ঝুরোগল্প / উঠোনের দোষ : কাজল সেন
কথায় বলে, নাচতে না জানলে উঠোনের দোষ। কথাটা আর যার ক্ষেত্রেই সত্যি হোক, টুকটুকির ক্ষেত্রে নয়। টুকটুকি নেহাৎ বাচ্চাবয়স থেকে গুরুজির কাছে কত্থকনাচ শিখেছে। বিভিন্ন নাচের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার পেয়েছে। ক্লাবের বার্ষিক অনুষ্ঠানে নৃত্যপ্রদর্শন করে প্রশংসা কুড়িয়েছে। কলেজে পড়াকালীন একটি সাংস্কৃতিক সংস্থার সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনের জন্য টুকটুকিকে কলকাতাতেও যেতে হয়েছিল। আর সেখানেই পরিচয় হয়েছিল অন্য একটি সাংস্কৃতিক সংস্থার সঙ্গীতশিল্পী অগ্নিভর সঙ্গে। অগ্নিভ মুগ্ধ হয়েছিল টুকটুকির নৃত্যপরিবেশনা দেখে। অগ্নিভ সরাসরি টুকটুকিকে প্রস্তাব দিয়েছিল, সে তাকে বিয়ে করতে আগ্রহী।
বিয়ে হয়েছিল। দু’বাড়ির মধ্যে আলাপ আলোচনা করেই বিয়ে হয়েছিল। অগ্নিভ পাত্র হিসেবে খুবই ভালো। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পর এমবিএ করে একটি মাল্টিন্যাশনাল আইটি কোম্পানিতে উচ্চপদে কর্মরত। গান তার প্যাশন। এদিকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে শ্বশুরবাড়িতে আসার আগে টুকটুকি ভেবেছিল, এবার নৃত্য নিয়ে সে আরও পড়াশোনা করবে, বড় কোনো গুরুজির কাছে তালিম নেবে। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে আসার পর বুঝতে পারল, অগ্নিভ আদৌ পছন্দ করছে না যে, টুকটুকি আর নাচের সঙ্গে জড়িত থাকুক। টুকটুকি অবাক হয়েছিল, সে কী, তুমি তো আমার নাচ দেখেই আমাকে বিয়ে করেছিলে, তুমি নিজেও সঙ্গীতশিল্পী, তাহলে তুমি আমাকে বারণ করছ কেন? অগ্নিভ বলেছিল, বিয়ের আগে আর বিয়ের পরে পরিস্থিতি এক থাকে না। বিয়ের আগে তুমি মেয়ে ছিলে, বিয়ের পরে বউ। আমি চাই না আমার বউ স্টেজে নাচ করুক। টুকটুকি প্রতিবাদ করেছিল, তুমি এই যুগের ছেলে হয়ে একথা বলছ? বলতে পারছ? বিয়ের আগে একথা আমাকে বলোনি কেন?
টুকটুকি জানে না, অগ্নিভ তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল তার নাচ দেখে নয়, বরং তার রূপ দেখে। টুকটুকিকে অসাধারণ রূপবতী বললেও কম বলা হয়। সেই রূপে মজেছিল অগ্নিভ। অগ্নিভ আর কোনো চান্স নেয়নি। বিয়ের পরে পরেই তাকে গর্ভবতী করেছিল। টুকটুকির মনে হয়েছিল, সে এক অবাঞ্ছিত চক্রান্তের শিকার।
বিয়ের আগে টুকটুকির কোনো গাইনোকলজিক্যাল সমস্যা ছিল না। গর্ভবতী হবার পর বিভিন্নরকম সমস্যার সূত্রপাত। সেইসঙ্গে অনেকটা বেড়ে গেল তার শরীরের ওজন। সবরকম ডাক্তারি পরামর্শ এবং সাবধানতা অবলম্বন করেও শেষরক্ষা হলো না। টুকটুকির গর্ভপাত হলো। আর সেইসঙ্গে দুমড়েমুচড়ে গেল তার যাবতীয় শারীরিক ও মানসিক উৎসাহ উদ্দীপনা এবং নাচের প্রতি প্যাশন।
তারপর আস্তে আস্তে শরীর সুস্থ হয়ে উঠেছিল ঠিকই, রূপ ও সৌন্দর্যের যেটুকু ঘাটতি হয়েছিল, তাও একটু একটু করে গুছিয়ে উঠেছিল। টুকটুকিকে আগের মতোই ঝকঝকে লাগছিল। ঠিক এইসময় কলকাতায় রবীন্দ্রসদনে অগ্নিভদের সাংস্কৃতিক সংস্থার অনুষ্ঠানের আয়োজন হলো। সংস্থার সদস্যরা জোর জবরদস্তি করে অগ্নিভকে রাজী করালো টুকটুকিকে অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করার জন্য। কথাটা শোনামাত্র দুঃখে ক্ষোভে ফেটে পড়ল টুকটুকি। না, কিছুতেই না। আমি নাচ করব না। অগ্নিভ বলল, আমি বলছি তুমি করবে। এবার টুকটুকি আরও মরিয়া হয়ে বলল, আমি কি তোমার হাতের পুতুল? ইচ্ছেমতো নাচাবে? আর তখনই শ্লেষ ঝরেছিল অগ্নিভর গলায়, নাচতে না জানলে উঠোনেরই দোষ!
Posted in: September 2020, STORY