রাজা রাক্ষস আর এ্যাক্রোপোলিস : ভাস্বতী গোস্বামী

ভিজেই ছিল রাত। আর মাঠ জুড়ে চাঁদের কঙ্কাল ছড়িয়ে রেখেছে। অন্ধকার চুবিয়ে আরক। হাত-পা-মাথা-লিঙ্গ-যোনি তৈরি হচ্ছে ফটাফট। অন্ধকারকে নিয়ে যা-যা করা যায়, সবই হচ্ছে। ব্যালান্স-শিট, চার্জ-শিট, পিরিয়ডের ক্যালেণ্ডারে ব্যবহৃত সংখ্যা, আর অন্ধকার ঢেকে দিচ্ছে পরস্পরকে।

একটা সংখ্যার অপেক্ষা পেরিয়ে তুমি জন্মালে। স্কুলে গেলে, চাকরি-বাকরি, বিয়ে ইত্যাদি। তার মধ্যেও যা-যা করলে, সবই ওই অঙ্কের এ্যাক্রোপোলিস। অঙ্ক মেপে চললেই সঠিক স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া। ছুপং-ছুপাই। তুমি কতোক্ষণ ‘হাইড’ বা ‘জেকিল’। তারপর অন্ধকারও নিভে যায় তার সীমানা ফুরিয়ে গেলে।

আলোর ঘণ্টা পড়ে। ঘণ্টা বললেই প্রার্থনা না এসে মন্দির আসে। যেমন ‘বেল-টাওয়ার’ মানেই চার্চ বা মিনার হয়ে যায় মসজিদ। সব নিজের নিজের ঘর আর ঘুঁটি। তার মধ্যেই দোয়েলের মেঝে, পদ্মফোটা মেঘ, স্টিম- ইঞ্জিন আর এ্যাক্রোপোলিস।

পথ খুঁজে এগিয়ে গিয়েছিল রাজপুত্র। তার হাতে খোলা তরোয়াল। তার গায়ে জরির পোশাক। সে-ই যে বেরোলো সে, তার অশ্বের ‘খটখটে’ গুঁড়িয়ে দিলো কতো কিছু। রাজপুত্রের দুর্গ চাই, রাজার দুর্গের পরিধি চাই। তো রাক্ষস বহাল হলো। তার কুলোর মতো কান, মূলোর মতো দাঁত। তার প্রাণে এক ভোমরা ঝাপটায় পল্-পল্। পাহাড়-নদী-মাটি সবই সে কাটতে জানে নানান্ ‘শেপে’। আলাদা আলাদা কাজের জন্যে আলাদা আলাদা রাক্ষস—যার-যার ঘর, যার-যার ঘুঁটি।

ক্যালেণ্ডার বদলাতে বদলাতে সিন্ধু থেকে গালোয়ান। গিরগিটির রক্ত মেখে রাজা পোশাক বদলান ঘড়ি-ঘণ্টা ধরে। সূর্যের রঙ বাড়ে, কমে। রাক্ষস ‘চেইন’ শেখে মন দিয়ে, ‘কাট্টা’ বানানো শিখে নেয় ছোট বয়সেই। তারপর একদিন মাটি ভেঙে ভেঙে খোপ বানায়, এ্যাসিড ছুঁড়ে মারে আকাশের মুখে। আবর্জনা জড়ো করে। আবর্জনার গায়ে পর্দা থাকে না, প্রাণ থাকে।

তো এভাবেই জেগে থাকে রাজা আর রাক্ষস। তাদেরও স্কেল-মাপা খোপ আছে। রাজার দিলখুশ থাকলে রাক্ষসের কপালে জোটে চাঁদের মুনাফা। ভালো-লাগায় রাঙা হয় রাক্ষস। রাজার ‘জয়’ দিয়ে পতাকার দণ্ড আরও উঁচু করে। তার কাঁধের ছাপ স্পষ্ট হয়। তারপর মুনাফা কাটাকুটি করতে বসে। আঁশ, চামড়া সুন্দর ক’রে কেটে রাজাকে উপঢৌকন দেয়। রক্তে জল মিশিয়ে পাতলা ক’রে সেচের কাজে ব্যবহার করে। কৃষিকাজ থেকে যেখানে যেখানে বিশেষ রক্তের শিশু ফ’লে, তারা আবার দুর্গের ভিতরে যাওয়ার সুযোগ পায়। আদর ক’রে রাজা তাদের মিষ্টি জিব খুলে নেন। রাক্ষস আঁশটে জিব বেছে নেয়। দাঁতগুলো ফেলে আসে দুর্গের নীচের জঞ্জালে। পাহারা দিতে দিতে ঝিমোয় আর হরিণের কথা ভাবে। যেসব শস্যরা নাভির আলপনা জানে, অন্ধকারের চোখ খুলে গান গাইতে পারে তারাই হরিণ হয়। রাজপুত্রের ঘোড়া উড়ে যায় প্রার্থনা সঙ্গীতের আগে। ধর্ষণের আগে মেহেন্দির নকশা বেছে রাখে। বনের কুকুর-হরিণ-খরগোশরা দেখতে আসে রাজপুত্রের মহার্ঘ লিবাস। দ্যাখে, জামেয়ারের ফুলপাতার জ্যামিতি। খুঁজতে চেষ্টা করে তাদের নাম লেখা কল্কাগুলো। রাজপুত্র যত্ন করে চিহ্ন মুছে দ্যায়।

রাতে খুব চাঁদ হলে অনেক অশ্বমেধের ঘোড়া জড়ো হয়। এই ঘোড়া গন্ধ শুঁকতে জানে। আর, রাতভর রাজপুত্রের উচ্ছিষ্ট চিবোয়। ভোরবেলা আকাশ শূন্য হয়ে গেলে রাক্ষস জিব ছোলে। তারপর চার্ট দেখে দেখে কর্কট-শুয়োরদের রক্তের গ্রুপ আলাদা করে। আমূলে বদলে দ্যায় পায়ের পাতা, ঘিলু ও নিঃশ্বাসের প্রয়োজনীয় হাওয়া। শস্য ও প্রাণীরাও খুশি হয়। কারণ, তারা আরও বেঁচে থাকার আশ্বাস পায়। তাদের বাসের জন্য চিহ্নিত থাকে আলখাল্লার পকেট। এসবই বিলকুল মুফতে। তাই খাবার কথা, রক্তের কথা আর মনে থাকে না তাদের। পালা ক’রে সঙ্গম করে রাক্ষসের পাহারায়। হাতকে সচল রাখে। চাঁদের তরলে মুছে নেয় ঘাম। তারপর নেমে যায় গোসলের নির্জনে।

তখনও আকাশে আগুন ছোঁড়ার টার্গেট প্র‍্যাক্টিস করছে তার ক্যালেণ্ডারের ছোট ছোট সংখ্যারা। সমবেত আকাশ শূন্য হচ্ছে। শোওয়ার আগে রাজা ন্যাংটো হয়। লিবাস বদলে যাবে। রাজপুত্র মেঘরঙা লিবাস পছন্দ করে। আকাশে দ্রুত চেইন সেলাই হয়। মিসাইলের মন-কেমন-করা বৃষ্টি নামে। এবার সেচের আগে সমস্ত রক্ত এসে জমে রাক্ষসের ঠোঁটে। দাঁতে লেগে থাকে বিন্দু বিন্দু লাভা আর ‘হানি-রোজ’ সিরাপ। দাঁতে দাঁত চেপে রাক্ষস সর্ষে জাফরান আর কলাচাষের প্রস্তুতি নেয়।

Facebook Comments

Leave a Reply