অর্ধেকের খোঁজে: নিজস্ব বুননে ভারতীয় নারীদের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ – অমৃতা সরকার
একাদশ কিস্তি
“পরীরা আমায় ডাকছে” : সরোজিনী নাইডুর কবিতা
সরোজিনী নাইডু ( ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দ – ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ) কবি বরোদা সুন্দরী ও শিক্ষাবিদ অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ সন্তান। হায়দ্রাবাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অতীব ‘অভিজাত’ বাড়ির সন্তান হওয়ায় তিনি তাঁর বাড়িতেই ছোটোবেলা থেকেই কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী এঁদের সান্নিধ্য পেতেন। ছোটোবেলা থেকেই সরোজিনীর ‘ইন্ডিয়ান’ পরিচিতিই যেন তাঁর একমাত্র ‘পরিচয়’ হয়ে ওঠে সেইভাবেই তাঁর মা-বাবা মানুষ করতেন। ‘হিন্দু’ ও ‘ব্রাহ্মণ’ পরিচিতি যেন সরোজিনীর সত্তায় প্রকট ভাবে প্রভাব না রাখে সেইটা নিশ্চিত করতে ‘ইংরেজি’ ভাষাকেই তাঁর মা-বাবা অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন। ‘ইংরেজি’কে নিজের ভাষা করে, মা-বাবার কাছ থেকে হিন্দু সংস্কৃতিকে চিনে এবং হায়দ্রাবাদের ঐতিহ্যশালী ‘মুসলিম’ সংস্কৃতিকে জেনে সরোজিনী যেন প্রকৃত কসমোপলিটান হয়ে ওঠেন সেই শিক্ষা ছোটোবেলা থেকেই সরোজিনীর জন্য বরাদ্দ হয়েছিল। নিজের নয় বছর বয়স অবধি ইংরেজি শিখলেও, তিনি কিছুতেই ইংরেজি বলতে চাইতেন না। এগারো বছর বয়স থেকে সরোজিনী নিজের লেখার ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে বেছে নেন। পড়াশুনায় মেধাবী সরোজিনী মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে ম্যাট্রিকুলেকশনে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পনেরো বছর বয়সে সরোজিনীর জীবনে আসেন তাঁর চেয়ে দশ বছরের বড়ো বিপত্নীক গোবিন্দরাজু নাইডু। এই প্রেম অবশ্যই উল্লেখ্য এই কারণে যে ‘নাইডু’ অব্রাহ্মণ হওয়ায় সরোজিনীর মা-বাবা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং মেয়েকে ইংল্যান্ডে পড়াশুনার জন্য পাঠিয়ে দেন। তিন বছর ইংল্যান্ডে থাকাকালীন প্রথমে তিনি লণ্ডনের কিংস কলেজে পড়াশুনা করেন, পরে কেম্ব্রিজের গির্টন কলেজে পড়াশুনা করেন। ইংল্যাণ্ডে থাকাকালীন তিনি বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে স্পেনে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য পাঠানো হয়। সেখান থেকেই ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হায়দ্রাবাদ ফিরে আসেন এবং সেই বছরই বাড়ির অমত সত্ত্বেও গোবিন্দরাজ নাইডুকে বিয়ে করেন।
সরোজিনীর কবিতা সাহিত্য সমালোচকরা সাধারনত ‘সেন্টিমেন্টাল’ বলে দেগে দেন। একই সঙ্গে তার কবিতা একজন ‘এলিটের’ দৃষ্টিতে ভারতীয় যাপনকে ‘ওভার-রোমান্টিসাইজ’ করে বলেও সমালোচিত হয়। আমরা যদি নারীবাদের প্রেক্ষিত থেকে দেখি তাহলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নারীবাদী-অবচেতন তাঁর কবিতায় চিহ্নিত করতে পারি। প্রথমত তিনি ভারতীয় নারীর পিতৃতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে চাওয়া রূপটিকে তীব্র ভাবে সমালোচনা করেন নি ঠিকই, কিন্তু তাঁর কবিতা ভারতীয় নারী যে পিতৃতন্ত্রের শিকার তা নিজের অজান্তেই ধরে ফেলে। যেমন ‘চুড়িওয়ালা’ কবিতাটি কোন রঙের চুড়ি কোন বয়সী নারীর জন্য বরাদ্দ তা বয়ান করতে করতেই দেখিয়ে ফেলে যে উজ্জ্বল রঙটি বরাদ্দ ‘কাঁচা হাতের’ নারীর জন্য এবং ধূসর রঙটি বরাদ্দ সোনার ছেলেদের দোলনা দুলিয়ে , সংসারকে বুক দিয়ে আগলিয়ে যে নারী বৃদ্ধ হয়ে গেছেন তার জন্য। মাথায় রাখতে হবে একজন সিমোন দ্য বোঁভোয়া ‘দ্য সেকেণ্ড সেক্স’ লিখবেন এই কবিতার প্রায় সাড়ে তিন দশক পরে। ভারতীয় টিপিক্যাল প্যাটার্ণে জন্ম, বিয়ে ও মৃত্যুকে রাখতে গিয়ে সরোজিনী নিজের অজান্তেই বিয়ের উজ্জ্বল রঙের শাড়ি বুননের ঠিক পরেই রেখে দেন মৃত্যুর সাদা কাফনের বুননের খতিয়ান। প্রেম প্রকাশে সরোজিনীর নারী অনেক বেশি উচ্চকিত সরোজিনীর পুরুষের চেয়ে। একে কি ভারতীয় নারীবাদের স্রোত ভাবতে অসুবিধা হবে আমাদের? ‘গাঁয়ের গান’ কবিতায় যখন মেয়ের মা মেয়েকে বিয়ের, ঘুমপাড়ানি গানের, বিয়েতে হতে চলা পঞ্চ ব্যঞ্জনের, বিয়ের গয়নার, বিয়ে করতে আসা রাজপুত্রের লোভ দেখায় মেয়ে সবকিছু নস্যাৎ করে জানায় যে ঘন বনে যে ঝোরা বয়ে যায়, তার ধার থেকে পরীরা তাকে ডাকে; সে সেখানেই যেতে চায় এই সবকিছু ফেলে। এই স্বর তর্কাতীত ভাবেই একজন নারীবাদীর।
চুড়িওয়ালা
মন্দিরের সামনে মেলা…
ঝলমলে বোঝা বয়ে নিয়ে যাই মোরা চুড়িওয়ালা
রামধনুরঙা উজল আলো ছলকানো চুড়ি কিনবে কারা?
পুরন্ত জীবনের সোহাগী চিহ্ন কারা নেবে গো
আহ্লাদী মেয়ে আর সুখী বউ মানুষের জন্য।
নীল আর রূপোলি মিশমিল চুড়িগুলো যেন পাহাড়ি কুয়াশা
কাঁচা হাতে মানায় ভালো।
চুড়ি যেন ঘন বনে নদীর ধারে চুপটি করে ফুটে থাকা কুঁড়ির স্বপ্ন,
চুড়ি যেন নতুন পাতার গা চোয়ানো সবুজ আলো।
গায়ে হলুদের সকালবেলার কনের হাতের চুড়ি
সূর্য ধোয়া ক্ষেতের ফসলের রঙ যেন!
যজ্ঞবেদীর আগুনের রঙ চুড়ি,
কনের হাসিকান্নার মতো রুনঝুন
বাজে, ঝিকিমিকি চুড়ি, কোমল কিন্তু স্পষ্ট।
বেগুনি আর সোনালি ধূসর চুড়িগুলি
সে হাতের যে পার করেছে আধেক জীবন,
যে হাত সোনার ছেলেদের দোলনা দুলিয়েছে,
ঠাঁই দিয়েছে নিরাপদ বুকে ঘর গেরস্থালিকে,
পূজা করেছে স্বামীকে দেবতার পাশে।
ভারতের তাঁতীরা
ওগো তাঁতী, দিন শুরু হতেই
এত খুশিয়াল কাপড় বুনছো কেন গা?
মাছরাঙার ডানাটির মতো নীল
কাপড় বুনছি মোরা নবজাত শিশুটির তরে।
ওগো তাঁতী, রাত নামতেই
অমন উজল রঙের কাপড় বুনছো কেন গা?
বেগুনি সবুজ রঙা ময়ূরের পেখম যেন
রাণীর বিয়ের শাড়ি বুনছি মোরা।
ওগো তাঁতী, শান্ত ও ধীর,
এমন শীতল জোছনায় কী বুনছো তোমরা?
পালকের মতো সাদা, মেঘের মতো সফেদ
বুনে চলেছি মৃত মানুষের কাফন।
প্রেমের গান
সে ( নারী)
বাঁশির তালে যেমন দোলে সাপ,
আমার মন তোমার আঙুলে তেমনি খেলে, প্রিয়!
প্রেমিকের মতো রাতের হাওয়া যেমন
ঝুঁকে পড়ে যুঁইবিথান আর শিরিষ বীথির উপর,
রঙিন পাকা ফলের ডালে যেমন
ফুটে থাকে উজ্জ্বল টিয়ার ঝাঁক, এক গোছা লাল ফুল যেন!
সে ( পুরুষ)
গোলাপের পাঁপড়ি মাঝেসুবাস যেমন
আমার বুকের মাঝে লুকিয়েছে তোমার মন, হে প্রিয়!
মালার মতো, মণির মতো, অশোকগাছে
বাসা বাধা ঘুঘুটির মতো
চুপটি করে শুয়ে থাক, যতক্ষণ না ভোর
তার সোনালি তাঁবু ফেলছে ওই কুয়াশা মোড়া ক্ষেতের উপর।
গাঁয়ের গান
বাছা, আমার সোনা, কোথা যাস তুই?
সব গয়না কি হাওয়ায় ভাসাবি?
যে মা তোর মুখে খাবার তুলেছে তাকে ফেলে যাবি?
রাজপুত্তুর ঘোড়া ছুটিয়ে বে করতে আসছে। তাকে কাঁদাবি?
মা আমার, আমি বনে চললাম
যেথায় চম্পা গাছে চম্পা ফুটে আছে।
নদীর চরে ফুটেছে পদ্ম, শাপলা
পরীরা আমায় ডাকছে সেথায়, শোনো!
বাছা, আমার মানিক, ধরায় কত না সুখ!
বিয়ের গান, ঘুমপাড়ানিয়া গান,
চন্দনগন্ধ মাখা দুপুর।
তোর বিয়ের কাপড় বোনা সারা,
রূপোলি, সোনালি জড়িতে মোড়া,
পঞ্চব্যঞ্জন চেপেছে উনুনে,
এখন তুই যাস কোথা?
বিয়ের গান আর ঘুমপাড়ানিয়া গানে
দুঃখের সুর বাজে,
আজ যা রোদের হাসি,
কাল তা মরণ বাতাস।
বনের গান অনেক মধুর
যেখান দিয়ে বনের ঝোরা বয়,
মা, আমি থাকতে পারবো না,
পরীরা আমায় ডাকছে—-
Posted in: September 2020 - Serial, TRANSLATION