রাক্ষস কথা : জয় বিশ্বাস

আজ আমি রাক্ষসের কথা বলছি। আমার রাক্ষসদের মুলোর মত দাঁত, কুলোর মত কান আর ভাটার মত জ্বলন্ত চোখ নয়। তারা সাধারণ মানুষ, শোষিত মানুষ যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। যারা বরাবরই রবি ঠাকুরের ভাষায় সভ্যতার পিলসুজ। আলো পৌঁছয় না তাদের গায়, অন্ধকারেই রয়ে যায়। মানুষ হলেও তারা মানুষের মর্যাদা পায়নি, এখনও পায় না। শোষক শ্রেণীর সঙ্গে অর্থাৎ দেবতাদের সঙ্গে তাদের লড়াই সেই আদিকাল থেকে আজও চলছে। আমি জানি আমার এই ‘রাক্ষস কথা’ ভক্তদের ভালো লাগবে না। ভক্তদের মানে সেইসব লোকজন যারা আর্যদের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করে। খুব অল্প কথায় বলা যায় যাযাবর আক্রমণকারী আর্যদলের সেনাপতি ও প্রধান যোদ্ধা ইন্দ্র। আর্যরা যাযাবর পশুচারী সভ্যতার স্তরে থাকবার সময়ই এসে পড়েছিল এদেশে; পরে প্রাগার্যদের কাছে শিখে কৃষিজীবী হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে ও অতি ধীরে ধীরে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছোট ছোট শহরের পত্তন করে নগর কেন্দ্রিক গ্রামীণ জনপদের বিস্তার ঘটায়। বিজয়ীরা বিজিতদের দমন করবে, শাসন করবে এটা চিরসত্য। তুলনামূলক ভাবে উন্নত অনার্যরা যুদ্ধে পারদর্শী আর্যদের কাছে পরাভূত হল, বশ্যতা স্বীকার করল।
আর্য সেনাপতি ও প্রধান যোদ্ধা ইন্দ্র প্রাগার্য গোষ্ঠীর অগণ্য দলপতিকে হত্যা করে, দুর্গ ভেদ করে তাদের নগরে প্রবেশ করে পশুধন ও অন্যান্য সম্পদ হরণ করে আর্যদের মধ্যে বণ্টন করত। নরহত্যাকারী, লুণ্ঠনকারী ইন্দ্র এবং তার সহচরেরা কালক্রমে হয়ে গেল দেবতা। পরাজিত প্রাগার্য গোষ্ঠী ও কৌমগুলিকে আর্যরা ‘দাস’, ‘দস্যু’, ‘রাক্ষস’ বা ‘অসুর’ বলে অভিহিত করেছিল। ঋগ্বেদে দেবতারা প্রধান যে গুণের জন্য প্রশংসিত হচ্ছে সেটা হল শৌর্য, যার দ্বারা, শত্রুবিনাশ, লুণ্ঠন, শত্রুর স্বর্ণ, পশু, শস্য, দাস অপহরণ এবং পরাভূতকে দমন ও হত্যা করা যায়। ঋগ্বেদের দেব চরিত্রে সমাজের ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ভূমিকায় আসীন মানুষের প্রতিফলন দেখা যায়।
উন্নততর কৃষিজীবী সভ্যতার অধিকারী সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে যাযাবর পশুরা আর্যরা তাদের অশ্বচালিত রথ ও লোহার অস্ত্রের জোরে যুদ্ধে জয়লাভ করে। প্রাগার্য গ্রাম নগর দখল করে বসবাস করতে শুরু করে। বিজয়ী আর্যদের সঙ্গে পরাজিত অনার্যদের দ্বন্দ্ব কিন্তু থেমে যায়নি। যতই আর্যরা পরাভূত অনার্যদের ‘দস্যু’, ‘রাক্ষস’, ‘অসুর’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করুক লড়াই একটা ছিলই। বৃত্র ও অন্যান্য অসুরদের প্রসঙ্গে ঋগ্বেদে দেখা যায় অকুণ্ঠিত আনন্দের প্রকাশ। বৃত্রকে ইন্দ্র কুপিয়ে কেটেছে যেমন করে কুঠার দিয়ে গাছের ছাল কাটা হয়। শত্রুর সম্পত্তি হরণেও কোন দ্বিধা নেই, বার বার বলা হয়েছে, ওদের সর্বনাশ কর।
বৈদিক সাহিত্যে পরাভূত, যদিও সভ্যতার নিরিখে আর্যদের থেকে উন্নত প্রাগার্যদের ‘অসুর’, ‘রাক্ষস’ ইত্যাদি ভাবে হীন প্রতিপন্ন করা হয়েছিল। এই রাক্ষস অর্থাৎ শোষিত সাধারণ মানুষেরা শুধু বৈদিক সাহিত্যেই নয় মহাকাব্যেও উপেক্ষিত। হাজারো অন্যায় স্বত্বেও রামচন্দ্র পুরুষোত্তম।যত দোষ নন্দ ঘোষ ঐ রাক্ষসদের। রাক্ষসরাজ রাবণ ‘ভিলেন অফ পিস’। যদিও পরবর্তীকালে আমরা দেখেছি ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ ও ‘বৃত্র সংহার’ কাব্যে রাক্ষসদের ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত আর হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় দুজনেই রাম এবং ইন্দ্রকে নায়কের আসন দেন নি। মহাভারতকারও কিন্তু রাক্ষসদের প্রাপ্য মর্যাদা দেন নি। দেবতাদের অর্থাৎ অস্ত্রগুরু দেবসন্তান অর্জুনকে তুষ্ট করার জন্য রাক্ষস, সামাজিকভাবে নিচুস্তরে থাকা একলব্যের সর্বনাশ করতে পিছপা হয় না। আবার ঘটোৎকচের জীবনটাই দেখুন। নিজেদের দুর্যোধনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য জঙ্গলে জঙ্গলে বেরানো পাণ্ডবেরা রাক্ষসদের সহযোগিতা পেয়েছিল। ভীমের হিড়িম্বাকে বিয়ে করা, ঘটোৎকচের পিতা হওয়া সবই স্বাভাবিক। ভীম নিশ্চয় অসভ্য, বর্বর, কুৎসিত কোন নারীকে বিয়ে করেনি। অথচ এই নারীকে ছেড়ে যেতে তার বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় নি। এমনকি ধর্মরাজও কোন ধর্মের বাণী শোনায় নি। নিজেদের স্বার্থ পূরণটাই ছিল তাদের কাছে মুখ্য ব্যাপার । কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে এই স্বার্থপর ভীম নিজের পরিচয়কে পাথেয় করে ঘটোৎকচ এর মত মহাবীরকে পান্ডবপক্ষে নিয়ে আসে। তথাকথিত অসভ্য, বন্য, রাক্ষস ঘটোৎকচ কিন্তু কোন প্রশ্নই ভীমকে করেনি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বীরের মৃত্যু বরণ করেছে। ঠিকঠাক বিচার করলে ঘটোৎকচ অর্জুনের জীবন বাঁচিয়েছিল; অবশ্যই পরোক্ষভাবে। বীর ঘটোৎকচ যখন কৌরব সেনাদের মধ্যে ‘ত্রাহি মধুসুদন’ রব তুলে দিয়েছে, প্রবল আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে তখন কুরু সেনাপতি কর্ণ বাধ্য হয়ে অর্জুনের জন্য সযত্নে তুলে রাখা মৃত্যুবাণ প্রয়োগ করে ঘটোৎকচকে হত্যা করে। সেই অস্ত্র অর্জুনের উপর প্রয়োগ করলে অর্জুনের মৃত্যু ছিল নিশ্চিন্ত। সুতরাং একথা বলাই যায় মহাভারতের যুদ্ধে পরোক্ষভাবে ঘটোৎকচ অর্জুনের প্রাণ রক্ষা করেছিল।
পাণ্ডবকুলের আর এক সন্তান অর্জুন পুত্র অভিমন্যু অমর হয়ে আছে মহাভারতের কলমে। সে শহীদ। তার মৃত্যুতে পাণ্ডবরা শোকে আকুল হয়। অনেক কিছুই ঘটে তার মৃত্যুর পর। কিন্তু পাণ্ডবকুলের আর এক সন্তান ঘটোৎকচের মৃত্যু আর দশটা সাধারণ মৃত্যুর মতই ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত হয়, কোন গুরুত্ব পায় না। কেন এই অবিচার? ঘটোৎকচ রাক্ষস বলে?
দেবতা আর রাক্ষসের লড়াই আবহমান কাল ধরেই চলছে। রাক্ষসরা বিনা প্রতিবাদে দেবতাদের শাসন মেনে নেয় নি। লড়াই তারা করেছে। কিন্তু লড়াই-এর পথটা ঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারেনি। প্রথম তাদের লড়াই এর সঠিক দিশা দেখালেন জার্মানির এক ‘রাক্ষস’ কার্ল মার্কস। তিনি রাক্ষসকুলকে বোঝালেন শ্রেণী সংগ্রাম এর কথা, বোঝালেন রাক্ষসদের শৃঙ্খল ছাড়া হারানোর কিছু নেই। জিতে নেওয়ার জন্য আছে গোটা দুনিয়া। তার শ্লোগান ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ খুলে দিল এক নতুন দিগন্ত। মার্কসের দেখানো পথে রাশিয়ার রাক্ষসরা লেনিনের নেতৃত্বে সফল করল সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার স্বপ্ন। রাশিয়ার বিপ্লব সারা পৃথিবীর শোষিত মানুষকে দেখাল মুক্তির পথ। ধনতন্ত্রের ভিত কেঁপে উঠল। দেবতারা বুঝল এভাবে চললে তাদের দিন সমাগত। সেই সময় জার্মানিরই আর এক দেবতা ‘হিটলার’ বিশুদ্ধ আর্যরক্তের দাবী নিয়ে পৃথিবীর অধীশ্বর হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। হিটলার আর তার চেলা মুসোলিনি পৃথিবীতে নামিয়ে আনল ফ্যাসিবাদের বিভীষিকা। কিন্তু এই ফ্যাসিবাদকে রুখে দিল ‘রাক্ষস’ স্ট্যালিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার রাক্ষসরা। হিটলার আর তার স্যাঙ্গাতদের কি করুণ পরিণতি হয়েছিল সেটা ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে চিনের ‘রাক্ষসরা’ মাও-সে-তুং’য়ের নেতৃত্বে বিপ্লব সফল করল। কিউবায় ফিদেল আর চে’র নেতৃত্বে হল সফল বিপ্লব। হো-চি-মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামের লড়াই বাধ্য করল আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদকে নতি স্বীকার করতে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় এত লড়াই এর পরেও রাক্ষসরা নিজেদের আদর্শ সমাজটাকে গড়ে তুলতে পারে নি। লড়াই চলছে বিশ্বজুড়ে। সারা পৃথিবীতে নয়া ফ্যাসিবাদ মাথা চাড়া দিয়েছে। সে দাবি করে প্রশ্নহীন আনুগত্য। এক ‘জি হুজুর’ জনগণ। যারা সব কিছু মেনে নেবে নীরবে। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানেও মহান আর্য’ উত্তরাধিকারের জিগির তুলে নয়া ফ্যাসিস্টরা শোষণের রোলার চালাচ্ছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ, হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থান শ্লোগানে কাজ হাসিলের চেষ্টা। প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বন্ধ করার জন্য হাজারো কালা কানুন, দেশদ্রোহীর তকমা, মিথ্যে মামলা, পোষা সংবাদমাধ্যম সব আছে। আজ হিটলারের ছায়া ভারতবর্ষকে ঢেকে দিয়েছে। শোষিত মানুষদের নিয়ে তাদের একটাই ভাবনা ‘এরা যেন একজোট না হয়’। এই সর্বহারাদের নিংড়েই পুঁজির পুষ্টি। সুতরাং রাক্ষসরা একজোট হও। দেবতাদের হারাতেই হবে। মনে রেখো “তোমাদের শিকল ছাড়া হারানোর কিছু নেই। জিতে নেওয়ার জন্য আছে গোটা পৃথিবী।”

Facebook Comments

Leave a Reply