে যাবে, ঠিক এমন সময় সে দেখল যুবকটিকে ইতিমধ্যেই খুন করা হয়েছে। রক্তাক্ত দেহটির পাশে পড়ে রয়েছে একটি রক্তমাখা চাকু। হুবহু তার চাকুটির মতো! থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বর্তমান খুনীটি। তড়িঘড়ি নিজের পকেটে হাত দিয়ে খেয়াল করে, তার চাকুটি নেই, এবং সেইসঙ্গে দেখতে পায় নিজের মোবাইলটি পড়ে আছে মৃত যুবকের মাথার ঠিক পাশে!
খুনের আগেই খুন হয়ে যায় কিভাবে? তাও আবার একই খুনীর দ্বারা? ভাবতে ভাবতে আপনি টেবিলে রাখা ঘড়িটার দিকে তাকালেন। দেখলেন আপনার ঘড়িতেও রাত সাড়ে বারোটা। অথচ মোবাইলের স্ক্রীনে লেখা রাত দুটো বেজে দশ মিনিট। না না, এটা কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়।নেহাত টেবিল ঘড়িটার ব্যাটারী ফুরিয়ে গেছে।
আপনি আবার ডুব দিলেন দুশো বাইশ নম্বর পাতায়।কিন্তু একি!সেখানে খুনী, যুবক, চাকু, কাউকেই আপনি খুঁজে পেলেন না!এতক্ষণ যা যা পড়ছিলেন সেই সমস্ত বিবরণ হঠাৎ পাল্টে গেল কিভাবে?

মঞ্চের ম্যাজিক দেখতে দেখতে হাততালি দিয়েছিলেন আপনি। ম্যাজিশিয়নের হাতের ফুল হঠাৎ শিক্ষকের হাতের রুল হয়ে গেল? এও কি সম্ভব? এইসব সম্ভব অসম্ভবের ওলিগলি হেঁটে আপনি বাড়ী পৌঁছেছিলেন। এসমস্ত অকল্পনীয় বিষয় উড়িয়ে দিয়ে ভেবেছিলেন গোয়েন্দা গল্পটা শেষ করে তবেই রাতে ঘুমোবেন। কিন্তু, মঞ্চের সেই ম্যাজিককে আপনি ছেড়ে এলেও, সে হয়ত আপনার জামার পকেটে ঘাপটি মেরে ঢুকে আপনার সঙ্গে আপনার বাড়ী এসেছিল এবং একসঙ্গে গোয়েন্দা গল্পটি পড়বে বলে ঠিক করেছিল। আর তাই হয়ত সেদিন রাত্রে দুশো বাইশ নম্বর পাতায় আপনার সঙ্গে শেষমেষ তার দেখা হয়ে গেল!

হলঘরে ঠাসাঠাসি করে বসে আছে ক্লাস ইলেভেন, সেকশন – এ। গোটা চল্লিশ (অ)মুগ্ধ দৃষ্টির এপারে যন্ত্রচালিতের মতো ব্ল্যাকবোর্ড জুড়ে ইন্টিগ্রেশন, ডেরিভেশনের ঢেউ তুলে তুলে দৃশ্যান্তর ঘটিয়ে চলেছেন সত্যপ্রিয় বাবু। হঠাৎ করে সক্কলের ঘুম উড়িয়ে দিয়ে বাইরের গনগনে রোদের থেকেও একখানি গনগনে অঙ্ক নিক্ষেপ করলেন ছাত্রদের দিকে, এবং অঙ্কের উত্তর জানতে চাইলেন। এরমধ্যেই শেষ বেঞ্চের এক ছাত্র “থ্রি জিরো ফাইভ সেভেন পয়েন্ট..” বলে একটা উত্তর দিয়ে মাথা নীচু করে বসে রইলো। সত্যপ্রিয় বাবু ছেলেটিকে সকলের মধ্যে খুঁজে বের করে হনহন করে ওর দিকে এগিয়ে গেলেন। স্যারকে দেখে ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়াল ছেলেটি। ওর খাতার দিকে তাকালেন সত্যপ্রিয় বাবু।
-“অঙ্কটা না করেই উত্তর দিয়ে দিলি যে?”
-“অঙ্কটা আমি পারতাম না স্যার, তাই মনগড়া
একটা সংখ্যা বলে দিয়েছি… স্যার এমন আর হবেনা স্যার।”
সত্যপ্রিয় বাবু বলে উঠলেন-
” অবাক ব্যাপার তো! এ তো একদম ঠিক উত্তর!..”
সত্যপ্রিয় বাবু এই ঘটনার কোনো সত্যতা খুঁজে না পেয়ে ছেলেটির দিকে শুধু চেয়ে রইলেন।

সত্যপ্রিয় বাবুর মতোই আমি, আপনিও এমন অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়েছি বা ভবিষ্যতে হতে পারি। সেই সমস্ত ঘটনাগুলো কখনও আমাদের আলিঙ্গন করে ঐতিহাসিক সত্যে,কখনও বা আলিঙ্গন করে আমাদেরই চৌহদ্দির মধ্যে।

“বারমুডা ট্রায়াঙ্গল”-এর কথা আমরা কে না জানি। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের আনুমানিক তেরো কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে অবস্থান করছে এই রহস্যস্থান। অনুমান করা হয়, মিয়ামি, পুয়োর্তো রিকো এবং বারমুডা, এই তিন জায়গাকে রেখাঙ্কিত করলে যে ত্রিভুজাকৃতি অংশ তৈরী হয়, সেই স্থানই হল “বারমুডা ট্রায়াঙ্গল” ; যেখানে বহু জাহাজ এবং বিমান রহস্যজনকভাবে গায়েব হয়ে যায়। বহু গবেষক বহু তথ্য আরোপ করলেও আমাদের কাছে তা আজও রহস্যময় ও অদ্ভুত একটি বিষয়।
এই পৃথিবীতে যেমন সোজা রাস্তা রয়েছে, তেমনই রয়েছে আঁকাবাঁকা বহু পথ। যদি সোজা ও বাঁকা পথের গন্তব্য একই হয় তাহলে সোজা পথ ধরে অনায়াসেই পৌঁছে যাওয়া যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কিন্তু, পথ যদি আঁকাবাঁকা হয়, সেক্ষেত্রে কোনো নতুন পথিকের পক্ষে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো জটিল হয়ে দাঁড়ায়। সেই সমস্ত বাঁকা পথের কোনো কোনো বাঁকে এসে মনে হয় সমস্তটাই গোলকধাঁধা। প্রকৃত রাস্তার হদিশ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। চারপাশে বিস্তৃত এমন নানান স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট ঘটনাগুলোও এই সোজা এবং বাঁকা পথের মতোই।

হয়ত,এমনই কোনো এক সোজা পথ আপনার ভীষণ চেনা।যাদবপুর এইট-বি বাসস্ট্যান্ড থেকে বাঁ হাতে যে চওড়া গলিটা চলে গেছে, সেই গলি বরাবর হাঁটতে হাঁটতে আবার বাঁ হাতের একটি গলি ধরে এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে একটি বটগাছ পরে। সেই গাছটিকে ছেড়ে তিন নম্বর বাড়ীটা আপনার মামার বাড়ী। অর্থাৎ, এ রাস্তা আপনার মুখস্থ। মামা বাড়ীতে বৃদ্ধ মামা -মামী ছাড়া কেউ থাকেন না। প্রতিবছরে অন্তত দু তিন বার এখানে এসেই থাকেন আপনি। কিন্তু গত দু বছর বাইরে থাকার দরুন আসা হয়নি। সপ্তাহ খানেক আগে আপনি ফিরেছেন। মনস্থির করেছেন এবার একদিন মামা বাড়ীতে আসতেই হবে। কিন্তু,তাদের কাউকে ফোনে যোগাযোগ করতে না পেরে উদগ্রীব আপনি আজই চলেছেন মামা বাড়ীর উদ্দেশ্যে। কিন্তু এ কি! যাদবপুরের চেনা পথ ধরে গিয়েও কেন খুঁজে পাচ্ছেন না আপনার মামা বাড়ী? স্থানীয় কিছু ব্যক্তিদের জিজ্ঞেস করায় তাদের উত্তর, তারা আগে কখনওই ওই জায়গার নাম শোনেনি। অদ্ভুত! মাত্র দু বছরে একটা চেনা ঠিকানা কিভাবে হারিয়ে যেতে পারে?
সমস্ত অদ্ভুত ঘটনার আড়ালে থাকে কিছু না কিছু বাস্তব কারন। গাড়ীর সামনের কাঁচে যদি বৃষ্টিফোঁটা জমে যায় তাহলে গাড়ীর চালক ওয়াইপার চালিয়ে দিয়ে কাঁচের উপরের সেই জল বারবার মুছে নেয় সামনের রাস্তা দেখার জন্য। ঠিক তেমনই হয়ত আমরা অবাস্তবের আবরণ মুছে আড়ালে থাকস সেই বাস্তবকে দেখতে চাই বারবার।
উপরে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাগুলোর আড়ালেও হয়ত রয়েছে বাস্তব আর অবাস্তব মিলে যাওয়া একটি সূক্ষ্ম সুতো, যা খালি চোখে আমি, আপনি কেউই দেখতে পাই না।
ধরা যাক, এই নিবন্ধেরই একদম প্রথমে বিবৃত দুশো বাইশ নম্বর পাতায় খুনীর খুন করতে এসে টের পাওয়া, সে ইতিমধ্যেই খুনটা করে ফেলেছে! এমনও তো হতে পারে খুনী Alzheimer’s এর স্বীকার। এই রোগের লক্ষ্মণ মূলতঃ কিছুক্ষণ আগের কোনো ঘটনার বিস্মৃতি ঘটা।এখানে হয়ত খুনীরও তাই হয়েছে! আর পাঠক যখন এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটি পড়ছিলেন তখন নিজের অজান্তেই হয়ত দুশো বাইশ নম্বর পাতার পরিবর্তে একশো বাইশ নম্বর পাতা উল্টে ফেলেছেন তিনি এবং সম্পূর্ণ উত্তেজনার বশে পাতার নম্বর ভুল দেখেছেন!
দ্বিতীয় ঘটনায়, সত্যপ্রিয় বাবুর অঙ্ক ক্লাসে ছাত্রটি হয়ত সামনের কোনো ছেলের খাতায় অঙ্কের উত্তরটি দেখে আগেই নিজে বলে দিয়েছে! অথবা হয়ত এটি সত্যিই একটি কাকতালীয় ঘটনা!
পরবর্তী ঘটনায় পথিকের চেনা পথ অচেনা হয়ে যাওয়া বা চেনা ঠিকানাটা খুঁজে না পাওয়ার কারণ হয়ত Dementia নামক এক ধরনের ভুলে যাওয়া ব্যাধি যা Alzheimer’s হওয়ারই পূর্ব লক্ষণ। হয়ত,পথিক যে সমস্ত স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে ঠিকানা জানতে চাইছিলেন, তারা ওই অঞ্চলে বেশীদিনের বাসিন্দা নন।
আসলে Alzheimer’s Disease হওয়ার কারন amyloid শ্রেণীর নিউক্লিক অ্যাসিড সম্বলিত একধরনের প্রোটিন মস্তিষ্কের কোষের ভিতরে এবং বাইরে জমাট বেঁধে যায়। ফলে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ, বিশেষ করে স্মৃতিকোশ(memory cell) ক্ষয় পেতে থাকে, সেই কারনে মস্তিষ্ক থেকে acetyle choline নামক এক ধরনের সিগন্যালিং নিউরোট্রান্সমিটারের ক্ষরণ কমে যায় এবং মস্তিষকের এক কোশ থেকে অপর কোশে সিগন্যাল বা বার্তা ঠিকঠাক ভাবে পৌঁছতে পারে না। আর ঠিক সেই কারণেই স্মৃতিবিভ্রম ঘটে।
এ তো গেল বিঞ্জানসম্মত এবং বাস্তবসম্মত কারণ। কিন্তু আমি মনে করি আমাদের চারপাশের এই অদ্ভুত ঘটনাগুলির একটি নিজস্বতা থাকে।আমরা ঘটনাগুলিতে যুক্তি খুঁজতে গিয়ে তাদের নিজস্বতা নষ্ট করে ফেলি। আলোর পাশে যেমন অন্ধকার থাকে, সত্যের পাশে যেমন অসত্য থাকে, ভালোর পাশে যেমন মন্দ থাকে, দুঃখের পাশে যেমন থাকে আনন্দ। ঠিক তেমনই বাস্তব ঘটনার পাশে অবাস্তব, অদ্ভুত কিছু ঘটনা থাকুক না। এতে এমন কি ক্ষতি? আম খেতে খেতে যদি আমরা আমের বহিঃস্তক, অন্তঃস্তক,আমের বীজপত্র ইত্যাদি বিশ্লেষণ করতে বসি তাহলে তো আম খাওয়ার মজাই উপভোগ করা যায় না! সমস্ত কিছুর বিশ্লেষণ কি সত্যিই প্রয়োজন? প্রয়োজন যতক্ষণ না আমাদের দুয়ারে এসে দাঁড়ায়,অর্থাৎ যতক্ষন না পর্যন্ত আমরা অদ্ভুত কোনো ঘটনার ভুতের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হই, ততক্ষণ পর্যন্ত অদ্ভুতের ভুত তাড়ানো আমার মতে নিষ্প্রয়োজন। নাহলে অদ্ভুত ঘটনা গুলো নিয়ে উত্তেজনাময় গপ্পোসপ্পো গুলো জাস্ট মাঠে মারা যায়!
“বাঁশি বেজেছিল, ধরা দিনু যেই থামিল বাঁশি,
এখন কেবল চরণে শিকল কঠিন ফাঁসি।”
রবিঠাকুরের এই পঙক্তিদুটিও হয়ত তাই বলে!

[তথ্যসূত্র- NHS.Uk, ScienceDirect]

Facebook Comments

Leave a Reply