আওয়াজ : মনীষা চক্রবর্তী
সেদিনের পর আজ অব্দি চোখের পাতায় শান্তির ঘুম জোটেনি। কেবল একটাই কথা যা বারবার স্বশরীরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে যায়, সেদিন যা দেখেছি তা ঠিক কি ছিলো বা কেন ছিলো?
আমি আর সজলের ছোটো বেলার বন্ধু।আমাদের দু’জনেরই জীবনে একটাই শখ, বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে ঘুরতে যাওয়া আর গ্রামবাসীর সহজ সরল জীবন দেখে কিছুটা নিজের অস্থির জীবন কে সান্ত্বনা দেওয়া, ঠিক কতোটা সহজ হলে এতোটা নিরিবিলি বাঁচা যায়।
তাই প্রতি বারের মতোই গত রবিবার আমি ও সজল নিজের নিজের বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম, বাড়ি থেকে ঠিক ২০০ কিমি দূরের মধু পড়া নামক একটি গ্রামে, খুব আনন্দ আর নতুন করে একটু শান্তি পাওয়ার আশায় ।
তবে সেদিন বাড়ি থেকে বলেই বেরলাম, আজ রাতে ফিরবো না, কোনো না কোনো ব্যবস্থা করে নেব ওখানেই রাত কাটানোর। মায়ের সেই একই কথা, দেখিস বাবা পারলে রাতেই ফিরে আসিস। কিন্তু আমরা মনে মনে ঠিক করেই ফেলেছিলাম, রাতটা গ্রামেই কাটানোর।
শেষমেশ পৌঁছে গেলাম সেই মধু পাড়া গ্রামে । গ্রামটার, কি অদ্ভুত সৌন্দর্য। আমরা সারাদিন ধরেই গ্রামে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন রকমের ছবি তুললাম। কখন ছোটো ছোটো বাচ্চাদের নিয়ে বা বয়স্ক মানুষদের নিয়ে। এই সব মাঝে আমরা এক্কেবারে ভুলেই গেছিলাম যে রাতে কোথাও থাকার আমরা কোনো ব্যবস্থাই করিনি। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নামবার সাথে সাথেই গ্রামের রাস্তাঘাটও ফাঁকা হতে থাকে । তখন সজল বলে উঠলো, সোম আমরা কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি, গ্রামে এসে আগেই রাত কাটানোর ব্যবস্থাটা করে নেওয়া উচিৎ ছিলো, কারণ জানিসই তো, গ্রামের মানুষ অন্ধকার নামলে বেশি রাত অব্ধি জেগে থাকে না।
তখনই দূর থেকে আমার নজরে একটা চায়ের গুমটি পড়লো। আমি সজল কে ইশারায় বললাম, চল ওইখানে, নিশ্চয়ই কোনো না কোনো সাহায্য পেয়ে যাব। চায়ের গুমটি বেশ ছোটো, আমরা দু কাপ চা নিলাম আর চায়ে ঢোক দিতে দিতে আমার প্রথম প্রশ্ন, কাকু আমরা গ্রাম ঘুরতে এসেছি, তবে রাত কাটানোর কোনো ব্যবস্থা হয়নি। আপনি কি একটু এই বিষয়ে সাহায্য করতে পারবেন।
উনি আমাদের দিকে একটু অদ্ভুত ভাবেই দেখলেন আর বললেন, হ্যাঁ, ওই সামনের দেখো একটা দোতালা পাকা বাড়ি আছে। ওখানে কেউই থাকে না, বাড়ির মালিক বহুদিন হলো গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেছেন। চাবিটা অবশ্য আমার কাছেই রাখা, তোমরা বরং ওখানেই রাত কাটিয়ে নাও। আমরা মনে মনে ভীষণ খুশি, যাক শেষমেশ পাকা বাড়িতেই রাতটা কাটানো হবে।
লোকটি আমাদের হাতে চাবি ধরিয়েই চলে গেল। প্রথমটা একটু অবাকই লাগলো, চাবি দিয়ে চলে গেলো? তার পর মনে হলো, গ্রামের মানুষেরা তো সহজ সরলই হয়। ওদের মধ্যে অত প্যাঁচ কোথায় ।
আমি আর সজল ঢুকে পড়লাম চাবি খুলে, ভেতরটা বেশ সেরকম পরিষ্কার না। সে যাই হোক, একটা রাতেরই তো ব্যাপার। টুকটাক খাবার আমরা বাড়ি থেকেই নিয়েই এসেছিলাম। তা খেয়েদেয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম। মাঝ রাত প্রায় এক’টা, হঠাৎ প্রচণ্ড বৃষ্টি নামে। জানলা কপাটের আওয়াজে আমার আর সজলের দুজনেরই ঘুম ভেঙে যায়। সজল ঝটপট উঠে জানলাটা লাগিয়ে দেয়। আমরা আবার শুয়ে পড়লাম। তবে বেশিক্ষণের ঘুম জোটেনি।তার ঠিক পনেরো মিনিট পর প্রচণ্ড বাসনের শব্দ।কেউ যেন সব বাসনপত্র ছোড়াছুড়ি করছে। আমাদের দুজনেরই ঘুম ভেঙে যায়।রুমের বাইরে আমরা ছুটে বেরিয়ে আসি।তবে মনে হলো শব্দটা ওপর থেকেই আসছে।আমরা একে-অপরের দিকে তাকালাম।সজল বলে উঠলো, বাড়িতে তো কেউই থাকে না, তবে এই আওয়াজ টা কিসের।আমি আর সজল দুজনেই মোবাইলের টর্চ লাইট জালিয়ে সিঁড়ি ওঠতে শুরু করলাম, উপরে প্রচণ্ড অন্ধকার, আর যত সিঁড়ি আমরা চড়ছি ততই যেন বাসনের শব্দ বেড়েই যায়।তবে চিরকালই আমার বড্ড সাহস, তাই আগে আগে আমিই উঠছিলাম।কিন্তু যা অন্ধকার কিছুই সেরকম দেখা যাচ্ছিল না।
উপরে ওঠতেই প্রচণ্ড সিগারেটের গন্ধ।কেউ যেন হঠাৎ করে আমার হাতটা চেপে ধরে আর ধাক্কা দিয়ে নিচের দিকে ছুঁড়ে দেয়।আমি আর সজল হুমড়ি খেয়ে পড়ি।তখনও অব্ধি আমরা বুঝে ওঠতে পারছিলাম না, যা দেখছি তা ঠিক কি? তবে, আমরা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছিলাম।তাই ছুটে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লাম বাইরে। তখনও প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছে।আমরা ভাবলাম সেই চায়ের গুমটির দিকে ছুটে যাই।তবে গুমটি টা আর চোখে পড়লো না। আজ অব্ধি আমরা এতটা ভয় কোনোদিন পাইনি।আমরা গাড়ি নিয়ে বৃষ্টি মাথায় ওই গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।মোটামুটি ভোরের আলো ফুটে গেছে।সজল আমার সাথে আমার বাড়িতেই উঠলো।মা আমাদের ওই অবস্থায় দেখে ভয় পেয়ে গেছিলো আর প্রচণ্ড বকাবকি করতে থাকে।তবে আমরা মা কে কোনো কথা জানালাম না।আমি সজল কে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলাম।
ঘটনা টা ঘটে যাওয়া আজ সাত দিন হয়ে গেছে।কিন্তু আমি আর সজল এখনো ওই রাত্রি ভুলতে পারিনি।
যা ঘটেছিল তা ঠিক কি ছিলো আর আমরা সেই চায়ের গুমটিটাই বা কেন আর দেখতে পেলাম না।
এই প্রশ্ন গুলো যেন সবসময় মাথা ভারি করে রেখেছিলো।
তবে একটা কথা নিশ্চিত, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা আর কোনোদিন ওই গ্রামে ফিরবো না ।
Posted in: September 2020 - Cover Story, STORY