পাগলের মাথার নিলাম : অর্ঘ্য দত্ত বক্সী
এম.এম একটি বিশ্বব্যাপী সংস্থা। ভারতের মুখ্য মুখ্য শহরগুলিতে এর শাখা রয়েছে।
বাহ্যিকভাবে মূলত রিহ্যাব সেন্টার, কিছুটা অ্যাডভেঞ্চার বা রিয়াল লাইফ গেমেরও মতো কিছুটা। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর কাজ বৃদ্ধাশ্রমেরও মতো! বহুবিধ ইন্টারপ্রিটেশন রয়েছে – যেমন যেকোনো ঘটনার থাকে। আবার কিছু কিছু সাহসী আত্মবিশ্বাসী মানুষ আছে যারা এখানে এক বছর কাটিয়ে বিরাট অংকের টাকা পেতে চ্যালেঞ্জ করে ভর্তি হয়। এরম অসংখ্য ধরনের মানুষ নিয়ে এই সংস্থাটির কারবার।
প্রকৃতপক্ষে সংস্থাটি যে কী করে আর করে না তার ১০০% হদিশ কেউই রাখে না। নিত্য ব্যবহার করি এমন বহু মুখবুকজাতীয়দের মতোই রাখে না। শুধু জানা যায় বহু বহু টাকার আর দিমাকের খেলা চলে এখানে। অসম্ভব ঝুঁকিপূর্ণ এবং অসম্ভব লাভজনক ওপেন সিক্রেট এটি। শেয়ার মার্কেট? না, সে এক শিশু এর কাছে। তার তো অনেক কিছুই স্বচ্ছ, বাস্তব তথ্যনিষ্ঠ। কিন্তু ম্যাডমাসের উদ্দেশ্য ক্রিয়াকর্ম ইত্যাদির অনেকটাই ধোঁয়াশা, আধুনিক পুরাণের মতো। আবার যেন তার একটা এমনও আবেদন আছে যা সূর্যের মতো স্পষ্ট, উজ্জ্বল… হট। এককথায় ম্যাডমাস আকর্ষন করে, যার টান অমোঘ।
এটি একটি এক বছরের জার্নি বা কোর্স বা ট্রিটমেন্ট যাই তাকে বলা হোক না কেন (সবকটিই কিছু না কিছু ক্ষেত্রে সঠিক)। সাধারণত এখানে প্রথম ছয়মাসে সবধরনের ক্লায়েন্টের সমস্যা সমাধানের বা নিরাময়ের চেষ্টা করা হয় আর তার পরের ছয়মাসে ওই সমস্যাগুলিকেই দ্বিগুণভাবে ফিরিয়ে আনা হয়! আজব পাগল… কিন্তু কেন? লেয়ার আছে, লেয়ার, গভীরের কোনও শেষ নেই। স্বেচ্ছায় যারা ভর্তি হয় বা করানো হয় তাদের অর্থদাতারা এসব তথ্য কিছু সত্য কিছু গুজব হয়ত উপর উপর জানেও। কিন্তু তারা যারা নিজেদের আত্মীয়দের এখানে ভর্তি করছেন ও তার জন্য ফি দিচ্ছেন তারা এটা অন্তত জানেন না সেই টাকা এম.এম.-এর কাছে নগণ্যের থেকেও কম। তারা ক্লায়েন্ট নন, তারা বরং নিজেদেরই বেচতে স্বেচ্ছায় তুলাদণ্ডে উঠে বসেছেন।
এসব জানে না, জানে গ্রাহকেরা নাকি সেলিব্রিটি হয়ে যায় এখানে! এই সব কুয়াশা সংস্থাটিকে আরো বেশি বেশি আকর্ষনীয় করে তোলে।
আলাদা আলাদা ক্যাটেগরির জন্য ফিও আলাদা আলাদা। বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের জন্য যা পারিশ্রমিক একজন বেট লড়তে আসা সাহসী আত্মবিশ্বাসী মানুষের জন্য তার পরিমাণ অনেক বেশি। ভর্তি হতে আসাদের সম্মতিক্রমেই যাবতীয় সাইকোলজিক্যাল টেস্ট, ল্যাপটপ মোবাইল ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ গুগল তথ্য, লাইফ স্টাইল, হোল বডি চেকাপ, জিন ডি.এন.এ সব কিছু জেনে নেওয়া হয়। এতকিছু যে সেই মানুষটার স্মৃতিভ্রংশ হলে ওরা রিইন্সটল করে দেবে। এত্তকিছু যা সেই মানুষটা নিজের সম্পর্কেও জানে না, এমনকি তার সঙ্গে যোগাযোগে থাকা সব মানুষের যৌথ ইনপুটের থেকেও যা বেশি। গভীরতম অবচেতনের গোপনীয়তা যা শুষে নেওয়া হয়…
এরপর ঠিক করা থাকে যে, যে যে উদ্দেশ্যে যারা যারা এসেছে তাদের ভাঙা গড়ার খেলা কীভাবে চলবে যাতে উলটো আউটপুট বের করে আনা যায়। শুধু নিন্দেই করে চলেছি তাহলে আসে কেন? কারণ অনেকটা কৌতূহলও। এই পৃথিবীটার অভ্যন্তরে কী আছে তা তো কেউ পুরোটা আজ পর্যন্ত জানেনি। এমনকি সংস্থাটির অনেক শীর্ষকর্তারাও তার সবটা জানে না। জানে না এর হায়ারারকি কত ধাপ অবধি উঁচুতে আর কত অবধি নিচে নেমে গেছে। কেউ বলতে পারে না কোম্পানিটির মালিকানা কার! রাষ্ট্রই শেষপর্যন্ত কীনা বা হয়ত রাষ্ট্র নিজেও ভয় পায় একে। রাষ্ট্রসম্মত সংস্থাই তাই বলা যায় একে।
বেচে দিয়েছে নিজেকে টাকার কাছে, হয়ত, রাষ্ট্র… আর হয়ত ক্লায়েন্টের আত্মীয়স্বজন… সেই মধ্যযুগের দাস কেনা বেচার মতো বেচে দিয়েছে বাবা, মা, সন্তান, ভাই বোন… এত টাকার কাছে বিক্রি হয়ে বেচে দিয়েছে।
এবার আলাপ শেষ করে গতে আসা যাক। আস্তে আস্তে ঢোকা যাক ব্যবস্থাটিতে। রূপক প্রতীকীতে ভর দিয়ে। এর অস্ত্রোপচার কেন্দ্রটিতে আছে এক অনন্ত কুয়ো, বিরাট বড় পরিধির এক দৈত্যকুয়ো। কুয়োর অভ্যন্তরে দুদিকে দুটো করে বাক্স, সব এক আকৃতির, যেখানে একজন করে মানুষই বাস করতে পারে। তেমন বাক্সগুলোয় এক এক করে মানুষ ঢুকছে আর লিফটের মতোই নামতে থাকছে। অতল গহ্বরের থেকে তেমনই একটা করে বাক্স বেরিয়ে আসছে। একটা ঢুকছে আর একটা করে ঘটাং করে উঠে আসছে। তবে বাক্সগুলো খুললে সবাইকেই যে জীবন্ত পাওয়া যাচ্ছে তার কোনও গ্যারান্টি নেই। জানাও যাচ্ছে না কতদিনের মৃতদেহ। শুধু জামাকাপড় পরা একটি কঙ্কাল। এমনই অক্লান্তভাবে ঘটে চলেছে… যেন এটাই স্বাভাবিক। একজন করে ঢুকছি আর একজন করে বেরিয়ে আসছি। বি.আর.চোপড়ার বিশ্বরূপ যেমত!
আস্তে আস্তে কুয়োর ভিতর এবার ক্যামেরা নামানো যাক যেহেতু এতো শুধুই ক্যামেরার শিকার এরা সব। দেখা যায় প্রত্যেক বাক্সের ভিতরে যে একইরকমের ব্যবস্থা তা কিন্তু নয়। ওদের হাতে আছে আপনার সম্বন্ধে অসীম তথ্যভান্ডার, অতি যত্নে তাকে ডেটা অ্যানালিসিসও করে রাখা আছে। সেজন্য ট্রিটমেন্টও বিভিন্ন ধরনের। যারা বহির্মুখী তারা হয়ে যায় নির্বাক। যাদের অ্যাডভেঞ্চারের নেশা, ওপেননেস টু এক্সপিরিয়েন্স… তারাও কুঁকড়ে যাবে বাজের শব্দে। নেশাগ্রস্তদের চিকিৎসায় নেশার প্রতি অমানুষিক খিদে বানিয়ে রিলিজ দেওয়া হয়। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অবচেতনেও বিশ্বাস করে ফেলেন যে তারা সংসারের বোঝাই। যারা সব ঝামেলা ওয়ার্কলোড থেকে দূরে ব্রেক নিয়ে এখানে একাকী সময় কাটাতে আসে তারা বের হয়ে কাজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার মতো মানসিক স্থিতি আর কখনও পায় না। কাউকে কাউকে টাকার বিনিময়ে প্রাইভেট জেলখানার মতো রেখে দেওয়া হয় আর কেউ কেউ আসে জেলখানার অভিজ্ঞতা নিতে এসে আসামী হয়ে যায় মনস্তাত্ত্বিক। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয় তাদের যারা টাকা প্রাপ্তির জন্য চ্যালেঞ্জ নেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা মৃতাবস্থায় বাক্স থেকে বেরোয় নয়ত এতটাই ভারসাম্য হারায় যে টাকার ব্যবহারিক চাহিদা যোগানে তার আর কোনও কাজ থাকে না।
এ সব কী? কেনই বা? কারা ওরা? কী চায়?
ধীরে ধীরে আমরা এগোবো।
কতগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য প্রত্যেক বাক্সেই আছে। যেমন বাক্সের দেওয়াল যে বস্তুতে গড়া তার মধ্য দিয়ে শব্দ, তাপ, আলো, গন্ধ কিছুই প্রবেশ বহির্গমন করতে পারবে না। হিরের মতো শক্ত আর পারদের মতো নমনীয়। প্রয়োজন মতো ই.এম ওয়েভ বাড়ানো কমানো যায়। শুধু বাক্সের মাথায় প্রয়োজনে খোলা বন্ধ করা যায় কিছু অর্ধভেদ্য ছিদ্র আছে। এই ছিদ্রগুলোও থাকত না যদি না তার অন্য কোন কাজ থাকত। সেসব ক্রমশ প্রকাশ্য।
এবং সেটা এই যে, এখানে জলবায়ুকে মেরু অঞ্চলের মতো করে রাখা হয়। অর্থাৎ বাক্সে ঢুকে নামতে থাকার প্রথম দিন থেকে তিন মাস অলটারনেটিভ দিনরাত্রি হবে। দ্বিতীয় ধাপে তিন মাস সম্পূর্ণ অন্ধকার। ছয় মাস পরে কুয়োর একদম তলায় পৌঁছলে শুরু হবে তৃতীয় ধাপ। এই তিনমাসও অন্ধকারই থাকবে শুধু তারপর থেকে বাক্স উপরের দিকে উঠবে। চতুর্থ ও শেষধাপে একেবারে বাইরে বেরিয়ে আসা অবধি আলো থাকবে ২৪ ঘণ্টার জন্য। সুতরাং তিন মাস আলো, ছয় মাস অন্ধকার আর শেষ তিন মাস আবার আলোই। এবং সবার ক্ষেত্রেই হবে এটি সমানভাবে প্রযোজ্য।
খাবারও সমাজতান্ত্রিকভাবে দেওয়া হয়। রোজ ভাত আর রুইমাছ। সারা বছর ধরে প্রতিদিন দুবেলা এক পরিমাণ ভাত ও ১০০% একই স্বাদের ঝোল। নিখুঁত আগের দিনের সাইজ ও স্বাদ। গ্যারান্টিড। যদি অবশ্য তা ৩৬৫ দিন ধরে খাওয়ার জন্য সবাই বেঁচে থাকে!
কখন সে ঘুমালো, কখন সে জাগলো, কোন বার, কত তারিখ, কোন মাস… কিছুই আর তার গণনায় থাকবে না। সে যে কোনদিনও এগুলো ঠিকঠাক জানতে পারবে, এ বিশ্বাসও তার থাকবে না। অন্ধকারের ছয়মাস শুধু স্পর্শ ছাড়া আর বাকি চার ইন্দ্রিয়ের কোন কাজ থাকবে না। ছয়মাস পর তারা যে আগের মতো স্বাভাবিক কাজ করবে তারও গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। এমনিতে তো বটেই, এই যে তারা অন্ধকারে থাকবে নাইট ভিশন ক্যামেরা দিয়ে তাও ২৪ ঘন্টা মনিটারিং হতে থাকবে। আর সে তুমি লেখাশ্রমিক কিংবা তা ধিন ধিনা… বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং আস… সেটাই তার খাবার জোগাড়ের পেশা।
এতক্ষণ সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা হল। এবার বিশেষ বিশেষ ট্রিটমেন্টগুলি শোনা যাক। উদাহরণস্বরূপঃ
ধরা যাক ব্যক্তিটি খুবই আড্ডাবাজ ও প্রগলভ। কথা বলেই তার আনন্দ। তার হবে কোনোধরনের শব্দহীন সম্পূর্ণ নীরব একটি বাক্সব্যবস্থা। এবং সে নিজে চিৎকার করলে নিজেও প্রায় শুনতে পারবে না এমন শব্দশোষকে ঢেকে রাখা হবে তার বাক্সের দেওয়াল। সে গোটা একটা বছর তার বলা কথার কোন প্রতিক্রিয়া পাবে না। তবে কি সে নিজেই কথা বলে নিজেই উত্তর দেবে… এমনকি তার উত্তরও!
হয়ত কোন রূপসীর বাক্সের দেওয়ালময় শুধু আয়না আর স্লো পয়েজনে নষ্ট হতে থাকা মুখের ত্বক, পড়ে যেতে থাকা চুল সে দেখবে তিনমাস ধরে। হয়ত তার কষ্ট হবে। কিন্তু অন্ধকারাচ্ছন্ন ছয়মাস পর যখন সে তার মুখ দেখবে সেই মুহূর্তেই মানসিকভাবেও সে উন্মাদ হয়ে যাবে। বাহ্যিক ও মানসে সে তখন পরিপূর্ণ পাগলি।
বয়স্ক লোকেদের ক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের জন্য করা যাবতীয় আত্মবলিদানগুলিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হতে থাকবে টিভিতে পুনর্নিমাণ করে। তার পরপরই তাদের উপর সন্তানদের করা সব অত্যাচার এবং বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নিয়ে তার সন্তান ও স্পাউসের করা যতধরনের গোপন সমালোচনা, ঘেন্না, বোঝাবোধ- সে সব ব্যক্তিগত কথার অডিও শোনানো হবে। সারা বছরটা ধরে তারা এমনই অসংখ্য ক্লিপিং দেখে ও শুনে যেতে থাকবে। কখনও কখনও নকলও। যার যত ডোজ দরকার!
ধরা যাক এক অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ। তার প্রতিটা ইন্দ্রিয়ে ভরে ভরে দেওয়া হবে ভয়। তার দর্শন ও শ্রবণের ক্ষমতাকে ক্ষইয়ে দেওয়া হতে থাকবে ইউ.ভি জাতীয় হাই কনট্রাস্ট ব্রাইটনেস আলোয় আর তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গে, তীব্র-তীক্ষ্ণতম শব্দের একটানা রণনে। তার বাক্সের দেওয়াল জুড়ে এল.ই.ডিতে শুধু রক্ত, পচা রিগরের মানব-মৃতদেহ ও স্যাডিস্টের অত্যাচারের দৃশ্য। আর সে শুধু শুনে যাবে চাপ চাপ যন্ত্রণার হাহাকার, মৃত্যুভয়ের আর্তনাদ, ক্ষুধায় উন্মাদ মানুষের চিৎকার আর কখনও কখনও গণধর্ষণ হতে থাকা মেয়ের মৃদুস্বরে একটানা গোঙানি। ফ্লোরে দেওয়া থাকবে এমন সব কেমিক্যাল যাতে তার হাত-পা কুষ্ঠের মতো ক্ষয়ে যেতে থাকে। বাক্সের যেখানে যেখানে সে হাত দেবে তা খাবার হলেও সে শক খেতে থাকবে। মাইল্ড থেকে আস্তে আস্তে করে বেশি। অন্ধকার দশায় তাকে খাবারও কম দেওয়া হতে থাকবে যাতে সে প্রায় দাঁড়িয়ে উঠে চলার ক্ষমতা হারাতে থাকে। নিজেকে পঙ্গু মনে করতে থাকে। এবং একসময়ে সামান্য বাসন পরার শব্দে সে কেঁপে ওঠে…। মূলত বেট লড়তে আসা মানুষদের জন্য আরো কিছু বেশি ট্রিটমেন্ট। যেমন মাঝে মধ্যে অক্সিজেন কমিয়ে অজ্ঞান করে দেওয়া থেকে বিষাক্ত গ্যাস হয়ে মৃতদেহের পচা পুঁতিগন্ধময় খাবার… সবকটি ইন্দ্রিয় দিয়েই যতরকমের অত্যাচার করা যায় তা এক গবেষণার বিষয়।
আমরা জেনেছি এই কোর্স বা ট্রিটমেন্টের চারটি স্তর। নেশাগ্রস্ত কাউকে (ধরা যাক মদাসক্তি) প্রথম তিনমাস সাবসটেন্স ছাড়া রেখে ও ওষুধ দিয়ে সুস্থবোধ করানো হয়। তার কানে রবিশংকর আর টিভিতে একের পর এক মোটিভেশনাল স্পিচ। তার স্কুলের গ্রুপ ফটো, তার প্রেমিকার সঙ্গে হওয়া চ্যাটের “আশ্বাস” – এসবই সে পেতে থাকে। এই প্রথম পর্বের পর আসে দুভাগে তিনমাস করে অন্ধকারের পর্যায়।
এই সময়কালে ধীরে ধীরে ক্রমাগত বাক্সের তাপমাত্রা কমানো হতে থাকে। বাক্সের ছাদ থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরে যেতে থাকে একটানা। মূলত বেদনার সংগীত ও তার অতীত বিচ্ছেদগুলির এপিসোড সিরিয়ালের মতো অসহ্যভাবে চলতে থাকে স্ক্রিনে একটানা আর হৃদয়বিদারক সেই বিষাক্ত তর্কাতর্কি! পরবর্তী পর্যায়ে অন্ধকার থাকলেও সে পেতে থাকে মদের গন্ধ, স্ক্রিনে প্রচুর মদ্যপান করা হচ্ছে এমন সব দেবদাসি বিরহ দৃশ্য এবং তার ব্র্যান্ডের সিগারেট দু একটা করে পেতে থাকে সে। শেষ পর্বে আলোয় ফেরার তিন চারদিন আগে থেকে তাকে দেওয়া হয় অপ্রতুল মদ সিগারেট কাবাব। তারপর আলোয় আসতেই এক লহমায় সব বন্ধ। কিন্তু বাক্সের পরিবেশ সেই অন্ধকারের আবহেই থাকে। সেই মদ খাওয়ার দৃশ্য, সেই ব্যর্থ প্রেমের গুমোর আর শীতাতপ। সারা জীবনের শ্রেষ্ঠ অপমানগুলোর রিমেক চলতে থাকে। একেবারে শেষে যখন তার মুক্তি পাওয়ার সময় হয়ে আসে তখন তাকে শোনানো হয় সত্য মিথ্যা সব শোকসংবাদ। এভাবে এক বছর পর সে যখন মাটিতে পা দেয়; মুক্তি উপভোগ করার বদলে সে দেখে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কেউ আসেনি। সে জিজ্ঞাসা করে যে নিম্নগামী পরের বাক্সটায় সে পুনরায় ঢুকতে পারবে কিনা!
সাধারণভাবে মানসিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে যেতে থাকা ব্রাত্য মানুষদের তাদের বিভিন্ন বোকামি করা নিয়ে একটি শব্দ বারংবার ক্রমাগত এমনকি এক একটি বাক্যে দুই তিনবার করে শ্রুতিগোচর করানো হয় এবং সেই শব্দটি হল – “পাগল”। “ওঁ” এর পর যে শব্দ মানুষের মনকে সবচেয়ে বেশি আন্দোলিত করে। তাকে আহত করে। এমন তো অনেক ক্লায়েন্ট থাকে ম্যাডমাসের যাদের ঢোকানোই হয় তাদের এক বছরে পূর্ণ উন্মাদ করে দিতে হবে এই শর্তে এবং স্বার্থে। এই কেসে টাকাও সবচেয়ে বেশি ঢালা হয় কীনা তাই এটা সংস্থাটির দায়িত্বের মধ্যে পরে। একটি বোকামি থেকে তৈরি হওয়া এক পরিস্থিতি সামাল দিতে আরো করে ফেলা দু-চারটি পরিস্থিতিতে বোকামি… এভাবে এক্সপোনেনশিয়ালভাবে ক্লায়েন্টের সারা জীবনের ভুলগুলো বারংবার টাইমলাইন ধরে তাকে দেখানো বা শোনানো হয়। হতেই থাকে। আর কখন যে সে সব করার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় তা সে ব্যক্তি নিজেও বোঝে না।
এবার গল্প শেষ হয়ে এল…
কথা হল ম্যাডমাস এমনতর সবকিছু উদ্ভট করেই বা কেন আর তাকে এসব করার লাইসেন্সই বা কে দিয়েছে? লাভ আছে কারণ যা আগেও বলা হয়েছে যে এটি শেয়ার মার্কেটের থেকেও অর্থনৈতিকভাবে বেশি ক্ষমতাশালী ও বেশি লাভবান আন্তর্জাতিক সংস্থা। বৈধ গ্যাম্বলিঙের সর্বোন্নত কোম্পানি এটি। একধরনের রিয়াল লাইফ রিয়ালিটি শো। বিনোদন। মানুষের উপর মানুষের জুয়াখেলা। এই সার্কেলে চলে আসা মানুষদের মধ্যে ধরা যাক x, সে কতদিনে টোটালি ব্রেকডাউন করবে বা এখন উইপন দিলে এক্ষুনি সুইসাইড করবে কিনা তা নিয়ে গ্যাম্বলিং চলে কোটি কোটি টাকার। আর রাষ্ট্র তো কাঁচাবাজারের মতো বিক্রি হয়ে গিয়েছে অনেক অনেক আগেই। আসলে রাষ্ট্রের মতো মেরুদণ্ডহীন দাস ও তার দাসতন্ত্রের উপমা খুঁজতে শক্তি সুনীলও হার মেনে যাবে। নৈতিকতা বা মানবিকতার সংজ্ঞাই পালটে ফেলা হয়েছে সংবিধানের হাস্যকরেক্সভাবে ফ্রয়েডের মানুষেরাই শূকর-নান্দনিক, মার্ক্সের বা গান্ধির মানুষদের দেখা পাওয়া গেলে জাদুঘরে রাখা হয় তা সে দার্শনিকরা যাই বলে থাকুন।
মানুষের উপর এখানে মানুষ বাজি ধরে। একটি মানুষকে ন্যুড অবধিই দেখানো হবে না সেই মেয়েমানুষটিকে গণধর্ষণও করা হবে তা ঠিক করবে মানুষের গ্যাম্বলিং। টাকা যেদিকে বেশি সেদিকের সিদ্ধান্তই পালন করা হবে। তাকে দিয়ে পর্নোগ্রাফি করানো হবে না তার কিডনি খুলে নেওয়া হবে… কীভাবে তুমি অত্যাচার করতে চাও তা শুধু জানাও আর টাকা ঢালো… এইভাবে নাগরিক জীবনের পেষণ থেকে মন ভোলাতে তোমার আজকের ভার্চুয়াল রেপিস্ট বা স্যাডিস্ট হওয়ার স্বাদ… অহো মাখন ডিলিশাস…
আগেকার রাজা নবাবদের বিনোদন ছিল সংগীত, নৃত্য, যৌনতা, কবিতা, মদ্য। সে ছিল মানুষ। আর এ হল রাষ্ট্র নামক জন্তুটির বাস্তবিক বিনোদনের অতিসামান্য একটি অংশ। কারণ সাদামাঠা যৌনতা কী সিনেমা খেলা আর উত্তেজক বিনোদন দেয় না। এইসব নেশা হয়ে গেছে একঘেয়ে। প্রেমিক প্রেমিকার নর্মাল পার্কে বসে হাতে হাত রেখে ভালবাসা করা দেখলে ভাবা হয় এরা অর্ধোন্মাদ বা আদিবাসী।
আসলে মানুষ বলে একটাই প্রজাতি থাকলেও তাদের মধ্যে বিত্তে বুদ্ধিতে ক্ষমতায় বিজ্ঞতায় বড়রা এইসব কমাদের আর আজকাল মানুষ ভাবে না। তাদের ওরা মানুষ বলতে ঘৃণা করে। বলে এপ-ম্যান বা AsMan, মানুষের মতো জীব, বা-নর। ক্রীতদাসপ্রথাও সম্ভবত এই পাশবিক বিনোদনে লজ্জা পেয়ে যাবে।
আজ মিস্টার হাজারিকে খেতে দেওয়া হবে কিনা তা নিয়ে লাখ লাখ টাকার বেট এক একজন ধরতে পারে কারণ আগের দুদিনও হাজারিকে খেতে দেওয়া হয়নি
কিছু লোক বলবে হ্যাঁ কিছু লোক বলবে না
তারা দর হাঁকবে তারাও দর হাঁকবে
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আরো অত্যাচার করার দিকেই জনমত ও অর্থ বেশি ঢালা হয়।
যারা হাজারির ভালো চায়, চেয়ে নিজের কষ্টসাধ্য উপার্জিত টাকা দিয়েও এই গেম শোতে হাজারিকে খাওয়াতে চায় তারা হেরে যায় তা বড় কথা নয়। আসলে এই মানুষগুলো মানবিকতা প্রকাশ করার মাধ্যম হিসাবে একে দেখে। দেখে নিজেকে ভুলিয়ে রাখে। না, তারাও চায় না হাজারিকে মুক্তি দেওয়া হোক। স্থায়ী পরিবর্তনের বদলে তারাও গ্যাম্বলিঙই করছে, তাদের কাছেও হাজারি একটা অবজেক্টমাত্র…। শেষে হাজারিকে নিয়ে কেউ আর কিছু ভাবেই না। তার পক্ষে বা বিপক্ষে টাকা ঢালার মতো কোনও ইস্যুই অবশিষ্ট থাকে না। হাজারি হারিয়ে যায়। মানুষ প্রজাতি থেকে নেমে যায়।
কমলিকা প্রেগন্যান্ট অবস্থায় বাক্সে ঢুকেছে। চারমাস পরে তার সন্তান প্রসব হতে পারে। এখন তার বাচ্চা হবে না তাকে গর্ভেই মেরে ফেলা হবে না মারা হবে সদ্যোজাত অবস্থায় তা ঠিক করবে গ্যাম্বলাররা। টিআরপি। কমলিকা নয়। যদিও কোনোক্ষেত্রেই বাচ্চাটি জীবিত ও সুস্থ থাকবে এমন কোন অপশন রাখা হয়নি। লড়াইটা কম পাশবিকতার সঙ্গে বেশির…
টাকা – এই বস্তুটি এই কনসেপ্টটি মানুষের প্রজাতির মধ্যেই অনেক অনেক শাখা প্রজাতির যে জন্ম দিয়েছে শুধু তাই নয় সব মানুষকে আর মানুষ রাখেনি। মানুষ শুধু কিছু উত্তেজক মুহূর্তের দাস। উত্তেজক স্থূল ও সহজ কিছু বিকৃত বিনোদনের দাস। আর দাস টাকার। টাকা দিয়ে সে আত্মহত্যা কিনে রাখার বৈধতা পেয়ে গেছে। আর কীসের ভয় তার!
মানুষি সভ্যতা সময়ের সঙ্গে আধ্যাত্মিকভাবে ক্রমশ উর্দ্ধমুখী হবে বা সাইন তরঙ্গের মতো হবে এ দুই তত্ত্বই অবান্তর। আসলে সে গড়িয়ে চলেছে স্লোপে, অতলান্ত কুয়োর নিচের দিকে গতিসূত্র মেনে ত্বরণ গতিতে। আসলে সকলেই পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থান করতে চায় কীনা তাই। “এত নিশ্চিন্ত কেন আপনারা?” তোমাকেও কুয়োয় ঢোকাবে আরও বিত্ত-বুদ্ধি-ক্ষমতায় উন্নততর কোনো মানবপ্রজাতি। আর তাই যে মানুষটি বেট ধরছে সে জানেও না যে তাকে নিয়েও বেট ধরা হচ্ছে। সে জানে না যে স্বাধীন সত্তা বলে আর কিস্যু নেই। অথবা সে জানে, মনের কোনও গহিনে এ উদ্বেগ তার একটু একটু করে বাড়ছে। শিল্প দর্শন প্রতিবাদ এখনও প্রাসঙ্গিক তাই।
তবু শেষাবধি সে কিছু উত্তেজক মুহূর্তেরই দাস।
সে বলছে, এ কী?
আমি সুইসাইড কিনেছি।
আড়াই সেকেন্ড দেরি হচ্ছে কেন?
বা হয়ত একদিন শোনা যাবে যে খুন করার অভিজ্ঞতাও অর্থ দিয়ে কেনা যায়।
সে AsMan জ্যান্ত, গোটা দুই অর্ডার ছিল যে!
Posted in: September 2020, STORY