দানোর বিভক্ত দাঁত : অর্ক চট্টোপাধ্যায়

দাঁত মানে বিভক্তি। সবকিছু ভেঙ্গে টুকরো হয়ে যায়। স্মুচ করতে গিয়ে দাঁতে ঠকাঠকি হয়ে চিলতে উঠে আসলে কি হবে দানোবাবুর?

দানোর দাঁত মাজার কথা বললে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পড়াকালীন আমাদের মাস্টারমশাই অম্লান দাশগুপ্তর একটা কথা মনে পড়ে। অম্লানদা একটি ক্লাসে ‘বিশ্বাস’ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন “এই যে ধরো, সকালে উঠে দাঁত মাজার সময় তুমি বিশ্বাস করো, এই টুথপেস্টে বিষ নেই, এটা কিন্তু কোথাও গিয়ে রাষ্ট্রবিশ্বাসও বটে।”

আমরা বিজ্ঞাপনে শুনেছি, ‘আপকে পেস্ট মে নামক হ্যায় ক্যায়া?’ আমরা শুধোচ্ছি, আমাদের পেস্টে বিষ আছে কিনা? প্রশ্নটা অবাস্তব মনে হলেও অবাস্তব নয়। বিশেষত, আমরা যে সময়ে বসবাস করছি তাতে তো নয়ই। রাষ্ট্র যে আগেও অভিভাবক ছিল না এমনটা নয়, কিন্তু এখন তো সে সরাসরি নিরাপত্তা কেড়ে নিতে শুরু করেছে। এহেন সময়ের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে আমরা কি বিশ্বাস রাখতে পারি আমাদের টুথপেস্টে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে না?

এহেন ভয়কে মনোবিকলনের ভাষায় আ-শঙ্কা বলা হয়। চিনতে ভুল হবার কি আছে? আমাদের সময়টা তো আ-শঙ্কারই সময়। এবার প্রশ্ন হল এখানে দানো এল কোথা থেকে? রাষ্ট্রশক্তির কাছে দানবায়িত আমরা কি আসলে আশঙ্কায় পাওয়া দানো নাকি সরকারবাহাদুর নিজেই সেই দানো যে সকালে উঠে দাঁত মাজতে গেলে ভাবে, তার পেস্ট বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়নি তো?

রাজনৈতিকতার কেন্দ্রে পাপবোধ সমারূঢ় হয়ে থাকে। চলতে থাকে চোরাগোপ্তা আক্রমণ। দানো জানে, প্রজা-নাগরিকদের ওপর সে কি ধরণের অন্যায় করে আসছে। তাই টুথপেস্টে চক্রান্ত দেখে। ক্রান্তদর্শী না হলেও দানো মোদের চক্রান্তদর্শী তো বটেই।

আরো বেসিক প্রশ্নে আসি। দানোর কি দাঁত থাকে? লোককল্পনায় দানবদের অনেকসময় বড়ো বড়ো দাঁত থাকে বলে মনে করা হয়। দানো মাত্রেই কি তবে ড্রাকুলা? দাঁত কি রক্ত চোষে? মানুষের? গরীব নাগরিকের? আমার সামনের দুখান দাঁত কিয়ৎ বড়ো বলে ছোটবেলা থেকে বুড়োবেলা অব্দি নানা ঠাট্টা রসিকতা শুনেছি। দাঁত বড় হলে কি বেশি দাঁত মাজতে হয়?

আচ্ছা, দানো যদি দাঁত না মাজে তাহলে কি হতে পারে? সে কি তখন আর রক্ত চুষতে পারবে না? নাকি দানোর মুখে গন্ধ হলে প্রজা-নাগরিক বলবে, “বেশ রক্ত চুষবেন তো চুষবেন কিন্তু চোষার আগে দাঁতখানা মেজে আসুন দিকিনি। না হলে দেব না।” কোভিডের বাজারে আমাদের মুখে মাস্ক। তাই গন্ধ থাকলেও নো চাপ।

আমি-দানো দাঁত মাজতে মাজতে প্রায়ই ভাবি, এবার বদলাতে হবে ব্রাশটা। কেমন যেন কেলিয়ে পড়েছে। তারপরও অনেকদিন কেটে যায়, বদলাই না। ভাবি, চলছে চলুক না। ব্রাশ বদল মানে তো পণ্য থেকে পণ্যান্তর। কিন্তু সবই যে পণ্য? পা থেকে মাথা, ফোন থেকে লেখা, সবই তো পুঁজি! পুঁজিবাদের বাহির দেখা যায় না এমনতর মধ্য-তিরিশে পৌঁছে আমি-দানো পিছন ফিরে ফিরত তাকালে দেখতে পাই, সব ব্রাশই বদলানো দরকার অথচ চলছে চলুক। এইভাবে আমি-দানো দেখতে পাই সব কেমন গড্ডলিকা হয়ে গয়ংগচ্ছ হয়ে রইলো। বদলানো দরকার তাও বদলালো না। কারণ আমি-দানো ভাবলাম, চলছে চলুক না নেতানো ব্রাশ।

দাঁতের এদিক ওদিক ঘুরন্ত ব্রাশ মগজে জাগানিয়া চিন্তার মত। ঘুরতে থাকে। খুঁড়তে থাকে। পরিষ্কার করে কিন্তু কি যে পরিষ্কার করে বুঝতে পারে না। ভারত কিছুতেই আর স্বচ্ছ হয়না। নগ্ন শরীর ঢোকে ম্যানহোলে। স্বচ্ছ ভারত অভিযান চলছে না!

ঐ গর্তগুলোর নাম ‘ম্যানহোল’ কেন? কেন ঢুকতে হয় মানুষকে ঐখানে? আমাদের সবার দাঁতের ময়লা পরিষ্কার করতে? আমি-দানো বসে বসে ভাবি। আমায় ঢুকতে হয়না ঐ ম্যানহোলে। কারণ আমি ব্রাহ্মণ। একটা বিশেষ জাতিকে ঠেলে দেওয়া হয় ম্যানহোলে। শহরের দাঁত মাজবার জন্য।

আমি-দানো নেতিয়ে পড়া ব্রাশটার দিকে তাকিয়ে আমার শ্রেণীচরিত্র বুঝে নিই জাতিবর্ণধর্মশ্রেণী, সবরকম বিভক্তির সমাজে। আমার দাঁতেও ম্যানহোলের পাঁক এসে লাগে। রাজনৈতিকতায় অপরাধবোধ এক কেন্দ্রীয় অনুষঙ্গ।

Facebook Comments

Leave a Reply