রাক্ষস দাঁত মাজে : অহনা সরকার

ছবিটা ব্রায়ান পিটারসনের।

“রাক্ষস কখনো দাঁত মাজে না”! লাইনটা শুনতেই – সম্ভবত “”রাক্ষস-খোক্কস” বইটার নাম, ওপরে মলাটে বেশ বড় বড় কান মূলোর মতোন দাঁত বের করা দুই মূর্তিমানের ছবি। ছোটোবেলায় বেশ ভয়ই করতো মলাটখানায়। তো পড়লাম যেদিন, দুই রাক্ষস ভাই বাতাবি আর অন্যজনের মনে নেই, বাকি গল্পগুলোও মনে নেই। রাক্ষস ব্যাপারটা কি আসলে, এই রাক্ষস ভূত অ্যালিয়ন এই সব অদেখা না চেনা শব্দগুলো সামনে সাজিয়ে পরিবেশ বানানো ভয়ের, ছোটোবেলায় তাড়াতাড়ি খেয়ে নেবার জন্য আর বড় হলে?

আর বড় হলে?

রাত ১টা ঊনিশ ছিলো কুড়ি হলো সবে। ঘুমিয়ে পড়া উচিত, আসছে না কি করবো!
“দ্য আদিবাসী উইল নট ড্যান্স” হাঁসদা সৌভেন্দ্র শেখরের লেখা। ইংরাজিতে অবশ্য। ২০১৪ সালে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পায়।
“দ্য আদিবাসী উইল নট ড্যান্স” – কি মনে পড়লো! আগন্তুক ছবির সেই সিন, যেখানে মমতাশঙ্কর কোমরে কাপড় গুঁজে – জংলী শহুরে সভ্যতা!
না। ২০১৯ এ সুপ্রীম কোটে, বনআইন ২০১৯ – ১১.৮ লক্ষ বনবাসীকে উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
বন জঙ্গল থাকে কারা ফূর্তি লোটায় গাছ চুল্লী ধ্বংস এসব কমবেশি সবারই জানা।
তবে না জানা কি?
অবতার ছবিটা মনে আছে? স্টিভেন স্পিলবার্গ। সেই আদিমতম গাছ, যা নাকি বিশ্বাস করতো তারা আত্মারা থাকে সব সেখানে, আর সেই গাছ না বাঁচলে সম্ভবই নয় বাঁচা তাদেরও
“সালুমারাদা” কন্নড় ভাষায় অর্থ যার বৃক্ষশ্রেণী। কর্ণাটকের হুলিকাল গ্রামে। প্রায় শ চারেক বট আর পিপুল একসাথে একে অন্যকে বেঁধে জড়িয়ে শিকড়ে শিকড়ে।

ছবিটা উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া

বেশ কয়েকবছর থেকেই, রাস্তার পাশে শোভা পেতে শুরু করে, “একটি গাছ একটি প্রাণ”! চরিত্রটা দেখে নেওয়া যাক বরং গত তিরিশ বছরে বিভিন্ন সরকারের ৫৪০০ বর্গ মাইল বনাঞ্চল বিভিন্ন পুঁজিপতিদের হাতে সমর্পণ। বস্তার খনি অঞ্চল সে প্রসঙ্গ না বলাই ভালো! সম্প্রতি একটা নাম খুব সামনে আসছে হাঁসদেও ছত্তিশগড়ের যেখানে একলক্ষ সত্তর হাজার হেক্টর বনাঞ্চলকে খোলামুখ খনির ছাড়পত্র দিয়েছে সরকার।
বলিভিয়া আমাজন খুব সামনে ক্যালিফোর্নিয়া সবাই এসে দাঁড়াচ্ছে একে একে ! ” উন্নয়ন” ঘটছে চওড়া রাস্তা ব্যায়বহুল রিসর্ট আরো আরো যত মারণ ও মরণকামী দুষ্প্রাপ্য!
এমনও শোনা যাচ্ছে দার্জিলিং সিকিমের মানুষ লাইনে দাঁড়াচ্ছেন এসি কিনতে! কেরালায় ক্রমশ কমে আসা বৃষ্টিপাত
পাশ কাটিয়ে ছোট্টো উদাহরণ দেওয়া যাক একটা, চের্নোবিল সোভিয়েত রাশিয়ার সেই পারমাণবিক পরিতক্ত্য শহর সেখানে গাছ ফুল পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণী ফিরে আসতে শুরু করেছে নিজেরাই

তবে কোনোদিন সকালে উঠে যদি দেখি আমার ব্রাশটা ভিজে ভয় ভয়ানক করবে!

আমাদের রান্নাঘরের পাশে যে গাছটা, নাম জানি না। উজাড় যদিও এখন আগেই কয়েকদিন হলুদ ফুলে নুয়ে আমরা তিনবছর এখানে এসেছি, ভরাট রূপ এই প্রথম দেখছি
যেমন কেউ কেউ উত্তরপাড়া থেকে হাওড়া ব্রিজ, কেউ বাড়ির ছাদ থেকে হিমালয়ের প্রান্ত আমাদের ব্যালকনি থেকে খুব ফিকে সূর্যাস্ত আর বিশম্ভর পাখি সে যে কত ডাক কত রকমের আশ্চর্য আকাশ রাতের
একটা গা থেকে উল্কার অন্য গা সরে গেলে! ওই চলাচল। ভীষণ চাই জানেন রাক্ষস বিরাট আসুক এক আর তার হা এ দীঘার পাড় থেকে সমস্ত দোকানপাট বোল্ডার হোটেল ভেঙে চুরে – সত্যিই চাই
সমস্ত গল্প রাজপথ পার্ক সিঁড়ি স্তম্ভ স্ট্যাচু ভেঙে উপড়ে, স্কুল কলেজ পরীক্ষা কম্পিটিশন সব খেয়ে নিক রাক্ষসটা। সংখ্যায় পড়ে থাক শূন্য কেবল মাত্র

যেভাবে অ ঘোষিত হচ্ছি কিংবা খরচ

সংখ্যার দৌলতে চলুন মিছিল করি। সামনে আমরা হাঁটবো পিছনে সারি সারি রাঙা চোখ ঘুম বাপধন

খুঁদ কুঁড়ো দুজনকে আলাদা করলে! ভাগ বেশি কার দানায়?
এসব যুক্তি তর্ক – বদলে অনেক ফেলার পর ভাবলাম

একটা গল্প বলা যেতে পারে! বলি

সীতা দেশভ্রমণে বেরিয়েছেন রামের সাথে। যাচ্ছেন ট্রেনে ঘুরছেন ইধার উধার বায়না কিন্তু সবসময় জানলার ধারে উনিই বসবেন। ঠিক আছে তাই সই। রাম অখুশি হচ্ছেন খুব যে তাও নয়। চলেছেন দেখতে দেখতে জানলা বাহির গাছপালা ছোটাছুটি বাদামভাজাওয়ালা এলো তো! কি বায়না বাবা রে খাবেই খাবে! ছাড়ানো বাদাম নুন অল্প রস লেবুর ছোটো চামচ দিয়েছে একটা তারিয়ে তারিয়ে সেই যাপন

তবে যাওয়া কোথায় হবে সেটার ঠিক নেই কোনো। প্রথমে ভেবেছিলেন জঙ্গল না সমুদ্র পাহাড় হয়ে টয়ে সব এখন কে জানে – “পছন্দ হবি যেথা পড়বক্ষণ নাবি”। এমনই ভাবনা বেছে রেখেছেন।
“ইশ্ পাখি দেখো দেখো পাখি কত্ত”! বাদাড়ে টিয়া এক ঝাঁক জানলার পাশ কাটিয়ে যেতেই সীতা দেবী গলা ছেড়ে ওঠেন! “এখানে নামি হ্যাঁ এখানে কত পাখি কত কত এখানে”! নাছোড় রাম চেন টেনেছেন ততক্ষণে ট্রেনের। ট্রেনও ঘচাৎ –
তো গালাগালা হেনো তেনো শোনার পর বেশ খানিকটা নামা হলো। কি যেন স্টেশনটার নাম! পড়া যায় না বাপু এমন সব দূর দূরান্ত! যাককে হবে নাম কিছু একটা তবে পাখি আছে ঝাঁক ঝাঁক দেখো ওই যে সীতাহরণ ছুটে বেড়াচ্ছে সারা স্টেশন! আছে খেয়াল কোনো যে এটা অন্য দেশ একটা বেচাল! তা বেশ হলুদ কালো বেঞ্চ একটা দেখে রাম সটান হলেন ঘুমও তৎক্ষনাৎ! সীতাও বেশ ক্লান্ত খানিক সহজ কথা পাখিদের পিছন পিছন দৌড়ানো এমন!
“ও বাবা ঘুম লাগিয়েছে মিনসে”! শুই তবে আমিও যাক গে ভেবেই বোধহয় এমন রামের চিৎপাট বুকের ওপর মাথা ঠেকিয়ে দেবী সীতা চোখ জড়িয়ে আসছে তারও ঘুমে “উমম বাবারে”!

শব্দ কি সব হচ্ছে যেন! কি এসব! “উঃ!” মাথা তুলতে যাবার সময়ই বড় ডালটা সবচেয়ে পড়েছে একদম দুজনের ওপর! “ওঃ! ইই”! পাশেই কৃষ্ণচূড়া গাছ একটা ঝ্যাঁকড় বেশ সুযোগ বুঝে মালদার পার্টি কাটা চলছে আর কি কুপিয়ে। তারই ডাল একটা! পাশে যে ঘুমন্ত দুজন মানুষ! গাছ তবে জানতো না আর যে কাটছে বাদই দিন কথা তার!
তাও চিৎকারে ভাঙা ডাল শব্দাশব্দি! লোকজন এসে কাটা কৃষ্ণচূড়া সরিয়ে নিচ থেকে পাঁজর ভাঙ্গা রাম আর ডান হাত সাথে জখমি কলারবোন সীতা উদ্ধারকার্য!
“কারা দুজন মাল! জামাকাপড় পরেছে দেখ শালারা যেন রামায়ণ থেকে! যত মালেগ শালা! মাইরি”!
গাড়ি চলার পথে শুনতে শুনতে এসবই হসপিটালে নিয়ে যাওয়া চলছে তাদের। রাম পরিচয় নিজেদের দেবেন ভেবেন চুপ করে থাকেন। যতই হোক যা রাজার ছেলে একটু কূটবুদ্ধি আছে ভালোই।
“ও সীত জল খাবেন গো একটু? দাদারা জল একটু দিন না”!
গাড়িটা যেখানে থেমেছে আর যাই হোক কখনোই হসপিটাল নয় সেটা। কিন্তু বলবেন কি কিছু তার আগেই! ” ওকি ওকি সী”! দুটো হাত জবরদস্ত গলার ওপর ভাঙা পাঁজরে! তবে ওরম জ্ঞান অজ্ঞান সীতাকে ও অবস্থাতেই! শুধু হইয়ের চিৎকার আর একটু বোধহয় সীতার আর্ত রাম সাঙ্গ হন!
পাশাপাশি ডেডবডিদুটো কেরোসিন ভালো করে ঢেলে, পোড়া শেষ হলে ছাই সব বেশ মাটির গর্তে পুঁতে – ওল্লাস শোনা যায় জ্যায় শ্রী

ধড়মড় করে রাম উঠে বসেন! বাপরে! সীতা! ঘুমাচ্ছে পাশে। কোথাও গিয়ে টিয়ে দরকার নেই ভ্রমণে বুঝিয়ে বলবেনক্ষণ সকালে – বাইরে রামরাজ্য চলছে এখন!

রাক্ষস পুষি আমরা, মনে গভীর অতলে। দেখা যায় মাঝে মাঝে তাকে ভাবি থাক আছে, করবে কি ইই বা! সকালে ওঠা ঘুম ব্রেকফাস্ট –
হ্যাঁ দাঁত মাজে বৈকি।
আমার ব্রাশেই রোজ

Facebook Comments

Leave a Reply